আমাদের ছোট গাঁয়ে ছোট ছোট ঘর
থাকি সেথা সবে মিলে নাহি কেহ পর
পাড়ার সকল ছেলে মোরা ভাই ভাই
এক সাথে খেলি আর পাঠশালে যাই
আহা কী মজার একটি কবিতা। কী আনন্দের একটি কবিতা। এ কবিতার পাঠক সংখ্যার কথা একবার ভাবা যাক! কত হবে সংখ্যাটি! কেউ কি মিলাতে পারেন এর যোগফলটি। উত্তর হবে- না। হাজার হাজার নয়। বরং লক্ষ লক্ষ। যারা বাংলা ভাষায় শিক্ষিত হন- স্কুলে যান- তাদের সকলেই পাঠ করেন এই কবিতাটি। কবিতাটি লিখেছেন কবি বন্দে আলী মিয়া।
এই কবিতার মধ্যে আমাদের প্রিয় বাংলাদেশের সমস্ত গ্রামের ছবি আঁকা। শিল্পীরা ছবি আঁকেন রঙ দিয়ে। একজন কবিও আঁকেন ছবি। কিন্তু রঙ দিয়ে নয়। তিনি আঁকেন শব্দ দিয়ে। ভাষা দিয়ে। অথচ কবির শব্দের মধ্যেও রঙ থাকে। ছবি তো থাকেই। বন্দে আলী মিয়ার এই কবিতা দেখা যাক। তিনি লিখলেন- আমাদের ছোট গাঁয়ে ছোট ছোট ঘর-। লাইনটি পাঠ করার সাথে সাথে মনের চোখে ভেসে ওঠে গোটা বাংলাদেশের গ্রাম। যে যে গ্রামে জন্ম নিয়েছে। বেড়ে উঠেছে। এবং গ্রামের নদী নালায় সাঁতার কেটেছে। পাখি ধরার চেষ্টা করেছে। দোয়েল পাখির শিস শুনেছে। দেখেছে সবুজ বৃক্ষের ভেতর বাদামি অথবা এশ কালারের ঘর। তারা বোঝেন বন্দে আলী মিয়ার এই কবিতার ছোট ছোট ঘরের রূপ।
দ্বিতীয় লাইনটি- থাকি সেথা সবে মিলে নাহি কেহ পর। কী মায়াময় কবিতা। কী মিলমিশের কবিতা। গ্রামের সকলে মিলে এক সাথে থাকার আনন্দটি অন্যরকম। পাড়া মহল্লায় একই বয়সের অনেক ছেলে মেয়ে থাকে। তারা এক সাথে মিলে মিশে কাজ করে। খেলাধুলা করে। স্কুলেও যায় এক সাথে। কবি এ কথাটিই ভীষণ আনন্দের সাথে বলেছেন-
পাড়ার সকল ছেলে মোরা ভাই ভাই
একসাথে খেলি আর পাঠশালে যাই
এমন আন্তরিক কবিতা, ভালোবাসা এবং সবাই মিলে বসবাসের কবিতা খুব কমই আছে। গ্রামের প্রতি গ্রামের দৃশ্যের প্রতি কবির মমতা কতটা বোঝা যায়। কিন্তু কবি এখানে থেমে যাননি। তিনি গ্রামের প্রতি ভালোবাসার চূড়ান্ত কথা বললেন-
আমাদের ছোট গ্রাম মায়ের সমান
আলো দিয়ে বায়ু দিয়ে বাঁচাইছে প্রাণ
কী অদ্ভুত উচ্চারণ করলেন তিনি- গ্রামটি যেই সেই জিনিসের সাথে তুলনীয় নয়। স্বয়ং মায়ের সাথে তুলনা করা যায়। তিনি তাই করলেন। লিখলেন- ছোট গ্রামটি আমার মায়ের সমান। মায়ের মতো। আলো বাতাস দিয়ে এই গ্রামেই আমরা বসবাস করি। এভাবে বন্দে আলী মিয়া আমাদের প্রকৃতির ছবি এঁকেছেন তাঁর কবিতায়। লিখেছেন-
মাঠ ভরা ধান তার জল ভরা দীঘি
চাঁদের কিরণ লেগে করে ঝিকিমিকি
দিগন্ত জোড়া ধানের মাঠ আমরা দেখি। দেখি ধানের ক্ষেত ঢলে পড়া বাতাসের ঢেউ। ধান পেকে গেলে সোনারঙ ছবি দুলতে থাকে ধানের মাঠে- আহা! দীঘির জলে চাঁদের আলো ঝিকমিকিয়ে ওঠে। সেই ঝিকমিকানো আলোর উৎসব দেখে আমরা আনন্দ পাই। সেই আনন্দ-ছবির কথাই লিখে দিলেন বন্দে আলী মিয়া।
বন্দে আলী মিয়া জন্মেছেন পাবনা জেলার রাধা নগর গ্রামে। ১৯০৬ সালের ১৭ জানুয়ারি। তাঁর গ্রামটি ছিলো একেবারে সাধারণ গ্রাম। ঝোপঝাড়ে ভরা সবুজ বৃক্ষের গলাগলি ছিলো অবিরত। ছিলো লতাপাতায় ঘেরা ছায়ার গ্রাম। এমন গ্রামে বেড়ে উঠেছেন বন্দে আলী মিয়া। তাঁর পরিবার তেমন সচ্ছল ছিলো না। অর্থাৎ টাকা পয়সা কমই ছিলো। তাঁর পিতা মুন্সি উমেদ আলীর ছিলো খুব কম বেতনের চাকরি। পাবনা জজ কোর্টের একজন নিম্ন পদের কর্মচারী ছিলেন তিনি। যে কারণে আর্থিক টানাপড়েন লেগেই ছিলো তাদের সংসারে।
বন্দে আলী মিয়া পাবনা মজুমদার একাডেমিতে লেখাপড়া করেন। ১৯২৩-এ তিনি এসএসসি (মেট্রিকুলেশন) পাস করেন। তারপর কলকাতা আর্ট একাডেমিতে ভর্তি হন। প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হন এই আর্ট একাডেমিতে। কিন্তু অর্থনৈতিক দিক থেকে তার সমস্যা থাকায় আয় রোজগারের পথ খোঁজেন তিনি। ১৯২৫ সালে ইসলাম দর্শন পত্রিকায় সাংবাদিক হিসেবে যোগ দেন। এরপর ১৯৩০ সালে কলকাতা কর্পোরেশন স্কুলে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত শিক্ষকতায় ছিলেন তিনি।
বন্দে আলী মিয়া একজন বিশিষ্ট কবি। কবিতায় তিনি ঢেলে দিয়েছেন তার হৃদয়ের সবটুকু ভালোবাসা। বাংলাদেশের গ্রামের সৌন্দর্য চিত্রিত করেছেন তিনি। গ্রামের প্রাকৃতিক নিবিড়তার বর্ণনা এবং সবুজের মনোরম দৃশ্যের মায়ার কথা লিখেছেন তাঁর কবিতায়। গ্রামের মানুষের সহজ সরল জীবন এবং জীবনের আনন্দ বেদনার কাহিনী নিয়ে লিখেছেন তিনি। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থের নাম ময়নামতির চর। এটি প্রকাশ পেয়েছে ১৯৩২ সালে। আরেকটি কাব্যগ্রন্থ- পদ্মানদীর চর। আরও একটি গ্রন্থের নামও চরের নামে- মধুমতির চর। এ দুটি বই প্রকাশ পেয়েছে একই সালে-১৯৫৩। তাঁর কাব্যগ্রন্থ মোট ৬টি। বাকি ৩টির নাম- অনুরাগ-১৯৩২, অনুরাগ-১৯৩২, ধরিত্রী-১৯৭৫। ৬টি গ্রন্থের ৩টিই চরের নামে। এতে বোঝা যায় বাংলাদেশের গ্রাম এবং গ্রামের মানুষও প্রকৃতি তাকে কিভাবে জড়িয়ে রেখেছিলো।
তিনি ঔপন্যাসিক হিসেবেও বেশ পরিচিত। শিশুসাহিত্যিক হিসেবে আছে তাঁর খ্যাতি। কিশোর কবিতায় বন্দে আলী মিয়া এক অনন্য নাম। বন্দে আলী মিয়ার কবি খ্যাতি মূলত কিশোর কবিতাতেই। এ ছাড়া তিনি ছিলেন চিত্রকর। তাঁর প্রকাশিত উপন্যাস হলো- অরণ্য, গোধূলী, ঝড়ের সংকেত, নীড় ভ্রষ্ট, জীবনের দিনগুলো, বসন্ত জাগ্রত দ্বারে, শেষ লগ্ন, অরণ্য গোধূলী।
প্রকাশিত শিশুতোষ গ্রন্থের নাম- চোর জামাই, মেঘকুমারী, মৃগপরী, বোকা জামাই, কামাল আতাতুর্ক, ডাইনী বউ, রূপকথা, কুচবরণ কন্যা, ছোটদের নজরুল, শিয়াল পণ্ডিতের পাঠশালা, বাঘের ঘরে ঘোগের বাসা, সাত রাজ্যের গল্প, হাদিসের গল্প।
তাঁর জীবনের একটি বিশেষ দিক হলো তিনি আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের সান্নিধ্য পেয়েছিলেন। তাঁর জীবনের বৈশিষ্ট্য দেখার সুযোগ হয়েছিলো তার। নজরুলের প্রাণ খোলা হাসি উল্লাসে আন্দোলিত হয়েছিলেন তিনি। যার কারণে নজরুলকে নিয়ে লিখেছেন বই- ছোটদের নজরুল।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাথেও বন্দে আলী মিয়ার জানাশোনা ছিলো। রবীন্দ্রনাথের আধ্যাত্মিক দৃষ্টিভঙ্গির অনুরাগী বন্দে আলী মিয়া।
তিনি বিভিন্ন গ্রামোফোন কোম্পানিতে পালা গান রচনা করতেন। লিখতেন নাটিকা। এগুলোর রেকর্ড কলকাতার বাজারে বেশ জনপ্রিয় ছিল। ১৯৬৪ সালের দিকে তিনি কাজ করেন ঢাকা বেতারে। পরে রাজশাহী বেতারে চাকরি করেন।
শিশু-সাহিত্যে বিশেষ অবদানের জন্য তিনি ১৯৬২ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার পান। ১৯৬৫ সালে পান প্রেসিডেন্ট পুরস্কার। মরণোত্তর একুশে পদক লাভ করেন তিনি। ১৯৭৯ সালে ২৭ জুন পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নেন এ কবি।