বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী, বাংলা সাহিত্যের ঝড়তোলা কবি, কাজী নজরুল ইসলামের ওপর ভিত্তি করে নানা সময়ে, নানা আঙ্গিকের মজার মজার, সুুন্দর সুুন্দর, মনকাড়া লেখামালা আমাদের চোখে পড়ে। প্রবন্ধ, নিবন্ধ, স্মৃতিচারণ ও মনোমুগ্ধ গ্রন্থের সন্নিবেশনে কবিকে করা হয়েছে সাহিত্যায়ন। অনেক সময় তাঁর ওপর ভিত্তি করে নানা ধাঁচের ছড়া, কবিতা রচিত হয়েছে, বহতা নদীর মতো হচ্ছে এখনও। এ সংখ্যা বিস্তর। এর নেই নির্দিষ্ট কোনো পরিসংখ্যান। প্রতিষ্ঠিত, অপ্রতিষ্ঠিত, নবীন হাতের-প্রবীণ হাতের, কাঁচা হাতের- পাকা হাতের এই রচনাগুলো সাহিত্য রসে কানায় কানায় টইটম্বুর। তাঁকে কেন্দ্র করে লিখেছেন অনেক নামীদামি খ্যাতিমান কবি সাহিত্যকগণও। তাঁদের জাগ্রত কলম বাংলা সাহিত্যের বরপুত্র কাজী নজরুল ইসলামকে তুলে ধরেছেন নানাভাবে, নানা আঙ্গিকে। বক্ষ্যমাণ নিবন্ধে আমরা “কবিদের কবিতায় কবি নজরুল” শিরোনাম নিয়ে আলোচনা করার প্রয়াস পাবো।
বাংলা সাহিত্যের নোবেলবিজয়ী কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নজরুলের “ধূমকেতু” পত্রিকার প্রকাশনা উপলক্ষে পাঠানো এক আশীর্বাণীতে লিখেছেন-
“আয় চলে আয়রে ধূমকেতু
আঁধারে বাঁধ অগ্নিসেতু,
দুর্দিনের এই দুর্গশিরে
উড়িয়ে দে তোর বিজয় কেতন।
অলক্ষণের তিলক রেখা
রাতের ভালে হোক না আঁকা
জাগিয়ে দেরে ধমক মেরে
আছে যারা অর্ধ চেতন।”
কবি বন্দে আলী মিয়া কাজী নজরুল ইসলামকে নিয়ে লিখেছেন-
“কতকাল তব পাশে বসি নাই, শুনি নাই কথা
শুনি নাই হাসি রোল, হেরি নাই তব চপলতা।
তোমার লেখনী স্তব্ধ- কত লগ্ন বৃথা চলে যায়,
মোরা তব প্রিয়জন চেয়ে আছি মূক দুরাশায়।”
(প্রিয় কবি/বন্দে আলী মিয়া)
কাজী নজরুল ইসলামকে নিয়ে খ্যাতিমান কবি কাজী কাদের নেওয়াজের সুুন্দর অনুভূতি-
“রবি ডুবে যায় বলাকা পাখায়, পানিয়া ভরনে গৌরী ধায়
দূর অতীতের স্মৃতি স্মরি করি! এ দীন অর্ঘ দেয় তোমায়।”
(গানের কবি নজরুল / কাজী কাদের নেওয়াজ)
বাংলা সাহিত্যের শক্তিমান কবি, কবি সুফিয়া কামাল নজরুলকে নিয়ে লিখছেন-
“ব্যথিত জনের লাগি
গানের আঘাতে হানিয়া দুয়ারে বল:
ওঠো সবে জাগি।”
(বিষের বাঁশীর কবিকে / সুফিয়া কামাল)
বাংলা সাহিত্যের আধুনিক কবি আল মাহমুদ কাজী নজরুল ইসলাম সম্পর্কে লিখেছেন-
“সাহসের সমাচার শেষ হয়ে যাচ্ছে ক্রমে ক্রমে
হে কবি, একদা
ভেসে যেতে যেতে কালো তোমার চুলের মত মেঘ
বড়ো অনুরোধ করে রক্তের ওপারে যেতে প্ররোচনা দিত,
কারাগার ভেদ কর দাঁড়াতো দণ্ডিত।
পথে এসো বলে
প্রকাণ্ড প্রাচীন মুখে গাওয়া হতো ধ্বংসের ধ্রুপদ।”
(সাহসের সমাচার / আল মাহমুদ)
বাংলা সাহিত্যের আরেক জনপ্রিয় কবি শামসুর রাহমান নজরুলের ক্ষুরধার বাক্যের তরবারিকে প্রতিটি সূর্যোদয়ের ঝলসে উঠতে দেখেন-
“একদা কবিতা তার বুক নগ্ন করে দিল
আপনার চোখের সম্মুখে
আপনি যে নগ্নতা দেখেছেন নিজেরই মনে সূর্যোদয়।”
কবি অমরেন্দ্রনাথ বন্দোপাধ্যায় নজরুলকে নিয়ে লিখেছিলেন একটি চমৎকার কবিতা। সে কবিতাটি নিম্নরূপ :
“এসো দুর্বার, বিদ্রোহী কবি! দুর্জয় দুর্দম!
এসো পূর্ণিমা পূর্ণচন্দ্র অংশু ক্ষুব্ধ সুরনদ।
এসো রুদ্রের তেজোদীপ্ত মিথ্যাকে মারি ডাণ্ডা।
এসো হিন্দুর পরম বন্ধু, মুহাম্মাদীর রক্ত ভাই
হরিও হরের মূর্ত মানব! আহবানে তব ভক্তরাই।”
জনপ্রিয় কবি কুমুদরঞ্জন মল্লিক ছাত্রজীবনে নজরুলের যে চিত্র আঁকেন তা বর্ণনা করেন এভাবে-
“কিশোর তরুণ, তেজস্বী নজরুল
অম্লান তাজা টাটকা গোলাপ ফুল।
বুকেতে তাঁহার খেলিতেছে নিশিদিন
ভাব ও ভাষার বিদ্যুৎ বেদুঈন।”
মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান লিখেছেন-
“বাংলার সবুজ পটে, গড়বে পতাকা অবিনাশী
দিলে তুমি সে শক্তির সুবিক্রম শোণিত সাহস”
(নজরুল / মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান)
প্রখ্যাত কবি আব্দুল কাদিরের অনুভূতি এ রকম-
“বিক্রমকে স্তব্ধ করতে পারেনি, পারবে না:
স্থান কালে সে বদু নহে যুগ যুগান্তে অবাধ গতি
প্রাচ্য এবং প্রতীচীতে তার লাগি নাই গতির যতি।”
(যতিচিহ্নহীন প্রতিভা / আব্দুল কাদির)
কবি মুকুল চৌধুরীর কলম নজরুল সম্পর্কে কী সুুন্দর যাদুময়ী ভঙ্গিতে লেখেন-
“অনন্য সাধক তিনি।
তাঁর কণ্ঠ ও কলমের, তাঁর ছন্দ ও সুরের
লাবণ্য ও আভায় শব্দ প্লাবিতবাক্য আপ্লুত।
তাঁর অফুরান উপমার স্রোতধারায়
অজস্র প্রস্রবণ ও সঙ্কুচিত।
অনন্য সাহস তিনি।
কী সাম্যস্তোত্র বিরচনে, কী ধ্যানের মুগ্ধতায়
কী বিশ্বচারিতায়, কী উজ্জ্বল উৎক্রান্তিতে
কী জাতি সত্তার মোচন নিনাদে, কী রাগের রসাস্বাদনে
তৃষ্ণার বিচিত্র বাগানে তিনি ঝড়ের কোকিল।”
(বাজপাখি /মুকুল চৌধুরী)
কাজী নজরুল ইসলাম সম্পর্কে বিখ্যাত কবি মসউদ উশ শহীদের মনকাড়া আবেগ-
“ওরা বলেছিল, দুদিনেই হারাবেন তিনি,
দুদিনেই মুছে যাবে সব মধু রিনিঝিনি।
যুগের বিচারে, কালের বিচারে লেখালেখি তাঁর।
টিকবে না মোটেই, হেরে যাবে বারবার।
ওরা বলেছিল- অথচ এখন ওরাই নেই
ওরাইতো হারিয়েছে- রেখে নজরুলকেই।
নজরুল আজ কাল- মহাকাল করেছে জয়
মানুষের মনে নিবিড় আসনে হয়েছেন- অক্ষয়।”
(অক্ষয় নজরুল /মসউদ উশ শহীদ)
বাংলা সাহিত্যের জনপ্রিয় কবি ও গীতিকার মতিউর রহমান মল্লিক নজরুলকে নিয়ে লিখেছেন-
“নজরুলের ভালোবাসায় ছিলো চিত্রের আগে
চিত্রাঙ্কনের বিকশিত প্রতিভা
যেমন ঝড়ের আগে অসম্ভব সাহসের উৎকর্ষ
যেমন নিসর্গের আগে সৌন্দর্যের বর্ণালী রেহান
এবং বিস্তারের আগে প্রতীতি ও প্রত্যয়ের
উত্তরঙ্গ উত্থিতির মত
অনবরত বিজয়।”
(নজরুলের ভালোবাসা/ মতিউর রহমান মল্লিক)
এ সময়ের বাংলা কবিতার অত্যন্ত জনপ্রিয় মুখ, তারুণ্যের অহঙ্কার কবি মোশাররফ হোসেন খান কাজী নজরুল ইসলাম সম্পর্কে লিখতে গিয়ে কলম চালিয়েছেন এভাবে-
“খেলাটি শেষ না হতেই বেজে গেল ঘণ্টা।
সমুদ্র তো আর দেখাই হলো না!
তা না হোক।
চলো আমরা এখন অন্যখানে যাই
যেখানে রয়েছে
সমুদ্রের চেয়েও মহান এক দ্যুতি
এসো, এইতো এখানে—
দেখ, এখানেই জেগে আছে
মান্যবর ইতিহাস।
সূর্য কিংবা সমুদ্র
সবই লীন হয়ে গেছে ঐখানে—
যেখানে নজরুলের নাম।
তাহলে এবার ফেরা যাক।
নজরুলকে দেখেছি যখন—
সমুদ্র দেখার আর
কীইবা প্রয়োজন!”
(নজরুল দর্শন/ মোশাররফ হোসেন খান)
কবি নাসির হেলাল লিখেছেন-
“তোমার ডাগর ডাগর চোখ দুটি দেখে
আমার মনে পড়লো
অসীম আকাশের কথা উদার জমীনের কথা
মনে পড়লো নদী থেকে সমুদ্রে চলাচলের কথা
আর আমার বৃদ্ধ পিতার
সস্নেহে মাথায় হাত বুলানোর কথা।”
কবি আবিদ আজাদের কবিতায় নজরুল উঠে এসেছে এভাবে-
“হে কবি, তোমার মুখ শোকাহত সর্বজনীনতা
আমাদের। বাংলা অক্ষর রাশি- আজো কাল শুনি
সুন্দরের সানুদেশে। তুমি ছিলে স্বপ্নের চিরুনি
মানুষের হাত থেকে মানুষের সমাজের চুলে।
এলিজি রচনা নয়, এ শুধু হৃদয়ে বাউণ্ডুলে
কবিতার মুষ্টির আঘাত-
করাঘাত।”
(এলিজি: নজরুল ইসলামের স্মৃতির উদ্দেশে/আবিদ আজাদ)
ভারতের স্বনামখ্যাত কবি অচিন্ত্য কুমার সেনগুপ্ত লিখেছেন-
“নজরুল ইসলাম
বন্ধনের শোষণের শাণিত ঠাকুর
কে সে যোদ্ধা দ্রোহ-দৃপ্ত চঞ্চল দুর্বার?
পরিশেষে স্থির হয়ে বসে যোগাসনে
জীবনের গভীরের প্রাণনে মননে
বিদ্রোহেরে করে তোলে প্রগাঢ় প্রণাম
কে সে যোগী? জানো তার নাম?
নজরুল ইসলাম।”
(নজরুল ইসলাম/অচিন্ত্য কুমার সেনগুপ্ত)
নন্দিত কবি জাকির আবু জাফর লিখেছেন-
“তোমার দুচোখ দেখে আজো অবাক হয় চোখেরা
কী এক স্বচ্ছতা কী এক দুরাগত ছবির ছবি
প্রতিটি মুহূর্তে কী যেন বলতে ব্যাকুল
কী যেনো অব্যক্ত রহস্যের রোরুদ্যতায় আকাশ ডুবিয়ে রাখে চিরকাল
চোখভরা সফেদ আগুন এই বুঝি পোড়াবে আলস্যের ঘুম
হাসির উল্লাসে দুলবে সমস্ত রহস্যের প্রকৃতি
পাখিরা ডানায় নীলিমা জড়িয়ে ছুটে যাবে জীবনের দিকে
আর তুমি পৃথিবীর সব ছন্দ জড়িয়ে নিসর্গে বাজাবে সুরের বাদন।”
(নজরুল তোমার চোখ/জাকির আবু জাফর)
প্রখ্যাত কবি অন্নদাশংকর রায় নজরুল সম্পর্কে সবচেয়ে সুুন্দর এবং গ্রহণযোগ্য একটি কবিতা আমাদের উপহার দিয়েছেন। সে কবিতাটি হলো এমন-
“ভুল হয়ে গেছে বিলকুল
আর সবকিছু ভাগ হয়ে গেছে
ভাগ হয়নিকো নজরুল।
এই ভুলটুকু বেঁচে থাক,
বাঙালি বলতে একজনই আছে
দুর্গতি তাঁর ঘুচে যাক।”
এমনিভাবে অসংখ্য কবি সাহিত্যিকগণ কাজী নজরুল ইসলাম সম্পর্কে সুন্দর সুুন্দর ছড়া, কবিতা, প্রবন্ধসমূহে সুচিন্তিত মতামত রেখেছেন। তাদের সেই রচনাসমূহ নজরুল সম্পর্কে জানার পাশাপাশি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছে এবং করছে। আর নবীন, প্রবীণ, নামীদামি কবি সাহিত্যিকদের লেখায় বিভিন্ন আঙ্গিকে নজরুল এসেছে এবং আসছে বলে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, নজরুল একজন বড়মাপের বিশ্ববিখ্যাত কবি। নিজের অবস্থান সম্পর্কে কবি তাই নিজেই লিখেছেন-
“আমি বিশ্ব ছাড়ায়ে উঠিয়াছি একা চির উন্নত শির।”