Home সায়েন্স ফিকশন ইউরেনাসের মেয়ে -আহমেদ বায়েজীদ

ইউরেনাসের মেয়ে -আহমেদ বায়েজীদ

হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিল আবু জাফর। নদী তীরের এই জায়গাটা একটু কেমন যেন। এক পাশে নদী, এক পাশে জঙ্গল। মাঝখান দিয়ে পথ। দুপুরের পর এই সময়টায় জায়গাটা একদমই নির্জন। অন্য সময়ও এই পথে খুব একটা লোক চলাচল করে না। চারদিকে তাকিয়ে একটু কেমন যেন লাগলো আবু জাফরের। সেকি ভয় পাচ্ছে? পরক্ষণেই একটু লজ্জাও পেল নিজে নিজে, আধুনিক যুগে সে একজন শিক্ষিত মানুষ হয়ে ভিত্তিহীন জিনিসে ভয় পাচ্ছে! কিন্তু ‘কেমন লাগা’ ভাবটা গেল না তাতেও। এবার বিকল্প উপায় খুঁজে পেল সে। ‘আমার জরুরি কাজ আছে’- মনে মনে এটি বলে হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিল। এবার সন্তুষ্ট হলো মন। ভূত-প্রেত কিছুর ভয়ে নয়, জরুরি কাজ আছে তাই সে দ্রুত হাঁটছে।
অজুহাতটা একেবারে মিথ্যাও নয়। দুপুর গড়িয়ে সাড়ে তিনটা বেজে গেছে। দ্রুত বাসায় ফিরে ঢাকায় সংবাদটা পাঠাতে হবে। মফস্বল সম্পাদক লোকটা সুবিধের নয়। বয়স হয়ে গেছে তাই সামান্যতেই রেগে যান। বলে দিয়েছেন, ঘটনা যাই ঘটুক- বিকেল চারটার আগে সংবাদ পাঠাতে হবে। মফস্বলে সাংবাদিকতা করার এই এক ঝামেলা। পারলে সন্ধ্যায় যা ঘটে তার সংবাদটাও ঢাকার অফিস থেকে বিকেলের আগে পেতে চায়। কিছুই করার নেই, এসব মেনেই চাকরি করতে হবে। উপজেলা শহরের এই সাংবাদিকতা ঠিক চাকরিও নয়, এখানে এসব করে সংসার চলে না। সামান্য যা টাকা-পয়সা দেয়া হয়, সংবাদ সংগ্রহ আর পাঠানোর কাজেই তা শেষ হয়ে যায়। তবু ছাত্রজীবনে মাথায় ঢোকা এই পোকাটা সরাতে পারেনি আবু জাফর। কলেজে শিক্ষকতার পাশাপাশি তাই করে যাচ্ছে কাজটা।
গিয়েছিল গহীনডাঙ্গা গ্রামে। উপজেলা সদর থেকে তিন কিলোমিটার দূরে। পথে একটি সাঁকো আছে তাই মোটরসাইকেল নিয়ে যেতে পারেনি। আর দ্রুত ফিরতে হবে বলে নদীর পাড়ের এই শর্টকাট রাস্তাটা ধরেছে। গহীনডাঙ্গা গ্রামের একটি পরিবার হঠাৎ করেই উধাও হয়েছে গতকাল। একই পরিবারের মা-বাবা আর দুই-ছেলে মেয়ে। ছেলেটির বয়স ১০, মেয়েটির ৮ বছর। গত পরশু সন্ধ্যায়ও নাকি ওদের দেখেছে পাশের বাড়ির লোকজন; কিন্তু এরপর থেকে আর কোন খোঁজ নেই। কোথাও বেড়াতে গেছে এমনটাও কেউ দেখেনি। আজ দ্বিতীয় দিনেও ওদের কোন খোঁজ না পাওয়ায় হইচই পড়ে গেছে। হইচইয়ের আরেকটি কারণ আছে, তিন বছর আগে একই রকমভাবে এই গ্রাম থেকে হঠাৎ নাই হয়ে গিয়েছিল আরেকটি পরিবার। সেই পরিবারটিরও আর কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি।
কলেজ ছুটির পর সেই সংবাদ সংগ্রহের জন্যই গিয়েছিল আবু জাফর। এখন দ্রুত বাসায় গিয়ে খবরটা ঢাকায় পাঠাতে না পারলে আবার ঝাড়ি খেতে হবে। সংবাদটা কিভাবে সাজাবে সেটা নিয়ে ভাবতে ভাবতে দ্রুত হাঁটতে লাগলো। এর দুটি উপকারিতা, বাসায় গিয়ে দ্রুত কাজটা করতে পারবে, দ্বিতীয়ত ভূত-প্রেতের চিন্তা মাথায় আসবে না; কিন্তু তার চিন্তায় ছেদ পড়লো হঠাৎ। সামনে দেখলো পথের পাশে একটি ছোট্ট মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বয়স আটও হতে পারে বারোও হতে পারে। ঠিক ধারণা করতে পারলো না আবু জাফর। মেয়েটির চেহারাটাও কেমন যেন একটু অস্বাভাবিক ঠেকলো তার কাছে; কিন্তু এখন ওসব নিয়ে চিন্তা করার সময় পেল না। এই নির্জন জায়গায় মেয়েটি একা দাঁড়িয়ে কী করছে সেটিই তার কৌতূহল।
‘এই মেয়ে এখানে কী করছিস?’ ধমকের সুরেই প্রশ্নটা করলো আবু জাফর।
মেয়েটি মুচকি হাসি দিল প্রশ্ন শুনে। মেজাজটা খারাপ হয়ে গেল আবু জাফরের। হাসির কিছু তো সে বলেনি। অন্যমনস্ক ছিলো তাই ধমকটা বরং একটু জোরেই হয়ে গেছে। এমন ধমক শুনে এইটুকু মেয়ের কেঁদে ফেলার কথা। এ তো উল্টো হাসছে।
‘এখানে এসেছিস কেন ত্ইু? সাথে কেউ আছে?’
মেয়েটি এবারো কোন উত্তর দিল না। এমনভাবে তাকালো যেন অবাক হয়েছে প্রশ্ন শুনে। আবু জাফরের ইচ্ছে হলো একটা চড় মারে ওকে; কিন্তু এসব নিয়ে মাথা ঘামালে চলবে না। তার হাতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ একটি সংবাদ আছে। আগামীকালকের পত্রিকায় প্রথম পৃষ্ঠায় না হলেও শেষ পৃষ্ঠায় অন্তত ছাপা হবে। তাকে সেসব নিয়েই মাথা ঘামাতে হবে এখন। তাই মেয়েটির উদ্দেশে ‘যা, বাড়ি যা’ বলে আবার হাঁটতে শুরু করলো।
বাড়ি পৌঁছে দ্রুত ল্যাপটপ খুলে বসলো আবু জাফর। ২০ মিনিটের বেশি লাগলো না সংবাদটি লিখতে। এবার মোবাইল ফোনটা হাতে নিলো। পাঠানোর আগে সর্বশেষ কোন খবর আছে কি না সেটা জেনে নিতে হবে। ফোন করলো থানার ওসির নম্বরে।
‘হ্যালো, ওসি সাহেব। আবু জাফর বলছি…. সাংবাদিক। গহীনডাঙ্গার নিখোঁজের কোন আপডেট আছে?’
ওসি নতুন কিছুই জানাতে পারেননি। ফোন রেখে ল্যাপটপের কি-বোর্ডে হাত দিল আবু জাফর। তখনই শুনতে পেল পেছন থেকে একটি মেয়ে কণ্ঠ। ‘ওদের আর পাওয়া যাবে না’।
অবাক হয়ে পেছনে তাকায় আবু জাফর। নদীর পাড়ে দেখা সেই মেয়েটি দাঁড়িয়ে আছে তার পেছনে। তাড়াহুড়োয় বাসার দরজাটা লাগাতে ভুলে গিয়েছিল। তাই মেয়েটি ঢুকে পড়েছে বাসায়। ‘কী বললি! ….এই মেয়ে তুই দেখি আমার বাসায় চলে এসেছিস? বাড়ি কই তোর?’ বলতে বলতে মোবাইল ফোনটা তুলে সময় দেখলো আবু জাফর। সাড়ে চারটা বেজে গেছে।
‘দাঁড়া, হাতের কাজটা শেষ করে তোর সাথে কথা বলছি।’ মেয়েটির উদ্দেশে এটুকু বলে সংবাদটা ইমেইল করার কাজে মনোযোগ দিল সে। কাজ শেষ করে তাকিয়ে দেখে মেয়েটি একই রকমভাবে দাঁড়িয়ে আছে। ‘বল এবার, কেন এসেছিস আমার পিছু পিছু? আর কী যেন বলছিলি….’
‘ওদের আর পাওয়া যাবে না, গ্রামের ওই পরিবারটিকে’। শান্ত স্বরে বললো মেয়েটি।
‘তুই জানলি কী করে পাওয়া যাবে না। আর তোকে এসব নিয়ে ভাবতেই কে বলেছে, পিচ্চি মেয়ে…. নাম কী তোর?’
‘ইউরিনা’
‘ইউরিনা! এটা আবার কেমন নাম’ অবাক হলো আবু জাফর। ‘বাড়ি কোথায় তোর?’
এই প্রশ্ন শুনে চোখ দুটো বড় হয়ে গেল মেয়েটির, মুখটা হাঁ হয়ে গেল। বিস্মিত হলো যেন। এরপর বললো, ‘ইরেনাসে, ওখানে তো নামের প্রচলন নেই। তবু যেহেতু তোমাদের মতো রূপ দেওয়া হয়েছে তাই আমার নাম রাখা হয়েছে ইউরিনা’।
মেয়েটির কথার আগামাথা কিছুই বুঝলো না আবু জাফর। প্রশ্নটা আবার করলো, ‘কোথায় বাড়ি বললি?’
‘ইউরেনাস। সৌরজগতের সপ্তম গ্রহ। সেখান থেকে এসেছি আমি।’
আবু জাফর মেয়েটির দিকে ভালো করে তাকালো আবার। চেহারায় অস্বাভাবিকতাটা আগেই খেয়াল করেছে; কিন্তু গুরুত্ব দেয়নি। চোখ দুটো অনেকটাই গোল। মুখটা লম্বাটে। এই বয়সের একটা শিশুর চেহারায় যে কোমলতা আর মিষ্টি ভাবটা থাকার কথা সেটাও নেই। একটু ভয় পেয়ে গেল আবু জাফর। ‘তু…তুমি এখানে কেন এসেছো!’ ভয়ে নিজের অজান্তেই তুই থেকে তুমিতে এসে গেছে সে।
‘ভয় পেয়ো না। আমার দ্বারা কোন ক্ষতির আশঙ্কা নেই। কারো ক্ষতি করার ক্ষমতাও অবশ্য নেই আমার।’ বললো মেয়েটি।
এক মুহূর্ত নিজের বিদ্যাবুদ্ধির আলোকে চিন্তা করলো আবু জাফর। জ্ঞান-বিজ্ঞান নিয়ে তার পড়াশোনার অভ্যাস আছে। তাই নিজেকে সামলে নিলো। মেয়েটিকে বললো, ‘খুলে বলো তো সব কিছু!’
মেয়েটি বলতে শুরু করলো, ‘গহীনডাঙ্গা গ্রামের ওই পরিবারটিকে নিয়ে আমাদের স্পেসশিপ এতক্ষণে অনেকদূর পাড়ি দিয়েছে। ওরা আর কখনো পৃথিবীতে ফিরবে না।’
‘তার মানে ইউরেনাসে নেওয়া হয়েছে ওদের! কেন?’
‘মানুষের মতো শরীর ও মানসিকতা পাওয়ার আকাক্সক্ষা আমাদের বহু যুগের। তিন বছর আগে যে পরিবারটি নিখোঁজ হয়েছিল তাদেরও আমরাই নিয়েছি। ওদের ওপর পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে আমাদের বিজ্ঞানীরা অনেকটাই সফল। আমাকে এই যে দেখছো, এটি আমাদের গ্রহের প্রাণীদের আসল রূপ নয়। আমাকে মানুষের মতো শরীর ও অভ্যাস দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে; কিন্তু পুরোপুরি নিখুঁত হয়নি। তবু আমাকে কয়েক ঘণ্টার জন্য পৃথিবীতে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে এখানকার পরিবেশের সাথে মিশতে পারি কি না সেটি বোঝার জন্য।’ বললো মেয়েটি।
‘কিন্তু তাই বলে মানুষদের অপহরণ করছো কেন তোমরা?’
‘তুমি হয়তো খেয়াল করোনি, আমার আচরণে কিছুটা ত্রুটি আছে। যখন কাঁদার কথা তখন হাসি আসছে, যখন ভয় পাওয়ার কথা তখন বিস্মিত হচ্ছি। আবার চেহারাটাও নিখুঁত হয়নি। তাই এবার দু’জন প্রাপ্ত বয়স্ক নারী-পুরুষ এবং একটি ছেলে ও একটি মেয়েকে নেওয়া হয়েছে। তাদের ওপর নতুন করে গবেষণা করে সব বয়স ও জেন্ডার ভিত্তিক মানসিকতার নকশা তৈরি করা হবে। অনুভূতিগুলো আর চেহারাটা ঠিকঠাক হলেই আমরা মানুষে রূপান্তরিত হতে পারবো।’
‘এতে তোমাদের লাভ কী?’ প্রশ্ন করলো আবু জাফর।
মেয়েটি বললো, বিজ্ঞানের কাজই তো নতুন কিছু করা। মানুষকে দেখে আমাদের গ্রহের বিজ্ঞানীদের আগ্রহ হলো এমন শরীর ও অনভূতি আমাদের গ্রহের প্রাণীদের জন্য তৈরি করার। তাই এতো বছর ধরে চেষ্টা করে যাচ্ছে তারা।
‘কিন্তু তুমি তো সব কিছু আমাকে বলে দিলে। এতে তোমাদের মহাপরিকল্পনা ফাঁস হয়ে যাবে না?’
মেয়েটি বললো, কিচ্ছু হবে না। তুমি এখন ঘুমিয়ে পড়বে। ঘুম থেকে উঠে তোমার কিছুই মনে থাকবে না। এরপর সে তার বামহাতের কব্জিতে থাকা ঘড়ির মতো যন্ত্রটায় চাপ দিলো। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে প্রচণ্ড ঘুম এলো আবু জাফরের চোখে। জোর করে চোখ মেলে রেখে সে বলতে চাইলো, তোমরা সফল হবে না। ¯্রষ্টার মতো নিখুঁত করে মানুষ বানানো কোন সৃষ্টির পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু তার কথাগুলো মুখ ফুটে বের হলো না। বসা অবস্থায়ই চেয়ারের সাথে হেলে পড়লো সে। তলিয়ে গেল গভীর ঘুমে।

SHARE

Leave a Reply