কোনো কোনো কবির ভাগ্য ভীষণ রকম ভালো। একটি কবিতা-ছড়া অথবা একটি বইয়ের জন্য পাঠক মনে রেখে দেন তাঁকে। তাঁর জায়গা হয়ে যায় মানুষের মনে। তিনি বেঁচে যান। থেকে যান পাঠক হৃদয়ে। অবশ্য সেই কবিতা কিংবা ছড়া অথবা বইটি যদি তেমন বই হয়। যদি কবিতাটি অথবা ছড়াটি পাঠকের মুখে মুখে উচ্চারিত হয়। যদি পাঠকের স্মৃতিতে গেঁথে যায়। এবং যদি সেটি প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম পঠিত হয়। তেমন কবিকে ভাগ্যবান ছাড়া আর কী বলা যায়। হ্যাঁ তিনি ভাগ্যবান এবং ভাগ্যবান।
তেমনি একজন ভাগ্যবান কবি খান মোহাম্মদ মঈন উদ্দীন। তার একটি ছড়া এবং একটি বই তাঁকে অমর করে দিয়েছে। পাঠকের ঠোঁটে উচ্চারিত হন তিনি। উচ্চারিত হন বড়দের এবং ছোটদের মুখে। এমনকি আমাদের শিশুদের মুখেও তিনি তুমুলভাবে উচ্চারিত। তার ছড়াটির নাম- ‘কানা বগির ছা।’ বইটির নাম ‘যুগস্রষ্টা নজরুল।’ বইটির কথার আগে তাঁর ছড়াটি পাঠ করা যাক-
ঐ দেখা যায় তাল গাছ
ঐ আমাদের গাঁ
ঐখানেতে বাস করে
কানা বগির ছা।
ও বগি তুই খাস কি!
পান্তা ভাত চাস কি!
পান্তা আমি খাই না
পুঁটি মাছ পাই না।
একটা যদি পাই
অমনি ধরে গাপুস গুপুস খাই।
কী যে মজার ছড়াটি। কী যে আনন্দময় এবং গতিশীল। এবং সহজ করে লেখা ছড়াটি। সহজ কিন্তু অনেক বড় কথা বলে দিয়েছেন তিনি। এই একটি ছোট্ট ছড়ার ভেতর লুকিয়ে আছে আমাদের বাংলাদেশের গ্রাম। প্রকৃতি। পাখি ও গ্রামের পান্তা খাওয়া মানুষের জীবন। গাঁয়ের সেই তালগাছ। তালগাছে বকের ছানা। সঙ্গে বাবুই পাখির বাসা। কানা বগির চেহারা আমাদের কী যে পরিচিত চিত্র। এক দৃষ্টে ডোবায় বসে ধানীজমির কিনারে কিংবা পুকুরে কলমিলতার ওপর বসে মাছ শিকারের দৃশ্যটি কে না দেখেছে। কে না জানে পান্তা খায় গ্রামের সাধারণ মানুষ। কিন্তু বগি খায় পুঁটি মাছ, কাচকি মাছ, চাপিলা এবং মলা মাছ। এসব খাওয়ার দৃশ্যে কবি খান মোহাম্মদ মঈন উদ্দীন পুঁটি মাছের চিত্র আঁকলেন। হলে কী হবে! পুঁটি মাছ ধরার দৃশ্যে লুকিয়ে আছে আরও মাছের গল্প। আরও খাওয়ার কাহিনী। এবং আরও মাছ ধরার দৃশ্য। একটি বকের ছানার পুঁটি মাছ খাওয়ার সঙ্গে পান্তা ভাতের গল্প জুড়ে কবি আমাদের গ্রামের সাধারণ মানুষের জীবন চিত্র এঁকে দিয়েছেন। এখানে এটি ছড়া ছাপিয়ে কবিতা হয়ে উঠেছে। হয়ে উঠেছে গ্রামে পান্তা খাওয়া মানুষের কালছবি। এখানে একজন কবির শক্তির পরিচয়। এখানেই কবি থেকে কবি আলাদা। এই যে চিত্র এঁকে দিলেন কবি এটিই কবির সার্থকতা এবং এখানে তিনি পাঠকের মুখে মুখে জেগে আছেন। একটি বইয়ের কথা বললাম-ওপরে। বইটি- ‘যুগ¯্রষ্টা নজরুল’। খান মোহাম্মদ মঈন উদ্দীনের এই বইটি একটি অনবদ্য বই। নাম থেকেই বুঝি বইটি আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামকে নিয়ে। বইটি স্মৃতিধর্মী হলেও এখানে মূল্যায়ন আছে নজরুলের। আছে নজরুলের বিশাল ব্যক্তিত্বের ছাপ। হৃদয়ের আবেগ মিশিয়ে লিখেছেন বইটি। সমস্ত ভালোবাসা ঢেলে লিখেছেন। লিখেছেন প্রাণের টানে। মানুষের প্রতি মানুষের একটি অনন্য উদাহরণ এই বইটি। এখন প্রশ্ন হলো- নজরুলকে নিয়ে লেখা এই বইয়ের পেছনের গল্পটি কী? এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ জিজ্ঞাসা। গল্পটি চমকে দেওয়ার মতো। হ্যাঁ ঠিক তাই। চমকে যেতে হয়- যখন আমরা জানি- নজরুলের সাথে যারা ভীষণ ঘনিষ্ঠ ছিলেন। ছিলেন অন্তরঙ্গ- খান মোহাম্মদ মঈন উদ্দীন তাদের অগ্রসরদের একজন। তিনি নজরুল জীবনের অনেক রহস্যময় ঘটনার দর্শক। সাক্ষী। নজরুল যাদেরকে মন দিয়ে গ্রহণ করেছেন খান মোহাম্মদ মঈন উদ্দীন তাদেরই একজন। নজরুলের সঙ্গ পেতে সঙ্গ নিতে কী যে ব্যাকুল ছিলেন এই কবি। সেই ব্যাকুলতা প্রকাশ পেয়েছে এই বইয়ের পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায়।
‘যুগ¯্রষ্টা নজরুল’ বইটির ভাষণ সাবলীল। চমৎকার। গতিশীল। পড়ে ক্লান্তি আসে না। বিরক্তিও না। বরং যত পড়া যায় ততই ভালো লাগে। যত পড়া যায় আনন্দ জাগে। পড়তে ইচ্ছে হয় আরও। নজরুলের জন্য যত ভালোবাসা মোটেই গতানুগতিক নয়। মোটেই সাধারণ নয়। মোটেই নয় সস্তা কোনো প্রীতির চিহ্ন। বরং এ ভালোবাসা হৃদয় উৎসারিত আনন্দের স্রােত। তীব্র ভালোবাসার এক ধারা। যে ভালোবাসা মানুষকে ভাষা দেয় তেমনি। এ বইটির জন্য ১৯৬০ সালে ইউনেস্কো পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। একবার ভাবলে বোঝা যায় বইটির ওজন কেমন। কেমন তার গুরুত্ব।
খান মোহাম্মদ মঈন উদ্দীন জন্ম ১৯০১ সালে। ১৯৮১’র ১৬ ফেব্রুয়ারি চিরবিদায় নেন এ পৃথিবী থেকে। নজরুলের জন্ম ১৮৯৯ সালে ২৪ মে। বয়সে নজরুলের চেয়ে মাত্র দু’বছরের ছোট। সমবয়সী হওয়ার কারণে তিনি এক দিকে নজরুলের ঘনিষ্ঠ বন্ধু অন্য দিকে এক বিরাট ভক্ত। বন্ধু ও ভক্তের দ্বিমুখী ভালোবাসা তাঁকে ‘যুগ¯্রষ্টা নজরুল’ লিখতে উৎসাহ জুগিয়েছে। তাঁর চোখে নজরুল ছিলেন এক মহা বিস্ময়! এক অবাক চরিত্র। খান মোহাম্মদ মঈন উদ্দীন শিশুসাহিত্যিক হিসেবে খ্যাতি পেয়েছেন। বাংলা একাডেমি পুরস্কারটিও পেয়েছেন শিশুসাহিত্যে। পেয়েছেন ১৯৬০ সালে। ১৯৭৮ সালে সাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্য পেয়েছেন রাষ্ট্রীয় পুরস্কার- একুশে পদক।
শিশুদের জন্য তিনি রচনা করেছেন জীবনীমূলক গ্রন্থ। প্রবন্ধ, নিবন্ধ ও গল্পের বই। এসব বইগুলোর নাম স্মরণ করা যায়- মুসলিম বীরাঙ্গনা-১৯৬৩, আমাদের নবী-১৯৮৪, খোলাফা-এ-রাশেদীন-১৯৫৭, বাবা আদম-১৯৫৮, স্বপ্ন দেখি-১৯৫৯, লাল মোরগ-১৯৬১, শাপলা ফুল-১৯৬২।
তাঁর চারটি কবিতার বই- পালের নাও-১৯৫৬, হে মানুষ-১৯৫৮, আর্তনাদ-১৯৫৮, নয়া সড়ক- ১৯৬৭।
ছোট গল্পের বই ১টি- ঝুমকোলতা-১৯৫৬।
খান মোহাম্মদ মঈন উদ্দীন আমাদের ঐতিহ্য নিয়ে কাজ করেছেন। কাজ করেছেন বিশ্বাস নিয়ে। সাধারণ মানুষের জীবন যাপন তার লেখায় চমৎকার ফুটে উঠেছে। তিনি আত্মবিশ্বাসী এবং সুস্থ বিশ্বাসের কবি। তাঁকে আমরা স্মরণে রাখবো এবং রাখা জরুরি।