কেশোওয়ারি পৃথিবীর সবচেয়ে হিংস্র পাখি। পাঁচ ফুট উচ্চতার বিশাল ওজনের পাখি কেশোওয়ারি। এরা উড়তে পারে না। এদের সমস্ত দেহ চুলের মতো মোটা লোমে ঢাকা থাকে। যার ফলে এদের ডানা দেখা যায় না।
বর্তমানে কেশোওয়ারির তিনটি প্রজাতি টিকে আছে। তাদের শুধুমাত্র পাপুয়া নিউগিনি, উত্তর-পূর্ব অস্ট্রেলিয়া এবং তার আশপাশের কিছু দ্বীপে পাওয়া যায়। কেশোওয়ারি লম্বায় ৫ ফিট ৬ ইঞ্চি পর্যন্ত হতে পারে যা পাখিদের মধ্যে লম্বায় তৃতীয় বৃহত্তম।
কেশোওয়ারির চেয়েও লম্বা হয় কেবল দুটো পাখি- উটপাখি এবং ইমু। একটি প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ কেশোওয়ারির ওজন ১২১ পাউন্ড এবং স্ত্রী কেশোওয়ারির ওজন ১৫৭ পাউন্ড পর্যন্ত হয়, যা ওজনে পাখিদের মাঝে দ্বিতীয়। প্রথম অবস্থানে আছে উটপাখি।
স্ত্রী কেশোওয়ারি পুরুষ কেশোওয়ারির চেয়ে আকারে বড় এবং গায়ের রঙ বেশি উজ্জ্বল হয়। উভয়েরই লম্বা গলার রঙ রাজকীয় নীল এবং পুরো গা ঝাঁকড়া, কালো মসৃণ পালকে ঢাকা থাকে। এদের উজ্জ্বল নীল রঙের গলায় আছে টকটকে লাল চামড়ার ঝালর।
কেশোওয়ারির দেহের আশ্চর্যজনক একটি ব্যাপার হচ্ছে তার মাথার হেলমেটের মতো একটি গঠন যা ক্যাসক নামে পরিচিত। দুই বছর বয়স থেকে এদের মাথায় ক্যাসক তৈরি হওয়া শুরু হয় এবং বয়সের সাথে সাথে বড় হতে থাকে। এটি কেরাটিন নামক প্রোটিন দিয়ে তৈরি, যা দিয়ে আমাদের নখ গঠিত। এই হেলমেটের কাজ কী হতে পারে তা নিয়ে বিজ্ঞানী মহলে প্রচুর গবেষণা হয়েছে। একটি কারণ হতে পারে, গাছপালা ঝোপঝাড়ের তলা দিয়ে হাঁটার সময় সংঘর্ষের হাত থেকে এটি কেশোওয়ারির মাথা রক্ষা করে।
এ ছাড়াও এটি একটি গৌণ যৌন বৈশিষ্ট্যও হতে পারে যা দিয়ে প্রজননের সক্ষমতা বোঝায়। তবে জীববিজ্ঞানী এন্ড্রু ম্যাক তার নিজস্ব পর্যবেক্ষণ থেকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণটি বলেন। কেশোওয়ারি খুবই মৃদুস্বরে ডাকে। মানুষের শ্রবণক্ষমতার সর্বনিম্ন ফ্রিকোয়েন্সিতে তাদের ডাক শুনতে পাওয়া যায়। ম্যাকের ধারণা এই ক্যাসক এমপ্লিফায়ার হিসেবে কাজ করে, যার ফলে কেশোওয়ারির ডাক কয়েক গুণ হয়ে ছড়িয়ে পড়ে।
কেশোওয়ারির দেহ ঢাকা থাকে লম্বা মোটা কালো লোমে। এরা খুবই লাজুক। মানুষের কাছ থেকে দূরে থাকা এদের স্বভাব। চালচলনে বেশ নিরীহ মনে হলেও রেগে গেলে এরা ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে। শূন্যে লাফ দিয়ে ধারালো নখ দিয়ে প্রতিপক্ষকে আক্রমণ করে। হিংস্র স্বভাবের জন্য বনের অনেক প্রাণী এদের এড়িয়ে চলে। মানুষ এর কাছাকাছি গেলেই আক্রমণ করে না কিন্তু যদি মনে করে তাদের কোনো ক্ষতি হতে পারে তবে তাদের ধারালো নখ ও ঠোঁট দিয়ে সহজেই ঘায়েল করে ফেলে।
যেহেতু তারা উড়তে পারে না কাজেই তাদের লেজে উড়তে সহায়ক পালক থাকে না। কেশোওয়ারির লম্বা শক্তিশালী দুটো পা আছে। প্রতিটি পায়ে তিনটি করে আঙুল এবং প্রতিটি আঙুলে শক্ত, ধারালো নখর থাকে। মাঝের আঙুলে ছুরির মতো ধারালো নখ আছে যা তারা অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে। কেশোওয়ারি খুব দ্রুত ছুটতে পারে, ঘণ্টায় প্রায় ৩০ মাইল বেগে। তারা খুব দক্ষ সাঁতারুও বটে।
কেশোওয়ারির খাদ্য মূলত বিভিন্ন ফলমূল। তারা গাছের নিচে পড়ে থাকা ফল খেয়ে থাকে। একটি পূর্ণবয়স্ক পাখি দিনে প্রায় ১১ পাউন্ড ফল খেতে পারে। তাদের মলের সাথে সাধারণত অর্ধ-পরিপাককৃত ফল বের হয়ে আসে। এই মল তারা আবার খায়। খাবারের মাধ্যমে বিভিন্ন গাছের বীজ বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে দিয়ে তারা পরিবেশে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ফল ছাড়াও কেশোওয়ারি ইঁদুর, সরীসৃপ ইত্যাদি খেয়ে থাকে।
মা কেশোওয়ারি ছন্নছাড়া ধরনের হয়। তারা একইসাথে কয়েকটি পুরুষের সাথে মিলিত হয় এবং ডিম পাড়ার পর চলে যায়। কেশোওয়ারির ডিম সবুজ রঙের হয়। ডিম ফোটা থেকে শুরু করে বাচ্চা বড় হওয়া পর্যন্ত সব দায়িত্ব থাকে বাবার ওপর। ডিম ফুটতে ৫০ দিনের মতো সময় লাগে। এই সময়ে বাবা কখনোই বাসা ছেড়ে যায় না, এমনকি খাবারের জন্যও নয়। পুরো সময় না খেয়ে ডিম পাহারা দেয়। ডিম ফোটার পর নয় মাস পর্যন্ত বাবা তার বাচ্চাদের লালন পালন করে। বাচ্চারা বড় হয়ে গেলে বাবা তাদের খাবার খুঁজতে শেখায়।
এই পাখিটি পৃথিবীর সবচেয়ে বিপজ্জনক পাখি হিসেবে পরিচিত। বিপদে পড়লে তারা শত্রুকে পা দিয়ে লাথি দেয়, যা কখনো কখনো মেরে ফেলতেও সক্ষম হয়। পায়ের আঘাতে খুব সহজেই হাড় ভেঙে ফেলতে পারে। এই পায়ের সর্বোচ্চ ব্যবহার করতে তারা প্রায় ৭ ফিট উঁচু পর্যন্ত লাফ দিয়ে, পা নিচের দিকে করে ঝাঁপিয়ে পরে শত্রুকে ছিঁড়ে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন করে দেয়। কেশোওয়ারি লাফ দিয়ে প্রতিপক্ষের কাছে বেশ দ্রুত চলে যায় ও লাথি দিয়ে মাটিতে ফেলে ঠোঁট দিয়ে ক্ষত করে ফেলে। কেশোওয়ারি কুকুর জাতীয় প্রাণী মেরে ফেলে।
এদের ভয়ঙ্কর রূপ দেখে ২০০৭ সালে গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ড এদের বিশ্বের সবচেয়ে হিংস্র পাখি হিসেবে বর্ণনা করা হয়। এখন পর্যন্ত দুজন মানুষ কেশোওয়ারির হাতে মারা গেছে বলে রেকর্ড আছে।
বন্য পরিবেশে একটি কেশোওয়ারি কতদিন বেঁচে থাকে তা সম্পর্কে সঠিক ধারণা পাওয়া যায় না। তবে চিড়িয়াখানায় ৪০-৬০ বছর বয়সী কেশোওয়ারিও রয়েছে। ১৯৮২ সালে ঢাকা চিড়িয়াখানার জন্য স্ত্রী-পুরুষ মিলিয়ে কেশোওয়ারির জোড়া আনা হয়।