একদিন বিকেল বেলা গ্রামের সাংবাদিক প্রীতি আপু নিজের ঘরে বসে একটি বিজ্ঞান সম্পর্কিত বই পড়ছিল। চোরের মতো নিঃশব্দে ঘরে ঢুকে তার টেবিল ঘেঁষে দাঁড়ালাম। সে আমার দিকে তাকিয়ে বললো, ‘কবে গ্রামে এসেছ? বসছো না কেন? চেহারা এমন হয়েছে কেন? অসুস্থ নাকি?’
আমি ধাপ করে বসে পড়লাম। চোরকে যেন জিজ্ঞাসা করা হচ্ছে সে চুরি করেছে কি না, এই রকম অতিমাত্রায় বিব্রত হয়ে বললাম, ‘না আপু, অসুস্থ না।’
গুরুতর কিছু ঘটেছে সে ব্যাপারে নিঃসন্দেহ হয়ে, সে আমাকে জিজ্ঞাসা করলো, ‘কী হয়েছে?’
প্রীতি আপু সম্পর্কে আমার চাচাতো বোন। আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘আপু, সত্যি করে বলতো ভূত বলতে কিছু আছে কি?’
উত্তরে সে আমাকে বললো, ‘তুমি কী পাগল হয়ে গিয়েছ, এই বিজ্ঞানের জগতে ভূতের কথা বলছো। ‘সে মুখ ঘুরিয়ে বলে ভূত বলতে কিছুই নেই।’
অনেকক্ষণ ইতস্তত করে, অনেক ভূমিকা করে আমি তাকে সব কিছু খুলে বলি।
আমি ঢাকায় থাকি। মাঝে মধ্যে গ্রামে বেড়াতে আসি। গ্রামে কিছু দিন হয়েছে এসেছি। কিছু বন্ধুদের কাছে সব সময়ই শুনতাম গ্রামে নাকি ভূত আছে। আমার বাড়ির পিছনেই রয়েছে একটি ছোট বন, বনটি পেরুলেই সেই ভাঙ্গা বাংলো ঘর। যেখানেই রয়েছে সেই ভয়ানক ভূত।
প্রথম প্রথম আমি বিশ্বাস করিনি। একদিন তাই সময় করে গ্রামের এক বন্ধুকে নিয়ে যাই সেখানে। সবাই বলে বাড়ির চৌকাঠের ভেতরে একবার প্রবেশ করলে আর বের হওয়া যায় না।
পিতলের তৈরি চৌকাঠ দেখতে খুব সুন্দর। কৌতূহলবশে প্রবেশ করি চৌকাঠের ভেতর। বাংলো ঘরটা বেশ ভয়ানক। চৌকাঠের ওপরে ঝুলছে একটি বাল্ব। বাংলো ঘরের কোনায়ও একটি বাল্ব আছে কিন্তু সেটি ভাঙা। মনে হচ্ছে কেউ ইট দিয়ে ভেঙে ফেলেছে বাল্বটি। বাড়িটি ঘুরে ঘুরে দেখি দু’জন।
বন্ধু বললো, ‘আমরা যে এখানে এসেছি এটা ওরা বিশ্বাস করবে না, চল ভিডিও করি।’ আমি মোবাইলটা বের করে ভিডিও করি। বের হওয়ার সময় একটু ভয় ভয় লাগছিল। কিন্তু খুব সহজেই বের হয়ে যাই সেখান থেকে। কই আমাদের তো কিছুই হলো না। সন্ধ্যার আগেই বাড়ি ফিরে আসি আমরা।
আমরা পরের দিন সকালে অন্যান্য বন্ধুদের এ ঘটনা বলি। প্রথমে তারা বিশ্বাস করছিল না। পরে ভিডিওটা দেখে তারা বিশ্বাস করল। পথ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিল একটি লোক। হয়তো আমাকে উদ্দেশ করে বলেছিল এত সাহস থাকলে সন্ধ্যার পর যেও।
একবার সেখানে গিয়ে অনেক সাহস হয়ে গেল। আজ আবার যাবো এ কথা মনে মনে ভাবছিলাম। বিকেলে বন্ধুর বাড়িতে গিয়ে বলি চলো যাই। সন্ধ্যার পর যাব এ কথা শুনে সে ভয় পেয়ে আমাকে বলে, ‘আজ আমি যেতে পারব না, মা শুনলে বকা দেবে।’ আমি বলি আচ্ছা আজ একাই যাবো।
সন্ধ্যা হলো আমি সাহস করে টর্চলাইট ও মোবাইল নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম বাড়ি থেকে। বেশি দূরে ছিল না বলে খুব অল্প সময়ে চলে যাই সেখানে। চৌকাঠের সামনে বাল্বটা জ্বলছিল। আমি ভেতরে ঢুকলাম। লোকটার কথায় একটু ভয় ভয় লাগছিল। একটা সেলফি তুললাম ঘরে ভাঙা লাইটের সামনে। চৌকাঠে হাতটা রেখে যেই দ্বিতীয় সেলফিটা তুলবো এমন সময় জোরে এক ধাক্কা খেয়ে মাটিতে আছড়ে পড়ি!
সমস্ত শরীর ঝনঝন্ করে উঠল। তারপর আর কিছুই মনে নেই। জ্ঞান ফিরতেই দেখি সময় রাত আটটা পনেরো মিনিট। এক দৌড়ে বাড়িতে আসি। রাত্রে ঠিকমত ঘুমাতে পারিনি। আপু আমার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনল। বিশ্বাস করা কঠিন হলেও বিশ্বাস করলো। সে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আচ্ছা আমি আজ তোমার সাথে যাবো।’ বিকালে আমি আপুর কথামতো সেখানে যাই। আপু আমার ফুফাতো ভাই আফনানকে নিয়ে আসে। ফুফাতো ভাই আফনান সেবার ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করেছে। আপু আমার দিকে তাকিয়ে হেসে হেসে বলে- এ বাড়িটা কাদের জানো। আমিতো জানি না। সে বলে এটা তোমার ফুফুর বাড়ি। সে বলে, ‘তোমার এই ভাই মূল্যবান পিতলের চৌকাঠ যাতে চুরি না হয় সে জন্য এখানে ভূত রেখে দিয়েছে।’ আমি বলি এটা কিভাবে সম্ভব। আফনান ভাই আমাকে বলেন, ‘এই পিতলের চৌকাঠে আমি বাল্ব থেকে বিদ্যুৎ সংযোগ দিয়েছি যার ফলে এই চৌকাঠ স্পর্শ করলেই বৈদ্যুতিক শক লাগে। আর ভূত! ভূত বলতে তো কিছুই নেই। এগুলো হলো কুসংস্কার ও বিজ্ঞানের খেলা।
আমি হাঁফ ছাড়লাম এবং বললাম আমার ভাগ্য ভালো যে বিদ্যুৎ শকে মারা যেতে হয়নি। ভাইয়া বলো তাহলে তোমরাও এই ভয়ঙ্কর ভূত সম্পর্কে জেনে গেলে। আমি আর আপু হাসতে হাসতে বললাম, আমরা এই ভয়ঙ্কর ভূতের আসল রহস্য আর কাউকে বলবো না।