[গত সংখ্যার পর]
সাত.
সকালে দেরি করে ঘুম ভাঙলো গোয়েন্দাদের।
ম্যাজমেজে শরীর নিয়ে ঘুম থেকে উঠল দুই গোয়েন্দা। আবিদের তন্দ্রা তখনও পুরোপুরি কাটেনি। আড়ামোড়া ভেঙে বলল, ‘মা, জলদি নাস্তা দাও।’
বিপ্লব হেসে বলল, ‘এই আবিদ, কী বকছো তুমি? এটা কি বাড়ি নাকি? না স্বপ্ন দেখছ?’
তন্দ্রা ছুটে গেল আবিদের। খাটের ওপর থেকে এক লাফে নিচে নেমে বলল, ‘স্যরি, ডিটেকটিভ দোস্ত। আই অ্যাম ভেরি ভেরি স্যরি।’
বিপ্লব চুপ করে রইল। তাকিয়ে রইল জানালার দিকে। ইতোমধ্যে ও হাতমুখ ধুয়ে এসেছে। চোখে-মুখে হাসির একটা ঝলক দেখা যাচ্ছে।
বিপ্লবের ঘাড়ে টোকা দিয়ে বলল আবিদ, ‘এই বিপ্লব, কথা বলছ না কেন? আবার হাসছ দেখছি।’
‘খুব মজার স্বপ্ন দেখেছ, তাই না?’ দুষ্টু হাসি মুখে রেখেই জিজ্ঞেস করল বিপ্লব।
‘বুঝলে কিভাবে?’ অবাক হলো আবিদ।
‘তোমার আনন্দ দেখে।’
‘আমার আনন্দ দেখে?’ ধপ করে খাটের ওপর বসল আবিদ। ‘আমি আবার আনন্দ করলাম কখন? তবে হ্যাঁ, স্বপ্ন একটা দেখেছি। শুনতে চাও নাকি স্বপ্নটা?’ আবিদকে এই মুহূর্তে দেখলে বোঝা যাবে না যে সে একটু আগে নাস্তার কথা বলছিল।
‘বলো শুনি।’
‘শোন তাহলে। আমি দেখলাম একটি সুন্দর ফুটফুটে উজ্জ্বল…’
‘থাক থাক আর বলো না।’ আবিদকে থামিয়ে দিল বিপ্লব। ‘তুমি কী স্বপ্ন দেখেছ, আমি তা বুঝে ফেলেছি।’
‘বুঝে ফেলেছ?’
‘হ্যাঁ। এখন চলো, ফুফু নাস্তা দিয়েছেন, সেরে ফেলি।’
আবিদের ক্ষুধাটা যেন হঠাৎ আবার উদয় হলো। উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘তাড়াতাড়ি চলো।’
‘দাঁড়াও দাঁড়াও, অত ব্যস্ত হয়ো না।’ আবিদের হাত টেনে ধরে তাকে যাওয়া থেকে ফিরিয়ে বলল বিপ্লব।
অবাক দৃষ্টিতে আবিদ তার বন্ধুর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। এই একটা কারণে আবিদ খুবই অবাক হয়। বিপ্লব কিছুই খোলাখুলি বলে না। বললেও তাতে থাকে রহস্যের হাজারটা গন্ধ।
‘পুলিশের অফিসে যাওয়ার কথা মনে আছে তো?’ বিপ্লব জিজ্ঞাসা করল।
হেসে ফেললো আবিদ। ‘ও, এই কথা? আছে, খুবই মনে আছে।’
‘থ্যাঙ্কস। এবার চলো।’
দরজা দিয়ে বাইরে বেরিয়ে গেল ওরা।
নাস্তার পর ঘরটাতে আবার মিলিত হয়েছে দুই গোয়েন্দা আর সুমি।
আলোচনায় বসেছে।
আলোচনা চলছে গত রাতের ঘটনা নিয়ে।
‘আশ্চর্য।’ বলল আবিদ। ‘পুলিশও ওদের কাছে হার মানল?’
‘মানল। কিন্তু…’ বিপ্লবের অসম্পূর্ণ বাক্য।
‘কিন্তু কী?’ জিজ্ঞেস করল আবিদ।
‘গোয়েন্দারা হার মানবে না।’ আবিদ কিছু বলার জন্য মুখ খুলছিল। তাকে থামিয়ে দিয়ে আবার বলল বিপ্লব, ‘ধরো, ইন্সপেক্টর আমাদের ওপর কাজটা ছেড়ে দিলেন…, চলো, ইন্সপেক্টরের অফিসে যাই।’
‘তোমার যা হুকুম! তুমি হলে গোয়েন্দাপ্রধান।’ মিটিমিটি হেসে দাঁড়িয়ে পড়ল আবিদ।
‘আমি আসব?’ এতক্ষণ পর সুমি মুখ খুললো।
‘অফকোর্স! অবশ্যই।’ বলল বিপ্লব।
ফুফুকে বেড়াতে যাচ্ছে বলে বেরিয়ে পড়ল ওরা।
পথে আর তেমন কথাবার্তা হলো না। পুলিশ অফিস চেনা ছিল সুমির। সেই নিয়ে গেল ওদেরকে। বিপ্লব দরজার সামনে দাঁড়িয়ে দরজায় টোকা দিলো।
‘এসো।’ ভেতর থেকে ইন্সপেক্টরের গলা ভেসে এলা।
দরজা ভেজানো ছিল। ঠেলে ভেতরে ঢুকল তিন কিশোর কিশোরী।
‘এলে তাহলে? বসো।’ চেয়ার দেখিয়ে ওদেরকে বসতে বলে নিজেও বসলেন নিজের চেয়ারে। বিশাল টেবিলের ওপাশে শুধু মাথাটাই দেখা যাচ্ছে ইন্সপেক্টরের।
টেবিলের ওপর এক পাশে দুটো টেলিফোন সেট, কিছু কাগজপত্র, ডেস্ক ক্যালেন্ডার, কলম ও বড় নেমপ্লেট রয়েছে। ‘পরিচয়ের পালাটা শেষ করা যাক।’ কলিংবেলে টিপ দিয়ে বললেন ইন্সপেক্টর।
‘আমার নাম বিপ্লব খান।’ নিজের নাম বলল বিপ্লব। হ্যান্ডশেক করল ইন্সপেক্টরের সাথে।
বিপ্লবের পাশেই বসে ছিল আবিদ। বলল, ‘আমি আবিদ।’ সেও হ্যান্ডশেক করল ইন্সপেক্টরের সাথে।
‘আর তোমার নাম সুমি।’ সুমির দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললেন ইন্সপেক্টর।
‘জি।’ সুমি বলল ছোট্ট করে।
এই সময় দরজায় দেখা দিল একটা মুখ। কেমন যেন মলিন, ‘আমাকে ডাকছেন, স্যার?’ জিজ্ঞেস করল লোকটি।
‘চার কাপ কফি।’ বললেন ইন্সপেক্টর।
‘ওকে স্যার।’ বলে দরজার ওপাশে হারিয়ে গেল লোকটা।
‘আর আমার নাম’ ছেলেমেয়েদের দিকে তাকিয়ে বললেন ইন্সপেক্টর। ‘মো….’
‘হারিস মোল্লা।’ সম্পূর্ণ করল বিপ্লব। নেমপ্লেটে নামটা দেখে নিয়েছে।
‘চালাক ছেলে।’ হেসে বললেন ইন্সপেক্টর মো. হারিস মোল্লা। ‘ও,’ প্রসঙ্গে আসার জন্য বললেন তিনি। ‘তোমাদেরকে ডেকেছি যে জন্য। কালতো তোমরা নিজের চোখেই সব দেখেছ। ওসব বলে খামাখা কথা বাড়াতে চাই না আমি। আসল কথাটুকু সংক্ষেপে বলছি শোনো। বেশ কয়েকদিন হলো ওই এলাকাটায় উৎপাত শুরু হয়েছে। রাতে লোকজন শান্তিতে ঘুমাতে পারে না। তাছাড়া ঐ এলাকাটা, যেখানে বাংলোটা রয়েছে, ওটা একটা মনোরম জায়গা। সে যাই হোক, ওখানে এখন লোকজন ঠিকমত ঘুরতেও পারে না। সন্ধ্যা হতেই ওদিকে চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। আমার কাছে এ বিষয়ে বহু রিপোর্ট আছে। পুলিশ হিসাবে আমার কর্তব্য জনগণের পাশে থেকে তাদেরকে সাহায্য করা, তাদেরকে নিরাপত্তা দেওয়া। কিন্তু বুঝতেই পারছ, কিছুই করতে পারছিনে আমি।’ একটু থেমে দম নিয়ে আবার বলতে শুরু করলেন, ‘আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি এলাকার শান্তি ফিরিয়ে আনতে। একদল সরকারি গোয়েন্দাও লাগিয়েছিলাম। কিন্তু তারা কিছুই করতে পারেনি। রাতের অন্ধকারে গোপনে নৌকা করে যেত গোয়েন্দারা। লুকিয়ে থাকতো আসামিদের আশায়। শেষে কাউকেই পেত না। নদীতে বড় বড় ঢেউ দেখত আর ঠিক সেই মুহূর্তেই শুনত বিকট চিৎকার। সঙ্গে সঙ্গে বাংলোর কাছে চলে আসত ওরা। তারপর আর কিছুই দেখত না। ও হ্যাঁ, ছায়ার মত কী যেন ঢুকতে দেখত ভেতরে। সঙ্গে ঢুকত হালকা আলো। আর তা দেখে ও শুনেই ওরা পালাত। গোয়েন্দাদের মতে ওগুলো ভূত। ওরা কি সিদ্ধান্ত নিয়েছে জান?’ সমর্র্থনের জন্য না থেমে বলে গেলেন তিনি, ‘ওরা আমাকে বলেছে আমি যেন বাংলোটা ভেঙে ফেলার ব্যবস্থা করি। কিন্তু তোমারই বল, ওটা কি ভাঙা সম্ভব? অমন একটা বাংলো, তাছাড়া, তাছাড়া ওখানে যদি সত্যি সত্যিই ভূত থেকে থাকে?’ থামলেন হারিস মোল্লা।
ঢোক গিললো আবিদ ও সুমি। ভেতরে ভেতরে খুব ভয় পেয়েছে ওরা। মুখ শুকিয়ে গেছে। আগেই চার কাপ কফি দিয়ে গেছে লোকটা। ইন্সপেক্টরের ইঙ্গিতে একটা করে কাপ হাতে তুলে নিলো ওরা। চুমুক দিয়ে গলা ও মুখ ভিজিয়ে নিলো।
বিপ্লবের ঠোঁটের কোণে হাসি দেখতে পেলেন ইন্সপেক্টর হারিস। কাপ টেবিলের ওপর নামিয়ে রেখে বললেন, ‘তোমরা বোধ হয় ভয় পেয়েছ। যাক গে, আসল কথাটা এবার বলি, আমি তোমাদেরকে ভাড়া করতে চাই। কালরাতে শুনেছি তোমরা গোয়েন্দা। বেশ কয়েকটা কেসের সমাধান করেছ। তাই আমার এই অনুভূতি। আমি জানি অনেক সময় বড়রা যে কাজ পারে না, ছোটরা তা অনায়াসেই করতে পারে।’ সমর্থনের আশায় বিপ্লবের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন তিনি।
‘একদম খাঁটি কথাটাই বলেছেন স্যার।’ বলল আবিদ।
‘তোমরা কেসটা নিচ্ছ তো?’ জানতে চাইলেন ইন্সপেক্টর।
আবিদ ‘না’ বলতে যাচ্ছিল। তাকে থামিয়ে দিয়ে বিপ্লব বলল, ‘হ্যাঁ স্যার, নিচ্ছি আমরা কেসটা।’
‘জায়গাটা চেনা আছে ভালো করে?’
‘আছে স্যার, মোটামুটি।’
‘আজ সন্ধ্যা থেকেই কাজে নামতে চাও?’ ইন্সপেক্টর হারিস জিজ্ঞেস করলেন।
‘হ্যাঁ স্যার, আজ সন্ধ্যা থেকেই।’ হেসে জবাব দিল বিপ্লব।
‘ওকে। অন্য একজন অফিসার থাকবেন তোমাদের সাথে, আমি বলে দেবো। আমিই থাকতাম। কিন্তু আমাকে একটু বাইরে যেতে হচ্ছে। তবে চিন্তা করো না, কাজটা সেরেই আমি দ্রুত তোমাদের সাথে যোগ দেবো।’
আর একবার করে হাত মেলালো ইন্সপেক্টর হারিসের সাথে ওরা। উঠে দাঁড়াল বাইরে বের হবার জন্য।
‘শোন।’ ডেকে বললেন অফিসার। ‘প্রয়োজন হলেই ফোন করবে আমাকে। আর হ্যাঁ, সাবধানে থাকবে।’
‘থাকব স্যার।’ বলে ঘর হতে বেরিয়ে গেল ওরা।
সেদিন সন্ধ্যার একটু আগে বাংলোর সামনে হাজির হলো দুই গোয়েন্দা আর সুমি।
নদীর তীরে সেই সিঁড়িটাতে বসেছে। অপেক্ষা করছে সন্ধ্যা নামার।
সঙ্গের পুলিশ অফিসার খুব লাজুক স্বভাবের। তবে কথা বলে টানা টানা বাংলাতে। সে এখন ওদের সাথে নেই। মোড়ে ঘুরতে গেছে। গোয়েন্দাদের বলে গেছে সন্ধ্যা নামতেই এখানে চলে আসবে।
চীনাবাদাম খেয়ে সময়টা কাটাচ্ছে ওরা। মাগরিবের আজান হলো। আবিদ আর সুমিকে বসিয়ে রেখে মসজিদ থেকে নামাজ সেরে এলো বিপু। বিপু ফিরতে নামাজ পড়তে গেলো আবিদ।
সূর্য ডুবে গেছে। আঁধার নামতে শুরু করেছে।
কথামতো ফিরে এলেন পুলিশ অফিসারটি। তার নাম লাল মিয়া।
বিপ্লবের কথামত নির্দিষ্ট জায়গায় চলে গেল আবিদ আর সুমি। অবশ্যই সঙ্গে টর্চ নিয়েছে। দুইজনকে দুই জায়গায় পাঠান হয়েছে। ওদের কাজ তেমন কিছু দেখলে সঙ্কেত দেওয়া- দুইবার টর্চ মিটমিট করে জ্বেলে তিন বারের বার দীর্ঘক্ষণ জ্বালিয়ে রাখা। বিপ্লব তার উত্তর দেবে বা যে উত্তর দেবে তার সঙ্কেত হচ্ছে পাঁচবার মিটমিট করে জ্বালিয়ে তারপর কিছুক্ষণ ধরে রাখা।
আবিদ রয়েছে বাংলোর পুব পাশে ভাঙা পাঁচিলটার আড়ালে। সুমি রয়েছে ঠিক তার বিপরীত পাশে, অর্থাৎ বাংলোর পশ্চিম পাশে নদীর ধারে। ওখান থেকে বাংলো কিছুটা ওপরে অবস্থিত।
বিপ্লবের ঘড়িতে সন্ধ্যা সাতটা বাজার অ্যালার্ম বাজল।
ঝিঁ ঝিঁ ডাকতে শুরু করল চারিদিকে। কান ঝালাপালা করে দিতে লাগল ওদের বিরক্তিকর ডাক।
আর এরই মাঝে এক সময় পানিতে ঢেউ উঠল। আরও কিছুৃ পর শোনা গেল ‘ছলাৎ ছল ছলাৎ ছল’ শব্দ- নৌকার দাঁড় ফেলার শব্দ। সিঁড়ির আড়ালে হামাগুড়ি দিয়ে বসল বিপু ও লাল মিয়া। চোখ নদীর দিকে।
দাঁড় বাওয়ার শব্দ এগিয়ে আসতে লাগল কূলের দিকে। এক সময় শেষও হলো। কিন্তু কোন আলো চোখে পড়ল না। আকাশে এখন চাঁদ পুরোপুরি ওঠেনি। তবে তারা উঠেছে বেশ কয়েকটা। তারার আলোতে নদীর কিনারটা আবছা দেখা যাচ্ছিল। কিন্তু নৌকার কোনো চিহ্ন না দেখেই অবাক হচ্ছিল বিপ্লব। এই সময় লাল মিয়া তার টর্চটা জ্বালালো। তাকে থামানোর কোনো সুযোগ পেলো না বিপ্লব।
কেটে গেল আরও কিছু সময়। দম বন্ধ করে বসে রয়েছে বিপ্লব। হঠাৎই কেমন অস্থির হয়ে উঠল ওর মন। একা একা মনে হতে লাগলো। পাশে তাকিয়ে দেখল, লাল মিয়া নেই, উধাও হয়ে গেছে।
ভয়ার্ত চোখে একবার বাংলোর দিকে তাকাল বিপ্লব, আর তখনই চোখে পড়ল ওটা। একটা আলো ঘনঘন দুইবার জ্বলে উঠে তৃতীয়বার একটু বেশিক্ষণ জ্বলল। আবিদের সঙ্কেত ওটা। তার মানে, কিছু একটা দেখেছে সে। তবে একটু অবাক হলো- আলোটা কেমন কাঁপছিল!
তাড়াতাড়ি বিপু তার জবাব দিল টর্চ জ্বেলে। তারপর কিছুক্ষণ নীরবতা। পাশেই কোথাও একটা ঝিঁঝিঁ পোকা জোরে জোরে ডাকতে লাগল। আর থাকতে পারল না বিপ্লব। এগিয়ে গেল আবিদের উদ্দেশে, আর এগিয়ে গিয়েই ভুলটা করল।
আট.
উঁচু-নিচু এবড়ো থেবড়ো পথ।
অন্ধকারে এগিয়ে চলেছে একা বিপ্লব।
আকাশ কিছুটা পরিষ্কার। দূর থেকে বাংলোটাকে একটা কালো পাহাড়ের মত মনে হচ্ছে বিপ্লবের কাছে।
বাংলোর কাছে পৌঁছে গেল বিপ্লব। আর মাত্র ১০ ফুট মত দূরে দরজাটা। ঠিক এই সময়ই ভেসে এলো একটা ভয়ঙ্কর তীক্ষè চিৎকার। সমস্ত আকাশে বাতাসে প্রতিধ্বনিত হতে লাগল। গা শিরশির করে উঠল বিপ্লবের। ঘাড়ের লোম খাড়া হয়ে গেল। হাত থেকে পড়ে গেল টর্চটা। শক্ত মাটিতে পড়ে কাচ ভাঙলো ঝনঝন করে। শব্দটাকে উদ্দেশ্য করে ডান দিকে তাকাল ও। আর তখনই ঘটে গেল ঘটনাটা।
প্রকাণ্ড একটা কিছু নেমে আসছে বিপুর মাথার ওপর।
একটা লাঠি, বিপ্লবকে আঘাত করার জন্য প্রস্তুত। পাঁই করে ঘুরে মাটিতে ডিগবাজি খেল ও। আর অমনি লাঠির আঘাতটা বিঁধল মাটিতে। আরেকটু হলেই থেঁতলে যেত ঘাড়-মাথা।
আস্তে আস্তে সতর্কতার সাথে উঠে দাঁড়াল গোয়েন্দাপ্রধান। আবার উঠে এসেছে লাঠিটা। এবার দেখতে পেল লোকটাকে, লাল মিয়া।
কুৎসিত একটা ছায়ার মত লাগছে তাকে, দেখলেই গা শিরশির করে।
বিপু হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে রইল কয়েক সেকেন্ড। বোধ শক্তি হারিয়ে ফেলেছে যেন।
নিজের অজান্তেই এবার মাথা নিচু করে বসে পড়ল ও। কিন্তু এবার আঘাতটা পুরোপুরি এড়াতে পারল না। মাথার ডান পাশটায় কানের ওপরে ছুঁয়ে গেল লাঠির আঘাত। সঙ্গে সঙ্গে সেখানে বিপ্লবের এক হাত উঠে গেল। ব্যথায় গুঙিয়ে উঠল। চোখে তারাফুল দেখতে দেখতেও মিলিয়ে গেল সেটা। অজ্ঞান হতে রাজি নয় ও। কিছুতেই মনোবল হারাবে না। তাই দাঁতে দাঁত চেপে মুখ শক্ত করে টলতে টলতে উঠে দাঁড়াল।
মাথাটা কেমন ঝিম ধরে আছে। এই সময় আবছা আবছা শুনতে পেল পদশব্দটা। এগিয়ে যাচ্ছে নদীর দিকে। নিশ্চয় লাল মিয়া। একসময় মিলিয়ে গেল পদশব্দটা।
টলোমলো পায়ে এগিয়ে চললো বিপ্লব। মনে নানান চিন্তা মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে। কিন্তু চিন্তা করার সময় এখন নেই। বন্ধুকে বাঁচাতে হবে যে করে হোক। বুঝতেই পারছে আবিদ কোনো বিপদে পড়েছে।
আবিদের টর্চটা আরেকবার জ্বলে উঠল। সঙ্কেত ঠিকমত পৌঁছতে পারল না। দুইবার জ্বলে উঠেই থেমে গেল। বিপ্লব হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিলেও তার হাঁটা দ্রুত হচ্ছে না। টলছে সে, মাথা ভীষণ যন্ত্রণা করছে।
কিছু কি দেখতে পেল আবিদ? শত্রুদের কাউকে? নাকি অন্য কিছু? নাকি কোন বিপদ হলো তার? এই সব কথা ভাবছে বিপ্লব।
প্রায় পৌঁছে গেছে গন্তব্যস্থলে। কিন্তু ওর জন্য আরও বিপদ অপেক্ষা করছিল। ওঁৎ পেতে ছিল দুটো ডাকাত। বিপ্লবের দিকে বাগিয়ে ধরেছে তাদের ধারালো চকচকে ছুরি।
কে এই ডাকাত দুটো? কী চায় তারা? বিপুকে মারতে চায়? লাল মিয়াও তো সেটাই চেয়েছিল। তাহলে কি সেও এই ডাকাত দলের একজন?
অন্ধকারের মধ্যে কালো মুখোশ পরেছে ডাকাত দুটো। অবশ্য সেটার প্রয়োজন ছিল না। এমনিতেই এই অন্ধকারের মধ্যে তাদের কেউ চিনতে পারবে না।
আর হ্যাঁ, একটা ব্যাপার লক্ষ করল বিপ্লব। ডাকাত দুটোর চোখগুলো কেমন বন্যপশুর মত জ্বলজ্বল করে জ্বলছে। সে চোখের জ্যোতিতে হিংসা, আক্রোশ। আবার আতঙ্ক ও ভয়ও যেন মিশে আছে। কেন এটা করতে গেল তারা? হ্যাঁ, একটাই ব্যাখ্যা এর- মানুষকে তাড়ানো। তাহলে কি সরকারি গোয়েন্দারা এটা দেখেই পালিয়েছে? রহস্য কেবলই জটিল হয়ে আসছে। জট পাকাচ্ছে যেন।
বিপ্লব ঠিক করল কিছুতেই এদের হাতে ধরা দেওয়া চলবে না। তাই তাদেরকে অন্যত্র সরিয়ে দেওয়ার বুদ্ধি আঁটল। সেই মতো যেন ভয় পেয়েছে এমন ভাব দেখিয়ে দৌড় দিল একদিকে। ডাকাত দুটোও ওর পিছু নিলো। তবে অল্প যেতেই আচমকা একটা শব্দে উল্টো দিকে দৌড়াতে শুরু করল ডাকাত দুটো।
দাঁড়িয়ে পেছন দিকে তাকাতেই সুমির সঙ্কেত পেল বিপ্লব। সেও কিছু দেখেছে নিশ্চয়ই। কিন্তু আশ্চর্য! আলোটা নদীর দিকে এত দ্রুত সরে যাচ্ছে কেন?
কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে কয়েক মুহূর্ত ঠায় দাঁড়িয়ে রইল বিপু ভাইয়া। কী করবে ভেবে পাচ্ছে না। কোনদিকে যাবে ও এখন? আবিদের দিকে, নাকি সুমির দিকে?
নিজের টর্চটাও তো হারিয়েছে। এখন কী করবে?
প্রথমে আবিদের অবস্থানের দিকেই গেল বিপ্লব। কিন্তু ভালো করে খুঁজেও সেখানে বা আশপাশে আবিদকে পাওয়া গেল না। সুমির ওদিকে যেতে হবে- সিদ্ধান্ত নিয়েই সেদিকে এগিয়ে চলল।
বাংলোর সামনে খোলা প্রান্তর দিয়ে যাওয়ার সময় একবার দরজাটা পরীক্ষা করল ও। না, খোলা নেই ওটা, বন্ধ। মস্ত এক তালা ঝুলছে। সরে আসবে ওখান থেকে, ঠিক এই সময় শুনতে পেল আবিদের আর্তচিৎকার, ‘বিপ্লব, তুমি কোথাআআআয়…।’
ঢোক গিলল বিপ্লব। সব ভুলে গলা ফাটিয়ে ও-ও চিৎকার করল, ‘আবিইইইদ, আমি এখানেএএ…।’
প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে এল বিপ্লবের কণ্ঠটা।
আর কোনো শব্দ নেই। নাম ধরে আরও বার কয়েক ডাকল বিপ্লব। সুমির নাম ধরেও ডাকল। কিন্তু কেউই কোনো সাড়া দিল না।
আঁতকে উঠল বিপ্লব। কী হয়েছে ওদের? কিছু হয়ে গেলে কী জবাব দেবে ওদের বাবা-মাদের?
বিপ্লবের গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। চারদিকে বিশাল শূন্যতা ছাড়া কিছুই নেই যেন। এই শূন্যতার মাঝে এক অসহায় শিশুর মতো মনে হচ্ছে নিজেকে, যে একটু আগে তার মাকে হারিয়ে এখানে এসে পড়েছে।
নিজের মধ্যে এতটাই ডুবে গিয়েছিল যে, কখন তার পাশে চিকমিক এসে দাঁড়িয়েছে তা ও খেয়ালই করেনি। ধাতব দণ্ডের প্রচণ্ড আঘাতে মাথা ঘুরে পড়ে গেল বিপ্লব। জ্ঞান হারানোর পূর্বে একটি কথাই ওর কর্ণকূহরে প্রবেশ করল, ‘থাক খোকা কিছুক্ষণ এখানে পড়ে। বাকি দুটোকে নিয়ে গেলাম।’
নৌকায় বন্দী দুই কিশোর-কিশোরী- আবিদ ও সুমি। হাত-পা বাঁধা অবস্থায় পিঠে পিঠ ঠেকিয়ে বসে আছে। দুইজনের চার হাত এক জায়গায় একসাথে দড়ি দিয়ে বাঁধা। আবিদের পা বাঁধা একটা খুঁটির সাথে।
আকাশেও এই মুহূর্তে গোল থালার মত চকচকে চাঁদ। একবার মেঘের ভেতরে ঢুকছে, আবার বেরিয়ে আসছে। জায়গায় জায়গায় তারারা যেন মেলা বসিয়েছে। আধবোজা চোখে সেদিকে তাকিয়ে রয়েছে আবিদ।
সুমি গভীর ঘুমে অচেতন।
টর্চ দুটো পাশেই পড়ে আছে।
নৌকার দাঁড় বাইছে চিকমিক আর পিকমিক। ফিরোজ মামা নৌকার গলুইয়ের কাছে বসা।
আলাপ চালিয়ে যাচ্ছে তিন গুণ্ডা।
‘ফিরোজ মামা, ছেলেমেয়ে দুটোকে কী করব?’ জিজ্ঞেস করে চিকমিক।
‘আপাতত আমাদের হেড অফিসেই থাকবে। কাল আসার সময় ওদের নিয়ে আসব। আটকে রাখব গুদাম ঘরে।’ ফিরোজ মামার সোজা জবাব। ‘তবে হ্যাঁ, ওদেরকে ভালো খাবার দেবে। কিন্তু একটা শর্তে, ওরা ওসব গোয়েন্দাগিরি করতে পারবে না এই মর্মে যদি মুচলেকা দেয়।’
‘তাহলে তো ওদেরকে ছেড়েই দেওয়া হবে।’ বলল চিকমিক।
‘হুঁ। কিন্তু তার আগে তিন নম্বর ছোকড়াকে আমার চাই।’
‘ওকে তো ধরেই ফেলেছিলাম। তোমার কথামতই ওকে অজ্ঞান করে ফেলে এসেছি। তখন আনলাম না কেন তাহলে?’ [চলবে]