ক্রিকেট নিয়ে গল্প হচ্ছিল বন্ধুদের আড্ডায়। এর মধ্যে একজন হুট করে প্রশ্ন করে বসল- ‘বলতো রিফাত, ওয়েস্ট ইন্ডিজের রাজধানীর নাম কী?’ চিন্তায় পড়ে গেল রিফাত। অষ্টম শ্রেণিতে পড়লেও ক্রিকেট দুনিয়ার প্রায় সব খবরই রাখে রিফাত। ওয়েস্ট ইন্ডিজের ক্রিকেট নিয়ে তো অনেক কিছুই জানে ও। এক সময়ে বিশে^র সবচেয়ে দাপুটে এই দলটির সোনালি দিনের কত গল্পই না পড়েছে পত্রিকা-ম্যাগাজিনে। ভিভরি চার্ডস, গ্যারি সোবার্স, ব্রায়ান লারাদের গল্প তো জানে। ক্রিস গেইল, আন্দ্রে রাসেলদের ধুমধাড়াক্কা টি-টোয়েন্টি ম্যাচও তো কম দেখেনি; কিন্তু ওয়েস্ট ইন্ডিজ দেশটি সম্পর্কে তো কিছুই জানে না। মুখ ঘুরিয়ে চাইলো অন্য বন্ধুদের দিকে- তারাও সবাই চুপ।
বাড়ি ফিরে বিশ^ মানচিত্র নিয়ে বসলো; ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, শ্রীলঙ্কা, জিম্বাবুয়ে সবই পেল; কিন্তু অনেক খুঁজেও ওয়েস্ট ইন্ডিজ নামের কোন দেশ পেল না। ক্রিকেট দুনিয়ায় এত বিখ্যাত একটি দল- সেটি কিনা মানচিত্রে খুঁজেই পাওয়া যাচ্ছে না! বন্ধুর প্রশ্নের জবাব দিতে না পেরে লজ্জা পেয়েছিল; কিন্তু এবার নিজের কাছেই একটু অবাক লাগলো রিফাতের।
কিশোর বন্ধুরা, রিফাতের মতো এমন ঘটনা কি তোমাদের কারও জীবনে ঘটেছে? ঘটাটা অস্বাভাবিক নয়, কারণ বিশে^ তো ওয়েস্ট ইন্ডিজ নামের কোন দেশই নেই। মানচিত্র, রাজনীতি, কূটনীতি কোথাও এই নামে কোন দেশের উপস্থিতি নেই। শুধুমাত্র ক্রিকেট মাঠেই পাওয়া যায় এই দেশটিকে; কিন্তু কেন? সেটি নিয়ে আলোচনা করবো এবারের লেখায়।
ওয়েস্ট ইন্ডিজ ছিলো এক সময় ক্রিকেট বিশে^র সবচেয়ে শক্তিশালী দল। ১৯৭০ এর দশক থেকে ১৯৯৪-৯৫ সময় পর্যন্ত বিশ^ ক্রিকেটে সেরা দলগুলোর একটি ছিলো এটি। ওয়ানডে বিশ^কাপের প্রথম দুটি আসরের শিরোপা গেছে তাদের ঘরেই। পরবর্তীতে দলটি আর সেই ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে পারেনি। অবস্থা এতটাই খারাপ হয়েছে যে, ২০১৯ ওয়ানডে বিশ^কাপে খেলার জন্য তাদের বাছাইপর্বে অংশ নিতে হয়েছে জিম্বাবুয়ে, আফগানিস্তান, আরব আমিরাত, নেপালের মতো দলের সাথে।
এখন টি-টোয়েন্টিতে দলটি কিছুটা শক্তিশালী। ২০১২ ও ২০১৬ টি-টোয়েন্টি বিশ^কাপের শিরোপা জিতেছে তারা। মনে করা হয়, টি-টোয়েন্টিই ওয়েস্ট ইন্ডিজের ক্রিকেটের অধঃপতনের বড় একটি কারণ। অর্থের প্রলোভনে পড়ে দলের বেশির ভাগ খেলোয়াড়ই সারা দুনিয়ার ফ্রাঞ্চাইজি লিগে খেলে বেড়ায়। জাতীয় দলের চেয়ে তাদের এতেই আগ্রহ বেশি।
কোথায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ
আগেই বলে নেই- ওয়েস্ট ইন্ডিজ কোন একক দেশ নয়। কয়েকটি স্বাধীন দ্বীপ দেশ ও কয়েকটি বিভিন্ন দেশের শাসিত দ্বীপ মিলে সম্মিলিতভাবে গঠন করা হয়েছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট বোর্ড। দ্বীপগুলোর অবস্থান উত্তর আমেরিকা মহাদেশে। উত্তর আটলান্টিক মহাসাগর ও ক্যারিবীয় সাগরে অবস্থিত দ্বীপগুলো। অঞ্চলটি ক্যারিবীয় অঞ্চল নামেও পরিচিত। ১৪৯২ সালে ইতালীয় নাবিক ক্রিস্টোফার কলম্বাস প্রথম ইউরোপীয় হিসেবে জাহাজ নিয়ে এই অঞ্চলে পৌঁছান। সে সময় পূর্ব এশিয়া বিশেষ করে ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া- এই অঞ্চলটিকে ডাকা হতো ইস্ট ইন্ডিজ নামে। এর সাথে মিল রেখে পশ্চিমে অবস্থিত ওই অঞ্চলটিকে ইউরোপীয়রা ডাকতে শুরু করে ওয়েস্ট ইন্ডিজ।
ষষ্ঠদশ শতাব্দীতে অঞ্চলটিতে ইউরোপীয় বণিকদের আনাগোনা শুরু হয়। আধিপত্য বিস্তার নিয়ে এ সময় ফরাসি, ইংলিশ, স্প্যানিশ, ডাচ, পর্তুগিজদের মধ্যে অনেক লড়াইও হয়। ইউরোপীয়রাই এখানে দাস হিসেবে আফ্রিকানদের আনতে থাকে। তাদের মাধ্যমে চলতো ইউরোপীয়দের ব্যবসা ও কৃষিকাজ। ধীরে ধীরে সেই আফ্রিকানরাই অঞ্চলটিতে স্থানীয় আদিবাসী কার্বিস ও ইউরোপীয় দখলদারদের চেয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে ওঠে।
যেভাবে শুরু
১৮৯০ এর দশকে ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলটি গঠিত হয়। সে সময় ওই অঞ্চলে সফর করা ইংল্যান্ড দলের বিরুদ্ধে খেলার জন্য ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিভিন্ন দ্বীপ থেকে খেলোয়াড় বাছাই করে একটি দল গঠন করা হয়। এরপর এই ধারণাটি পছন্দ হয় স্থানীয় কর্মকর্তাদের। সেটিই বহাল রাখেন তারা। ১৯২০ এর দশকে এই অঞ্চলে ক্রিকেট আয়োজন ও উন্নয়নের লক্ষ্যে সম্মিলিতভাবে গঠিত হয় ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট বোর্ড। ১৯২৬ সালে বিশ^ ক্রিকেট সংস্থা ইমপেরিয়াল ক্রিকেট কনফারেন্সের (আইসিসির পূর্ব নাম) সদস্য হিসেবে যোগ দেয় দেশটি। তখন সংস্থাটির সদস্য ছিলো ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকা। টেস্ট পরিবারের চতুর্থ সদস্য হিসেবে ১৯২৮ সালে প্রথম টেস্ট ম্যাচ খেলে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। এরপর দোর্দণ্ড প্রতাপে এগিয়ে চলা। ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দলটি টেস্ট ম্যাচ খেলেছে ৫৪৮টি। ১৭৫টি জয়ের বিপরীতে হার ১৯৭টি ম্যচে। আর ড্র হয়েছে ১৭৫ ম্যাচ এবং একটি ম্যাচ টাই হয়েছে।
দ্বীপসমূহ
ওয়েস্ট ইন্ডিজ অঞ্চলের ক্রিকেট সংস্থার বর্তমান নাম ‘ক্রিকেট ওয়েস্ট ইন্ডিজ’। যেসব দ্বীপ নিয়ে এই বোর্ড গঠিত তার মধ্যে ১০টি স্বাধীন দেশ। এগুলো হলো এন্টিগুয়া অ্যান্ড বারবুডা, বার্বাডোজ, ডমিনিকা, গ্রেনাডা, গায়ানা, জ্যামাইকা, সেন্টলুসিয়া, সেন্টভিনসেন্ট, ত্রিনিদাদ অ্যান্ড টোবাগো ও সেন্টকিটস অ্যান্ড নেভিস। এ ছাড়া আছে ব্রিটিশ শাসিত দ্বীপ অ্যাঙ্গুইলা, মন্টসারেট ও ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডস। আছে নেদারল্যান্ডস শাসিত রাজ্য সিন্টমার্টেন ও যুক্তরাষ্ট্রের অঞ্চল ইউএস ভার্জিন আইল্যান্ডস।
সব মিলে ওয়েস্ট ইন্ডিজে প্রধানত ছয়টি ক্রিকেট সংস্থা আছে। এই ছয় সংস্থার ছয়টি দল ওয়েস্ট ইন্ডিজের ঘরোয়া ক্রিকেটের সর্বোচ্চ স্তরে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। (প্রথম শ্রেণি, লিস্ট এ, টি-টোয়েন্টি কাপ)। সংস্থা বা দলগুলো হলো- বার্বাডোজ, গায়ানা, জ্যামাইকা, ত্রিনিদাদ অ্যান্ড টোবাগো, লিওয়ার্ড আইল্যান্ডস ও উইনওয়ার্ডস আইল্যান্ডস। এন্টিগুয়া অ্যান্ড বারবুডা, সেন্টকিটস, নেভিস, এবং ব্রিটিশ, মার্কিন ও নেদারল্যান্ডস শাসিত দ্বীগুলো মিলে গঠিত হয়েছিল ওয়ার্ড আইল্যান্ডস টিম। আর ডমিনিকা, গ্রেনাডা, সেন্টলুসিয়া, সেন্টভিনসেন্ট মিলে গঠিত হয় উইনওয়ার্ডস আইল্যান্ডস টিম।
তবে প্রতিটি দ্বীপেরই আলাদা ক্রিকেট সংস্থা আছে। যেমন সেন্টকিটস ও নেভিস- এই দুটি দ্বীপ মিলে একটি সার্বভৌম দেশ; কিন্তু দুটি দ্বীপের ক্রিকেট সংস্থা আলাদা। দুটি সংস্থাই অবশ্য লিওয়ার্ড আইল্যান্ডস টিমের অংশ।
যেহেতু অনেকগুলো রাষ্ট্র ও অঞ্চল মিলে একটি ক্রিকেট দল বা সংস্থা, তাই ওয়েস্ট ইন্ডিজের কোন জাতীয় পতাকা বা জাতীয় সঙ্গীত নেই। তবে ক্রিকেট সংস্থাটি তাদের অঞ্চলের প্রকৃতির সাথে মিল রেখে একটি পতাকা তৈরি করেছে এবং ‘র্যালি রাউন্ড দ্য ওয়েস্ট ইন্ডিজ’ নামের একটি গানকে তাদের সঙ্গীত হিসেবে গ্রহণ করেছে। ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের কোনো আন্তর্জাতিক ম্যাচ শুরুর আগে এই গানটি বাজানো হয় এবং ক্রিকেট সংস্থার এই পতাকা প্রদর্শন করা হয়।
মজার ব্যাপার হচ্ছে ক্রিকেট ছাড়া আর কোনো বিষয়েই এই দ্বীপগুলো এক সাথে অংশ নেয় না। এমনকি ফুটবলও খেলে তারা আলাদা দল হিসেবে। রাজনীতি, কূটনীতি সবই আলাদা দেশগুলোর।
কার বাড়ি কোথায়
টেস্ট ক্রিকেটের এক ইনিংসে সর্বোচ্চ অপরাজিত ৪০০ রানের ইনিংস খেলা কিংবদন্তি ব্যাটসম্যান ব্রায়ান লারা ত্রিনিদাদ অ্যান্ড টোবাগোর নাগরিক। দুটি প্রধান দ্বীপ ত্রিনিদাদ ও টোবাগোর সাথে আরো কিছু ছোট দ্বীপ মিলে দেশটি গঠিত। রাজধানী পোর্ট অব স্পেন শহরটি অবস্থিত ত্রিনিদাদ দ্বীপে। পোর্ট অব স্পেনের কাছেই ছোট্ট শহর শান্তা ক্রুজে জন্ম ব্রায়ান লারার। লারাকে বলা হয় প্রিন্স অব পোর্ট অব স্পেন। পোর্ট অব স্পেনেই অবস্থিত ওয়েস্ট ইন্ডিজের সবচেয়ে বড় ক্রিকেট ভেন্যু কুইন্সপার্ক ওভাল। ইয়নবিশপ, দিনেশ রামদিন, রবি রামপাল ত্রিনিদাদ অ্যান্ড টোগাবোর নাগরিক।
আবার ড্যারেন স্যামির দেশ সেন্টলুসিয়া। যে কারণে তিনি প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট খেলেছেন উইওয়ার্ড আইল্যান্ডস দলের হয়ে। সেন্টলুসিয়ার প্রথম ক্রিকেটার হিসেবে স্যামি ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলে জায়গা পেয়েছেন। ক্রিস গেইলের দেশ জ্যামাইকা। রাজধানী কিংসটনে জন্ম তার। এই জ্যামাইকারই নাগরিক বিখ্যাত অ্যাথলেট উসাইন বোল্ট। জ্যামাইকার নাম লেখা জার্সি পরে বোল্ট একের পর এক পদক জিতেছেন অলিম্পিকসহ অ্যাথলেটিকসের সব প্রতিযোগিতায়; কিন্তু ক্রিস গেইলকে খেলতে হয়েছে ওয়েস্ট ইন্ডিজের পরিচয়ে। এ ছাড়া কোর্টনি ওয়ালশ, মারলন স্যামুয়েলস, মাইকেল হোল্ডিং, প্যাট্রিক প্যাটারসনও জ্যামইকার নাগরিক। স্যাবাইনা পার্ক জ্যামাইকার বিখ্যাত ক্রিকেট ভেন্যু। ক্লাইভলয়েড গায়ানারা, ভিভ রিচার্ডস এন্টিগুয়া অ্যান্ড বারবুডার।