বেলারুশের সরকারি নাম বেলারুশ প্রজাতন্ত্র। মধ্য-পূর্ব ইউরোপের একটি স্থলবেষ্টিত প্রজাতন্ত্র। তবে দেশটি অতীতে বাইলোরুশিয়া বা বেলোরুশিয়া নামে পরিচিত ছিল। এর উত্তরে ও পূর্বে রাশিয়া, দক্ষিণে ইউক্রেন, পশ্চিমে পোল্যান্ড এবং উত্তর-পশ্চিমে বাল্টিক প্রজাতন্ত্র লিথুয়ানিয়া ও লাটভিয়া। বেলারুশের মধ্যভাগে অবস্থিত মিন্স্ক রাজধানী ও বৃহত্তম নগর। অন্যান্য বড় শহরগুলোর মধ্যে আছে ব্রেস্ত, হ্রোদনা, হোমিয়েল, মোগিলেফ, ভিতেভ্স্ক এবং বাব্রুইস্ক।
বেলারুশের আয়তন ২ লাখ ৭ হাজার ৫৯৫ বর্গকিলোমিটার (৮০ হাজার ১৫৩ বর্গমাইল)। জনসংখ্যা ৯৪ লাখ ৭৭ হাজার ৯১৮ জন। জনসংখ্যার ৮৩.৭ শতাংশ জাতিগতভাবে বেলারুশীয়, ৮.৩ শতাংশ রুশ, ৩.১ শতাংশ পোল, ১.৭ শতাংশ ইউক্রেনীয় এবং অন্যান্য ৩.২ শতাংশ। এ দেশের তিন-চতুর্থাংশ জনগণ শহর অঞ্চলে বাস করে। এ দেশের প্রধান ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে রয়েছে রুশ অর্থডক্স খ্রিষ্টান ৪৮.৩ শতাংশ, রোমান ক্যাথলিক ৭.১ শতাংশ এবং অন্যান্য ৩.৩ শতাংশ। এ ছাড়া অধার্মিক ৪১.১ শতাংশ। ২০০৭ সালের হিসাব অনুযায়ী বেলারুশে ৪৫ হাজার মুসলিম আছে যা মোট জনসংখ্যার ০.৫ শতাংশ।
১৯৯৫ সালের একটি গণভোটের মাধ্যমে রুশ ও বেলারুশ ভাষা দেশের সরকারি ভাষা হিসেবে সাব্যস্ত হয়। এর মধ্যে বেলারুশীয় ভাষায় প্রায় ৯৮ শতাংশ জনগণ কথা বলে। ১০ শতাংশ লোক রুশ ভাষায় কথা বলতে পারে। পশ্চিম সীমান্তবর্তী অঞ্চলে পোলীয় এবং জার্মান ভাষার প্রচলন আছে।
বেলারুশে একটি কেন্দ্রীয়ভাবে পরিকল্পিত অর্থনীতি বিদ্যমান। সরকার নিয়ন্ত্রিত ভারী শিল্প কারখানাগুলো এই অর্থনীতির চালিকাশক্তি, তবে কৃষিও একটি গুরুত্বপূর্ণ খাত। এ দেশের মুদ্রার নাম বেলারুশিয়ান রুবল।
বেলারুশের প্রাকৃতিক সম্পদের মধ্যে রয়েছে পিট কয়লার মজুদ, অল্প পরিমাণ জ্বলানি তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস, গ্রানাইট পাথর, বেলে পাথর, মার্ল পাথর, চক, বালি, গ্রাভেল পাথর ও ক্লে। ১৯৮৬ সালে পার্শ্ববর্তী ইউক্রেনের চেরনোবিলে যে পারমাণবিক বিপর্যয় ঘটে তার তেজস্ক্রিয়ার প্রায় ৭০ শতাংশ বেলারুশ অঞ্চলে প্রবেশ করে এবং বিকিরণের প্রভাবে বেলারুশীয় ভূমির প্রায় এক-পঞ্চমাংশের ক্ষতি হয়। জাতিসংঘ ও অন্যান্য সংস্থা তখন ঐ এলাকার তেজস্ক্রিয়তা হ্রাসে কার্যকর ব্যবস্থা নিয়েছিল।
বেলারুশ মূলত অরণ্য, হ্রদ ও জলাভূমিতে পূর্ণ একটি সমতল ভূমি, যার কোন প্রাকৃতিক সীমানা নেই। দেশের মধ্যভাগে দক্ষিণ-পশ্চিম থেকে উত্তর-পূর্বে চলে গেছে বেলারুশ পর্বতশ্রেণী। দেশটির মোট আয়তনের ৪০ শতাংশেরও বেশি জনবিরল অরণ্যে আবৃত। প্রায় ৩ হাজার নদী ও প্রায় ৪ হাজার হ্রদ দেশটির ভূগোলের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
বেলারুশের আবহাওয়ার বৈশিষ্ট্য হলো শীতকাল মৃদু থেকে ঠাণ্ডা এবং গ্রীষ্মকাল ঠাণ্ডা ও আর্দ্র। শীত মৌসুমে দক্ষিণ-পশ্চিমে (ব্রেস্ট নগরী) তাপমাত্রা থাকে মাইনাস ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং উত্তর পূর্বে (ভিতেবস্ক নগরী) তাপমাত্রা থাকে মাইনাস ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। গ্রীষ্মকালে গড় তাপমাত্রা থাকে ১৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বেলারুশে গড় বার্ষিক বৃষ্টিপাত ৫৫০ থেকে ৭০০ মিলিমিটার (২১.৭-২৭.৬ ইঞ্চি)। দেশটি মহাদেশীয় আবহাওয়া ও সামুদ্রিক আবহাওয়ার মাঝে উত্তরণ অঞ্চলে অবস্থিত।
বিংশ শতাব্দীর আগ পর্যন্ত বিভিন্ন রাষ্ট্র বিভিন্ন সময় বেলারুশ অঞ্চলটি শাসন করে। এগুলোর মধ্যে আছে পোল্যান্ডের ডিউক রাজত্ব, লিথুয়ানিয়ার ডিউক রাজত্ব এবং পোলীয়-লিথুয়ানীয় কমনওয়েলথ। ১৮শ শতাব্দীতে এটিকে রুশ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। কেবল মধ্য-ঊনবিংশ শতাব্দীতে এসে বেলারুশে জাতীয়তাবাদী ও সাংস্কৃতিক জাগরণ ঘটে। ১৯১৯ সালে বেলোরুশীয় সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র হিসেবে বেলারুশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯২২ সালে এটি সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠাকারী চারটি রাষ্ট্রের একটি ছিল। ১৯৩০ সালে দ্বিতীয় পোলীয় প্রজাতন্ত্রের বেলারুশ জাতি অধ্যুষিত এলাকাগুলো আধুনিক সীমান্তের মধ্যবর্তী অঞ্চলে বেলারুশীয় ভূমিগুলোর সম্পূর্ণ একত্রীকরণ সংঘটিত হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে দেশটির প্রভূত ক্ষয়ক্ষতি হয়; এ সময় বেলারুশের এক-চতুর্থাংশ জনসংখ্যার মৃত্যু ঘটে এবং দেশটি অর্ধেকেরও বেশি অর্থনৈতিক সম্পদ হারায়। যুদ্ধ-পরবর্তী বছরগুলোতে বেলারুশ ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে ওঠে। ১৯৯১ সালের ২৭ জুলাই বেলারুশের আইনসভা দেশটির সার্বভৌমত্ব ঘোষণা করে। আগস্ট মাসে দেশটি স্বাধীন দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পায়, যা ডিসেম্বরে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনে ভূমিকা রাখে।
বেলারুশ জাতিসংঘের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে অন্যতম। এ ছাড়াও দেশটি স্বাধীন রাষ্ট্রসমূহের কমনওয়েলথ (সিআইএস), সিএসটিও, ইইইউ ও জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের সদস্য। বেলারুশ ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগদানের কোন আগ্রহ প্রকাশ করেনি, তবে ইউনিয়নটির সাথে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক বজায় রেখে চলেছে এবং সে মতে দেশটি ইইউ এর দু’টি প্রকল্পে অংশগ্রহণ করে। সেগুলো হলো পূর্বাঞ্চলীয় অংশীদারিত্ব ও বাকু উদ্যোগ।
বর্তমান বেলারুশের রাজনীতি একটি রাষ্ট্রপতি শাসিত প্রজাতন্ত্র কাঠামোয় পরিচালিত হয়। ১৯৯৪ সাল থেকে আলেক্সান্দর লুকাশেঙ্কো দেশটির রাষ্ট্রপতি। বেলারুশ ও রাশিয়াকে একত্রিত করে একটি মাত্র রাষ্ট্র রুশ ও বেলারুশ ইউনিয়ন করার ব্যাপারে ১৯৯৬ সাল থেকে দ্বি-পাক্ষিক আলোচনা চলছে। সরকারপ্রধান হলেন রাষ্ট্রপতি মনোনীত প্রধানমন্ত্রী। এ দেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী রোমান গলোভচেনকো। রাষ্ট্রের নির্বাহী ক্ষমতা সরকারের ওপর ন্যস্ত। এ দেশের পার্লামেন্টের নাম ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি বা জাতীয় পরিষদ। জাতীয় পরিষদ দ্বিকক্ষবিশিষ্ট : ১১০ সদস্যের প্রতিনিধি পরিষদ (নিম্নকক্ষ) এবং ৬৪ সদস্যের প্রজাতন্ত্র পরিষদ (উচ্চকক্ষ)। আইন প্রণয়নের ক্ষমতা এই দ্বিকাক্ষিক আইনসভার ওপর ন্যস্ত। তবে রাষ্ট্রপতি আইনের মতই অনির্দিষ্টকালের জন্য কার্যকর অধ্যাদেশ জারির ক্ষমতা রাখেন। বেলারুশের দু’টি বড় রাজনৈতিক দলের নাম হচ্ছে ঐক্যবদ্ধ নাগরিক দল ও গণফ্রন্ট। এ ছাড়াও সেখানে আরও কিছু ছোট দলও রয়েছে।
বেলারুশ ছয়টি প্রশাসনিক অঞ্চলে বিভক্ত এবং অঞ্চলগুলোর নাম সেগুলোর প্রশাসনিক কেন্দ্রের নামানুসারে নামকরণ করা হয়েছে। প্রত্যেক অঞ্চলের একটি করে প্রাদেশিক আইন প্রণয়ন কর্তৃপক্ষ আছে। এগুলোকে আঞ্চলিক পরিষদ বলা হয়। আঞ্চলিক পরিষদ অধিবাসীদের ভোটে নির্বাচিত হয়। এ ছাড়াও একটি করে প্রাদেশিক নির্বাহী কর্তৃপক্ষ আছে যাকে আঞ্চলিক প্রশাসন বলা হয় এবং এর প্রধানকে প্রেসিডেন্ট নিয়োগ দিয়ে থাকেন। অঞ্চলগুলো আবার রেইওন বা জেলায় বিভক্ত। ছয়টি অঞ্চল আবার ১১৮টি রেইওনে বিভক্ত। মিনস্ক নগরী নয়টি জেলায় বিভক্ত এবং দেশের রাজধানী হিসেবে বিশেষ মর্যাদা ভোগ করে থাকে। একটি নির্বাহী কমিটি রাজধানী মিনস্ক পরিচালনা করে থাকে এবং এটাকে স্বায়ত্তশাসনের সনদ দেওয়া হয়েছে।
বেলারুশের ছয়টি অঞ্চল (প্রশাসনিক কেন্দ্রসহ) হলো : ব্রেস্ট রেজিওন (ব্রেস্ট), গোমেল রেজিওন (গোমেল), গ্রডনো রেজিওন (গ্রডনো), মোগিলেভ রেজিওন (মোগিলেভ), মিনস্ক রেজিওন (মিনস্ক) ও ভিতেবস্ক রেজিওন (ভিতেভস্ক)। এ ছাড়াও আছে বিশেষ প্রশাসনিক জেলা মিনস্ক নগরী।
বেলারুশের জনপ্রিয় খাবার প্রধানত সবজি, গোশত ও রুটির সমন্বয়ে তৈরি হয়। খাবারগুলো ধীরে রান্না করা হয় অথবা ঢাকনাওয়ালা পাত্রে ঝোলসহ তাপ দিয়ে রান্না করা হয়। বেলারুশীয়রা সাধারণত সকালে হালকা নাস্তা করে এবং দিনের শেষভাগে দু’বার পেটপুরে খাবার খায়। বেলারুশে গম ও রাই শস্যের রুটি খাওয়া হয়। রাই এদেশে প্রচুর পরিমাণে উৎপাদিত হয় এবং গমের জন্য এখানকার আবহাওয়া খুব বেশি অনুকূল নয়। আতিথেয়তা দেখাতে একজন মেজবান অতিথি বা আগন্তুককে ঐতিহ্যগতভাবে রুটি ও লবণ পরিবেশন করে।
বেলারুশে ফুটবল, হকি, আইস হকি, টেনিস, অ্যাথলেটিকস ইত্যাদি নানা খেলাধুলা হয়ে থাকে। ফুটবল এ দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা। যদিও এ দেশের জাতীয় ফুটবল দল কখনই বড় ধরনের কোনো টুর্নামেন্টে খেলার যোগ্যতা অর্জন করেনি। তবে বেটবরিসভ নামক একজন ফুটবলার চ্যাম্পিয়ন লিগে খেলেছেন। এ দেশের জাতীয় হকি দল ২০০২ সালে সল্ট লেকসিটি অলিম্পিকসে চতুর্থ স্থানে খেলা শেষ করে। এর আগে তারা কোয়ার্টার ফাইনালে সুইডেনের বিরুদ্ধে স্মরণীয় জয়লাভ করে। ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপে দলটি নিয়মিত প্রতিযোগিতা করে থাকে এবং প্রায়ই কোয়ার্টার ফাইনালে ওঠে। বেলারুশের অসংখ্য হকি খেলোয়াড় ইউরেশিয়ায় কন্টিনেন্টাল হকি লিগে খেলে থাকেন এবং বেশ কয়েকজন উত্তর আমেরিকার জাতীয় হকি লিগে খেলেছেন।
ডারিয়াডমরাচেভা নামক একজন বাইঅ্যাথলেট ২০১৪ সালের শীতকালীন অলিম্পিকে তিনটি স্বর্ণপদক লাভ করে। মহিলা টেনিস খেলোয়াড় ভিকটোরিয়া আজারেনকা প্রথম বেলারুশিয়ান মহিলা যিনি ২০১২ সালে অস্ট্রেলিয়ান ওপেনে গ্র্যান্ড স্লাম সিঙ্গলস শিরোপা জয় করেন। তিনি ২০১২ সালে গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিকসে ম্যাকসমিরনির সাথে মিশ্র দ্বৈতে স্বর্ণপদক জয় করেন। বেলারুশ ১৯৯৪ সালের শীতকালীন অলিম্পিকস থেকে অলিম্পিক গেমসে অংশগ্রহণ করে আসছে। এ দেশের দ্বিতীয় জনপ্রিয় খেলা আইস হকির উন্নয়নের জন্য সরকার জোর চেষ্টা চালিয়ে আসছে।