Home খেলার চমক বেন স্টোকস সেরা অলরাউন্ডার আবু আবদুল্লাহ

বেন স্টোকস সেরা অলরাউন্ডার আবু আবদুল্লাহ

কলকাতার ইডেন গার্ডেন্সে ২০১৬ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ফাইনালের কথা। শেষ ওভারে ওয়েস্ট ইন্ডিজের জয়ের জন্য দরকার ১৯ রান। ইংলিশ অধিনায়ক বল তুলে দিলেন পেস বোলিং অলরাউন্ডার বেন স্টোকসের হাতে। আগে দুই ওভার মোটামুটি ভালোই বোলিং করেছেন স্টোকস। তা ছাড়া শেষ ওভারে স্ট্রাইকিং প্রান্তে ওয়েস্ট ইন্ডিজের ৮ নম্বরে ব্যাট করতে নামা বোলার কার্লোস ব্রাথওয়েট। ম্যাচ তাই পুরোপুরিই ইংল্যান্ডের দিকে হেলে আছে; কিন্তু ভাগ্য সেদিন হেলে ছিল ওয়েস্ট ইন্ডিজের দিকেই। তাই তো স্টোকসের চার বলে পরপর চারটি ছক্কা হাঁকিয়ে অসাধ্য সাধন করেন ব্রাথওয়েট। চ্যাম্পিয়ন হয় ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ভিলেনে পরিণত হন বেন স্টোকস।
এই ঘটনার ঠিক ৩ বছর ৩ মাস ১১ দিন পর ইংল্যান্ড আরেকটি বিশ্বকাপ ফাইনাল খেলতে নামে লর্ডসে। সেটি ছিলো ২০১৯ ওয়ানডে বিশ্বকাপের ফাইনাল। প্রতিপক্ষ নিউজিল্যান্ড। এবারো ইংল্যান্ডের ভাগ্য গড়ে দেওয়ার দায়িত্ব পড়ে বেন স্টোকসের কাঁধে। এবার ব্যাট হাতে অপরাজিত ৮৪ রানের দুর্দান্ত এক ইনিংস খেলেন তিনি। ২৪২ রানের টার্গেটে ব্যাট করতে নেমে ইংল্যান্ডও তোলে নিউজিল্যান্ডের সমান ২৪১ রান। পিছিয়ে থাকা ইংল্যান্ডকে শেষ ওভারে দুটি ছক্কা হাঁকিয়ে টেনে তোলেন স্টোকস। ম্যাচ টাই হলে নিষ্পত্তির জন্য খেলা হয় সুপার ওভার। সেখানেও ইংল্যান্ডের হয়ে ব্যাট করতে নামেন স্টোকস। নাটকীয় সেই ম্যাচে সুপার ওভারেও টাই হয়। উভয় দলই করে ১৫ রান করে। শেষ পর্যন্ত পুরো ম্যাচে বাউন্ডারি সংখ্যা বেশি হওয়ায় ইংল্যান্ড জেতে বিশ্বকাপ। সুপার ওভারেও ইংল্যান্ডের ১৫ রান তোলায় বড় ভূমিকা ছিলো স্টোকসের। অবশ্য ভাগ্যেরও কিছুটা সহায়তা ছিলো।
সে যাই হোক- ক্রিকেটের জন্মদাতা ইংল্যান্ড প্রথমবারের মতো জেতে বিশ্বকাপ ট্রফি। ম্যাচ সেরা হন বেন স্টোকস। ইংল্যান্ডবাসীর কাছে নায়ক হয়ে ওঠেন তরুণ বেন স্টোকস। এখানে একটি বিষয় মনে করিয়ে দেই, স্টোকস বিশ্বকাপ ফাইনালে যাদের বিরুদ্ধে এমন দুর্দান্ত পারফরম্যান্স দেখিয়ে ইংল্যান্ডকে বিশ্বকাপ এনে দিয়েছেন, সেই নিউজিল্যান্ডই কিন্তু তার জন্মভূমি। ১৯৯১ সালে নিউজিল্যান্ডের ক্রাইস্টচার্চে জন্ম তার। পুরো নাম বেনজামিন এন্ড্রু স্টোকস। তার বাবা ছিলেন নিউজিল্যান্ড জাতীয় দলের রাগবি খেলোয়াড়। স্টোকসের বয়স যখন ১২ বছর, সে সময় তার পরিবার ইংল্যান্ডে অভিবাসী হয়। শৈশবে বাবার কাছে রাগবি শিখলেও পরবর্তীতে ক্রিকেটকেই বেছে নেন স্টোকস। বাম হাতে ব্যাটিং করার পাশাপাশি ডান হাতে মিডিয়াম পেস বোলিংয়ে শৈশব থেকেই দক্ষতার পরিচয় দেন তিনি।
যার ফলে ২০০৯ সালে কাউন্টি দল ডারহামের হয়ে পেশাদার ক্রিকেটে অভিষেক স্টোকসের। সেদিন বল করতে গিয়ে ব্যক্তিগত তৃতীয় বলেই উইকেট নেন স্টোকস। ওই বছরই ডাক পান ইংল্যান্ড অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপ দলে। যুব বিশ্বকাপে ভারতের বিপক্ষে করেন দুর্দান্ত এক সেঞ্চুরি। এরপর কাউন্টি ক্রিকেটেও ডারহামের হয়ে দারুণ খেলতে থাকেন। ২০১১ সালের আগস্টে ইংল্যান্ডের হয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলার স্বপ্ন পূরণ হয়। অভিষেক হয় আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে ওয়ানডে ম্যাচ দিয়ে। আর টেস্ট দলে ডাক পান ২০১৩-১৪ অ্যাশেজ সিরিজ দিয়ে। সেই সিরিজেই করেন ক্যারিয়ারের প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরি।
তবে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে প্রথম কয়েকটা বছর ভালো কাটেনি স্টোকসের। দলে আসা-যাওয়ার মধ্যেই ছিলেন। সেই সাথে জন্মও দিয়েছিলেন বেশ কিছু বিতর্কিত ঘটনার। তবে সে সব পিছনে ফেলে ২০১৭ সালটা ছিলো তার ক্যারিয়ারের টার্নিং পয়েন্ট। ওই বছর দেশের মাটিতে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে দুটি সেঞ্চুরি করেন অস্ট্রেলিয়া ও দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে। এরপর দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে টেস্ট সিরিজে ২৯৯ রান ও ৭ উইকেট নেন। কয়েক দিন পর ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজে ছিলেন আরো দুর্দান্ত। দুটি সেঞ্চুরির পাশাপাশি নেন ২ উইকেট। ওই বছর আইসিসির বর্ষসেরা টেস্ট ও ওয়ানডে দলে জায়গা করে নেন এই অলরাউন্ডার।
ওই বছরই আইপিএলে সবচেয়ে দামি ক্রিকেটার হয়ে হইচই ফেলে দেন ক্রিকেট বিশ্বে। ১৭ লাখ ইউরোতে (১৬ কোটি ৭২ লাখ টাকা) নিলাম থেকে তাকে কিনে নেয় রাইজিং পুনে সুপারজায়ান্ট। পরের বছরও তার দাম ওঠে ১৪ লাখ ইউরো। এরপর ক্রমশই বিশ্ব ক্রিকেটে নিজের অবস্থান শক্ত করেছেন স্টোকস। জ্যাক ক্যালিস ও আবদুর রাজ্জাকের পর বিশ্ব ক্রিকেটে অনেক দিন প্রতিভাবান পেস বোলিং অলরাউন্ডারের যে অভাব ছিলো তার দূর হয়েছে তার কল্যাণে। আর ইংল্যান্ড পেয়েছে ইয়ান বোথাম, এন্ড্রু ফ্লিনটফের যোগ্য উত্তরসূরি।
২০১৯ বিশ্বকাপে বিশ্ব দেখেছে বেন স্টোকসের সত্যিকারের অলরাউন্ড পারফরম্যান্স। উদ্বোধনী ম্যাচেই দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ব্যাট হাতে ৮৯ রানের ইনিংস খেলার পাশাপাশি নিয়েছেন ২ উইকেট। সেই ম্যাচে তার নেয়া আন্দিল ফেহলুকওয়ের ক্যাচটি সর্বকালের সেরা ক্যাচগুলোর একটি। এরপর শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে অপরাজিত ৮২ এবং অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে করেন ৮৯ রান। ভারতের বিপক্ষে ম্যাচটি ছিলো ইংল্যান্ডের বাঁচা-মরার লড়াই। জিতলে বেঁচে থাকবে সেমিফাইনালে যাওয়ার আশা, না জিততে পারলে বিদায় নিতে হবে টুর্নামেন্ট থেকে। সেই ম্যাচে ৫৪ বলে ৭৯ রানের ইনিংস খেলেন স্টোকস। আর ফাইনালে কী করেছেন সে কথা তো লেখার শুরুতেই বলেছি।
ইংল্যান্ডকে বিশ্বকাপ এনে দেওয়ার কিছুদিন পরই দেশের মাটিতে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে অ্যাশেজ সিরিজ খেলতে নামেন স্টোকস। সিরিজে ইংল্যান্ডের হয়ে দুই সেঞ্চুরিসহ ৪৪১ রান ও ৮ উইকেট নেন। তবে সেই সিরিজে হেডিংলিতে অতিমানবীয় এক ইনিংস খেলেন স্টোকস। নিশ্চিত পরাজয়ের দুয়ার থেকে ইংল্যান্ডকে জয় এনে দেন অপরাজিত ১৩৫ রানের ইনিংস খেলে। ২-২ এ সিরিজ ড্র করে ইংল্যান্ড। স্টোকসের সেই ইনিংসটি সর্বকালের সেরা টেস্ট ইনিংসের তালিকায় স্থান পেয়ে গেছে। প্রথম ইনিংসে মাত্র ৬৭ রানে অলআউট হয়ে যাওয়ার পরও ইংল্যান্ড জিতেছিল ম্যাচটি। প্রথম ইনিংসে ৭০ রানের কম করেও টেস্ট জেতার সর্বশেষ ঘটনা ছিলো ১৩১ বছর আগে। সেই স্মৃতিই ফিরিয়ে আনলেন স্টোকস। চতুর্থ ইনিংসে ৩৫৯ রান তাড়া করতে নেমে ইংল্যান্ডের নবম উইকেট পড়ে যায় ২৮৬ রানে। জয়ের জন্য তখনো দরকার ৭৩ রান। তার মধ্যে শেষ ব্যাটসম্যান জ্যাক লিচ করেছেন মাত্র ১ রান। আসলে পুরোটা সময় স্ট্রাইক ধরে রেখে যেভাবে ম্যাচ শেষ করেছেন স্টোকস, সেটিই তার ইনিংসটিকে নিয়ে গেছে সর্বকালের সেরা ইনিংসের কাতারে। প্রথম চার বলে চার-ছক্কা কিংবা দুই রান ছাড়া নেননি। পঞ্চম অথবা ষষ্ঠ বলে সিঙ্গেল নিয়ে প্রান্ত বদল করে পরের ওভারে আবার স্ট্রাইক নিয়েছেন।
অনবদ্য এসব পারফরম্যান্সের কারণে আইসিসির ২০১৯ সালের সেরা ক্রিকেটার নির্বাচিত হয়েছেন বেন স্টোকস। একই বছর বিবিসির বিচারে বছরের সেরা ক্রীড়া ব্যক্তিত্ব নির্বাচিত হয়েছেন। এ ছাড়া ক্রিকেটের বাইবেল খ্যাত উইজডেন ক্রিকেট ম্যাগাজিনের ‘ক্রিকেটার অব দ্য ইয়ার’ মনোনীত হয়েছেন।
২০২০ সালের শুরুতে দক্ষিণ আফ্রিকা সফরেও জাত চিনিয়েছেন স্টোকস। চার টেস্টের সিরিজে ৩১৮ রান করার পাশাপাশি নিয়েছেন ১০ উইকেট। এরপর করোনাভাইরাসের সংক্রমণে চার মাস বন্ধ থাকার পর ইংল্যান্ড-ওয়েস্ট ইন্ডিজ সিরিজ দিয়ে যখন ক্রিকেট মাঠে ফিরেছে তখনও বেন স্টোকস বুঝিয়ে দিয়েছেন এই চার মাসে এতটুকু ধুলাও জমেনি তার প্রতিভায়। সাউদাম্পটনে সিরিজের প্রথম টেস্টেই ১৫০ উইকেট ও ৪ হাজার রান করার মাইলফলক স্পর্শ করেন। আর ম্যানচেস্টারের ওল্ড ট্রাফোর্ডে দ্বিতীয় টেস্টে প্রথম ইনিংসে ১৭৬ রান করার পর দ্বিতীয় ইনিংসে করেন অপরাজিত ৭৮ রান। ৬৫ টেস্টের ক্যারিয়ারের দশম সেঞ্চুরি ছিল সেটি। বল হাতে নিয়েছেন ৩ উইকেট। তার এই অলরাউন্ড পারফরম্যান্সের কারণেই প্রথম টেস্ট হেরে গিয়েও সিরিজে সমতায় ফেরে ইংল্যান্ড।
একের পর এক কীর্তির কারণে অনেকেই বেন স্টোকসে সর্বকালের সেরা অলরাউন্ডার বলতে শুরু করেছেন। তবে সেটি না হলেও তিনি এই সময়ের সেরা অলরাউন্ডার সেটি বলতে আর কারো দ্বিধা থাকার কথা নয়। আইসিসি টেস্ট র‌্যাঙ্কিংয়ে অলরাউন্ডারদের মধ্যে এক নম্বরে আছেন। আর ওয়ানডেতে আছেন দ্বিতীয় অবস্থানে। ৬৫ টেস্ট পর্যন্ত ৩৯ গড়ে তার রান ৪৩৯৯, সেঞ্চুরি ১০টি। আর বল হাতে উইকেট ১৫৬টি। ৯৫ ওয়ানডেতে ৪১ গড়ে রান ২৬৮২, সেঞ্চুরি ৩টি, উইকেট নিয়েছেন ৭০টি। ২৬টি আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি খেলে ৩০৫ রানের পাশাপাশি উইকেট ১৪টি। বর্তমানে ২৯ বছর বয়সী এই অলরাউন্ডার হয়তো আরো অনেক দিন ক্রিকেটকে সমৃদ্ধ করবেন পারফরম্যান্স দিয়ে। সেই সাথে নিজেকে নিয়ে যাবেন নতুন উচ্চতায়।

SHARE

Leave a Reply