বাদুড় পৃথিবীর একমাত্র স্তন্যপায়ী প্রাণী যারা উড়তে সক্ষম। পায়ের হাড় হালকা হওয়ায় দাঁড়াতে অসমর্থ এই প্রাণীটিকে গাছের ডালে ঝুলতেও দেখা যায়। বাদুড় সাধারণত বাদামি, ধূসর কিংবা কালোরংয়ের হয়ে থাকে। তবে খুব বিরল হলেও সাদা রংয়ের বাদুড়ও আছে। এদের বসবাস হন্ডুরাসে। ইংরেজিতে এদের ‘হন্ডুরানহোয়াইট ব্যাট’ বলা হয়।
পৃথিবীতে প্রায় ১১০০ প্রজাতির বাদুড় রয়েছে। এদের প্রজাতির সংখ্যা স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মোটপ্রজাতির শতকরা প্রায় ২০ ভাগ। প্রায় ৭০ ভাগ বাদুড় পতঙ্গভুক। আর বাকিরা ফলমূল খায়। এরা নিশাচর প্রাণী। দিনের বেলায় অন্ধকার স্থানে, উঁচু গাছের ডালে, গুহায় কিংবা গাছের ফোকরে ঝুলে থাকে।
অনেকে বাদুড়কে রক্তচোষা স্বভাবের ভেবে থাকেন। বাস্তবে প্রায় ১ হাজার প্রজাতির বাদুড়ের মাঝে মাত্র তিন প্রজাতির বাদুড় রক্তচোষা হয়ে থাকে। রক্তচোষা হলেও আবার তাতে মানুষের রক্ত খায় ভেবে ভয় পাবার কিছু নেই। এরা প্রধানত গরুর রক্তপানের নেশায় থাকে।
সাদা বাদুড় সাধারণত হন্ডুরাসের পূর্বাঞ্চল, নিকারাগুয়ার উত্তরাঞ্চল, কোস্টারিকার পূর্বাঞ্চল এবং পানামার পশ্চিমাঞ্চলীয় রেইন ফরেস্টে পাওয়া যায়।
১৮৯২ সালে আমেরিকার প্রাণী ও পক্ষী বিশেষজ্ঞ জোয়েল আসাফ অ্যালেন হন্ডুরাস এবং পানামায় প্রথম সাদা বাদুড়ের দেখা পেয়েছিলেন। এগুলো ছাড়াও উত্তরাঞ্চলীয় বাদুড়ের আরেকটি প্রজাতির নাম জানা যায়, যা দেখতে সাদা রংয়ের।
উত্তরাঞ্চলীয় সাদা বাদুড়ের বৈজ্ঞানিক নাম Diclidurusalbus। এ প্রজাতির বাদুড়কে সাধারণত মেক্সিকো থেকে পশ্চিম ব্রাজিল ও ত্রিনিদাদে পাওয়া যায়। উভয় প্রজাতির বাদুড়ের গঠনগত দিক থেকে সামান্য কিছু পার্থক্য রয়েছে। সাধারণত নাক দেখে সহজেই বাদুড়কে আলাদা করা যায়।
এদের সাদা পশম, হলুদ নাক এবং কান রয়েছে। এরা খুবই ছোট এবং দৈর্ঘ্যে ৩.৭-৪.৫ সেন্টিমিটার পর্যন্ত লম্বা হয়ে থাকে। এদের প্রসারিত পাখার দৈর্ঘ্য ৪.০২ ইঞ্চি পর্যন্ত হয়ে থাকে। এরা আকারে ক্ষুদ্র বাদুড় প্রজাতিদের মধ্যে একটি। পুরুষ বাদুড়ের তুলনায় স্ত্রী বাদুড় কিছুটা ছোট হয়। সাদা বাদুড়ের দুইটি প্রজাতির মধ্যে হন্ডুরান হোয়াইট ব্যাট একটি। নাক দেখতে পাতার মতো ত্রিকোণাকার হয়। এ জন্য এরা Leaf nosed bat নামেও পরিচিত।
যোগাযোগের জন্য এরা ডাকাডাকি ও একে অপরকে স্পর্শ করে। খাবার সন্ধানের জন্য ইকো লোকেশনের ব্যবহার করে। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো এদের বাসায় অবস্থানের পদ্ধতি। এই বাদুড়গুলো সাধারণত হেলিকোনিয়া গাছের পাতার পার্শ্বশিরা কেটে তাবু কিংবা উল্টানো নৌকা আকৃতির রুস্ট তৈরি করে। প্রতিটি বাসায় কলোনি আকারে ছয়টি বা তারও বেশি বাদুড় ঝুলে থাকে। হেলিকোনিয়ার পাতার মধ্য শিরা বরাবর এরা ঝুলে থাকে।
হন্ডুরাসের সাদা বাদুড় নিশাচর প্রাণী। এরা রাতের বেলা খাবার সংগ্রহের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ে। এরা সাধারণত ডুমুর ফল খায়। ডুমুর ছাড়াও বিভিন্ন ধরনের ফলমূলও খায়।
সাদা বাদুড় বছরে একবার বাচ্চা প্রসব করে। বাচ্চাগুলো ২১ দিন পর্যন্ত মায়ের স্তন পান করে। ৩৫ দিন বয়স থেকে বাচ্চাগুলো স্বাধীনভাবে বসবাস করতে শুরু করে।
সূর্যের আলো পাতা ভেদ করে গায়ে পড়লে এদের সবুজ দেখায়। শিকারির চোখকে ফাঁকি দেওয়ার এ এক দারুণ কৌশল। কিন্তু বর্তমানে রেইন ফরেস্ট উজাড়ের কারণে এরা আজ বিলুপ্তির পথে।
বাদুড়কে অনেকেই ক্ষতিকর প্রাণী মনে করে থাকেন। কিন্তু বাদুড়ও মানুষের জন্য অনেক উপকার সাধন করে থাকে। শতকরা ৭০ ভাগ বাদুড় মশা-মাছি, গুবরে পোকা, তেলাপোকা ইত্যাদি পোকামাকড় খায়। বাদুড় হামিংবার্ডের মতো ফুলের মধু খেতে পারে। মধু খাওয়ার সময় তাদের শরীরে থাকা লোমে পরাগরেণু আটকে যায়। পরবর্তীতে ফুলে ফুলে ঘুরে বেড়ানোর সময় পরাগরেণু অন্যান্য ফুলে লেগে যায়। এভাবে বাদুড় ফুলের পরাগায়ণে সহায়তা করে। অনেক উদ্ভিদ প্রজাতি আছে যেগুলো বাদুড়ের দ্বারা পরাগায়ণ না হলে বংশ বিস্তার করতে পারবে না।
বাদুড় সাধারণত ৫-৩০ বছর বেঁচে থাকতে পারে। এরা পরিবেশের সাথে দ্রুত খাপ খাইয়ে নিতে পারে। উষ্ণমণ্ডলীয় প্রজাতির বাদুড় সাধারণত নেকটার বাফুলের মধু, পরাগরেণু, ফলমূল খেয়ে বাঁচে। উদ্ভিদের বংশ বিস্তারে সহায়তা করে। কিন্তু গাছপালা ধ্বংসের কারণে ও খাদ্যের অভাবে অনেক প্রাণীই বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে।
২০০৮ সালে International Union for Conservation of Nature (IUCN) তাদের রেড লিস্টে ক্ষুদ্র এই বাদুড়টিকে বিলুপ্ত-প্রায় প্রাণীর তালিকাভুক্ত করেছে। রেইন ফরেস্ট উজাড়, বিশেষত হেলিকোনিয়া উদ্ভিদ কমে যাওয়া, আলোক দূষণ, জলবায়ুর পরিবর্তন, খাদ্যের অভাব, চোরাকারবারি ও বাণিজ্য ইত্যাদি নানাবিধ কারণে প্রাণীটি আজ বিলুপ্তির পথে।
২০১২ সালে আন্তর্জাতিক অ্যানিম্যাল রেসকিউ ফাউন্ডেশনটি ব্রাজিলে পর্যবেক্ষণ করে দেখেন প্রধানত বনজঙ্গল উজাড়, কাঠের ব্যবসা এবং সেই সাথে ফলদ বৃক্ষ কাঁটার কারণে সেখান থেকে এই বাদুড়ের সংখ্যা হ্রাস পেয়েছে।
বাদুড়ের উপকারিতা ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার কথা বিবেচনা করে মধ্য আমেরিকার অনেক স্থানে হন্ডুরাসের সাদা বাদুড়টিকে সংরক্ষণের জন্য যথাযথ প্রকল্প ও পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। এ সকল পরিকল্পনার মধ্যে দ্রুত বনাঞ্চল হ্রাস কমিয়ে আনার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।
প্রাণী সংরক্ষণবিদ ও পরিবেশবিদদের কার্যক্রমের ফলে এখনও সংরক্ষিত এলাকায় এই বাদুড়কে প্রচুর সংখ্যায় দেখা যায়।