বিজয় এবং ভালোবাসা। দুটো শব্দই খুব প্রিয়। সকলের কাছেই প্রিয়। তোমার কাছে, আমার কাছে। আব্বু-আম্মু সবার কাছে। দোলনায় শুয়ে থাকা ছোট্ট গুলুমুলু বাবুটাও পছন্দ করে। পছন্দ করে ফোকলা দাদুও। বাবুটাকে লাল রঙের কোন খেলনা দাও, গপ করে ধরে নেবে। ওকে ভালোবাসা দাও, মিষ্টিমুখে ফুলের মতো মজা করে হাসবে। ওর পছন্দের জিনিসটা দিয়ে দাও, খুশিতে টগবগ করে উঠবে। কিন্তু যদি চোখ রাঙাও, দেখবে ঠোঁট দুটো ফুলিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠবে। হাতের খেলনাটা কেড়ে নাও, চিৎকার করে উঠবে।
এটা তোমার বেলাতেও। খেলতে বারণ করলেই মনটা খারাপ হয়ে যায়। মোবাইলের গেম খেলা বন্ধ করতে বললেও মেজাজ গরম। তোমার জামা দরকার। বাবা কিনে না দিলে কষ্ট লাগে। লাগে না? মনে মনে কোন কিছু চাইতেই যদি বাবা সেটা নিয়ে আসেন তখন ভীষণ মজা হয়। হয় না? আব্বু-আম্মুও তোমার ভালো কাজে খুশি হন। যদি সময়মতো লিখো পড়ো, ভালোভাবে চলো, নামাজ পড়ো, সুন্দর করে কুরআন পড়ো, সবার সাথে ভালো আচরণ করো তাহলে আব্বু আম্মু পাড়া-পড়শি সবাই খুশি হয়। হয় না? বাগড়া দিলেই মেজাজ হট। চোখ রাঙানি কিংবা ফটাশ করে পিঠের ওপর একটা। একটা কী? আদর?
এটাই পৃথিবীর নিয়ম। সবাই সবার অধিকার নিয়ে চলতে চায়। শুধু অধিকার নয়, একটু বেশিই চায়। মানুষের সৃষ্টিগত বৈশিষ্ট্য এটা। স্বাধীনতা চায়। বিজয় চায়। ভালোবাসা চায়। এ চাওয়াগুলো যদি ন্যায়সঙ্গত হয় তবে তাকে দিতেই হবে। এ সব তার অধিকার। এ অধিকার পরিবারে, সমাজে, দেশে এবং গোটা পৃথিবীতে। যখনই কেউ এ অধিকার থেকে বঞ্চিত করে তখনই শুরু হয় আন্দোলন সংগ্রাম।
আমরা বাংলাদেশী। বাংলাদেশ আমাদের ভালোবাসা। বাংলাদেশ আমাদের অহংকার। আমাদের স্বপ্নজগৎ। আমরা যুদ্ধ করে স্বাধীনতা এনেছি। বিজয়ী হয়েছি। সেই বিজয়ের মাটিতেই আমরা জন্মেছি। এটাই আমাদের স্বাধীন সার্বভৌম স্বপ্নের দেশ। লাল-সবুজের পতাকা আমাদের গর্ব। পতাকার দিকে তাকালেই আমরা শক্তি পাই। আলাদা একটা অনুভূতি জেগে ওঠে। হৃদয়ের আকাশে ভেসে ওঠে মহান মুক্তিযুদ্ধের গল্প। সাহসী বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ত্যাগের কাহিনী। মনের ভেতরে লাফিয়ে ওঠে ১৬ ডিসেম্বরের বিজয় উল্লাস। ইস! যদি বিজয়ের সেই দিনে আমরা বড়দের মতো থাকতাম! তোমরাও থাকতে! খুব মজা হতো তাই না?
যুদ্ধটা কিন্তু আমাদের দীর্ঘদিনের। এক সময় দেশটা ব্রিটিশরা দখল করেছিল। ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে। ওরা আমাদের সাথে প্রতারণা করে দেশটা কেড়ে নিয়েছিল। কেড়ে নিয়েছিল আমাদের স্বাধীনতা, আমাদের ভালোবাসা। আমাদের লেখাপড়ার অধিকার কেড়ে নিয়েছিল ওরা। কথায় কথায় কষ্ট দিতো। ওদের আদেশ মতো জমিতে ফসল ফলাতে হতো। নীল চাষ করতে বাধ্য করতো। ধনী এবং অভিজাত অবস্থা থেকে আমাদেরকে ফকির বানিয়ে ফেলেছিল। ধর্ম-কর্ম করতেও নানান রকম বাধা-বিপত্তি। সব কিছুতেই খাজনা। এমনকি নামাজ পড়তে, দাড়ি রাখতেও ট্যাক্স দিতে হতো। কী অত্যাচার রে বাবা!
আমরাও বসে থাকিনি। বিজয়ের জন্য সংগ্রাম করেছি। এ সবের বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছিলেন মীর নিসার আলী তিতুমীর। বাঁশের কেল্লা গড়ে লড়াই করেছেন। শহীদ হয়েছেন তিনি। হাজী শরীয়তুল্লাহ ফরায়েজী, নবাব আবদুল লতিফ, হাজী মুহাম্মদ মহসীন, নবাব স্যার সলিমুল্লাহ, শের ই বাংলা এ কে ফজলুল হক, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর মতো অনেকেই বিজয়ের জন্য দিনরাত কাজ করেছেন। অবশেষে ব্রিটিশ তাড়িয়ে ভারতবর্ষে দুটো নতুন দেশ হলো ১৯৪৭ সালে। একটির নাম পাকিস্তান আরেকটি ভারত। বাংলাদেশের মানুষেরা আমরা স্বাধীন পাকিস্তানের নাগরিক হলাম।
ভারতবর্ষে দুটি ধর্মের লোক বেশি। হিন্দু আর মুসলমান। ধর্মীয়ভাবে দুটি জাতি। দেশের যে অংশে মুসলমান বেশি সে অংশ নিয়ে পাকিস্তান হয়েছিল। যদিও ভাগ-বাটোয়ারা করতে অনেক নেতাই চালাকি করেছে আমাদের সাথে, তবুও আমরা মেনে নিয়েছিলাম। মুসলমান মুসলমান ভাই ভাই। সবাই খুশি হয়েছিলাম। একশো নব্বই বছর পরে আবারো একটা স্বাধীন দেশ পেলাম। আমাদের আর কোনো কষ্ট থাকবে না। কথায় কথায় কষ্ট দেবে না। আমাদের শোষণ করবে না। আমরা স্বাধীনভাবে চলতে পারবো। স্বাধীনভাবে কথা বলতে পারবো। আমাদের দেশের শিল্পীরা স্বাধীন পাকিস্তানকে নিয়ে গান গাইলেন। কবিরা কবিতা লিখলেন। নেতাদেরকে অভিনন্দন জানালেন। আহা কী আনন্দ আকাশে বাতাসে!
শুরুটা মন্দ ছিল না। শিক্ষা, সংস্কৃতি, উন্নয়ন সব কিছুতেই আশা জাগিয়েছিল পাকিস্তান। নিরাপত্তাও ছিল মানুষের। বড় বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানও গড়ে উঠেছিল বেশ কিছু। রাজশাহী, চট্টগ্রাম, জাহাঙ্গীরনগরসহ বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয় এবং বড় বড় কলেজও প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে রাজশাহী, খুলনায় এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে চট্টগ্রামে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ গড়ে ওঠে। এখন এগুলো রুয়েট, কুয়েট এবং চুয়েট নামে ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটি। কলকারখানাও কম হয়নি। কৃষি, শিল্প, ব্যবসায়-বাণিজ্য সবক্ষেত্রেই উন্নয়ন ছিল চোখে পড়ার মতো। কিন্তু পাকিস্তানি শাসকরা ছিল একদেশদর্শী। ওরা গণতন্ত্র দিতে পারেনি। দিতে পারেনি নাগরিক হিসেবে পশ্চিম পাকিস্তানিদের সাথে আমাদের সমান অধিকার। সরকারি দফতরের বড় বড় পদগুলো পশ্চিম পাকিস্তানের লোকেরা দখল করে রাখতো বেশির ভাগ।
সবচেয়ে খারাপ কাজটি করেছিল আমাদের মুখের ভাষা নিয়ে। গোটা পাকিস্তান মিলে বাংলা ভাষার মানুষ অনেক বেশি। তবুও তারা বাংলাকে বাদ দিয়ে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করতে চাইলো। আমরা কি আর তা মানি? গর্জে উঠলাম। এটা অন্যায়। এ অন্যায় আমরা মানি না, মানবো না। রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, মানতে হবে। গর্জে উঠলেন আমাদের দেশের বুদ্ধিজীবীরা। ভাষার লড়াই সফল করতে গঠিত হলো তমুদ্দন মজলিশসহ বিভিন্ন সংগঠন। বাংলাভাষার পক্ষে কলম ধরলেন আমাদের কবি সাহিত্যিক লেখক সাংবাদিক সবাই। তবুও বুঝতে পারলো না ওরা। অবশেষে রাজপথে সংগ্রাম শুরু হলো। ওরা জারি করলো ১৪৪ ধারা। সমস্ত বাধা পেরিয়ে রাস্তায় নেমে এলো ছাত্র-যুবক, সাধারণ মানুষ। মিছিলে গুলি চালিয়েও বন্ধ করতে পারলো না ভাষার আন্দোলন। রফিক উদ্দীন আহমদ, আবদুল জব্বার, আবুল বরকত, আবদুস সালাম, শফিউর রহমান, আবদুল আউয়াল, মুহাম্মদ অহিউল্লাহ জীবন দিয়ে প্রমাণ করলেন আমরা ভাষার অধিকার ছাড়বো না। অবশেষে আমরাই বিজয়ী হয়েছি। তাইতো ২১ ফেব্রুয়ারি এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে আমাদের এ সংগ্রামের ইতিহাস স্মরণ করা হয়। এটাও আমাদের জন্য গর্বের বিষয়।
অধিকারের ব্যাপারে আমরাও খুব সচেতন ছিলাম। শের ই বাংলা একে ফজলুল হক, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ আমাদের জাতীয় নেতৃবৃন্দ রাজনৈতিক অঙ্গনে অধিকার আদায়ে সোচ্চার ছিলেন। কাজী মোতাহার হোসেন, আবুল মনসুর আহমদ, মোহাম্মদ আবুল কাসেম, দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ, আবুল হাশিম, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, শাহেদ আলী, নূরুল হক ভূঁইয়া, ফররুখ আহমদ, আবদুল গফুরসহ অনেকেই বুদ্ধিবৃত্তিক অধিকার আদায়ে সোচ্চার ছিলেন। ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন এবং ১৯৬৬ সালের ৬ দফা আন্দোলন আমাদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে অনন্য ভূমিকা পালন করে। ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান আমাদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামকে স্বাধীনতা সংগ্রামে রূপান্তর ঘটায়। ছাত্রনেতা আসাদুজ্জামান আসাদ এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. সৈয়দ মোহাম্মদ শামসুজ্জোহার শাহাদাত গণঅভ্যুত্থান থেকে স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতীক হিসেবে দাঁড়িয়ে যায়।
১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে নিরঙ্কুশ বিজয় লাভ করে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। এ বিজয়ে আমরা ক্ষমতার অধিকারী হয়েও বঞ্চিত হয়েছি। শুরু হলো অসহযোগ আন্দোলন। থেমে থাকেনি ছাত্র আন্দোলনও। ১৯৭১ সালের ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় ছাত্রসমাবেশ। ডাকসুর ভিপি ছিলেন আ স ম আবদুর রব। পাকিস্তানি শাসকের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে তিনি সেখানে উড়িয়ে দিয়েছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের লাল সবুজের পতাকা।
স্বাধীন পতাকার পতপত শব্দে সারাদেশের মানুষ স্বাধীনতার প্রত্যাশায় বুক বাঁধে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের অগ্নিঝরা ভাষণে অসহযোগ আন্দোলন প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করে। ভেতরে ভেতরে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি। ২৫ মার্চ রাতে গ্রেফতার হন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি পাকিস্তানি শাসকদের লৌহ কারাগারে বন্দি। জেনারেল মুহাম্মদ আতাউল গণি ওসমানীর নেতৃত্বে গড়ে ওঠে মুক্তিযুদ্ধের ১১টি সেক্টর। প্রত্যেকটি সেক্টরে যোগ্য নেতৃত্বে এগিয়ে চলে মুক্তি সংগ্রাম। বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর মতো অনেক সাহসী প্রাণের গর্জনে কেঁপে ওঠে পাকবাহিনীর অন্তর। জেলে চাষি মুটে মাঝি, অভিজাত শ্রেণির মানুষেরাও নেমে পড়েন মুক্তিযুদ্ধে। প্রতিবেশী ভারতও আমাদের সাহায্য করে এ যুদ্ধে। হাজারো প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও ১৬ ডিসেম্বর অর্জিত হয় মুক্তির লাল সূর্য। স্বপ্নের স্বাধীনতা। আমাদের প্রাণের চেয়ে প্রিয় লাল সবুজের পতাকা।
বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের হৃদয় ছিল মুক্তিযুদ্ধের সাথে। খেটে খাওয়া মানুষগুলোই সোনালি অধ্যায়ের নির্মাতা। আমাদের পতাকায় তাঁদের ঘাম লেগে আছে। তারাই মহান মুক্তিযুদ্ধের আত্মতাগী সৈনিক। তাঁরা কখনো রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার কথা চিন্তা করেননি। চেয়েছিলেন জীবনের নিরাপত্তা। ন্যায্য পারিশ্রমিক। স্বাধীনভাবে কাজ করার অধিকার। আমরা আমাদের মতো করে বাঁচতে চেয়েছি। আমাদের উৎপাদিত পণ্য আমরা ভোগ করবো। আমাদের দেশ আমাদের মতো করে চালাবো। আমাদের বিশ্বাসকে বুকে ধরে থাকবো। সবুজ বাংলার চিরায়ত সংস্কৃতি আমরা লালন করবো। বাংলা ভাষাকে সর্বত্র ছড়িয়ে দেবো।
বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তী সামনে। পঞ্চাশ বছর মানে অনেক কিছু। ঘুরে দাঁড়িয়েছে মালয়েশিয়া। আমরা কেন পারবো না? আমাদের মানসিকতার পরিবর্তন দরকার। লেখাপড়ায় আরো মনোযোগী হলে তোমরাই পারবে। মোবাইলে নয়, পড়ার টেবিলে সময় দিতে হবে। সাংস্কৃতিক স্বাধীনতার কথা ভাবো। ডোরেমন, মটুপাতলু, শিবাসহ বিভিন্ন কার্টুন তোমরা দেখে থাকো। এগুলো কি আমাদের দেশের সংস্কৃতি? কেউ কেউ হিন্দি মুভি দেখে থাকো। হিন্দি কি আমাদের ভাষা? হিন্দি মুভি হিন্দি গান কি আমাদের বিশ্বাস এবং মূল্যবোধ শিখায়? আমাদের বাসা-বাড়িতে মা বোনেরা হিন্দি সিরিয়াল দেখে অনেকে। এগুলো কি আমাদের দেশপ্রেম শেখায়? নৈতিক চরিত্র ভালো করার শিক্ষা দেয়? এগুলো কি বাংলাদেশের মানুষের সংস্কৃতি? যদি তাই না হয় তাহলে বিজয়কে বুকে ধারণ করে আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আমাদের নৈতিক চরিত্র নষ্ট করে- এমন খারাপ জিনিস থেকে আমরা দূরে থাকবো। আমাদের বাংলাদেশটা গড়বো আমাদের বিশ্বাস এবং মূল্যবোধের আলোকে। পারবো তো? অবশ্যই পারবো। আমরা করবো জয় একদিন।