হাঁটি হাঁটি পা পা করে কৈশোরের অনেকগুলো দিন পার করে জীবনের উচ্ছল উজ্জ্বল সময়ে পা রাখে নাবিল। জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত যেন এখন নাবিলের কাছে চঞ্চল ঝর্ণাধারা। ভীষণ ডানপিটে ছেলে। সারাক্ষণ চাদশী তরুণ সংঘ আর সঙ্ঘের সদস্যদের নিয়ে যেন তার কাজ। খেলাধুলায় মেতে থাকলেও দোষ ছিল না। তা না করে কাঠবিড়ালির মতো কার গাছে পেয়ারা বড় হলো, কার কাঁঠাল পাকলো, কোন বাগানের আম পেকে টসটস করছে, কোন বাগানে লিচু কেমন ধরেছে সব দিকে তার নজর বেশি।
স্কুল ফাঁকি দেওয়া তার রুটিন মাফিক কাজ। টিফিনের সময় দলবেঁধে চলে যেত চাদশীর বিলে। গরমকালে চাদশী গ্রামটি ঘিরে থাকে জলাভূমিতে। বিল আর কিছুটা ঝোপঝাড়। দলবেঁধে চলতো সাঁতারের পাল্লা। বিলে কারো নৌকা বাঁধা থাকলে আর রক্ষা নেই। কার নৌকা তা আর জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন নেই। বেয়ে নিয়ে যেত বিলের মাঝে। নৌকা ধীরে ধীরে কাচের মতো স্বচ্ছ জল কেটে চলত। মাঝে মাঝে সালুক ধরার পাল্লায় কয়েকজন লাফিয়ে পড়তো নৌকার গলুই থেকে ঝপাত! ঝপাত! ঘোলা পানির ঢেউয়ে হঠাৎ কখনো-সখনো শাপলা-শালুকগুলো পানকৌড়ির মতো ডুব দিত। আবার জেগে উঠতো। শাপলা-শালুকগুলো যেন ওদের সাথে খেলায় মেতেছে। বিলের ধারে ধবল বকের সোনালি ডানার ঝাপটানি ওদের মাতিয়ে তুলতো।
সূর্য মাথার ওপর ঢলে পড়ার আগেই আবার যথাস্থানে ফিরে আসতো ওরা। বাড়ি ফেরার পথে চলতে কারো পুকুরে ঢিল মারার খেলা। খেজুর গাছের ঝুলন্ত রসের হাঁড়ি তাক করে ঢিল ছোড়া। মনটা অনন্ত পাখির মতো উড়তো। কেউ কেউ দু-একটা লাইন ধরে গান গাইতো। বাকিরা সবাই তার সাথে সুর মেলাতো। মা বাবা সব সময় আফসোস করেন আমাদের ছেলে কী যে হবে।
সারাদিন পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে পড়ালেখা একদম শিকেয় উঠেছে। তার ওপর আবার দু’চারটে নালিশ তো লেগে আছেই। আজ এর গাছের এটা নেই, কাল ওর সাথে ঝগড়া মারামারি। অন্যের জিনিস নষ্ট করা। এসব ঝামেলা কে পোহাবে? এইতো আজ নাকি আলভীদের পেয়ারা বাগানে ঢুকেছিলো। খাবিতো খা, আবার কি না দলবল নিয়ে আলভীকেই শাসানো? ভাগ্যিস গাঁয়ে নাবিলের বাবার বেশ নাম ডাক রয়েছে। নাবিলের দাদা এক সময় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন। তাতেই সাত খুন মাফ।
বিকেলে নাবিলের নানার বাড়ি দাওয়াত। তার মামাতো ভাই ইয়াছিনের জন্মদিন। রাজিহার ইউনিয়ন, অনেক দূর। ফিরতে রাত হবে। আজ আর ফিরবেন না বলে নাবিলের আম্মা ভেবে নিয়েছেন। ছেলেকে তৈরি হওয়ার জন্য আদর মাখা সুরে ডাক দিলেন নাবিল, না-বি-ল।
তাড়াতাড়ি কাপড় পরে তৈরি হও।
: আমার যাওয়া হবে না তোমরা যাও আম্মা। পাশের ঘর থেকে নাবিল অন্যমনস্কভাবে মায়ের কথার উত্তর দেয়।
: সে কি! তুমি না গেলে আমরা কী করে যাই?
: বারে! আমিতো প্রায়ই নানুবাড়ি যাই। আগামী রোববার আমাদের ফুটবল ম্যাচ। রোজ বিকেলে প্র্যাকটিস করতে হয়। ক্যাপ্টেন বলেছে এ সময় মিস করা চলবে না। একদম না।
নাবিলের আম্মু এবার নাবিলের কাছে এসে আদর করে বললেন-
একদিন মাঠে না গেলে কিছু হবে না, চলো লক্ষ্মীটি, দুষ্টুমি করে না।
: ইস! আম্মু আর মাত্র দু দিন বাকি।
আজ মাঠে না গেলে ফাইনালে আমাকে ওরা খেলতে নেবে না। নাবিল বরাবরই অভিমানী। একদম কথা শোনে না। আজ তার ভিন্ন রূপ দেখা গেলো না। মায়ের কথাকে উপেক্ষা করে মাঠের দিকে পা বাড়ায় নাবিল। মাঠের চারদিকে লোকে লোকারণ্য। আজ চাদশী তরুণ সংঘ বনাম রাজিহার তরুণ সংঘের মধ্যে ফাইনাল খেলা। মাঠের একদিকে সাজানো প্যান্ডেল সমেত কিছু চেয়ার। প্রধান অতিথির আসন অলংকৃত করেছেন চাদশী ঈশ্বরচন্দ্র উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সাহেব। রেফারির বাঁশির সাথে সাথে খেলা শুরু হয়ে গেল। খেলা চলছে। নাবিল ভালোই খেলছিল। হৈচৈ, হাততালি পড়ছে চারদিক থেকে। হঠাৎ বলটা জোরে শট করতে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে যায়। উঃ শব্দে চিৎকার করে নাবিল। হাতে ভীষণ ব্যথা পায়। তাড়াতাড়ি কয়েকজন ছুটে আসে ওকে ধরতে। হাঁটু কেটে রক্ত ঝরতে থাকে। ফাহিম রুমাল বের করে রক্ত বন্ধ করার চেষ্টা চালায়। রক্ত পড়া বন্ধ হলেও নাবিল ভীষণ ব্যথা অনুভব করে।
কয়েকজন ধরাধরি করে মাঠের বাইরে নিয়ে গেলো নাবিলকে।
: বাসার কাউকে কিছু বলবি না। দেখবি এমনিতেই সব ঠিক হয়ে গেছে। ফাহিম নাবিলকে সান্ত¡না দেয়।
কিন্তু পরক্ষণেই নাবিল উঃহ-হ শব্দে চিৎকার করে ওঠে। হাতের দিকে লক্ষ রাখতে দেখে হাত আস্তে আস্তে ফুলে যাচ্ছে। ব্যথা বাড়তে থাকে। অবশেষে আর নাবিলের খেলা হলো না। বন্ধুরা মিলে নাবিলকে বাড়ি পৌঁছে দিল। শেষ পর্যন্ত নাবিল এ খেলায় খেলতে না পারলেও জয়ের মালা কিন্তু তারাই ছিনিয়ে নিয়েছিল। এক গোলে চাদশী তরুণ সংঘ জয়ী হয়েছিল।
সকালের সোনালি রোদে চারদিক চিকচিক করে ওঠে। গাছের পাতাগুলো যেন একটু নড়েচড়ে অলসতা দূর করে। মিষ্টি বাতাস বইছে চারদিকে। বুক ভরে তাজা শিশির ভেজা বাতাস নেয় নাবিল। পড়ার ঘরের বারান্দায় একটা চেয়ার পেতে আনমনে বসে থাকে। একটা পাখি উড়ে এসে বসে উঠোনের পুরনো শজনে গাছের ডালে। তার উল্লাস ধ্বনি নাবিলের মুগ্ধ দৃষ্টি মাটি থেকে গাছের দিকে কেড়ে নেয়। রোদের তাপ বেড়ে চলে। নাবিল চেয়ার ছেড়ে পড়ার ঘরের খাটে গিয়ে বসে, আর ভাবে কেন যে কাল খেলতে গিয়েছিলাম। মা-তো কোনদিন খেলতে নিষেধ করেননি। শুধু সেদিনই আমাকে মা বারণ করেছিলেন। মায়ের কথা না শোনাতে এখন এত কষ্ট পেতে হচ্ছে। মা নিশ্চয় মনে কষ্ট পেয়েছেন। আমার হাত যদি ভালো না হয় তাহলে আর কোনদিন হয়তো আমি খেলতে পারব না। নৌকা বাইতে পারবো না চাদশীর বিলে। ঢিল মারার খেলাও আর হবে না। এসব ভাবতে ভাবতে নাবিলের দুচোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ে।
নাবিলের জলে ভেজা চোখ দুটো স্থির হয় ঘরের কোণে। সরু গর্ত থেকে একটা ছোট্ট ইঁদুর বেরিয়ে আসে। ছানাটি ঘরের এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করে কী যেন খুঁজছিল। গ্রামে এ সময় সবার ঘরে ঘরে নতুন ধান উঠে। নতুন ধানের মেঠো মেঠো গন্ধ চারদিক মাতিয়ে তোলে। ঘরের মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ধান পড়েছিল। ইঁদুর ছানাটি এক দৌড়ে আবার গর্তে চলে গেল। নাবিল চুপচাপ এক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে গর্তটার দিকে। কিছুক্ষণ পর ছানাটি আবার বেরিয়ে এলো। এবার একা নয়, সঙ্গে এক বড় ইঁদুর। বড় ইঁদুরটা হলো ছানাটির মা। ছানাটি তার মাকে ধানগুলোর কথা বললো। নাক দিয়ে শুঁকে বড় ইঁদুরটা আস্তে আস্তে ধানগুলোর কাছে গেল। মা ইঁদুরটা খুশিতে কয়েকটি ডাক দেয় চিক চিক চিক। নাবিল বুঝলো, মা ইঁদুরটা অন্ধ, চোখে দেখতে পায় না। ছানাটি সবসময় তার মাকে পথ চলতে সাহায্য করে, মায়ের জন্য খাবার খুঁজতে বের হয়।
বাইরে তখন কার যেন পায়ের শব্দ শোনা গেল। বাচ্ছা ছানাটি তার মাকে চি চি চিকচিক করে ডাকছে। বোঝা গেল ছানাটি তার মাকে বলছে মা, মা চলো এক্ষুনি আমরা পালাই। কে যেনো এদিকে আমাদের ধরতে আসছে। এই বলে ছানা ইঁদুরটি তাড়াতাড়ি খুব সাবধানে পথ দেখিয়ে মাকে গর্তে নিয়ে গেল।
নাবিল পুরো ঘটনা ভালো করে লক্ষ করলো। এবার সে বাবা-মায়ের সাথে নিজের ব্যবহারের জন্য খু-উ-ব লজ্জা পেল।
নাবিল মনে মনে ভাবল একটা বাচ্চা ইঁদুর তার মায়ের জন্য এত যত্ন নেয়, এত ভালোবাসে। আর আমি এত অবাধ্য ছেলে। ভাবতে ভাবতে নাবিল হু হু করে কেঁদে ওঠে। বাম হাত দিয়ে চোখের পানি মুছতে মুছতে নাবিল মনে মনে ভাবে আমিও ইঁদুর ছানার মতো মা বাবাকে সেবা করবো, আদর যত্ন করব, কথা শুনবো, পড়বো মন দিয়ে।
নাবিল হাতের দিকে তাকায়। হাতের ব্যথা কিছুটা থাকলেও তা আর ফোলা দেখাচ্ছে না। বাইরে তখন সোনালি রোদ হেসে উঠেছে। সত্যি নাবিলের ভীষণ ভালো লাগছে। মনে হচ্ছে বুকের ওপর থেকে বিশাল একটা পাথর সরে গেল। নাবিলের ফিরে আসা
আলতাফ হোসাইন রানা
হাঁটি হাঁটি পা পা করে কৈশোরের অনেকগুলো দিন পার করে জীবনের উচ্ছল উজ্জ্বল সময়ে পা রাখে নাবিল। জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত যেন এখন নাবিলের কাছে চঞ্চল ঝর্ণাধারা। ভীষণ ডানপিটে ছেলে। সারাক্ষণ চাদশী তরুণ সংঘ আর সঙ্ঘের সদস্যদের নিয়ে যেন তার কাজ। খেলাধুলায় মেতে থাকলেও দোষ ছিল না। তা না করে কাঠবিড়ালির মতো কার গাছে পেয়ারা বড় হলো, কার কাঁঠাল পাকলো, কোন বাগানের আম পেকে টসটস করছে, কোন বাগানে লিচু কেমন ধরেছে সব দিকে তার নজর বেশি।
স্কুল ফাঁকি দেওয়া তার রুটিন মাফিক কাজ। টিফিনের সময় দলবেঁধে চলে যেত চাদশীর বিলে। গরমকালে চাদশী গ্রামটি ঘিরে থাকে জলাভূমিতে। বিল আর কিছুটা ঝোপঝাড়। দলবেঁধে চলতো সাঁতারের পাল্লা। বিলে কারো নৌকা বাঁধা থাকলে আর রক্ষা নেই। কার নৌকা তা আর জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন নেই। বেয়ে নিয়ে যেত বিলের মাঝে। নৌকা ধীরে ধীরে কাচের মতো স্বচ্ছ জল কেটে চলত। মাঝে মাঝে সালুক ধরার পাল্লায় কয়েকজন লাফিয়ে পড়তো নৌকার গলুই থেকে ঝপাত! ঝপাত! ঘোলা পানির ঢেউয়ে হঠাৎ কখনো-সখনো শাপলা-শালুকগুলো পানকৌড়ির মতো ডুব দিত। আবার জেগে উঠতো। শাপলা-শালুকগুলো যেন ওদের সাথে খেলায় মেতেছে। বিলের ধারে ধবল বকের সোনালি ডানার ঝাপটানি ওদের মাতিয়ে তুলতো।
সূর্য মাথার ওপর ঢলে পড়ার আগেই আবার যথাস্থানে ফিরে আসতো ওরা। বাড়ি ফেরার পথে চলতে কারো পুকুরে ঢিল মারার খেলা। খেজুর গাছের ঝুলন্ত রসের হাঁড়ি তাক করে ঢিল ছোড়া। মনটা অনন্ত পাখির মতো উড়তো। কেউ কেউ দু-একটা লাইন ধরে গান গাইতো। বাকিরা সবাই তার সাথে সুর মেলাতো। মা বাবা সব সময় আফসোস করেন আমাদের ছেলে কী যে হবে।
সারাদিন পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে পড়ালেখা একদম শিকেয় উঠেছে। তার ওপর আবার দু’চারটে নালিশ তো লেগে আছেই। আজ এর গাছের এটা নেই, কাল ওর সাথে ঝগড়া মারামারি। অন্যের জিনিস নষ্ট করা। এসব ঝামেলা কে পোহাবে? এইতো আজ নাকি আলভীদের পেয়ারা বাগানে ঢুকেছিলো। খাবিতো খা, আবার কি না দলবল নিয়ে আলভীকেই শাসানো? ভাগ্যিস গাঁয়ে নাবিলের বাবার বেশ নাম ডাক রয়েছে। নাবিলের দাদা এক সময় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলেন। তাতেই সাত খুন মাফ।
বিকেলে নাবিলের নানার বাড়ি দাওয়াত। তার মামাতো ভাই ইয়াছিনের জন্মদিন। রাজিহার ইউনিয়ন, অনেক দূর। ফিরতে রাত হবে। আজ আর ফিরবেন না বলে নাবিলের আম্মা ভেবে নিয়েছেন। ছেলেকে তৈরি হওয়ার জন্য আদর মাখা সুরে ডাক দিলেন নাবিল, না-বি-ল।
তাড়াতাড়ি কাপড় পরে তৈরি হও।
: আমার যাওয়া হবে না তোমরা যাও আম্মা। পাশের ঘর থেকে নাবিল অন্যমনস্কভাবে মায়ের কথার উত্তর দেয়।
: সে কি! তুমি না গেলে আমরা কী করে যাই?
: বারে! আমিতো প্রায়ই নানুবাড়ি যাই। আগামী রোববার আমাদের ফুটবল ম্যাচ। রোজ বিকেলে প্র্যাকটিস করতে হয়। ক্যাপ্টেন বলেছে এ সময় মিস করা চলবে না। একদম না।
নাবিলের আম্মু এবার নাবিলের কাছে এসে আদর করে বললেন-
একদিন মাঠে না গেলে কিছু হবে না, চলো লক্ষ্মীটি, দুষ্টুমি করে না।
: ইস! আম্মু আর মাত্র দু দিন বাকি।
আজ মাঠে না গেলে ফাইনালে আমাকে ওরা খেলতে নেবে না। নাবিল বরাবরই অভিমানী। একদম কথা শোনে না। আজ তার ভিন্ন রূপ দেখা গেলো না। মায়ের কথাকে উপেক্ষা করে মাঠের দিকে পা বাড়ায় নাবিল। মাঠের চারদিকে লোকে লোকারণ্য। আজ চাদশী তরুণ সংঘ বনাম রাজিহার তরুণ সংঘের মধ্যে ফাইনাল খেলা। মাঠের একদিকে সাজানো প্যান্ডেল সমেত কিছু চেয়ার। প্রধান অতিথির আসন অলংকৃত করেছেন চাদশী ঈশ্বরচন্দ্র উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সাহেব। রেফারির বাঁশির সাথে সাথে খেলা শুরু হয়ে গেল। খেলা চলছে। নাবিল ভালোই খেলছিল। হৈচৈ, হাততালি পড়ছে চারদিক থেকে। হঠাৎ বলটা জোরে শট করতে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে যায়। উঃ শব্দে চিৎকার করে নাবিল। হাতে ভীষণ ব্যথা পায়। তাড়াতাড়ি কয়েকজন ছুটে আসে ওকে ধরতে। হাঁটু কেটে রক্ত ঝরতে থাকে। ফাহিম রুমাল বের করে রক্ত বন্ধ করার চেষ্টা চালায়। রক্ত পড়া বন্ধ হলেও নাবিল ভীষণ ব্যথা অনুভব করে।
কয়েকজন ধরাধরি করে মাঠের বাইরে নিয়ে গেলো নাবিলকে।
: বাসার কাউকে কিছু বলবি না। দেখবি এমনিতেই সব ঠিক হয়ে গেছে। ফাহিম নাবিলকে সান্ত¡না দেয়।
কিন্তু পরক্ষণেই নাবিল উঃহ-হ শব্দে চিৎকার করে ওঠে। হাতের দিকে লক্ষ রাখতে দেখে হাত আস্তে আস্তে ফুলে যাচ্ছে। ব্যথা বাড়তে থাকে। অবশেষে আর নাবিলের খেলা হলো না। বন্ধুরা মিলে নাবিলকে বাড়ি পৌঁছে দিল। শেষ পর্যন্ত নাবিল এ খেলায় খেলতে না পারলেও জয়ের মালা কিন্তু তারাই ছিনিয়ে নিয়েছিল। এক গোলে চাদশী তরুণ সংঘ জয়ী হয়েছিল।
সকালের সোনালি রোদে চারদিক চিকচিক করে ওঠে। গাছের পাতাগুলো যেন একটু নড়েচড়ে অলসতা দূর করে। মিষ্টি বাতাস বইছে চারদিকে। বুক ভরে তাজা শিশির ভেজা বাতাস নেয় নাবিল। পড়ার ঘরের বারান্দায় একটা চেয়ার পেতে আনমনে বসে থাকে। একটা পাখি উড়ে এসে বসে উঠোনের পুরনো শজনে গাছের ডালে। তার উল্লাস ধ্বনি নাবিলের মুগ্ধ দৃষ্টি মাটি থেকে গাছের দিকে কেড়ে নেয়। রোদের তাপ বেড়ে চলে। নাবিল চেয়ার ছেড়ে পড়ার ঘরের খাটে গিয়ে বসে, আর ভাবে কেন যে কাল খেলতে গিয়েছিলাম। মা-তো কোনদিন খেলতে নিষেধ করেননি। শুধু সেদিনই আমাকে মা বারণ করেছিলেন। মায়ের কথা না শোনাতে এখন এত কষ্ট পেতে হচ্ছে। মা নিশ্চয় মনে কষ্ট পেয়েছেন। আমার হাত যদি ভালো না হয় তাহলে আর কোনদিন হয়তো আমি খেলতে পারব না। নৌকা বাইতে পারবো না চাদশীর বিলে। ঢিল মারার খেলাও আর হবে না। এসব ভাবতে ভাবতে নাবিলের দুচোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ে।
নাবিলের জলে ভেজা চোখ দুটো স্থির হয় ঘরের কোণে। সরু গর্ত থেকে একটা ছোট্ট ইঁদুর বেরিয়ে আসে। ছানাটি ঘরের এদিক-ওদিক ছোটাছুটি করে কী যেন খুঁজছিল। গ্রামে এ সময় সবার ঘরে ঘরে নতুন ধান উঠে। নতুন ধানের মেঠো মেঠো গন্ধ চারদিক মাতিয়ে তোলে। ঘরের মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ধান পড়েছিল। ইঁদুর ছানাটি এক দৌড়ে আবার গর্তে চলে গেল। নাবিল চুপচাপ এক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে গর্তটার দিকে। কিছুক্ষণ পর ছানাটি আবার বেরিয়ে এলো। এবার একা নয়, সঙ্গে এক বড় ইঁদুর। বড় ইঁদুরটা হলো ছানাটির মা। ছানাটি তার মাকে ধানগুলোর কথা বললো। নাক দিয়ে শুঁকে বড় ইঁদুরটা আস্তে আস্তে ধানগুলোর কাছে গেল। মা ইঁদুরটা খুশিতে কয়েকটি ডাক দেয় চিক চিক চিক। নাবিল বুঝলো, মা ইঁদুরটা অন্ধ, চোখে দেখতে পায় না। ছানাটি সবসময় তার মাকে পথ চলতে সাহায্য করে, মায়ের জন্য খাবার খুঁজতে বের হয়।
বাইরে তখন কার যেন পায়ের শব্দ শোনা গেল। বাচ্ছা ছানাটি তার মাকে চি চি চিকচিক করে ডাকছে। বোঝা গেল ছানাটি তার মাকে বলছে মা, মা চলো এক্ষুনি আমরা পালাই। কে যেনো এদিকে আমাদের ধরতে আসছে। এই বলে ছানা ইঁদুরটি তাড়াতাড়ি খুব সাবধানে পথ দেখিয়ে মাকে গর্তে নিয়ে গেল।
নাবিল পুরো ঘটনা ভালো করে লক্ষ করলো। এবার সে বাবা-মায়ের সাথে নিজের ব্যবহারের জন্য খু-উ-ব লজ্জা পেল।
নাবিল মনে মনে ভাবল একটা বাচ্চা ইঁদুর তার মায়ের জন্য এত যত্ন নেয়, এত ভালোবাসে। আর আমি এত অবাধ্য ছেলে। ভাবতে ভাবতে নাবিল হু হু করে কেঁদে ওঠে। বাম হাত দিয়ে চোখের পানি মুছতে মুছতে নাবিল মনে মনে ভাবে আমিও ইঁদুর ছানার মতো মা বাবাকে সেবা করবো, আদর যত্ন করব, কথা শুনবো, পড়বো মন দিয়ে।
নাবিল হাতের দিকে তাকায়। হাতের ব্যথা কিছুটা থাকলেও তা আর ফোলা দেখাচ্ছে না। বাইরে তখন সোনালি রোদ হেসে উঠেছে। সত্যি নাবিলের ভীষণ ভালো লাগছে। মনে হচ্ছে বুকের ওপর থেকে বিশাল একটা পাথর সরে গেল।