আস্সালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ। কিশোরকণ্ঠের সুপ্রিয় বন্ধুরা সবাইকে জানাই শুভেচ্ছা। তোমাদের সামনে আজ আমার দেখা কিছু মজাদার গল্প বলবো। আশা করি তোমাদেরও ভালো লাগবে।
মনে হয় এইতো সেদিন, হাত বাড়ালেই যেন ধরা যায়। তখন এইচএসসি পরীক্ষার্থী, নাকে-মুখে পড়ছি। থাকি নানার বাড়িতে লজিং। এমনটা কেউ কখনো শুনেছো? যদিও লজিং বললাম, আসলে পালিয়ে থাকা। নানা কিশোর মণিরা ভেবো না, কোন কেইস-ফেইস ছিল কি না? আসলে সে সময় প্রচুর ছেলেপেলে আমায় খুঁজতো। কিশোর-তরুণদের একটি সংস্থার দায়িত্বে ছিলামতো তাই।
তো পালালাম নানা বাড়িতে। যদিও দুষ্টমি করে লজিং বললাম কিন্তু কাউকে পড়াতে হয় না। ছোট মামাতো ভাইবোনেরা সবাই এমনিতেই বেশ ভালো ছাত্র। তিন বেলা নানু-মামীর হাতে মজাদার খাবার খাই। এছাড়া সকাল-সন্ধ্যা মুড়ি-চা পর্বতো বোনাস। পূর্ব-বারান্দার ঘর, পুরোটাই আমার দখলে। পূর্ব পাশেই বিশাল পুকুর। চতুর্পাশটা দেখে কবির কণ্ঠে বলতে ইচ্ছে করে;
আমগাছ, জামগাছ বাঁশঝাড় যেন
মিলেমিশে আছে ওরা আত্মীয় হেন।
বিশাল দৈত্যের মতো কলাপতি (কলাবতী), সাহেব বাবুসহ হরেক রকম আম গাছের সারি। কাঠফাটা দুপুরে আমরা দস্যি ছেলেরা যখন পুকুর পাড়ে হামলে পড়া সাহেব বাবু গাছের মগডালে উঠতাম। অতঃপর সেখান থেকে বোমারু বিমানের মতো ড্রাইভ দিয়ে পুকুরের গহিন পানিতে গিয়ে পড়তাম। এখনতো মনে হয় আমাদের সে সব ড্রাইভ দেখলে ৬৫টি গোল্ড মেডেল পাওয়া সর্বকালের শ্রেষ্ঠ সাঁতারু মাইকেল ফেল্পসও ভিরমি খেতেন। সে সব গাছ থেকে সারারাত ডুভ ডুভ করে ডুভ ডুভ শব্দে আম পড়তো। পূর্ব পাড়ে বিশাল বাঁশঝাড়, বাতাসের দাপটে তাতে কেড়ৎ কেড়ৎ আওয়াজ উঠতো। এছাড়া ব্যাঙের বেসুরো আর নিশি-পাখির সুরেলা কণ্ঠ সব শুনে বিদ্বজনেরা নিশ্চয়ই বলতেন, দুইশত বছর আগের মোজার্টের ৪১ সিম্ফনির সবগুলো যেন এক হয়ে সুর তুলতো সেই ভর দুপুর-রাতের পুকুর ঘাটলায়।
মজার লজিং। যেহেতু পড়ানোর কোন ঝামেলা নেই। শুধু নিজের পরীক্ষার প্রস্তুতি আর হরেক পদের খাওয়া আর খাওয়া। কথায় আছে না ‘নাই কাজ তো খই ভাজ’। সুতরাং ব্রেইনের নিউরন সেলের মহাসাগরে কিছু টাইফুন ঝড় উঠলো। তিনটি প্রজেক্ট হাতে নিলাম।
এক. স্ব-উদ্ভাবিত গল্প সিরিয়াল
দুই. ছোটদের নামাজ প্রতিযোগিতা
এবং
তিন. সিনিয়রদের নামাজে আনতে মসজিদ কমিটির পক্ষ থেকে ব্যাডমিন্টন প্রতিযোগিতা।
ছোটদের নামাজ প্রতিযোগিতা নিয়েই সবচেয়ে মজা হয়েছিল। ছোট মামা অনেক মজাদার বিজনেস প্রজেক্ট করেছিলেন। মনে হয় না কোনটাতে সফল হয়েছিলেন। একটি ছিল আটা-চাল ভাঙানোর মেশিন। ছয় মাসের মাথায় সেটি বন্ধ হয়ে যায়। এরপর শুরু হয় সেখানে নামাজের আয়োজন। অতঃপর সেখান থেকে বর্তমান স্থলে স্থানান্তর। সবই ক্ষুদে মুসল্লিদের উদ্যোগে। সে সময় উজ্জ্বলের খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। পরে তার নাম রাখা হয়েছিল মুজাহিদুল ইসলাম। খালিদ, রাজিব, সুনু, সনেট, নবীনুর, সুমন, পাভলু, সাহেল আরো অনেকেই ছিল প্রতিযোগী। সনেট আল্লাহর দরবারে মেহমান হলেও বাকিরা দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে আছে। প্রতিদিন পাঁচ ওয়াক্তের দায়িত্ব একজনকে দেয়া হতো। সে বাড়ি বাড়ি গিয়ে ডেকে ডেকে প্রতি ওয়াক্তে ৪০, ৫০, ৬০ জন মুসল্লি হাজির করতো। একটি খাতায় সংখ্যাটি সুন্দর করে নোট রাখা হতো। কেউ কেউ ৮০-৯০ মুসল্লিও জোগাড় করে ফেলতো তখন মুসল্লির সারি মসজিদ ছাড়িয়ে নিচে বাঁশঝাড় পর্যন্ত চলে যেত। কী এক জান্নাতি প্রতিযোগিতা? মসজিদের বাইরে ঢালু জমিনে রুকু-সেজদা করতে গিয়ে কেউ কেউ পড়ে যায় যায় অবস্থা। তবু যেন সবার মুখে অনাবিল আনন্দের ফোয়ারা বইতো। সপ্তাহ শেষে কোন এক জুমাবারে তৎকালীন ইসলামিক ফাউন্ডেশনের উপ-পরিচালক আবুল কাশেম সাহেব আসতেন। সেই কিশোর বিজয়ীদের হাতে কিছু মজাদার ইসলামী বই উপহার হিসেবে তুলে দিতেন।
এই সেদিন একটি জাতীয় দৈনিকে এরকম একটি মজাদার খবর দেখে চমকে যাই। ভারতের বেঙ্গালুরুর একটি মসজিদ-কর্তৃপক্ষ বাচ্চাদের জামাতে নামাজ আদায়ে উৎসাহিত করতে অভিনব উদ্যোগ নিয়েছে। যারা ৪০ দিন ফজরের নামাজ জামাতে পড়েছে, উদ্যোগ ও প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী তাদের প্রত্যেককে একটি করে নতুন সাইকেল উপহার দেয়া হয়েছে।
প্রায় দুই মাস আগে মসজিদটির কর্তৃপক্ষ এ রকম সিদ্ধান্ত নেয়। তাদের এই উদ্যোগ স্থানীয় শিশু-কিশোরদের মাঝে দারুণ সাড়া ফেলে। তারা ফজরের নামাজ নিয়মিত জামাতে পড়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে ওঠে। ফলে নির্ধারিত দিন শেষে ৯৯ জন শিশু-কিশোরকে নতুন সাইকেল উপহার দেয়া হয়।
চমৎকার উদ্যোগ নেয়া মসজিদটির নাম হাজী স্যার ইসমাইল সাইত মসজিদ। মজার বিষয় হল, অন্যান্য স্থানীয় মসজিদে এমন উদ্যোগ নিয়ে মসজিদ-কর্তৃপক্ষের সাফল্যের কথা শুনে মসজিদ-কমিটি উদ্যোগটিতে স্পনসর করেছিল। প্রথম পর্বে ২০০ শিশু-কিশোর নিবন্ধিত হয়েছিল। তাদের মধ্যে ৯৯ জন টানা ৪০ দিন ফজরের নামাজ জামাতে আদায়ে সক্ষম হয়। ফলে তারা সাইকেল উপহার লাভ করে। আর যারা নিয়মিত ৪০ দিন ফজর জামাতে আদায় করতে পারেনি, তাদের হাত ঘড়ি উপহার দেয়া হয়।
বেঙ্গালুরুর এই মসজিদটিই এই প্রথম এমন উদ্যোগ নিয়েছে, তা নয়। বরং এই বছর কয়েক মাস আগে বাংলাদেশের চাঁদপুরের একটি মসজিদের এমন উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। এছাড়া ২০১৮ সালের মে মাসে মালয়েশিয়ার ক্যালানতানের একটি মসজিদ পবিত্র রমজান মাসে শিশুদের জন্য বিনামূল্যে বাইক উপহার দিয়েছিল।
এর আগে ২০১৮ সালের জুলাইতে তুরস্কের কোন্যা পৌরসভা-কর্তৃপক্ষ মসজিদে আসুন এবং আনন্দ করুন প্রকল্প চালু করে। এতে ১৪ বছর বয়সী শিশুদের টানা ৪০ দিন ফজরের নামাজ আদায়ে উৎসাহ দিয়ে এমন উদ্যোগ নিয়েছিল। ২০১৮ সালে মিশরের আল-বাহিরা প্রদেশের একটি মসজিদ শিশুদের ফজরের নামাজে শরিক হতে উৎসাহিত করে একটি প্রতিযোগিতার ঘোষণা করেছিল। প্রতিযোগিতা শেষে যারা টানা ৪০ দিন মসজিদে নামাজ পড়তে পেরেছিল, তাদের প্রতিশ্রুত উপহার দিয়েছিল।
মূলত এমন প্রতিযোগিতা-উদ্যোগের ধারণাটি প্রথম আসে ইস্তাম্বুলের একটি মসজিদ-কর্তৃপক্ষের। ইস্তাম্বুলের ফাতিহ জেলার সুলতান সেলিম মসজিদ-কর্তৃপক্ষই ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রথম এ ধরনের উদ্যোগ নিয়েছিল। তারা টানা ৪০ দিন ফজরের নামাজে অংশ নেয়া বাচ্চাদের সাইকেল ও বিভিন্ন সামগ্রী উপহার দিয়েছিল।
এ উদ্যোগের প্রায় ৩০ বছর আগে আমরা নামাজ প্রতিযোগিতা দিয়েছিলাম। শক্তিশালী স্পন্সরের অভাবে সেটি ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে পারেনি।
বাংলাদেশেও যদি পিএইচপি, আকিজ কিংবা ওয়ালটনের মতো বড় কোন শিল্পোদ্যোক্তা এগিয়ে আসেন তাহলে এখানেও মজাদার সেসব ঘটনা ঘটতে থাকবে, ইনশাআল্লাহ।