[গত সংখ্যার পর]
‘বিপু ভাইয়া, তুমি ঘামছো?’ বিপ্লবকে ওভাবে ঘামতে দেখে বলে উঠল সুমি।
বিপ্লব বলল, ‘এমনি ঘামছি আপু। ম্যালা (অনেক) গরম পড়ছে তো, তাই।’
‘আমি তো ফ্যানের সুইচ নাগালে পাইনে। তুমিই বরং জোর বাড়িয়ে দাও।’
‘লাগবে না সুমি আপু।’
‘কিন্তু তুমি ঘেমে তো গোসল হয়ে যাচ্ছ! এই যে…’ আবিদকে কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল সুমি। আসলে ওকে কী বলে ডাকবে ও? ওর তো নাম জানে না।
বুঝতে পারল বিপ্লব। বলল, ‘ও তোমার আবিদ ভাইয়া। আমার বন্ধু।’
‘হ্যাঁ সুমি আপু,’ বলল আবিদ। ‘আমাকে তুমি আবিদ ভাইয়া বলেই ডাকবে।’
একদিকে অনেকখানি ঘাড়টা কাত করে সায় দিল সুমি। তারপর বলল, ‘আবিদ ভাইয়া, তুমি উঠে গিয়ে ফ্যানের স্পিডটা বাড়িয়ে দিয়ে এসো প্লিজ!’
‘ও কে সুমি আপু।’ বলে উঠে দাঁড়াল আবিদ। তারপর ফ্যানের রেগুলেটর ঘুরিয়ে স্পিড বাড়িয়ে দিয়ে আবার নিজের জায়গায় এসে বসল।
সুমি বলল, ‘থ্যাংকিউ আবিদ ভাইয়া।’
আবিদ বলল, ‘ইউ ওয়েলকাম।’
এই সময় একটা ট্রেতে করে চার গেলাস লেবুর শরবত এনে ওদের সামনে টি-টেবিলে রাখল ফুফু। নিজে চেয়ারে বসে ওদের দিকে গেলাস এগিয়ে দিলো। সবাই গেলাস হাতে নিলো।
বিপ্লবের তো তর সইছে না। ঘটনাটা শোনার জন্য উদগ্রীব হয়ে আছে। তবে শরবতে চুমুক দিতেই ‘আহ্’ করে মুখ দিয়ে একটা সুখানুভূতি বেরিয়ে এলো। দেহটা শীতল হয়ে এলো। এরপর এক ঢোকেই গেলাসের সব শরবত শেষ করেই তবে থামল। যদিও বরাবরই তিন নিঃশ্বাসের কমে ও কোনো পানীয় পান করে না। এটা আমাদের প্রিয়নবীর (সা) সুন্নাত।
ওর এভাবে শরবত পান করা দেখে ফুফু বলল, ‘আর এক গেলাস শরবত করে দেব তোকে?’
‘না ফুফু,’ বলল বিপ্লব। ‘আগে তুমি ঘটনাটা বলো।’
‘হ্যাঁ ফুফু, আগে ঘটনাটা বলেন।’ বলল আবিদ।
‘কিন্তু…’ আবিদকে দেখিয়ে বিপ্লবের দিকে তাকিয়ে চোখে কী যেন ইশারা করে থেমে গেল ফুফু।
বুঝতে পারল বিপ্লব। বলল, ‘ও স্যরি। আমি তো ভুলেই বসে আছি ওর সাথে তোমার পরিচয় করিয়ে দিতে। ইতোমধ্যেই সুমির সাথে ওর পরিচয়ের পর্ব শেষ হয়েছে। এখন তোমার জ্ঞাতার্থে জানাচ্ছি যে, ওর নাম আবিদ, আবিদুর রহমান। আমার বন্ধু। আর এই সফরে আমার সহকারী।’
‘স্যরি আবিদ,’ বলল ফুফু। ‘তুমি কিছু মনে করো না কেমন?’
আবিদ ফুফুর দিকে তাকিয়ে একটু লাজুক হেসে বলল, ‘না ফুফু, আমারই উচিত ছিল আমার পরিচয়টা আগেই জানিয়ে দেওয়া। স্যরি তো আমারই হওয়ার কথা।’
‘কিন্তু এই বিপু, তোর সহকারী মানে? কোনো রহস্যের পেছনে দৌড়ে এখানে এসেছিস নাকি তোরা?’ তাই এসে থাকলে ওসব বাদ দে। আমি বাপু বেশি টেনশন নিতে পারব না। বাব্বাহ্, কী সব ভয়ঙ্কর ভয়ঙ্কর কাজে জড়িয়ে পড়িস তুই। ভাবি আমার কাছে যখন বলে, আমার গায়ের লোম খাড়া হয়ে যায়। না বাবা, আমি ওসব সহ্য করতে পারিনে।’
‘আরে না ফুফু,’ ফুফুকে আশ্বস্ত করে বলল বিপ্লব। ‘সে রকম কিছু না। তবে বলা তো যায় না, রহস্য একটা পেয়েও যেতে পারি।’
‘আর সেই লোভেই তো আমি এই সফরে বিপুর সহকারী হয়েছি।’ গোপন কথাটা ফাঁস করে দিলো আবিদ।
বিপ্লব ওকে চোখ টিপে থামিয়ে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু তার আগেই সব বলে দিয়েছে আবিদ। কাজেই যা হবার তা হয়ে গেছে। এখন অন্যভাবে ফুফুকে বোঝাতে হবে। বলল, ‘তুমি বলো ফুফু, চৌরাস্তার মোড়ে গুণ্ডা দুটো লোকটাকে ধরার পর কী হলো?’
ফুফু এবার সিরিয়াস হলো। মুখের কাঠিন্য আবার ফিরে এলো। বলল, ‘ইদানীং খুব ঘন ঘনই ওসব ঘটছে এদিকে। কী যে দিনকাল পড়ল!’ একটা বড় শ্বাস ছাড়ল ফোঁস করে। তারপর আবার বলল, ‘অন্যান্য ঘটনার মতোই সব পয়সা-কড়ি কেড়ে নিলো গুন্ডা দুটো ওই লোকটার কাছ থেকে। আহারে বেচারা!’
‘কিন্তু ফুফু, সে তো তুমি বললে বেশ কয়েকদিন আগের কথা। এখন কিসের সমস্যার কথা বলছিলে তখন?’
‘ঘটনাটা তো এখানেই শেষ না বাপ। এই তো সেদিন, মানে পরশু দিন, আমাদের বাড়ির ঠিক সামনে থেকে একটা হিরো সাইকেল চুরি হয়ে গেল।’
‘ওটাও নিশ্চয়ই গুণ্ডারা চুরি করেছে?’
‘তা আর বলছি কী? দারুণ উৎপাত করছে গুণ্ডারা এখন।’
এরপর আরো কয়েকটা চুরি-ছিনতাই ও একটি ডাকাতির কথা বলল ফুফু। কিন্তু কোনোটাতেই আকৃষ্ট হতে পারল না কিশোর গোয়েন্দা বিপ্লব খান। মনে মনে বলল, ‘ধুর! এসব কোনো ব্যাপার হলো? এ তো এখন সারা দেশেই হচ্ছে। অহরহ হচ্ছে। দেশটার যে কী হলো!’
অনেকক্ষণ ধরেই বিষয়টা চেপে রেখেছিল আবিদ। এবার আর চেপে রাখতে না পেরে বলেই ফেলল, অনেকটা বিপ্লবের কানে কানে বলার মতো, ‘এই বিপু, ক্ষিধে লেগেছে তো!’
কথাটা বোধ হয় একটু জোরেই বলা হয়ে গিয়েছিল। ফুফুও শুনতে পেল আবিদের এই কথা। বলল, ‘এই দেখ, কথা বলতে বলতে আমি তো আসল কথাটাই ভুলে গেছি।’ তারপর সুমির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘এই সুমি, মা যা তো, দুটো প্লেট ধুয়ে নিয়ে আয়। বিপু, ওকে নিয়ে হাত-মুখ ধুয়ে আয়। খেতে খেতে অন্য আলাপ করা যাবে।’
এক মিনিটের মধ্যেই ঘরটা খালি হয়ে গেল।
দশ মিনিট পর খেতে বসল ওরা। রান্নাঘরে পিঁড়ির ওপর বসেছে। ফুফু ভাত বেড়ে দিচ্ছে।
খেয়েই চলল ওরা।
‘কত দিন থাকবে বিপু ভাইয়া তোমরা?’ সুমির জিজ্ঞাসা।
‘দেখি কতদিন থাকতে পারি।’ সামান্য হেসে জবাব দিল বিপ্লব।
বিকালবেলা বেড়াতে বের হলো ওরা। বাড়ি থেকে সামান্য দূরে একটা নদী- নাম, কপোতাক্ষ। তার পাড়েই বসল ওরা। অবশ্যই সুমি আছে তাদের সাথে।
ডানপাশে দক্ষিণে একটা বাংলো এবং বামপাশে একটা স্কুল। যে জায়গাটায় বাংলোটা রয়েছে, সে জায়গাটা একটু উঁচু। ওখানে বসেই নদীর স্বচ্ছ পানির দিকে তাকাল ওরা।
বিপ্লব শুনেছে, এ নদীর পানি কাচের মতো স্বচ্ছ। সবকিছুই পরিষ্কার দেখা যায়। পানি বেশি না, সেজন্য একটা সোনার আংটি পড়লেও ওপর থেকে সেটা দেখা যায়।
সুমি জানাল, ‘এ নদীতে এক সময় জাহাজ চলত। এখন আর চলে না। তবে নৌকা চলাচল করে। আর এই বাংলোটা দেখছ, এটা নাকি ওই গুণ্ডাদের আস্তানা।’
‘পুলিশে জানে না?’ আবিদের প্রশ্ন।
‘জানে।’
‘তাহলে ধরে না কেন, ওদের?’
‘ধরতেই তো আসে। কিন্তু…’
‘কিন্তু কী?’
ভয়ে ভয়ে বাংলোটার দিকে তাকায় সুমি। বলে, ‘নদীর ধারে ঐ সিঁড়িটায় চলো। সব বলব।’
ওরা উঠে যায় নদীর কিনারে বাঁধানো সিঁড়িটাতে বসতে।
‘পুলিশ এসে কাউকেই পায় না।’ বলতে থাকে সুমি। ‘প্রথমে চারিদিক থেকে পুরো বাংলোটাই ঘিরে ফেলে ওরা, তারপর দরোজা দিয়ে ভেতরে ঢোকে। কিন্তু কাউকেই ভেতরে পাওয়া যায় না।’
‘ভূউত না-তো?’ আবিদ ভয়ে ভয়ে বাংলোর দিকে তাকাল।
‘কী জানি! হতেও পারে।’ বলল সুমি। ‘অনেকেই তাই বলে।’
‘কেল্লা ফতে!’ উঠে দাঁড়াল আবিদ। ‘আমি ভাই এখানে আর নেই। ভূতে আমার ভীষণ ভয়!’
বিপ্লব এতক্ষণ চুপ করে ছিল। এবার বলল, ‘পুলিশে খুঁজে পায় না। তার মানে..’ একটু জোরে বলল, ‘হাওয়া হয়ে যায় না তো?’
‘কী বললে?’ অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল আবিদ। যেন ওর কথা শুনতেই পায়নি।
‘না, মানে বলছিলাম…’ বলতে গিয়েও থেমে গেল গোয়েন্দা বিপ্লব। আবার বলল, ‘আচ্ছা, এই সুমি, বাইরে থেকে কিছু শোনা যায়? কেউ বলেছে তোমাকে?’
‘যায় তো। অনেকেই বলাবলি করে।’ সুমির জবাব। ‘কিন্তু কেন ভাইয়া?’
সে কথার সরাসরি কোনো জবাব না দিয়ে আবারও জিজ্ঞেস করে বিপ্লব। ‘কেউ ওদের কোনো কথা বুঝতে পারে?’
‘কিছু কিছু।’
‘তুমি কখনও শুনেছ?’
‘না, আব্বু এদিকে আসতেই দেয় না।’
‘হুঁ!’ নাক দিয়ে ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়ল আবিদ। ‘আচ্ছা, ওদের কথাবার্তা কোন্ সময় শোনা যায় বলতে পারবে?’
‘সন্ধ্যের দিকে।’
হাত ঘড়ি দেখল বিপ্লব। ছয়টা তিরিশ বাজে। আশপাশে তাকাল। হ্যাঁ, সন্ধ্যে হয়ে এসেছে। বলল, ‘এক কাজ করলে কেমন হয়?’ বলে অন্য দু’জনের দিকে তাকাল।
‘কী?’ আবিদের ভায়ার্ত কণ্ঠ।
‘সন্ধ্যে তো হয়ে এসেছে, ব্যাপারটা একবার পরীক্ষা করে দেখলে কেমন হয়?’
‘তার মানে, তুমি এখানে থেকে যেতে চাও?’ আবিদের চোখেমুখে স্পষ্ট ভয়ের ছাপ। ‘কিন্তু ফুফু না আমাদেরকে দ্রুত বাড়ি ফিরতে বলে দিয়েছেন!’
‘আমি বিপু ভাইয়া তোমার সাথে থাকতে চাই।’ সুমি সাহস দেখিয়ে বলল। বোঝা যাচ্ছে পিচ্চিটা বিপ্লবের বেশ ভক্ত হয়ে গেছে।
‘থ্যাংকিউ আপুমণি।’ বলে সুমির থুতনিতে আলতো করে হাত ছুঁয়ে আদর করল বিপ্লব। তারপর আবিদের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘অমন ভয় পেলে তো তুমি আমার সহকারী হতে পারবে না। মনে রাখবে, গোয়েন্দাগিরিতে রিস্ক একটু থাকেই। তাই বলে বসে থাকলে চলে না। রহস্যের যেহেতু একটা গন্ধ আমি পাচ্ছি, সেহেতু বিষয়টা একটু খতিয়ে দেখতেই হচ্ছে। তুমি না চাইলে থেকো না। বাড়িতে গিয়ে রেস্ট নাও। আমি বিষয়টা একটু দেখেই তবে বাড়ি ফিরব। আরে বাবা, মনে রাখবে, ভয় পেলে ভয়, ভয় না পেলে কিসের ভয়?’
এতে বোধ হয় একটু কাজ হলো। আর তাছাড়া গোয়েন্দা বিপু ভাইয়ার সহকারী হতেই তো ও এখানে এসেছে ওর সাথে। কাজেই পিছিয়ে যাওয়ারও কোনো উপায় নেই। বলল, ‘না মানে, আমি তো আছি তোমার সঙ্গেই। আসলে,… আচ্ছা ঠিক আছে, তুমি থাকতে আমার আবার কিসের ভয়?’
সুমি একদৃষ্টে তাকিয়ে ছিল আবিদের মুখের দিকে। এই মুহূর্তে আবিদের মুখের অবস্থাটা বেশ দেখার মতোই হয়েছে। অনেক চেষ্টা করেও আর হাসি থামিয়ে রাখতে পারল না। ফিক করে হেসে দিল। তবে দ্রুতই আবার নিজেকে সামলে নিলো। তারপর বলল, ওদেরকে আশ্বস্ত করে, বিশেষ করে আবিদকে, ‘কিচ্ছু ভেবো না তোমরা, আম্মুকে আমি ম্যানেজ করে নেব। বলব, তোমাদের নিয়ে আমার এক বান্ধবীর বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলাম।’
‘না সুমি, মিথ্যা কথা বলতে হবে না। আমরা বলব, ঘুরতে ঘুরতে সবাই ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম, তাই একটা রেস্টুরেন্টে বসে নাশতা সারতে গিয়ে দেরি হয়ে গেছে।’
‘কিন্তু সেটাও তো মিথ্যা কথা বলা হবে।’
‘উঁহু, আমরা সত্যি সত্যিই বাড়ি ফেরার সময় কোনো একটা রেস্টুরেন্ট বা ফাস্টফুডের দোকান থেকে কিছু কিনে খেতে খেতে যাব।’
‘তথাস্তু জাঁহাপনা।’ আত্মসমর্পণের ভঙ্গিতে বলল আবিদ।
সুতরাং, ওরা বসে অপেক্ষা করতে লাগল।
অন্ধকারের কালো চাদর এসে গ্রাস করল সমস্ত এলাকাটা। ধীরে ধীরে নিঃশব্দ নিস্তব্ধ হয়ে গেল পুরো চারপাশ। মাঝে মাঝে ঝিঁঝিঁ পোকার একঘেয়েমি ডাক। ঘেউ ঘেউ কুকুরের চিল্লানি।
তিন জোড়া চোখ বাংলোটার দিকে।
ওরা যে জায়গাটায় বসেছে সেখান থেকে বাংলোর দরোজাটা দেখা যায়।
‘এতো অন্ধকার! ওরা আসলে বুঝব কেমন করে?’ আবিদ বলল এক সময়।
‘জানি নাহ্!’ চাপা নিঃশ্বাস ছাড়ার মতো শব্দ করল বিপ্লব। ‘তবে আসলে অবশ্যই বোঝা যাবে।’
এমন সময় নদীর পানিতে একটা শব্দ হলো। লাফিয়ে উঠল আবিদ ও সুমি প্রায়- ‘কী-কিসের শব্দ?’
নদীতে শব্দ হতেই থাকল- ছল-ছল-ছলাৎ-ছল… ছল-ছল-ছলাৎ-ছল… ।
আস্তে আস্তে শব্দটা কাছিয়ে আসছে।
তিনজোড়া চোখই এখন নদীর পানির দিকে। কিছু দূরে এক টুকরো আলো দেখা যাচ্ছে।
পাঁচ.
‘কুইক।’ বলেই নদীর ঘাটের সিঁড়ির পিছনে লুকালো বিপ্লব। তাকে দেখাদেখি অন্য দু’জনও।
‘ঝপ! ঝপ!’ ওদের থেকে প্রায় বিশ ফুট দূরে শব্দটা চলে এসেছে।
‘নৌকা!’ বলল আবিদ। গলার স্বর খাদে নামিয়ে ফেলেছে।
তীরে ভিড়ল ছোট্ট নৌকাটা। তাতে একটা গোল আলো- বুঝি ছোট কোনো হারিকেন জ্বলছে। দূর থেকে ওটার আলোই চোখে পড়ছিল।
নৌকার ওপরে তিনজন দাঁড়িয়ে- অনুমান করল বিপ্লব। এতো আবছা আলো যে লোক তিনজনকে তিনটি ছায়ার মতো মনে হচ্ছে।
হারিকেনটা (আলোটা) হাতে নিলো একজন। তীরে নামল সে-ই আগে। অন্য দু’জন নামল তারপর। এগিয়ে চলল বাংলোর দিকে।
ছেলেমেয়েদের দেখল না ওরা। কেননা, ওরা সিঁড়ির আড়ালে লুকিয়ে আছে। আর বিপ্লব তো জানেই আলো থেকে অন্ধকারে কিছুই দেখা যায় না। কিন্তু অন্ধকার থেকে আলোতে তাকালে ঠিকই সব চোখে পড়ে।
এই মুহূর্তে তিনজোড়া চোখ আগন্তুক তিনজনের দিকে আবদ্ধ। শ্বাস নিতেও যেন ভুলে গেছে ওরা। রুদ্ধশ্বাস অপেক্ষা করছে এরপর কী হয় তা দেখার জন্য।
বাংলোটার প্রায় সামনে চলে এসেছে ওরা।
গা ঘেঁষাঘেঁষি করে দাঁড়িয়ে আছে গোয়েন্দারা। বিপ্লবের কাঁধের ওপর তো সুমির গরম নিঃশ্বাস পড়ছে। ওর মনে হচ্ছে কাঁধটা বুঝি পুড়েই যায়। কিন্তু কিছুই বলছে না। পাছে তীরে এসে তরী ডোবে।
ক্লিক করে দরজার তালা খোলার শব্দ হলো। এবার সত্যিই বুঝি দম বন্ধ করে ফেলল ছেলেমেয়েরা।
আগন্তুকরা ঢুকল ভেতরে। আবার দরজা বন্ধ হওয়ার শব্দ হলো।
একে অন্যের দিকে তাকাল ছেলেমেয়েরা।
‘কুইক! জলদি এসো।’ বলে নিঃশব্দে হামাগুড়ি দেওয়ার মতো করে এগিয়ে চলল বিপ্লব।
যেতে ইচ্ছে করছে না আবিদের। রাজ্যের ভয় এসে ভিড় করছে সমস্ত শরীরে।
সুমি অবশ্য অত ভয়-টয়ের মধ্যে গেল না। মোটামুটি সাহসী মেয়ে হিসেবে অনেকের কাছে পরিচিতি পেয়েছে ও। তার মুখ উঁচু করে মোটামুটি শব্দ করে একটা শ্বাস ফেলে এগিয়ে চলল বিপ্লবের পেছনে।
কী আর করবে আবিদ! এই নির্জনে একা একা মশার কামড় খাওয়ার চেয়ে বরং ওদের সঙ্গে গেলেই ভালো। আর তাছাড়া এসেছেই তো গোয়েন্দাগিরি করতে। কিশোর গোয়েন্দা বিপ্লব খানের সহকারী হিসেবে কাজ করতে। বন্ধু মহলে তো বিপ্লবের সহকারী হতে রীতিমতো হুড়োহুড়ি পড়ে যায়। সবাইকে তো আর বিপু ভাইয়া সহকারী বানায়ও না। এখন যেহেতু ওর ভাগ্যে বিষয়টা জুটে গেছে, তখন আর কিসের পিছুটান! ‘ফোঁস’ করে লম্বা একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। পরক্ষণই দু’হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরল। এই বুঝি ওর নিঃশ্বাসের শব্দে বেরিয়ে এলো লোক তিনজন। আর ওকে পাজাকোলা করে নিয়ে গেল ভেতরে। তারপর…। আর ভাবতে চাইল না ও।
নদীর দিক থেকে ঝিরি ঝিরি বাতাস বয়ে আসছে। বেশ ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা লাগছে। শরীর জুড়িয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এখন ওসব উপভোগ করার সময় না।
প্রায় নিঃশব্দে বিপু ভাইয়া ও সুমিকে অনুসরণ করল ও।
মোটামুটি নিঃশব্দেই যাওয়ার চেষ্টা করছে ওরা। বিপ্লব ঠোঁটে আঙুল চেপে শব্দ না করতে ইশারা করেছে। তাই সাবধানেই এগোচ্ছে ওরা। কিন্তু কতক্ষণ আর এভাবে চলা যায়! বিশেষ করে এ কাজে বিপ্লব ছাড়া তো আর কেউই অভিজ্ঞ না। তাই যা হবার তা হয়েই গেল।
আবিদের পায়ের নিচে শুকনো ডালপাতা ভাঙার শব্দ হলো।
‘শ্ শ্ শ্…’ আবার ঠোঁটে আঙুল চেপে সাবধান করল বিপ্লব।
এগিয়ে চলেছে ওরা।
আর একটু সামনেই বাংলোটা। নিঃশ্বাস ভারী হয়ে এসেছে তিনজনেরই।
বাংলোর কাছে চলে এসেছে ওরা।
বিপ্লব উঠে গেল আগে, তারপর সুমি। আবিদ ভুলেই গিয়েছিল যে বাংলোটা একটা উঁচু জায়গায় অবস্থিত। তাই সে পা দিয়েই প্রচণ্ড একটা হোঁচট খেল। টাল সামলাতে না পেরে পড়ে গেল। তারপর গড়াতে লাগল। গড়িয়ে যেতে লাগল নদীর দিকে। ভাঙতে লাগল শুকনো ডালপাতা।
নিজেকে সামলানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে আবিদ। কিন্তু আশপাশে তেমন কিছু না থাকায় আর নিজেকে সামলাতে পারল না। না, কোনো কিছু ধরে নিজের পতন ঠেকাতে পারল না।
বিপ্লব দম বন্ধ করে অপেক্ষা করল পানিতে আবিদের পতনের শব্দ শোনার জন্য। কিন্তু না, পানিতে পড়ার ‘ঝপাং’ শব্দ শোনার পরিবর্তে ওকে অবাক করে দেওয়ার মতো ঘটনা ঘটল। বিপ্লবের পেছনে বাংলোর দরোজাটা খুলে গেছে। তীব্র ‘ক্যাঁ-অ্যা-অ্যা-চ’ শব্দে চমকে উঠল। ঝট্ করে বিপ্লবের মাথা ঘুরে গেল সেদিকে। দেখল, হারিকেন হাতে একজন লোক বেরিয়ে এসেছে। হারিকেনের আলো লোকটার মুখে পড়ার দরুন বিপ্লব তার চেহারা দেখতে পেল মোটামুটি- গোলগাল মুখ, চাপা ও বোঁচা নাক, ইঁদুরের চোখের মত কুতকুতে দুই চোখ। চোখের ওপর পুরু ভ্রƒ-জোড়া। মাথায় ছোট হালকা লাল চুল, গায়ে বাদামি কোট। ব্যাস, এই। বাকিটা আলোর নিচে থাকায় স্পষ্ট হলো না।
‘কী চাও এখানে?’ কাটা কাটা বাংলায় বলল লোকটা। কেমন ধমকের সুর তাতে।
‘ইয়ে মানে…’ বিপু ভাইয়ার মুখে কথা জোগালো না। খুবই অবাক হয়েছে ও। এমনটি হবে তা মোটেও আশা করেনি। তার মানে আরেকটু সতর্ক হওয়া উচিত ছিল। বিশেষ করে আবিদ এই লাইনে নতুন। ওকে নিয়ে আরেকটু সাবধান হতে হবে এর পর থেকে।
সুমিটাকে নিয়ে তত সমস্যা নেই। ও তো ভাইয়ার গোয়েন্দাগিরি সম্পর্কে আগেই জানে। ভাইয়ার মুখে শুনে শুনে কখন কী করতে হবে তা প্রায় মুখস্থ হয়ে গেছে।
‘কী হলো, কথা বলছো না কেন?’ সন্তোষজনক কোনো জবাব না পেয়ে আবার জিজ্ঞেস করল লোকটা।
‘আ-আমরা সামনে…’ আবারও কথা জোগালো না বিপ্লবের মুখে। তোতলাতে লাগল। কিন্তু কেন এমন হচ্ছে তা বুঝতে পারল না। এমনটা সাধারণত হয় না ওর। এর চেয়েও তো অনেক কঠিন অবস্থার মুখোমুখি ও হয়েছে। সবসময়ই বুকে সাহস নিয়ে সবকিছু সামলেছে। বুকের মাঝে কখনও কখনও সামান্য ভয়ের দোলা লাগলেও তা মুহূর্তেই উবে গেছে কর্পূরের মতো।
‘আমরা আপনাদেরকে ফলো করছিলাম।’ ফোঁস করে বলে ফেলল সুমি।
বিপুর পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল সুমি। কথা ফাঁস হয়ে যাচ্ছে দেখে বিপ্লব তার হাতে দু’আঙুল দিয়ে চিমটি কেটে চুপ করতে বলল। ‘আঁউ!’ করে গুঙিয়ে উঠল সুমি।
কিন্তু যা হবার তা তো হয়েই গেছে। আসল কথাটাই বলে দিয়েছে সে। এখন উপায়?
দ্রুত কাজ করে চলেছে বিপ্লবের মগজ। পুরো সাহস ফিরে এসেছে বুকে। এরকম পরিস্থিতি ও খুব ভালো করেই সামাল দিতে পারে।
লোকটা কি সত্যি সত্যি বিশ্বাস করেছে সুমির কথা? করে থাকলে তো সমস্যা। আবার ভাবল, কিসের সমস্যা? ওদেরকে তো যে কেউই ফলো করতে পারে। বিশেষ করে অমন নিঃশব্দে বাংলোটাতে যখন ঢুকেছে, সেই বাংলোতে যেখানে দিনের বেলাতেও কেউ সহসা যেতে চায় না। কী বলবে ও লোকটাকে? কী বলে পরিস্থিতি সামাল দেবে?
কিন্তু ও কিছু বলার আগেই লোকটা মুখ খুলল আবার। ‘তোমার কী হয়েছে খুকি?’ সুমিকে জিজ্ঞেস করল সে। [চলবে]