পাখি বিশারদ পাখাল ভাইকে ঘিরে আমাদের আড্ডা চলছিল স্কুল মাঠের ভেতর। রোজ বিকেলে এই স্কুল মাঠটাই আমাদের প্রাণের আনন্দের প্রধান উৎস। পাখাল ভাই তার ভুলভাল বিভিন্ন তথ্য দিয়ে রোজ আমাদের বোকা বানাবার চেষ্টা করেন। আমরা তার চালাকি সবই বুঝি। মুখে কিছু বলি না। শুধু শুনে যাই। পাখাল ভাই আমাদের সিনিয়র পারসন। তার ভুল ধরলে লজ্জিত হবেন। বড়ো ভাইদের লজ্জিত করা উচিত হবে না ভেবে চুপ করে থাকি। কিন্তু আজ রকি নীরব থাকতে পারল না। পাখাল ভাই পাখির খাদ্য সম্পর্কে বিশাল বক্তৃতা দিচ্ছিলেন- ‘পাখিই একমাত্র জীব যা সরাসরি মানুষের উপকার করে থাকে। বুঝলি?’
আমরা সবাই একত্রে হ্যাঁ-সূচক মাথা নেড়ে বলি- ‘বুঝলাম।’
‘পাখির ডাক শুনতে না পেলে একটা ভোর কখনো স্নিগ্ধ হয় না। অথচ সেই পাখির খাবার নিয়ে আমরা কখনো চিন্তা করি না! তোরা চিন্তা করেছিস?’
‘না, চিন্তা করিনি।’ সবাই বলি।
আমরা চিন্তা করিনি বলেই বোধ হয় পাখাল ভাই আরাম পেলেন। বিজ্ঞ আর সবজান্তার ভঙ্গিতে বললেন, ‘পাখি পাকা ফল খাওয়ার সময় বীজসহ খায়, পরে পায়খানার সঙ্গে বীজ বের হয়ে যায়, সেখান থেকে জন্ম নেয় নতুন গাছ…।’
রকি বিরক্ত হয়ে বলল, ‘ছিঃ পাখাল ভাই, পায়খানা না বলে বিষ্ঠা বলেন, বিষ্ঠা। এরকম বিচ্ছিরি শব্দ ব্যবহার করলে এই জেনারেশন আপনার কাছে কী শিখবে?’
পাখাল ভাই নিজের শব্দ ব্যবহারে সতর্ক হয়ে বললেন, ‘আমরা দেখে থাকি আমাদের বাড়ির আঙ্গিনায়, উঠোনে, ঝোপঝাড়ে, জঙ্গলময় জায়গায় নতুন অনেক গাছ, যেগুলো কারো লাগানো নয়। ফুলের পরাগায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে পাখি। তবে সবচেয়ে গুরুত্ববহ কাজ হলো কীটপতঙ্গ নিধন। তোদের কাছে কি পরাগায়ন আর নিধন শব্দ দুটি কঠিন মনে হচ্ছে? আমি আবার সহজ শব্দ ব্যবহার করতে পারি না। তোরা তো স্কুলের ছেলেপুলে সব, অবশ্য তোদের কাছে এই শব্দ না বোঝারই কথা।’
ভাষা বিশারদের মতো ভাবগাম্ভীর্য নিয়ে পাখাল ভাই একটু থামলেন। সেই সুযোগে রকি তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে বলল, ‘আমরা সবাই এখন বড়ো হয়েছি। এখন আর প্রাইমারি স্কুলে পড়ি না, হাইস্কুলে পড়ি।’
পাখাল ভাই বললেন, ‘ফসলের অসংখ্য ক্ষতিকারক পোকা পাখি খেয়ে ফেলে। ফলে ফসল প্রাকৃতিকভাবে রক্ষা পায়। শূন্যে উড়ে উড়ে পাখি উড়ন্ত পোকা খায়। পরিসংখ্যান বলে, ছোট একটি পাখি এক ঘণ্টায় বারোশো পোকা খেয়ে ফেলতে পারে।’
‘তেরোশো পোকা নয় কেন? অথবা এগারোশো?’ রকি বলল।
এবার সত্যি সত্যি রকির ওপর আমার রাগ পেয়ে গেল। গুরুত্বপূর্ণ কথার মাঝে একটু পরপরই সে বাধা সৃষ্টি করছে। মানলাম আমরা ছোট মানুষ, তাই পাখাল ভাই উল্টোপাল্টা তথ্য বলে আমাদের বোকা বানাবার চেষ্টা করে থাকেন। কিন্তু আজ তিনি যেসব বিষয়ে বক্তৃতা দিচ্ছেন, আমার মনে হয় না এসব কোনো ভুল তথ্য। আমার ছোট কাকু রোজ পত্রিকা পড়েন, ইতিহাস পড়েন, তার ঘরভর্তি বই। সেদিন কাকুর ঘরে এসে দেখলাম, পাখিবিষয়ক একটা ছোট্ট আর্টিকেল কাকু মন দিয়ে পড়ছেন। আমিও কাকুর সঙ্গে একটু পড়লাম। জানা গেল পাখি সম্পর্কে অজানা অনেক তথ্য। আমার তাই মনে হচ্ছে পাখাল ভাই আজ আমাদের সঠিক কিছু শুনিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু রকিটা খুব জ্বালাতন করে যাচ্ছে।
আমি পাখাল ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বিনয়ের সুরে বলি, ‘পাখাল ভাই, আপনি বলতে থাকেন। আমরা মন দিয়ে শুনছি।’
খেয়াল করলাম, বিরক্ত মুখে পাখাল ভাই রকির দিকে তাকিয়ে আছেন। রকি আরেকবার জ্বালালে ঠাস করে গালে চড় বসিয়ে দিতে পারেন। আমার ভদ্র আচরণ পেয়ে সেদিক থেকে মুখ ফিরিয়ে এনে বলতে শুরু করলেন, ‘চীন দেশের একটি ঘটনা শোন সবাই। চীনা গবেষকদের প্রতিবেদনে উঠে আসে, একটি চড়ুই পাখি বছরে চার থেকে পাঁচ কেজি শস্য খেতে পারে। সে হিসাবে দশ লাখ চড়ুইয়ের খাবার বাঁচিয়ে প্রায় ষাট হাজার মানুষের খাদ্যের জোগান দেওয়া যেতে পারে। এ প্রতিবেদন চীনাদের ভাবনায় ফেলে দিল। কৃষির ক্ষতির কথা ভেবে অসংখ্য চড়ুই পাখি হত্যা করা হয়। চড়ুই মারার জন্য জোরেশোরে লোকদের বলা হলো। চড়ুই মারার উৎসবে মেতে উঠল গোটা চীন দেশ। দেশের আর্মিও চড়ুই হত্যার কাজে লেগে গেল। চড়ুই হত্যার জন্য পুরস্কারও ঘোষণা করা হলো। লোকজন বিভিন্ন পদ্ধতিতে চড়ুই মারতে থাকল। ডিম ও বাসা নষ্ট করা হলো। জালে আটকা পড়ল অসংখ্য চড়ুই। বন্দুক দিয়ে গুলি করে মারা হলো বাকি চড়ুই পাখি। চীন দেশের সব চড়ুই মারা পড়ল…’
রকি আফসোসের সুরে বলল, ‘ইশ্! এই চড়ুইগুলি যদি আমাদের দেশে থাকতো! তেলে ভাজা করে খেতাম।’
‘পরের বছরগুলোতে ফসলে স্বাধীনভাবে হানা দিল ক্ষতিকর অজস্র পোকা। সেই পোকা দমনের জন্যে পাখি তো নেই! পরিস্থিতি এমন হলো, সেই ফসল আর ঘরে তোলা গেল না। চীনে দেখা দিল দুর্ভিক্ষ। মারা গেল অসংখ্য লোক। টনক নড়ল দেশটির সরকারের। প্রকৃতিতে চড়ুই ফিরিয়ে আনতে শুরু হলো চড়ুই আমদানি।’
‘কয়টি চড়ুই আমদানি হয়েছিল? আচ্ছা শুধু কি চড়ুই পাখি পোকা মারার কাজ জানে? অন্য পাখি কি ঘোড়ার ঘাস কাটে শুধু?’ রকি প্রশ্ন করে।
পাখাল ভাই রকির কথা শুনেও না শোনার ভান করে বললেন, ‘এখন বুঝলি তোরা পরিবেশ রক্ষায় মানুষের চেয়ে পাখির ভূমিকা বেশি? পাখি আমাদের পরম বন্ধু। আমাদের আশপাশে আছে অনেক রকমের ফলের গাছ। ফল পাখির ভালো খাবার। অসংখ্য ফলগাছ পাখির ফেলে যাওয়া বীজ থেকে হয়েছে। এ জন্য গাছের ফলে রয়েছে পাখিরও অধিকার। পাখির জন্য গাছে কিছু ফল রাখা উচিত। তাহলে পাখি এইসব ফল খেয়ে আবার সেই গাছের বিস্তার ঘটাবে, উপকার হবে মানুষেরই।’
জ্ঞানের ভাণ্ডার খুলে দিয়ে পাখাল ভাইকে বেশ আরাম পেতে দেখলাম। দীর্ঘসময় পাখিবিষয়ক বক্তৃতায় চোখে মুখে ক্লান্তির ছাপ নেই, বরং উৎসাহিত আর আনন্দিত। যেন পাখিবিষয়ক যে কোনো প্রশ্ন জিজ্ঞেস করলেই, সাথে সাথেই জবাব দেবে আমাদের পাখাল ভাই। অবশ্য আমরা প্রশ্ন করি না। চুপ মেরে থাকি। আমাদের এত বুদ্ধি নেই প্রশ্ন করব।
রকি বলল, “আচ্ছা পাখাল ভাই, আপনি তো পাখি সম্পর্কে অনেক জেনে গেছেন। ‘পাখি পাকা পেঁপে খায়’-এই কথাটা দ্রুত কতবার বলতে পারবেন?”
পাখাল ভাই এবার বিরক্ত হলেন। বললেন, ‘তুই আমার সাথে বাঁদরামি করিস? সহজ কথাটা বলতে না পারার কী আছে?’
‘আচ্ছা বলুন। শুনব আপনার মুখ থেকে।’ রকি চ্যালেঞ্জের গলায় বলল।
পাখাল ভাই বড়ো করে শ্বাস নিলেন। এরপর বললেন, ‘পাখি পাকা পেঁপে খায়, পাখি পাকা পেঁপে খায়, পাখি পাপা পেঁপে খায়, পাখি পাপা পেকে খায়, পাখি পাপা পেকে খায়…।’
খিল খিল করে হেসে ফেলল রকি। সঙ্গে আমরাও হেসে উঠি। ‘পাখি পাকা পেঁপে খায়’ দ্রুত বলতে গিয়ে পাখাল ভাই বলে ফেলেছেন-‘পাখি পাপা পেঁপে খায়’। আরেকবার বললেন, ‘পাখি পাপা পেকে খায়’।
রকি বলল, ‘পাখিদের নিয়ে আপনি এত জানেন, আর এই সামান্য কথাটা ঠিকমতো বলতে পারলেন না! আগে শুদ্ধ বাংলা শিখে আসেন, তারপর পাখিবিষয়ক আমাদের জ্ঞান দেবেন।’
রকির কথা শেষ হতেই, আরেক দফায় হাসতে হাসতে আমরা সবাই ঘাসের ওপর গড়িয়ে যাচ্ছি। অপমান সহ্য করতে না পেরে, পাখাল ভাই রাগে দুঃখে উঠে দাঁড়ালেন। যেতে যেতে বললেন, ‘তোদের মতোন বাঁদরদের সাথে থাকলে আমিও বাঁদর হয়ে যাব!’