ÒAnd He taught Adam the nature of all things; then He placed them before the angels, and said:—Bow down to Adam;” (Sura Baqarah-31-34 )
মিল্লাতে ইব্রাহিমের সকলের সাধারণ বিশ্বাস আদম-হাওয়া বা এডাম-ইভের মাধ্যমেই পৃথিবীতে মানব সভ্যতার সূচনা। সৃষ্টির শুভ-সূচনাতেই পরম প্রভু শিক্ষক হয়ে প্রথম মানব আদমকে যাবতীয় নাম শিক্ষা দিয়ে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সূত্রপাত ঘটালেন। এ শিক্ষায় সর্বোচ্চ সফলতার কারণে আদম-হাওয়া আ. এবং সমগ্র মানবজাতি হলো আশরাফুল মাখলুকাত বা সৃষ্টির শ্রেষ্ঠজীব।
‘ইকরা’ (পড়)! মহাবিশ্বের মহান স্রষ্টা তাঁর সর্বশ্রেষ্ঠ ফেরেশতা জিবরাইল আমিনের মাধ্যমে বিশ্বের সর্বোত্তম মানুষ হযরত মুহাম্মাদ (সা)-এর কাছে সর্বপ্রথম এই শব্দের মাধ্যমেই মানবতার মুক্তির যুগান্তকারী গ্রন্থের শুভ উদ্বোধন করেন।
৬১০ খ্রিস্টাব্দের মাহে রমজানের কোনো এক সুন্দর দিনে কাবা থেকে ৩ কিলোমিটার দূরে মরুময় আরবের জাবালে নুর বা আলোর পাহাড়ের অন্ধকার পাথুরে হেরাগুহায় এটি অবতীর্ণ হয়। ৯ শ’ ফিট উচ্চতায় এ গুহায় পৌঁছতে প্রায় ১৭৫০ স্টেপে একজন তাগড়া মানুষের ৪০-৪৫ মিনিট সময় লাগবে। যখন এই শব্দটিসহ কুরআনের পাঁচটি আয়াত নাজিল হয় ঠিক তখনই শুরু হয়ে যায় মহানবীর (সা.) মহান শিক্ষা আন্দোলন।
‘পড়া লেখা করে যে গাড়ি ঘোড়া চড়ে সে’। ছোটবেলায় এ প্রবাদটি শুনে শুনেই আমরা বড় হয়েছি। এরকম কী একটা গানও তখন কানে কানে বাজতো। মনে হয় আমাদের গুরুজনেরা এটি বলতেন, যাতে করে আমাদের অবচেতন হৃদয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠার একটি আবেগ তৈরি হয়।
আর সেটি তারা চাইতেন সত্যিকার জ্ঞান, দক্ষতা এবং অবশ্যই সততার মাধ্যমে। পরবর্তীকালে যখন সক্রেটিস থেকে আল্লামা ইকবাল, রবি ঠাকুর ও মন্তেসরি পর্যন্ত প্রায় ৪০ জন মনীষীর শিক্ষা-সংজ্ঞা নিয়ে তুলনামূলক বিশ্লেষণ করার সুযোগ পাই তখনও সেই তিনটি বিষয়; জ্ঞান, দক্ষতা এবং সততাকেই খুঁজে পেয়েছি। কিন্তু এখনকার চিত্রটা কেমন?
যেমন, বলা যায় খুব সাম্প্রতিক উদাহরণ, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন ডিজি হেলথের ড্রাইভার আব্দুল মালেক আর অষ্টম শ্রেণি পাস ড্রাইভার নেই বরং সে-ই যেন ডিজি হেলথের মালিক বনে গেছে!
এ কথাটি লিখতে আমার খুব কষ্ট হয়েছে কিন্তু কী করবো বলো? যখন জাতীয় পত্রিকাগুলো লিখে একজন তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী হয়েও সে তার ২৭ জন নিকটাত্মীয়কে চাকরি দিয়েছে। সরকারি ড্রাইভার সংস্থার সে প্রেসিডেন্ট হিসেবে বহাল আছে ২৫ বৎসর যাবৎ। ঢাকাতে ১২ কাঠা করে জায়গার ওপর তার ২টি ৭ তলা বিল্ডিং যাতে আছে ২৪টি ফ্ল্যাট। ১৫ কাঠা জায়গার ওপর ডেইরি ফার্ম আছে তুরাগে। ধানমন্ডি হাতিরপুলে ৪ কাঠা জায়গায় ১০তলা নির্মাণাধীন বিল্ডিং। এবং বিভিন্ন জায়গায় আরো নামে-বেনামে ২৪টি ফ্ল্যাট। নানা ব্যাংকে ১০০ কোটি টাকা জমা আছে। পূর্ববর্তী ২ ডিজির সাহায্যে যেন সেই ছিলছায়া ডিজি।
তখনতো মনে হয় রূপকথা আলিফ-লায়লার সেই ভয়ঙ্কর দৈত্য তার যাদুকরী চেরাগ হাতে দাঁড়িয়ে আছে ড্রাইভার আব্দুল মালেকের পদপ্রান্তে একান্ত দাস হয়ে। তবে চুনোপুঁটি আব্দুল মালেকের লালনকারী বড় বড় ডিগ্রিওয়ালারা কিন্তু পরেছেন ভ্যানিশ জ্যাকেট যার ফলে তাদের কখনো দেখা যাচ্ছে না। নিশ্চয়ই এই ভ্যানিশ জ্যাকেট আমার দেশের এক শ্রেষ্ঠ আবিষ্কার। জানি না কেন এর পেটেন্ট দাবি করা হচ্ছে না?
যাক তোমাদের সামনে এ আলোচনা আর দরকার নেই। তবে স্বীকার করতেই হবে আব্দুল মালেকরা অষ্টম শ্রেণি পাস হলেও তাদের অনেক দক্ষতা আছে। নইলে নিজে দানকানা মাছ হয়েও কী করে দানবীয় নীল তিমির মতো বিশাল বপুওয়ালা ডিজি ও ঊর্ধ্বতনদের নাকে দড়ি দিয়ে ছাগলের মতো ঘুরায়। হ্যাঁ এই সব ডিজি, পাজিদের অনেক ডিগ্রি থাকলেও দক্ষতার ঘাটতি আছে আর সবচাইতে বড় সমস্যা সততার। তাদের ক্ষুধার কাছে সাহারা মরুভূমিও নস্যি। কুচকুচে গলিজময় বুড়িগঙ্গাও তাদের চেয়ে পূত-পবিত্র।
সাময়িক বিত্ত-বৈভবে এরা হাবুডুবু খেলেও অসহায়-গরিব জনগণের আমানত হরণের অপরাধে দুনিয়াতেও পাবে তারা ধিক্কার আর আখেরাতে তাদেরকে মধুর আলিঙ্গন করবে লেলিহান আগুনের সমুদ্র।
ও ভালো কথা, তোমরা আবার ভেবো না আমি কম ডিগ্রিধারীদের বোধ হয় হেয় করছি; বিষয়টি কিন্তু এরকম নয়। তোমরা নিশ্চয়ই জানো বাাংলাদেশের জাতীয় কবি নজরুলওতো এন্ট্রেন্স বা ম্যাট্রিক বা বর্তমানের এসএসসি পাস করেননি, কিন্তু তিনি ছিলেন স্বশিক্ষিত বাংলা, সংস্কৃত, উর্দু, ফারসি, আরবি ও ইংরেজি ভাষার সমন্বয়ে মাত্র ২৩ বছরের প্রায় ৪,০০০ এর মতো শুধু গান ও কবিতা রচনা করেন ।
ওদিকে টমাস আলভা এডিসন মাত্র তিন মাস স্কুলে গিয়েছিলেন, পরবর্তীতে সাবেক স্কুল শিক্ষিকা তার মা তাকে লেখা-পড়া ও গণিতের শিক্ষা দিয়েছেন আর সেই জ্ঞান দিয়েই ৩০ বছর বয়সে প্রথম আবিষ্কার এবং পরবর্তী ৫৫ বছরে গড়ে প্রতি মাসে ২টি করে সর্বমোট ১০৯৩টি আইটেম আবিষ্কার করেন এবং পেটেন্ট গ্রহণ করেন। এবং পৃথিবীর প্রথম শিল্প-বিজ্ঞান গবেষণা সেন্টার তৈরি করেন।
আবার যদি আব্রাহাম লিঙ্কনকে নিয়ে আলোচনা করি তবে কেমন হয়? তিনি অনিয়মিতভাবে স্কুলে পড়েছেন সর্বোচ্চ ১২ মাস। অথচ তিনি হচ্ছেন আমেরিকার প্রায় ২৫০ বছরের ইতিহাসের ৪৫ জন প্রেসিডেন্টের ওপর করা প্রায় ২০০টি জরিপের ভেতর সর্বোচ্চ স্কোর পাওয়া সবচেয়ে সফল ও জনপ্রিয় প্রেসিডেন্ট। তার ওপর এ পর্যন্ত প্রায় ১৬,০০০ বই লেখা হয়েছে। ভাবা যায় আমেরিকায় তার প্রভাব?
আর এই সব কিছুর পিছনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান হচ্ছে শিক্ষার; যে শিক্ষায় নিহিত রয়েছে- কমপক্ষে তিনটি বিষয় জ্ঞান, দক্ষতা এবং সততা। আর জ্ঞানার্জনের চাবি হচ্ছে বই পড়া, পড়া এবং পড়া।
ষোড়শ শতকের ফ্্রান্সের বিখ্যাত দার্শনিক ও বৈজ্ঞানিক রেনে ডেসকার্টেস (Rene Descartes) একটি চমৎকার কথা বলেছেন; The reading of all good books is like a conversation with the finest minds of past centuries.
তাই, আমরা শুধু বই পড়ি না অতীতের সফল ও ব্যর্থ যারা তাদের কথা শুনি তাদের জীবন জানি এমনকি তাদের সাথে কথাও বলি। এবং সেই অভিজ্ঞতার আলোকসম্পাতে নিজেকে ঋদ্ধ করি।
গত শতাব্দীর মার্কিন ঔপন্যাসিক যিনি একাধারে নোবেল এবং পুলিৎজার পুরস্কার পেয়েছিলেন তিনি হচ্ছেন, দ্য ওল্ডম্যান অ্যান্ড দ্য সি এর সেই বিখ্যাত লেখক আর্নেস্ট হেমিংওয়ে (Ernest Hemingway) তিনি একটি চমৎকার কথা বলেছেন, ‘বইয়ের চাইতে বিশ্বস্ত বন্ধু আর হতে পারে না।’ তাই আমরা সুহৃদ-সুজন বন্ধুদের মতোই বইয়ের কাছ থেকেও নিতে পারি পরামর্শ, প্রেরণা, সান্ত¡না ও সহযোগিতা।
বিখ্যাত মার্কিন সাংবাদিক মার্গারেট ফুলার (Margaret Fuller) বলেছেন খুবই মৌলিক একটি কথা; Today a reader, tomorrow a leader.
এর প্রমাণ আমরা দিতে পারি হাতে নাতে, যেমন;
আমেরিকার সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ প্রেসিডেন্ট যে বই দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন সেটি হচ্ছে ; Benjamin Franklin’s Autobiography
মহাত্মা গান্ধী প্রভাবিত হয়েছিলেন Unto This Last by John Ruskin, এবং লিউ টলস্টয়ের বই The Kingdom of God is Within You. আর লিউ টলস্টয় প্রভাবিত হয়েছিলেন ভিক্টোর হুগোর Les Misérables. আর আব্দুল্লাহ মামুন আল সোহরাওয়ার্দী প্রণীত Sayings of Muhammad বই দুটি দ্বারা। গত শতাব্দীর শ্রেষ্ঠতম বিজ্ঞানী আইনস্টাইন তার জীবনের সেরা ৫টি বইয়ের তালিকা করেছিলেন আর তাতে সর্বাগ্রে স্থান দিয়েছেন ৫০ খণ্ডের- Johann von Goethe’s oeuvre.
সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা প্রণীত সেরা ১৯টি বইয়ে তালিকায় সবার ওপরে আছে The age of surveillance capitalism.
যারা বিশ্বভ্রমণ করতে চান অথচ জীবন-সংসারে সময় নেই কিংবা তহবিলে টাকা নেই তারা জানবেন, বই পড়ে ‘ভিসা পাসপোর্ট ছাড়া বিশ্ব ভ্রমণ করা যায়’।
গত শতাব্দীর ম্যাজিকম্যান ছিলেন স্টিফেন হকিং আর তিনিই কি না বইকে তুলনা করেছেন পোর্টেবল ম্যাজিক হিসেবে।
বহু অগোছালো গপ্পো হলো। আজকে রাসূল সা.-এর কাছে আসা প্রথম শব্দের ওপর আমল করার জন্য এবং স্টিফেন হকিং এর পোর্টেবল ম্যাজিক যাচাই করার জন্য এসো হাতে তুলে নেই সমৃদ্ধ বই। যা দিয়েই আমরা আগামী বিশ্ব জয় করবো। ইনশাআল্লাহ।