Home সম্পূর্ণ রহস্য উপন্যাস গন্ধ-পাগল জুবায়ের হুসাইন

গন্ধ-পাগল জুবায়ের হুসাইন

ঘটনার আকস্মিকতায় একেবারে ‘থ’ মেরে গেল কিশোর গোয়েন্দা বিপ্লব খান।
গোয়েন্দাগিরিতে ইতোমধ্যেই বেশ সুনাম কুড়িয়ে নিয়েছে বিপ্লব। পুরো নাম বিপ্লব খান হলেও সর্বমহলে বিপু ভাইয়া নামে পরিচিত। কয়েকটা বেশ জটিল এবং গুরুত্বপূর্ণ রহস্যের সমাধান করে খোদ পুলিশের ইনভেস্টিগেশন টিমকে নাড়িয়ে দিয়েছে। বাঘা বাঘা গোয়েন্দারা যে কেসের সমাধানে হিমশিম খেয়েছে, তেমনই কিছু কেসের তদন্ত করে সুন্দর সমাধান বের করায় গোয়েন্দামহলে ও এক নামেই পরিচিত। অবশ্য ওকে দেখলে সে রকমটি মনে হয় না। হালকা-পাতলা চেহারার এক কিশোর ও। মাথাভর্তি একরাশ ঘন কালো চুল। মুখের থুতনিটা একটু ঝোলানো। সে কারণে মুখের শেপটা একটু লম্বাটে ধরনের। তবে একটু তীক্ষè করে তাকালে ওর চোখে-মুখে বুদ্ধিমত্তার ছাপ স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
একটা কাজ সেরে হেঁটেই বাড়ি ফিরছিল ওরা, বিপ্লব ও আবিদ। বিপ্লবের এবারের সফরসঙ্গী আবিদ। একই এলাকায় বাড়ি ওদের। পড়ে একই স্কুলে, একই ক্লাসে।
মাথার চুল ফুর ফুর করে উড়ছিল বাতাসে বিপ্লবের। চুল ও বরাবরই একটু বড়ই রাখে। চোখে-মুখে বেশ আরাম বুলিয়ে দিচ্ছিল বাতাসটা। এমনিতেই ঘামে ভিজে শার্টের নিচে গেঞ্জি শরীরের সাথে লেপটে গেছে।
আবিদের তো গেঞ্জি ভিজে শার্টও কালার পরিবর্তন করে ফেলেছে। নীল রঙের শার্টটা ঘামে ভিজে গাঢ় নীল রঙ ধারণ করেছে।
ভেজা শরীরে শেষ দুপুরের সুন্দর হাওয়াটা যেন সমস্ত দেহমনে শান্তির পরশ বুলিয়ে দিল। শুকনো গলাটা যেন প্রাণ ফিরে পেল। এতক্ষণ মনে হচ্ছিল হৃৎপিণ্ডটা গলার কাছে এসে ধুকপুক করছে। এক্ষণে সেটাও শান্ত হলো যেন।
‘আহ্্!’ অস্ফুটে আবিদের কণ্ঠ থেকে শব্দটা বেরিয়ে এলো। দু’হাত দু’পাশে মেলে অ্যারোপ্লেনের মতো কিছুটা ছুটল। অবশ্য রাস্তাটা একটু নিরিবিলি হলেও টুকটাক বাইসাইকেল ও রিকশা যাওয়া-আসা করছে টুংটাং বেল বাজিয়ে। তেমনই একটা সাইকেল সাঁই করে ওদের পাশ কাটিয়ে চলে গেল। আরেকটু হলে আবিদকে ধাক্কা দিয়ে ফেলেই দিয়েছিল আর কি। সাইকলেটাকে সাইড দিতে গিয়ে একটু ঘুরে গিয়েছিল ওর শরীরটা। আর তখুনি বেটারিচালিত রিকশাটা ওর পাশে ক্ষণিকের জন্য দাঁড়িয়ে ওকে তুলে নিয়েই প্রায় বাতাসের বেগে চলে গেল।
বিপ্লবের ব্যাপারটা বুঝতেই অনেকটা সময় লেগে গেল। ততক্ষণে রিকশাটা সামনের মোড় ঘুরে উঁচু পাঁচিলের ওপাশে হাওয়া হয়ে গেছে। ও কেবল মুখ ফুটে বলতে যাচ্ছিল, ‘আল্লাহপাক কতই না দয়াবান! দেখ না, আমরা গরমে কষ্ট পাচ্ছি বলে শান্ত বাতাসটা বইয়ে আমাদেরকে আরামে ভাসিয়ে দিলেন। সারা দিন এবং সারা রাতও যদি সিজদায় পড়ে থেকে তাঁর গুণগান করি, তবুও তাঁর দয়ার এতটুকু আদায় করা শেষ হবে না।’ কিন্তু কথাটা মুখ দিয়ে বের করতে পারল না। কেবল ‘… আমরা গরমে কষ্ট পাচ্ছি..’ পর্যন্ত বলতে পেরেছে ও। এর মধ্যেই ঘটনাটা ঘটে গেছে।
পুরো ঘটনাটা ঘটতে মিনিট দুয়েক সময় লাগল।
ধাতস্থ হতে আরো প্রায় কুড়ি সেকেন্ড চলে গেল। কী ঘটে গেছে যখন বুঝতে পারল ও, তখন ‘এই, এই তোমরা ওকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছ? থামো, থামো বলছি!…’ বলে চিল্লাতে চিল্লাতে ছুটল বেশ কিছু দূর। মোড়ের মাথার পাঁচিলের ওখানে পৌঁছে বহু দূর পর্যন্ত রিকশাটাকে আর দেখা গেল না। তার মানে ওটা দৃষ্টির আড়ালে চলে গেছে।
দ্রুত মাথার মধ্যে কাজ করে চলছে বিপু ভাইয়ার মস্তিষ্ক। চালু হয়ে গেছে ওটা পুরো দমে। কিন্তু কোনো কিনারা করতে পারল না। বুঝতে পারল না কেন ওর সঙ্গীকে ওভাবে তুলে নিয়ে গেল। কারা ছিল রিকশায় বা কয়জন ছিল, কিছুই বুঝল না। আসলে নিজেদের মধ্যে এতটাই মগ্ন ছিল ওরা, তথাপি গরমে হাঁফিয়ে উঠেছিল, তাতে আসলে ওসব কিছু খেয়াল করার সুযোগও ছিল না। ভীষণ কষ্টের মাঝে তৃপ্তির বাতাস শরীরে আনন্দ ছড়িয়ে দেওয়াতে ওরা আসলে নিজেদের মধ্যে আরো কিছুটা ঢুকে গিয়েছিল। আর সবচেয়ে বড় কথা, ওরা কি আর জানত যে এমন একটা ঘটনা ঘটবে? যদি জানত তাহলে তো প্রস্তুত হয়েই থাকতে পারতো।
কিন্তু এখন কী করবে বিপ্লব। এই এলাকার সবকিছু তো ও ভালোভাবে চেনেও না। মাত্র কয়েকদিন হলো বেড়াতে এসেছে। এসেই যথারীতি একটা রহস্যে জড়িয়ে পড়ে ও। পূর্ণ হয় রহস্যের সমাধানে বিপু ভাইয়ার সহকারী হওয়ার আবিদের বহু দিনের শখ। কিন্তু এটা কী হয়ে গেল? এখন কোথায় খুঁজবে আবিদকে? কোথায় নিয়ে গেছে ওকে ওরা?
ওদিক থেকে সাইকেল চড়ে একজনকে আসতে দেখে তাকে থামাল কিশোর গোয়েন্দা। জিজ্ঞেস করল একটা রিকশায় ওরই বয়সী একটা ছেলেকে ধরে নিয়ে যেতে দেখেছে কি না। তেমন কিছু খেয়াল করেনি বলে সাইকেল চালিয়ে চলে গেল লোকটা।
দ্রুত পায়ে হাঁটতে লাগল বিপ্লব। বামে আরেকটা সরু রাস্তা চলে গেছে। ওই রাস্তায় ঢুকে গেল ও। কিছু ছেলেপিলে ক্রিকেট খেলছে। এপাশে ফিল্ডিংয়ে দাঁড়িয়ে থাকা একজনকে জিজ্ঞেস করল, ‘এই যে ভাইয়া, এদিক দিয়ে একটা রিকশা যেতে দেখেছেন?’
ছেলেটা ওর দিকে কেমন কেমন করে যেন তাকাল। চোখ দুটো ভীষণ কটা তার। মাথার চুলগুলোও কেমন পাটের আঁশের মতো। রোগা ঢ্যাংঢেঙে শরীর। বলল, ‘কে গো ভাই তুমি? আগে কখনো এদিকে দেখেছি বলে তো মনে হয় না!’
বিপু পড়ল ভারি ফ্যাসাদে। আরে বাবা, ওর কি এখন এই সব খাজুরে আলাপের সময় আছে? ও যা জানতে চাইছে তা সরাসরি বলে দিলেই হয়। তা না,…
ওকে চুপ থাকতে দেখে ছেলেটা আবারও জিজ্ঞেস করল, ‘কী হলো, আমার কথার জবাব দিচ্ছ না কেন? কে তুমি?’
বিপ্লব এ কথারও কোনো জবাব দিল না। মনে মনে বলল, ‘আরে খোকা, আমি কে তা শুনে তোমার কী দরকার? তুমি এদিক দিয়ে কোনো রিকশা যেতে দেখেছ কি না তা বলে দিলেই তো খেল খতম।’
ঠিক এই সময় ব্যাটসম্যান একটা বল এদিকে হাঁকাল। বিপ্লবের সাথে কথা বলছিল বলে বলটা মিস করল সে। ফলে চার রান হয়ে গেল। অন্য ফিল্ডাররা গেল ক্ষেপে। বলটা কুড়িয়ে ফেরত পাঠিয়ে এবার ছেলেটা বিপ্লবের দিকে রুখে দাঁড়াল। এমন ভঙ্গি করল যেন ওর জন্যই বলটা মিস ফিল্ডিং হয়েছে। তেড়ে এসে বলল, ‘এই খুকা এই, তুমি কিডা? কেন এসেছ এদিকে? কী চায় তোমার? ও, কী যেন জিজ্ঞেস করছিলে, এদিক দিয়ে কোনো রিকশা যাতি (যেতে) দেখিছি কি না?’ হা হা করে হাসল। ‘তুমি কোন্ রিকশাডার কথা বলতিছাও? কত রিকশাই তো যাচ্ছে আসছে।’ হঠাৎ কঠিন হয়ে উঠল তার চেহারা। ‘এই মনু শোনো, ভালো চালি পরে এখেন থেকে কেটে পড়ো। নইলে কিন্তু…’
নইলে কী করবে তা ডান হাতটা মুষ্টিবদ্ধ করে বিশেষ ভঙ্গিতে বুঝিয়ে দিল।
যা বোঝার বুঝে নিয়েছে বিপ্লব। সেখানে আর এক মুহূর্তও দাঁড়াল না। তবে বুঝল, এদিক দিয়ে যদি আবিদকে তুলে নিয়ে যাওয়া রিকশাটা যেত, তাহলে নিশ্চয়ই ছেলেদের নজরে পড়ত। এভাবে মনোযোগ দিয়ে খেলতে পারত না। তার মানে এই রাস্তায় যায়নি।
ফিরে এলো ও। শরীরটা হঠাৎ করেই আবার গরম হতে শুরু করল।
নানান প্রশ্ন মাথার ভেতরে ঢুকে ওর ভাবনাগুলোকে এলোমেলো করে দিল।
রাস্তার এই দিকটাতে ডানে একটা ছোট পুকুর। শান বাঁধানো সিঁড়ি নেমে গেছে নিচে। পানি অনেকটা নিচে। পাশেই একটা জামরুল গাছ। সিঁড়ির বাম পাশটাকে প্রায় ঢেকে ফেলেছে। ওটার নিচে গিয়ে সিঁড়িতে বসল। পুকুরের শান্ত পানির দিকে তাকিয়ে থাকল বেশ কিছুটা সময়। প্রচণ্ড ক্লান্তি এসে ভর করছে শরীরে। কিন্তু এখন শরীরের কথা শুনতে গেলে চলবে না।
আবিদের কী হতে পারে, সম্ভাব্য কয়েকটা বিষয় ভেবে নিলো। তারপর হারিয়ে গেল কয়েকদিন আগের ঘটনায়।

দুই.

বার্ষিক পরীক্ষা শেষ। স্কুল দীর্ঘ ছুটি। এই ছুটিতে কোথায় কিভাবে কাটাবে তাই নিয়েই কথা হচ্ছিল ওদের মাঝে।
‘কী ঠিক করলে? কোথায় যাবে এই ভ্যাকেশনে?’ জিজ্ঞেস করল আবিদ।
‘আমার চেনা একটা ভালো জায়গা আছে।’ বলল বিপ্লব। ‘ভাবছি, সেখানেই যাব।’
‘কোথায় জায়গাটা?’ জানতে চাইল আবিদ।
‘স্বরূপদাহ। স্বরূপদাহ এই চৌগাছা উপজেলার একটি গ্রাম। খুবই সুন্দর। চারিদিকে সবুজের যেন চাদর বিছানো ওখানে।’ বেশ উৎসাহ নিয়েই বলল বিপ্লব ওরফে বিপু ভাইয়া।
‘সে না হয় বুঝলাম। কিন্তু কে থাকে ওখানে? আর গুরুত্বপূর্ণ কী-ই বা আছে?’ আরো জানতে চায় আবিদ।
‘ওখানে আমার ফুফু বাড়ি।’ সংক্ষেপে বলল বিপ্লব। ঠোঁটমুড়ে হাসল। অর্থাৎ কোনো রহস্য লুকাচ্ছে ও।
ওসব খেয়াল করল না আবিদ। আনন্দে লাফিয়ে উঠল। বেরিয়ে গেছে মুখের ঝকঝকে সাদা দাঁত।
এই মুহূর্তে ওরা বসে আছে ফাঁকা একটা মাঠে একটা উঁচু টিবির ওপর।
সূর্য ঢলে পড়েছে পশ্চিম আকাশে। রোদের তেজটাও তাই কমে গেছে। মাথার ওপরে ছায়া মেলে ধরা মোটা গাছটায় দুটো হলদে পাখি কিচির মিচির করছে।
আবিদের মুখের হাসি লেগেই রইল। দারুণ খুশি হয়েছে ও, চেহারা দেখেই বোঝা যায়। গোয়েন্দাগিরিতে ইতোমধ্যেই বেশ সুনাম কুড়িয়ে নিয়েছে বিপ্লব খান। কোনো কেসে ওর সহকারী হিসেবে থাকতে পারাটা বেশ গর্বের বিষয়। আবিদের কখনো ওর সহকারী হয়ে ওঠা হয়নি। অথচ ওরই খেলার সাথী, স্কুলের সহপাঠীরা প্রায়ই বিভিন্নভাবে এই কিশোর গোয়েন্দাকে সহযোগিতা করে। এই তো, সৈকতটা তো কয়েকবারই ওর সহকারীর ভূমিকা পালন করল। ইশ্! ভাবে ও। একবার যদি কোনো একটা কেসে বিপ্লবের সহকারী হওয়া যেত!
কিন্তু ও ভেবে অবাক হচ্ছে, হঠাৎ কেন গোয়েন্দাগিরি ছেড়ে ফুফু বাড়িতে বেড়াতে যাচ্ছে বিপ্লব? নাকি ওখানে কোনো রহস্যের সমাধানের জন্যই যাচ্ছে? শোনা যায়, বিপু ভাইয়া যেখানে যায়, সেখানেই রহস্য এসে ওকে হাতছানি দেয়। না, এবার ওর সঙ্গ ছাড়াটা ঠিক হবে না। বলা তো যায় না, কোনো না কোনো একটা রহস্য যদি পেয়ে যায় বিপু, তাহলে তার সহকারী হওয়া আর ঠেকায় কে! সুতরাং, যেভাবেই হোক, ওর পিছ কিছুতেই ছাড়ছে না আবিদ।
ঘাসের একটা কচি ডগা দাঁত দিয়ে ছিঁড়ছিল আবিদ। বিপ্লবের দিকে ফিরে বলল, ‘কখন যাচ্ছি আমরা?’
বিপ্লব পাশেই সবুজ ঘাসের ওপর চিত হয়ে শুয়ে ছিল। গাছের মগডালে পাখি দুটোর ঝগড়া উপভোগ করছিল। আবিদের কথায় ওর মুখের দিকে একবার তাকিয়ে নিয়ে বলল, ‘কাল সকালে।’
নিজের কানকে যেন বিশ্বাস করতে পারল না আবিদ। বলল, ‘কবে বললে?’
‘টুমরো মর্নিং।’
তড়াক করে লাফিয়ে উঠল আবিদ। ‘সত্যি? হুররে, আমার কী যে খুশি লাগছে!’
শোয়া থেকে উঠে বসল বিপ্লব। আবিদের দিকে কঠোর চোখে তাকিয়ে বলল, ‘যাব আমি আমার ফুফু বাড়ি। কিন্তু তুমি অত খুশি হচ্ছো কেন?’
ফাটা বেলুনের মতো চুপসে গেল আবিদ। লাফানো বাদ দিয়ে কাটা গাছের মতো ধপাস করে বসে পড়ল ঘাসের ওপর। বলল, ‘মানে? আমি যাচ্ছি না তোমার সাথে?’
বিপ্লব কিছু বলল না। একইভাবে তাকিয়ে রইল ওর দিকে।
কাকুতি ঝরে পড়ল আবিদের কণ্ঠে, ‘আমাকে সঙ্গে নেবে না তাহলে?’
চোখের পলক না ফেলে আবিদের চোখের দিকে তাকিয়েই রইল বিপ্লব। সে দৃষ্টি সইতে না পেরে ঘন ঘন পলক ফেলল আবিদ।
দীর্ঘ প্রায় পঞ্চাশ সেকেন্ড একইভাবে রইল বিপ্লব। তারপর হঠাৎ করেই হা হা করে হেসে উঠল। হাসি যেন আর থামেই না।
আবিদ পড়ে গেল বেকায়দায়। ভাবতে শুরু করল, বিপুটা কি পাগল হয়ে গেল? এভাবে তো সাধারণত ওকে হাসতে দেখা যায় না। আজ হঠাৎ কী হলো ওর?
ও যখন ভাবতে শুরু করেছে যে, বিপ্লব আজ আর হাসি থামাবে না, ঠিক তখনই বিপ্লব হঠাৎ করেই হাসি থামিয়ে আবিদের মাথায় একটা গাট্টা মেরে বলল, ‘চলো’।
উঠে দাঁড়িয়েছে বিপ্লব। চলতে শুরু করল।
আবিদের ঘোর তখনও কাটেনি। ঠোঁট দুটো প্রায় দেড় ইঞ্চি ফাঁকা হয়ে রইল। তাকিয়ে আছে বিপ্লবের দিকে। এ কেমন অদ্ভুত মানুষরে বাবা! গোয়েন্দারা বুঝি এরকমই হয়?
পেছনে আবিদ আসছে না বুঝতে পেরে দাঁড়িয়ে পড়ল বিপ্লব। ঘুরে এগিয়ে গেল ওর কাছে। রহস্যময় অদ্ভুত হাসিটি আবারও উপহার দিয়ে বলল, ‘কী ব্যাপার, এখানে আর কতক্ষণ বসে থাকবে? আর যেভাবে হাঁ করে আছো, তাতে না কোন্ সময় মাছি ঢুকে যায় মুখের মধ্যে।’
‘তুমি একাই যাবে?’ একরাশ হতাশা ঝরে পড়ল আবিদের কণ্ঠে।
করুণা হলো বিপ্লবের। হাঁটু গেড়ে বসল ওর পাশে। দু’হাতে ওর দু’কাঁধ ধরে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, ‘তুমিও যাচ্ছ আমার সাথে। তোমার বাবা-মাকে ম্যানেজ করে রেখেছি। কাল সকালেই একটা ব্যাগে টুকটাক কিছু জামা-কাপড় নিয়ে চলে এসো।’
চোখ ফেটে কান্না বেরিয়ে এলো আবিদের। ভেউ ভেউ করে কেঁদে ফেলল।
‘এই, এটা কী হচ্ছে? কাঁদছো কেন তুমি?’ জিজ্ঞেস করল বিপ্লব।
‘খুশিতে কাঁদছি।’ বলল আবিদ।
দূরে এক ঝাঁক বালিহাঁস গলার মালা তৈরি করে উড়ে যাচ্ছিল। সেদিকে তাকিয়ে বিপ্লব বলল, ‘দেখ দেখ, কী সুন্দর, তাই না?’
‘খুব সুন্দর!’
‘আর আমি?’
‘তুমিও খুব ভালো। আমার আম্মুর মতো।’
‘ধ্যাৎ, তোমার আম্মু তো অনেক ভালো। আমি গেলে তো আমাকে না খাইয়ে ছাড়েনই না। অবশ্য…’
‘অবশ্য কী?’
‘না কিছু না।’
‘না বিপু ভাইয়া, তোমাকে বলতেই হবে।’
‘না মানে বলছিলাম কি, মানে, ইয়ে মানে…’
‘আমার কিন্তু কান্না পাচ্ছে।’
‘এ মা, এই না কেবলই কান্না থামালে, আবার কেন?’
‘তুমি না বললে আমি কিন্তু সত্যি সত্যিই কেঁদে ফেলব। তোমার মায়ের কাছে গিয়ে নালিশও করবো।’
‘কী, কী নালিশ করবে?’
‘সেটা তোমাকে বলবো কেন? তোমার মাকে গিয়েই বলবো।’
‘ওকে, বলছি শোনো।’ হার মানল বিপ্লব। ‘তোমার আম্মু যখন আমাকে খেতে দেন, তখন তুমি অমন করে আমার দিকে তাকাও কেন? জানো, তোমাদের ওখান থেকে খেয়ে বাড়ি গেলে সেই রাতেই আমার ইয়ে শুরু হয়ে যায়!’
‘তার মানে? তার মানে তুমি বলতে চাচ্ছো তোমার খাবারের দিকে আমি লোভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি?’
জবাবে চোখের পাতাগুলো বার কয়েক ওপর-নিচ করল বিপ্লব।
হাত উঁচিয়ে তেড়ে গেল আবিদ ওকে মারতে। বিপ্লব কি আর তখন ওখানে থাকে? ভোঁ-দৌড় দিয়েছে ও। পেছনে চিল্লিয়ে আবিদকে বলল, ‘কাল ভোর হতেই আমাদের বাড়িতে চলে এসো। আমরা এবার স্বরূপদাহ যাচ্ছি।

তিন.

পরদিন সকালবেলা।
বাসস্ট্যান্ড থেকে একটা এক্সপ্রেসে উঠল ওরা। সঙ্গে নিয়েছে দুটো পিঠব্যাগ। ভেতরে দরকারি জামাকাপড় ও অন্যান্য কিছু জিনিস। বিপ্লব সঙ্গে একটা চারফলা ছুরি নিয়েছে। বাড়ি থেকে বাইরে কোথাও বেড়াতে গেলে সবসময়ই এটা কাছে রাখে। অনেক বার অনেক প্রয়োজনে কাজেও লেগেছে। আবিদ আসার সময় মা বলে দিয়েছেন, ‘সাবধানে থেকো। বাইরের খাবার একদম খাবে না কিন্তু।’
বাস এগিয়ে চলেছে পালবাড়ি রোড ধরে। থেকে থেকে রাস্তার দুই পাশে সবুজ মাঠ। গাছপালা। থেকে থেকে দোকানপাট, বাড়ি ঘর।
‘তোমার যখন ফুফু, তখন নিশ্চয় আমারও ফুফু।’ বলল আবিদ।
বিপ্লব কিছুই বলল না। কেবল ‘হ্যাঁ’ সূচক মাথা নাড়ল।
‘ফুফুকে ফোনে জানিয়েছো তো আমরা আসছি?’
‘না।’ সংক্ষিপ্ত জবাব বিপ্লবের।
‘না? কেন?’ একটু যেন অবাক হলো আবিদ।
‘হ্যালো নেই।’
‘হ্যালো মানে?’ আরো অবাক হলো আবিদ। মাঝে মাঝে বিপ্লব এমন সব উদ্ভট কথা বলে যে আবিদ তার কিছুই বোঝে না। এই যেমন এখন বলল ‘হ্যালো নেই’।
‘আহা! এই কথাটুকুও তুমি বুঝতে পারো না? তাহলে গোয়েন্দাগিরি করবে কিভাবে?’
আবিদ বুঝতে পারে না গোয়েন্দাগিরি করতে এই উদ্ভট কথাটার মানে বোঝার দরকার কেন? মুখ গোমড়া করে বসে থাকল ও। জানালা দিয়ে বাইরে তাকাল।
বিপ্লব লাল শার্ট আর সাদা প্যান্ট পরেছে। আবিদ একটা হালকা লাল শার্ট আর কালো প্যান্ট পরেছে। বেশ পরিপাটি ফিটফাট লাগছে ওদেরকে।
‘রাগ করেছ আবিদ?’ বিপ্লব জিজ্ঞেস করল।
এবার আবিদ কোনো কথা বলল না। আগের মতই চুপ করে বসে থাকল।
‘আবিদ রাগ করো না বন্ধু। আমি জাস্ট ফান করছিলাম তোমার সাথে।’ আবিদকে চুপ থাকতে দেখে বলল বিপ্লব।
এবারও কোনো কথা বলল না আবিদ।
‘শোনো, ফুফু বাড়িতে কোনো হ্যালো নেই মানে…’
‘কোনো ফোন নেই, এই তো?’ বিপ্লবকে কথা শেষ করতে না দিয়ে বলল আবিদ।
‘এই তো তুমি বুঝতে পেরেছ। তাই তো বলি, আমার বন্ধু এ কথার মানে না জেনে পারেই না। নাহ্, তুমি কিশোর গোয়েন্দা বিপু ভাইয়ার সহকারী হওয়ার যোগ্যতা রাখো।’ বলে বিশেষ ভঙ্গিতে আবিদের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসতে লাগল বিপ্লব।
কিছুক্ষণ ওর হাসির দিকে তাকিয়ে রইল আবিদ। হাসি ওর চোখে-মুখেও ছড়িয়ে পড়ল। হো হো করে হেসে উঠল।
ঠিক এই সময় তীক্ষè ব্রেক কষলো বাস। আর একটু হলেই সামনে হুমড়ি খেয়ে পড়ছিল দু’জনে। সামনের ছিট ধরে পড়ে যাওয়া থেকে বাঁচল ওরা।
‘কী হলো!’ আবিদের গলা শুকিয়ে গেছে। কথাটা ফ্যাঁসফ্যাঁস করে বের হলো। ‘এমন করে ব্রেক চাপল কেন?’
পাশ থেকে একজন ভদ্রলোক বললেন, ‘একটা লোক রাস্তা পার হচ্ছিল। তাকে বাঁচাতে গিয়েই কড়া ব্রেক কষেছে ড্রাইভার।’
আশ্বস্ত হলো বিপ্লব আর আবিদ। সেই সাথে অন্য প্যাসেঞ্জারও।
আবার চলতে শুরু করল গাড়ি। উঁচু একটা পুল পার হলো। ঝাঁকি খেল সারা শরীর।
‘তাহলে তুমি ফুফুকে জানাওনি?’ আগের কথায় ফিরে এলো আবিদ।
‘একটা সারপ্রাইজ দেব বলে জানাইনি। তবে আগেই জানিয়ে রেখেছি যে এবারের ছুটিটা আমি ওখানে কাটাব।’ জবাবে বলল বিপ্লব।
দীর্ঘ একটা নিঃশ্বাস ছাড়ল আবিদ। নাক দিয়ে বাতাস বের হবার সময় ‘ফোঁস’ করে শব্দ হলো। হেসে উঠল বিপ্লব।
চুড়ামনকাঠি বাজারে এসে বাস থামল। কিছু প্যাসেঞ্জার উঠল, কেউ কেউ নেমে গেল।
‘আর কত দূর স্বরূপদাহ?’ আবিদের প্রশ্ন।
‘আর এই তো অল্প দূর। চলে এসেছি প্রায়।’
বাস চলতে শুরু করল আবার।
কথা আর বেশি এগোল না। সকালে হালকা নাশতা সেরেই উঠেছিল। এক্ষণে তাই ক্ষিধেও পেয়েছে খুব। আবিদের মা ব্যাগের ভেতরে আলু ভাজি আর পরোটা ঢুকিয়ে দিয়েছেন। দু’জনে ভাগ করে খেল ওরা।
ওরা যখন বাস থেকে নামল, তখন বেলা প্রায় সাড়ে এগারোটা বাজে।
‘এবার হাঁটতে হবে।’ ঘোষণা করল বিপ্লব।
থমকে দাঁড়াল আবিদ। হাঁটাতে ওর ভীষণ বিরক্তি।
বুঝতে পেরে বিপ্লব বলল, ‘ফেরার বাস এখনি পেয়ে যাবে। ইচ্ছে করলে ফিরে যেতে পারো।’
কিন্তু আবিদ সেটা চায় না। অনেক আশা নিয়ে বিপ্লবের সাথে এসেছে ও। এত দূর এসে এখন ফিরে যেতে কে-ইবা চায়? হোক না একটু হাঁটাহাঁটি। হাঁটা তো একটা ভালো ব্যায়াম। এটা ব্যায়াম মনে করে কিছুটা হাঁটলে এমন কিছু হয়ে যাবে না।
পাশাপাশি হাঁটতে লাগল দুই কিশোর। কিন্তু তখনও জানে না, স্বরূপদাহ গ্রামে ওদের জন্য কী চমকটাই না অপেক্ষা করছে। জটিল রহস্যের জ্বালে জড়িয়ে যেতে চলেছে তা টেরই পায়নি।

চার.

দুইজনের পিঠে দুটো পিঠব্যাগ ঝুলিয়ে হাজির হলো ওরা বিপ্লবের ফুফু বাড়ির সামনে। ইটের দালান, টালির চালা। একতলা বাড়ি। দেখলেই বোঝা যায় অনেক পুরনো। পলস্তারা খসে গেছে জায়গায় জায়গায়। বেরিয়ে পড়েছে লাল ইট।
বাড়িটা দক্ষিণ পাশে রেখে পূর্ব পাশ দিয়ে ভেতরে ঢুকল দুই কিশোর গোয়েন্দা। ছোট্ট গেটটা খোলাই ছিল। ভেতরে খানিকটা জায়গা জুড়ে বারান্দা। বারান্দার সামনে কিছুটা ফাঁকা জায়গা- উঠান, উঠানের ওপাশে একটা ঘর।
ছোটখাটো ঘর। রান্নাঘর ওটা। ঘরের উত্তর পাশে গাছপালা, ছোট একটা বাগান বলা চলে ওটাকে। তবে মাঝারি ও ছোট আকৃতির গাছই বেশি।
বিপ্লব আর আবিদ উঠানে পা দেওয়ার সাথে সাথে ছোট্ট ফুটফুটে একটি মেয়ে, বয়স বারো তেরো হবে, ঘরে দৌড়ে গিয়ে তার মাকে ডাকাডাকি করতে লাগল, ‘মা, মা, দেখ বিপু ভাইয়া এসেছে।’
আবার বাইরে চলে এলো সে। বিপ্লবের পাশে এসে দাঁড়াল। আনন্দে যেন ভাসছে। এই বিপু ভাইয়াকে ও খুব পছন্দ করে। ওদের বাড়িতে গেলে তো সারাক্ষণ ওর পিছই ছাড়ে না। বিপ্লবও ওকে আদর করে অনেক।
আবিদকে দেখিয়ে বলল মেয়েটি, ‘ও কে, বিপু ভাইয়া?’
‘পরে বলব সুমি আপু।’ ওকে কোলে তুলে নিয়ে বলল বিপ্লব। পিঠব্যাগ থেকে আগেই হাতে নিয়ে রাখা ডার্ক চকোলেটটা ওর হাতে দিল। ‘চলো, আগে ভেতরে যাই।’ বলে যেতে উদ্যত হলো।
‘এ কিরে বিপ্লব, না বলেই চলে এলি? আয় আয়, ভেতরে আয়। লম্বা জার্নি করেছিস। কত ধকল গেছে তোদের ওপর দিয়ে। আয় আয়?’ দরোজায় দাঁড়িয়ে মুখস্থ করা বিদ্যার মত আউড়ে গেল বিপ্লবের ফুফু। অন্যদের কথা বলার কোনো সুযোগই দিল না।
ভেতরে ঢোকার সময় বিপ্লবের ফুফু আবার বলল, ‘আমাকে আগে জানালেই তো পারতি। বাসস্ট্যান্ডে লোক পাঠিয়ে দিতাম।’
‘তোমাকে সারপ্রাইজ দেব বলে আগে জানাইনি ফুফু।’ এতক্ষণে মুখ খোলার সুযোগ পেল বিপ্লব।
‘তা যা বলেছিস। আমি তো দারুণভাবে সারপ্রাইজড হয়েছি।’ বলল ফুফু।
সুন্দর করে সাজানো ঘরটা। আসবাবপত্র তেমন নেই। কেবল একটা কাপড় রাখার আলনা, একটা টেবিল ও দুটো চেয়ার এবং একটা শোবার খাট আছে। আর হ্যাঁ, খাটের সোজা ওপরে একটা বৈদ্যুতিক পাখা আছে।
ফুফু গিয়ে সিলিং ফ্যানের সুইচ অন করে দিলেন। ধীরে ধীরে ঘুরতে ঘুরতে এক সময় স্পিড নিয়ে ঘুরতে লাগল ফ্যান।
চেয়ারে নয়, খাটেই বসল ওরা। ফুফুও ওদের পাশে বসল। ‘খুব তো বললি নিজেরাই তো চলে এলাম। যদি গুণ্ডারা ধরত তোদের, তাহলে?’
‘আজকাল বুঝি এদিকে গুণ্ডাদের খুব উৎপাত হচ্ছে?’ জানতে চাইল বিপু ভাইয়া।
‘তবে আর বলছি কী! তোরা জানিস এখানে কী ঘটছে?’ বলেই কেমন রহস্যজনকভাবে থেমে গেল ফুফু। পালা করে তাকাতে লাগল ওদের দিকে।
সুমি সেই যে বিপ্লবের কোলে উঠেছে, এখনও নামেনি। এবার বিপ্লব ওকে আস্তে করে নামিয়ে পাশে বসিয়ে ফুফুর দিকে পূর্ণ মনোযোগ দিল। সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ে প্রশ্ন করল, ‘কী ঘটছে ফুফু?’
‘আর বলো না ভাইয়া,’ মা কিছু বলার আগেই বলে উঠল সুমি। ‘সেদিন সকাল আটটার সময় চৌরাস্তার মোড়ে দুটো গুণ্ডা একজনকে ধরল। আর সে কী গণ্ডগোল!’
কেমন তেরছা করে ওর দিকে তাকাল বিপ্লব। বোঝার চেষ্টা করল মেয়েটা কী বলতে চাইছে। কিন্তু ওর মুখের ভাষা কেন যেন পড়তে পারল না। শিশুরা নিষ্পাপ হয়। তাহলে তো তাদের মুখের ভাষা সহজেই বুঝতে পারার কথা। ও তো কত কত ক্রিমিনালের মুখের ভাষা অল্পতেই পড়ে ফেলতে পারে। তাহলে এই মেয়েটার মুখের ভাষা পড়তে পারছে না কেন?
কেমন অস্বস্তি লাগতে লাগল ওর।
বিপ্লব এবার একটু নড়ে উঠল। সরাসরি তাকাল ফুফুর দিকে। সতর্ক হয়ে উঠেছে ওর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়। বলল, ‘ব্যাপারটা খুলে বলবে ফুফু?’
আবিদও শোনার জন্য একটু সামনে ঝুঁকে এলো।
ফুফু আর ওদেরকে ঘোরের মধ্যে না রেখে বলল, ‘দিনকাল খুব ভালো যাচ্ছে না রে। দাঁড়া, আগে তোদেরকে লেবুর শরবত করে দিই। খেয়ে একটু ঠাণ্ডা হ, তারপর বলছি।’
‘কিন্তু ফুফু…’
বিপ্লবকে কথা শেষ করতে দিল না ফুফু। উঠে গেল লেবুর শরবত বানাতে।
বিপ্লব তখন উত্তেজনায় ভেতরে ভেতরে ছটফট করছে। আসল ব্যাপারটা না শুনলে ওর নার্ভগুলো আর শান্ত হবে না বোঝা-ই যায়। এই মুহূর্তে মৃদু ঘামছে ও। মাথার ওপরে সিলিং ফ্যান হালকা ‘গো গো’ শব্দে বাতাস দিয়ে চলেছে। তা সত্ত্বেও এই ঘামের চিকন ধারাটা ওর দুই জুলফির পাশ ঘেঁষে গড়িয়ে পড়তে লাগল। [চলবে]

SHARE

Leave a Reply