Home গল্প তোমাদের গল্প কিডন্যাপার ও আজব -আংটি আতাউল হক মাসুম

কিডন্যাপার ও আজব -আংটি আতাউল হক মাসুম

কথাটা শুনে কোনো কিছুতেই মন বসাতে পারছে না রবিন। না পড়ার টেবিলে, না খেলার মাঠে। রবিনের প্রিয় বন্ধু রাহাতকে কিডন্যাপ করেছে দুর্বৃত্তরা। শুধু তাই নয় রাহাতের বাবাকে ফোন করে তারা বিশাল অঙ্কের মুক্তিপণ দাবি করেছে। আরও বলেছে পুলিশের সাথে কোনোভাবে যোগাযোগ করা হলে রাহাতকে আর জীবিত ফিরে পাওয়া যাবে না। রাহাতদের পরিবারে মহা আতঙ্ক বিরাজ করছে। রবিন রাহাতদের বাসা থেকেই ফিরছে। রাহাতের আম্মু বারবার জ্ঞান হারাচ্ছেন। জ্ঞান ফিরলেই রাহাতের আব্বুকে যেভাবে হোক রাহাতকে উদ্ধারের টাকা জোগাড় করতে বলছেন। রবিন কী বলে সান্ত¡না দিবে ভাষা খুঁেজ পেল না। রাহাতের বাবা-মা দু’জনই রবিনকে বিশেষ ¯েœহ করেন।
কিডন্যাপারদের বেঁধে দেওয়া সময়ের কালকেই শেষ দিন। রাহাতের বাবা অনেক দৌড়-ঝাঁপ করে মুক্তিপণের টাকা জোগাড় করেছেন। কিন্তু রবিন শিওর না, টাকা পেলেই তারা রাহাতকে ছেড়ে দিকে কি না! রবিন বলেছিল পুলিশের সাহায্য নিতে। কিন্তু কেউ তা শোনেনি। আসলে এটা এমন স্পর্শকাতর বিষয় যে বিশ্বাস না করে কোন উপায় নেই। তাই রাহাতের বাবা কাল নির্দিষ্ট সময়ে, নির্দিষ্ট স্থানে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। রবিনের বুক ফেটে কান্না আসতে চাইল।
ছোটবেলা থেকেই রবিন সত্যবাদী, পরোপকারী। বন্ধুরাতো বটেই, ছোট বড় সবাই ওকে খুব ভালোবাসে। এমন ছেলেকে আসলে ভালো না বেসে পারা যায় না। একহারা গড়ন, মাথায় ঝাঁকড়া চুল, নিষ্পাপ দুটো চোখ ওর। লম্বা লম্বা পা ফেলে যখন হাঁটে ওর মায়ের ভাষ্যে তখন যেন রাজপুত্র হেঁটে যাচ্ছে। ব্যবহার আচারেও রবিন অদ্বিতীয়। ক্লাসের সবার সাথে তার দারুণ শখ্য। এতটুকু ছেলে দেশের ভালো-মন্দ নিয়ে যেভাবে চিন্তা করে তাতে ওর ক্লাস টিচাররাও তাজ্জব বনে যান। রাহাতকে উদ্ধারের বিষয়ে চিন্তা করছিল রবিন। মুক্তিপণের টাকা দিয়ে হয়তো রাহাতকে উদ্ধার করা যাবে কিন্তু এতে সন্ত্রাসীদের মনোবল আরো বেড়ে যাবে। দুর্বৃত্তদের অর্থলিপ্সা কখনো মেটার নয়। দুদিন পর আবার অন্য কোন ছেলেকে হাইজ্যাক করে নিয়ে যাবে তারা। কিছু একটা করা দরকার। একা একা পুকুরপাড়ে বসে এসব ভাবছিল রবিন। আজ ও খেলতে যায়নি। এই নীরব জায়গাটা ওর খুব প্রিয়। কোথাও কোন কোলাহল নেই। লোকজন খুব কম আসে এদিকে। মন খারাপ হলেই এখানে চলে আসে রবিন। তবে সন্ধ্যার আগেই বাসায় ফিরে যায় ও। সন্ধ্যার আলো-আঁধারিতে জায়গাটা কেমন ভুতুড়ে হয়ে ওঠে। তবে আজ কখন যে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে রবিন টেরই পায়নি। সন্ত্রস্ত চোখে চারদিকে একবার চোখ বুলিয়ে বাড়ির পথ ধরলো ও।
উত্তর পাড়ার শিমুলদের বাড়ি যাওয়ার আগে একটা ছোটখাটো জঙ্গল পড়ে। তার পাশে পুরনো বিশাল এক বটগাছ। পুরনো বটগাছের কাছাকাছি আসতেই ভয়ে গা ছমছম করে উঠলো রবিনের। বটগাছের পাশে সফেদ-সাদা এক জোব্বাধারীকে দেখতে পেল রবিন। চোখের ভুল ভেবে চোখ ফিরিয়ে নিতে চাইলে সে খেয়াল করলো জোব্বাধারী বৃদ্ধ লোকটি তার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছেন। তার ডান হাতে ধরা সুদৃশ্য একটি লাঠি। রবিনের সমস্ত ইন্দ্রিয় যেন অবশ হয়ে আসতে চাইল। বৃদ্ধ লোকটি বলে উঠলেন, আমি তোমাকে বিকেল থেকে দেখছি, তোমার কি মন খারাপ?
হ্যাঁ, আমার এক বন্ধু কিডন্যাপ হয়েছে।
ওর নাম নিশ্চয় রাহাত?
হ্যাঁ, আপনি কিভাবে জানেন!
আমি সব জানি। পুকুরপাড়ে তোমাকে মাঝে মধ্যে বসে থাকতে দেখি।
হ্যাঁ, কোন কারণে আমার মন খারাপ থাকলেই সেখানে চলে যাই।
তুমি কি দেশের জন্য ভালো কিছু করতে চাও?
হ্যাঁ চাই, কিন্তু আমি একা কতটুকু করতে পারবো?
আমি তোমাকে একটা জিনিস উপহার দিতে চাই। আমার ধারণা তুমি এর সঠিক ব্যবহার করতে পারবে। তুমি যেখানে বসে ছিলে তার শেষ সিঁড়িতে আবর্জনার স্তূপ সরালে একটা জিনিস পাবে, ওটা তোমার জন্য। এই বলেই বৃদ্ধ লোকটি অদৃশ্য হয়ে গেলেন। রবিনের হঠাৎ মাথা কেমন যেন ঝিমঝিম করে উঠলো। চোখের সামনে সবকিছু দুইটা করে দেখতে লাগলো সে।
রবিনের যখন জ্ঞান ফিরলো তখন সে নিজেকে নিজের বিছানায় আবিষ্কার করলো। সন্ধ্যার পর শিমুলের আব্বা তাকে অচেতন অবস্থায় বটগাছ তলায় দেখতে পায়। তারপর ধরাধরি করে বাসায় নিয়ে এসে মাথায় পানি দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। জ্ঞান ফিরলে উৎসুক দৃষ্টিগুলো রবিনকে ঘিরে ধরে। অগত্যা সাদা কিছু একটা দেখে ভয়ে সে জ্ঞান হারায় এটা বলে সবাইকে আশ্বস্ত করল। আসল কথাটি চেপে গেল সে। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে রাত আটটা বাজে। কাল রাহাতকে মুক্তি দেওয়ার কথা। রবিন কি পারবে বন্ধুকে উদ্ধার করতে। দুষ্কৃতকারীদের ধরিয়ে দিতে!
পরদিন স্কুল বন্ধ থাকায় সকাল বেলা রবিন এসে হাজির হলো পুকুর ঘাটে। না, চারদিকে কেউ নেই। আস্তে আস্তে সে সিঁড়ির শেষধাপে গিয়ে ময়লা পাতাগুলো সরাতে লাগলো। কিন্তু কই! কিছুইতো চোখে পড়ে না। আরো কিছু পাতা সরাতেই বের হয়ে এলো একটি পুরনো আংটি। আংটিটা দেখতে এমন যে রাস্তায় পড়ে থাকলেও কেউ ছুঁয়ে দেখবে না। এটাই বৃদ্ধের উপহার কি না ভাবতে ভাবতে পুকুরের পানিতে আংটিটা ভালো করে পরিষ্কার করলো রবিন। ফিরে আসবে এমন সময় কেউ তার নাম ধরে ডাকলো। তাকিয়ে দেখলো কালকের সেই বৃদ্ধ লোকটি। তিনি বললেন, ওটা তোমার কাছে আমার আমানত। সব সময় ভালো কাজে ব্যবহার করবে। আমি জানি তুমি কোনো অন্যায় কাজ করবে না। আংটি হাতে পরে তুমি যেকোনো মানুষের রূপ ধারণ করতে পারবে। আবার অদৃশ্যও হতে পারবে। কেউ তোমাকে দেখবে না। তবে অন্যায় কোন কাজে ব্যবহার করলে আংটি আর তোমার কথামতো কাজ করবে না। আংটি ধীরে ধীরে সবুজ আকার ধারণ করলে বুঝবে তোমার ইচ্ছা পূরণ হয়েছে। এ কথা বলেই বৃদ্ধ লোকটি বাতাসে মিলিয়ে গেলেন। আজ আর রবিন ভয় পেল না।
আজ বিকেলে রাহাতের বাবা মুক্তিপণের টাকা নিয়ে দেখা করতে যাবেন। যা করার তার আগেই করতে হবে। আংটির দিকে চেয়ে রবিন বলল আমি রাহাতের রূপ ধারণ করতে চাই। মুহূর্তেই দেখা গেল আংটির রং বদলে সবুজ হয়ে গেল আর রবিন হয়ে গেল রাহাত। রবিন সোজা চলে গেল রাহাত যেখান থেকে কিডন্যাপ হয়েছিল সেখানে। এতে একটু রিস্ক আছে, কিন্তু এর মাধ্যমে হয়তো কিডন্যাপারদের শনাক্ত করার সুযোগও বের হতে পারে।
রবিন যে ভয়টা করছিল, সেটাই ঘটে গেল। কলেজ রোড ধরে সে বাজারের দিকে হেঁটে আসছিল। যথাসম্ভব চেষ্টা করছিল পরিচিত লোকদের এড়িয়ে চলার। কিন্তু সাইকেল মেকানিকের দোকানের পাশ দিয়ে যেতেই দুর্জয় রাহাত, রাহাত বলে ডাকতে লাগলো। সাইকেল মেরামত করতে এসেছে সে। অগত্যা তাকে ফিরে আসার বিষয়টা বানিয়ে বলে কেটে পড়লো রাহাতবেশী রবিন। তারপর হেলাল রেস্টুরেন্টের সামনে এসে দাঁড়ালো। এখানেই রাহাতকে সর্বশেষ দেখা গিয়েছিল। রবিন রেস্টুরেন্টে প্রবেশ করে হাতমুখ ধুতে গিয়ে লক্ষ্য করল আয়নায় তাকে দেখে টেবিলে বসা দু’জন লোক যেন ভূত দেখার মত চমকে উঠল। দুজনে নিজেদের মধ্যে কথা বলার সময়ও মুহূর্তের জন্য রাহাতরূপী রবিনের ওপর থেকে নজর সরালো না। রবিন ভাবতে লাগলো এই দুজন রাহাতকে কিডন্যাপ করার সাথে জড়িত নয়তো! সে তার করণীয় ঠিক করে ফেলেছে। হাত-মুখ ধুয়ে সে সোজা হোটেলের পাকঘরে ঢুকে গেল। এমন ভাবে প্রবেশ করল যেন সে হোটেলের একজন কর্মচারী। তারপর আড়ালে গিয়ে প্রথমে দুর্জয়কে ফোন করলো। দুর্জয় ফোন ধরেই বলে উঠল, রবিন জানিস, রাহাতকে না পাওয়া গেছে! রবিন কিছু না জানার ভান করে বলল, তুই এখন কোথায়? দুর্জয় বলল, সাইকেল সেরে বাড়ি যাচ্ছি। রবিন দ্রুত তাকে সাইকেল নিয়ে হেলাল রেস্টুরেন্টের সামনে চলে আসতে বলল। তারপর আড়ালে গিয়ে আংটির দিকে তাকিয়ে বিড়বিড় করলো। অতঃপর রবিন হয়ে বের হয়ে খালি একটা টেবিলে বসে লোক দুজনের ওপর নজর রাখলো। ততক্ষণে তাদের খাওয়া শেষ হয়ে গিয়েছিল। তাদের একজন উঠে গিয়ে পাকঘরে প্রবেশ করল এবং অবাক হয়ে বের হয়ে প্রথম জনকে কী যেন বলল। দু’জন খানিক চিন্তা করল। তারপর দৃষ্টি বিভ্রম ভেবে হেসে উঠলো। বিল শোধ করে তারা মোটরসাইকেলে চেপে চলতে শুরু করলো। রবিন বের হয়েই দুর্জয়কে পেয়ে গেল। দুর্জয়ের সাইকেলের প্যাডেলে পা রেখে রবিন বলল, সব ঘটনা পরে খুলে বলব, তুই এখন সোজা থানায় চলে যা। আমি ফোনে ঠিকানা জানালে পুলিশ নিয়ে সেই জায়গায় চলে আসবি। কুইক।
মোটরসাইকেল বেশি দূর যায়নি। তাদের মোটরসাইকেলের গতিও খুব একটা বেশি নয়। ছুটির দিন হওয়ায় রাস্তায় ভিড় কম। রবিন নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে অনুসরণ করতে লাগল। রবিন কিছুটা পিছিয়ে পড়লেও মোড় ঘুরে আবার দেখতে পেল তাদের মোটরসাইকেল। বাজার থেকে মাইলখানেক অতিক্রম করে এক বাড়ির সামনে এসে মোটরসাইকেল থামলো। বাড়ির সামনে একটি বিদেশী সংস্থার সাইনবোর্ড ঝুলানো। মোটরসাইকেল কয়েকবার হর্ন বাজাতেই খুলে গেল গেট। রবিন দুর্জয়কে ঠিকানা জানিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো। তার মনে তখন নানান চিন্তা কাজ করছিল। দুর্জয় পুলিশ আনতে পারবে কি না। আবার এরা যদি অপরাধী না হয় তবে তাদের চূড়ান্ত অপমানিত হতে হবে। আবার রাহাতকে উদ্ধার করা যাবে কি না ইত্যাদি ইত্যাদি। অবশেষে পুলিশ এসে বাড়িটি ঘিরে ফেলল। তারপর অভিযান চালিয়ে তিনজন কিডন্যাপারকে গ্রেফতার করল। তারা এমনভাবে অফিসে কাজ করছিল যেন পুলিশের আগমনের হেতু বুঝতেই পারেনি। এরা আসলে বিদেশী সংস্থার নাম ভাঙিয়ে নানান অপকর্ম করে বেড়াতো। পুলিশ অনেকদিন ধরে এই চক্রকে খুঁজছিল। তাদের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী ভূগর্ভস্থ কক্ষ থেকে রাহাতসহ আরও ছয়জন অপহৃত ছেলেকে উদ্ধার করা হলো। অতঃপর থানার ওসি রবিন এবং দুর্জয়কে ডেকে নিয়ে পুরস্কৃত করলেন।

SHARE

Leave a Reply