বাংলাদেশে ঋতু পরিক্রমার তৃতীয় ঋতু শরৎকাল। ভাদ্র ও আশ্বিন মাস নিয়ে শরৎঋতু। খ্রিষ্টীয় পঞ্জিকা অনুসারে মধ্য আগস্ট থেকে মধ্য অক্টোবর পর্যন্ত শরৎঋতুর পথচলা। শরৎকে বলা হয় শুভ্রতার প্রতীক! সাদা কাশফুল, শিউলি, স্নিগ্ধ জ্যোৎস্না, আলোছায়ার খেলা দিনভর- এইসব মিলেই তো শরৎ। শরৎকালের প্রথম মাস অর্থাৎ ভাদ্রের শুরু থেকেই শরতের আবির্ভাবটা লক্ষণীয়। শরতের স্নিগ্ধতা এক কথায় অসাধারণ! জলহারা শুভ্র মেঘের দল যখন নীল, নির্জন, নির্মল আকাশে পদসঞ্চার করে তখন আমরা বুঝতে পারি প্রকৃতিতে শরৎ এসেছে। শরতের আগমন সত্যিই মধুর। গ্রীষ্মের কাঠফাটা রোদ আর বর্ষায় অঝোরধারায় শ্রাবণ ঢলের পর আসে শরতের আলোছায়ার খেলা: এই মেঘ, এই বৃষ্টি, তো কিছুক্ষণ পরই রোদ। শরতের অন্যতম বড় আকর্ষণ কাশফুল! নদীতীরে বনের প্রান্তে কাশফুলের রাশি অপরূপ শোভা ছড়ায়। কাশফুলের এ অপরূপ সৌন্দর্য পুলকিত করেনি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া ভার। গাছে গাছে শিউলির মন ভোলানো সুবাসে অনুভূত হয় শরতের ছোঁয়া। শরতের মেঘহীন আকাশে গুচ্ছ গুচ্ছ কাশফুলের মতো সাদা মেঘের ভেলা কেড়ে নেয় মন। শরৎকালেও বর্ষণ হয়, তবে বর্ষার মতো অবিরাম নয়। বরং শরতের বৃষ্টি মনে আনন্দের বার্তা বয়ে আনে। চারপাশের শুভ্রতার মাঝে বৃষ্টির ফোঁটা যেন আনন্দ-বারি! বৃষ্টি শেষে আবারও রোদ। দিগন্তজুড়ে সাতরঙা হাসি দিয়ে ফুটে ওঠে রংধনু। শরৎকে বলা হয় ঋতুর রানি। কারণ শরৎকালই বর্ষার সৌন্দর্যকে সাদরে গ্রহণ করে অপরূপ সাজে নিজেকে সাজিয়ে তোলে। বর্ষার হালকা মেঘ শরতের নির্মল আকাশে সাদা সাদা পাল তুলে মনের আনন্দে ভেসে বেড়ায়। দিনের বেলায় শরতের স্নিগ্ধ রোদে গ্রাম-বাংলার মাঠ-ঘাট, নদী-নালা, বড় বড় জলাশয় ঝলমল করে। শরতের এমন ভোলানো রূপ সত্যিই অতুলনীয়। শরতের সৌন্দর্য আমাদের মনে জাগিয়ে তোলে অনাবিল আনন্দ। ফুল, ফল, আর ফসলের দেশ বাংলাদেশের এই ঋতু সবার মনেই আনন্দের সঞ্চার করে। বাংলা ভাদ্র-আশ্বিন এই দুই মাস শরৎকাল। শরৎ অত্যন্ত মনোরম ঋতু। যার সৌন্দর্যের তুলনা হয় না। বর্ষার একটানা অস্বস্তির পর স্বস্তির নিঃশ্বাস নিয়ে আসে শরৎ। শরতের পবিত্রতার কাছে সবাই তাই হার মানে। শরতের প্রশংসা না করে কেউ থাকতে পারে না। শরতের আবেদন তাই প্রতিটি মানুষের কাছে আদরণীয়। শরৎ অনেক গুণে গুণান্বিত বলেই একে নিয়ে কল্পনার কোনো শেষ নেই। দেশের মাটি আর মানুষের সাথে গভীরভাবে মিশে আছে শরৎ। মিশে আছে প্রকৃতির সাথে একইভাবে। প্রকৃতি যে শরৎকে পেয়ে গর্বিত তার প্রমাণ মেলে আমরা যখন তাকাই প্রকৃতির দিকে। প্রকৃতির সাথে শরতের সুনিবিড় সম্পর্ক আর বোধ হয় অন্য কোনো ঋতুতে এতোটা দেখা যায় না। শরতের গ্রাম-বাংলা যেন আমাদের জীবনের প্রতিচ্ছবি। স্বপ্নের মতো মায়াবী আর ছবির মতো ঝকঝকে। এত মায়া এত মমতা এত ভালোবাসার ঢেউ অন্য ঋতুতে পাওয়া কঠিন। শরৎকে পেয়ে প্রকৃতি আরো সবুজ ও সজীব হয়ে ওঠে। শরতের এ সবুজের বুকে আরো সবুজের আস্তরণ ছড়ায় ধানের গাছগুলো। মৃদৃ বাতাসে নেচে তারা মনের আনন্দ প্রকাশ করে এই শরৎকালে।
কচি ধানগুলো আরো সবুজ হয়। আশ্বিনের শেষে চাষির মুখে ফুটে উঠবে হাসি। কৃষকের দামাল শিশুরা ধানের গন্ধ গায়ে মেখে উঠোনে গড়াগড়ি যাবে। ধান পাকবে হেমন্তে। শরৎ সেই হৈমন্তিক বাণী শোনায় কৃষকের কানে। শরতের ভোরে কৃষক ধানের জমির আল ধরে হেঁটে যায়। কৃষকের পায়ে শিশিরভেজা ঘাস আর শরীরে ধানগাছের পাতা পরশ বুলায়। এ পরশ তার মনে সুখের আমেজ আনে। শরতের ভোরে শিশিরে ধুয়ে যায় মাঠ-ঘাট-পথ-গাছ-পালা। মনে হয় প্রকৃতি যেন সারা রাত স্নান করেছে। মুক্তোর মতো ঘাসের ডগায় সূর্যের আলতো কিরণে ঝলমল করে ওঠে শিশির বিন্দু। শিউলি ফুলের পাপড়িতে কেঁপে ওঠে শরতের ভোর। আদর বুলানো হাওয়া। শিরশির দুলুনিতে মুগ্ধ। ভীষণ আরাম লাগে। ঘুম ঘুম আরামে চোখ বুজে আসে। কিন্তু মানুষ আবার ব্যস্ত হয় কাজে। কাজের সন্ধানে ছুটে চলে মানুষ। ছেলেমেয়েরা যায় পাঠশালায়। চাষি ছুটে খেত-খামারে। সারাদিন ব্যস্ততার পর আবার মানুষ ফিরে আসে আপন ঠিকানায়। শরতের প্রকৃতি আসলেই মনোমুগ্ধকর। সারা আকাশজুড়ে মেঘেদের ওড়াউড়ি। মেঘগুলো যেন উড়তে উড়তে কাত হয়ে যায়। ঢুকে যায় একদল থেকে আরেকদলে। কখনো উধাও হয়ে যায়। হারিয়ে যায় শূন্য থেকে। কোন কোন মেঘদল নেমে আসে দিগন্ত ছেড়ে। নেমে আসে পাহাড়ের ঢালে। উল্লেখ্য, শরতের আকাশ গাঢ় নীল। সাদা মেঘের ওপাড়ে নীলের গ্রাম। তাই শরতের আকাশভরা নীলে জেগে ওঠে সমুদ্র। সমুদ্রের বুকে বিছানা পাতে নীল। লোনা আরামে ঘুমিয়ে পড়ে। আবার জেগে ওঠে ঢেউয়ের উচ্ছ্বাসে। শরৎ দাঁড়িয়ে থাকে বকুল তলায়। ঝরে পড়া বকুলেরা দেখে। কাছে আসে শরৎ। বকুলের সৌরভ মেখে নেয়। মেখে নেয় হাতে মুখে গায়ে। শরৎ সুবাসিত হয়। এক সময়ে পুব আকাশে উজ্জ্বল করে সূর্য ওঠে। সকাল পেরিয়ে গড়িয়ে আসে শরৎ দুপুর। বকুল ছায়ায় ভিজিয়ে নেয় শরৎ দুপুর। শরৎ দুপুরের আলোয় ঘাস, ধান, বাঁশঝাড়, খড়ের চালে জমে থাকা শিশির বিন্দুগুলো শুকিয়ে যায়। শরতের দুপুর বড়ই নির্মল। নীলের গভীরতা বেড়ে যায় আকাশে। সাদা হালকা মেঘ আনমনে উড়ে যায়। ওড়ে দক্ষিণা দিগন্ত ছেড়ে। নীরব পাখা মেলে ওড়ে সাদা চিল। মেঘের কাছাকাছি ডানা মেলে শিকারি ঈগল। কোথায় লুকিয়ে আছে তার শিকার। শরতের দুপুর খানিকটা দক্ষিণে বেঁকে যায়। ধীরে ধীরে ছোট হয়। তারপর হেঁটে যায় বিকেলের দিকে। উল্লেøখ্য, শরতের বিকেল আরো মায়াবী। রোদ নিজেকে অনেকটা শীতল করে নেয়। সবুজ গাছগাছালি রোদ খেয়ে খেয়ে বেশ তাজা হয়ে ওঠে। কলাপাতার গায়ে রোদের সাথে কাত হয়ে থাকে শরৎ। ফলে বনানীর মতো মাঠও সবুজ হয়ে ওঠে। একসময় মাঠভরা ধানের সবুজে গড়াগড়ি করে শরৎ বিকেল। শরৎ সন্ধ্যা এসে দাঁড়ায় লালিমার নিচে। লাল কমলায় রাঙা হয় শরতের মুখ। শরৎ সন্ধ্যায় জমে ওঠে কবিতার আসর। গানের জলসা। পাখিদের গানে গানে শরৎ সন্ধ্যা প্রবেশ করে রাতের ঘরে। ঝিরঝির বাতাস হাত বুলিয়ে যায় প্রকৃতির গায়ে। সেই আরাম নিয়ে আসে শরতের রাত। পাখিরা চোখ বোজে, চোখ বোজে প্রকৃতির গাছেরা। ধীরে ধীরে শরৎ হাঁটে রাতের দিকে। রাতের শরৎ মানে ভেজা ভেজা ঘুম। ঘুম ঘুম তারাজ্বলা রাত। রাতভর জেগে থাকে জ্বোনাকি। শরৎ রাতের গায়ে জোনাকিরা খেলে যায়। শরতের রাত বড় মজার রাত। না ঠাণ্ডা। না খুব দীর্ঘ, না খুব ছোট। শরৎ রাতে আকাশে দেখা দেয় ঘন তারকার বন। রাতভর, সারারাত। একটানা জ্বলে। জ্বলতে জ্বলতে কত তারা নিভে যায়। নিভতে নিভতে আবার জ্বলে। কোন কোনটি দূর থেকে কাছে আসে, কোনটি আবার কাছ থেকে দূরে সরে যায়। যেতে যেতে চোখের আড়াল হয়ে যায়। এভাবে কত তারা জ্বলে আর কত তারা নেভে, কে রাখে তার খবর! শরতের মধ্য রাতে আকাশে জমে তারার মিছিল। উল্লেখ্য, শরতের পূর্ণিমা রাতে জ্যোৎস্নায় মন ভরে ওঠে। শরতের রাতে কোন একটি পূর্ণিমা যদি কেউ দেখে থাকে তবে সে কখনোই শরৎকে ভুলতে পারবে না। এ সময় মেঘমুক্ত রাতের আকাশে চাঁদ তার প্রাচুর্য উজাড় করে ঢেলে দিয়ে আকাশে ভাসে। কী অপূর্ব সেই দৃশ্য! যা ভোলার নয়। শরতের জোছনা শ্রাবণের মতো স্বচ্ছ থাকে না। ধোঁয়ায় মিশিয়ে নামে জোছনারা।
কুয়াশা কুয়াশা রাত কুয়াশায় মাখা মাখা চাঁদ। চাঁদের মুখে বিরাট দীঘি। রঙ মাখা। শরতের রাত বেয়ে পাখিরা উড়ে যায় ভোরের দিকে। সেই ভোর নেমে আসে আকাশ ছুঁয়ে। সেই আকাশই হয়ে যায় শরৎ সুদিন। উল্লেখ্য, শরৎ উৎপাদনের ঋতু। কৃষিনির্ভর বাংলাদেশে বর্ষায় জনজীবন বিপর্যস্ত হলেও বর্ষার কোন বিকল্প নেই। বর্ষার অবিরাম বর্ষণ আর খাল-নদী-বিল ছাপিয়ে আসা পানি অবারিত সবুজের মাঠ প্লাবিত করলেও পানি নামার সময় থেকে যায় স্তরে স্তরে পলি। যে পলিতে কৃষক বোনে তার আগামীর স্বপ্ন। তার স্বপ্ন জুড়ে থাকে সবুজ ফসলে ভরা দিগন্তজোড়া ক্ষেত। তাই বর্ষার উর্বর মাটিতে সবুজ সোনা ফলাতে আসে শরৎ। শরৎ এলে বৃক্ষরাজির আড়ালে আবডালে থাকা পাখিরা নুতন প্রাণের স্পন্দনে জেগে ওঠে। এ কথা সত্য যে বর্ষাকাল বন্য প্রাণীসহ নানা বর্ণের পাখিদের জন্য বেশ কষ্টের। তাই শরতের আগমনে তাদের দুঃসহ স্মৃতি ভুলে নতুন করে বাসা ও আশা বোনে। নানা গায়ক পাখির গানে মুখরিত হয়ে ওঠে শরতের পরিবেশ। এ সময় আমাদের জাতীয় পাখি দোয়েল, কোয়েল, বুলবুলিসহ সকল পাখি গান করে। বিশেষত শরৎকালে দোয়েল পাখির শিস শুনতে কী যে ভালো লাগে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। উল্লেখ্য, শরতের এই স্নিগ্ধ শোভাকে আরো মোহনীয় করে এই মৌসুমের বিচিত্র ফুলেরা। নদী কিংবা জলার ধারে ফোটে কাশ-কুশ, ঘরের আঙ্গিনায় ফোটে শিউলি-শেফালি, খাল-বিল-পুকুর ডোবায় থাকে অসংখ্য জলজ ফুল। আর শেষ রাতের মৃদু কুয়াশায় ঢেকে থাকা মায়াবী ফুলেরা যেন আরো রূপসী হয়ে ওঠে। শিশির ভেজা শিউলি বাতাসে মৃদু দোল খাওয়া কাশবনের মঞ্জরি, পদ্ম-শাপলা-শালুকে আচ্ছন্ন জলাভূমি শরতের চিরকালীন রূপ। সত্যিই বিচিত্র রূপ নিয়ে শরৎ আমাদের চেতনায় ধরা দেয়। আমাদের অন্যান্য ঋতুগুলো অনেক ফুলের জন্য বিখ্যাত হলেও মাত্র কয়েকটি ফুল নিয়ে শরৎ গরবিনী। তাই কাশ-শিউলির শোভা উপভোগ করতে হলে আমাদের রূপের রানি শরতের কাছে যেতে হবে। ভাবুকদের কাছে শরৎ ঋতু নানা গুণে গুণী। নমনীয়তা, ভদ্রতা, স্নিগ্ধতা ও মিষ্টতার ঋতুও শরৎ। কারো মতে রূপসী রূপের পরী, কারো কাছে ঋতু পরী শরৎ। আসলেই তাই। বসন্তের পর শরৎ ছাড়া এমন কোন ঋতু নেই যা ছোট বড় সকলের মনে দোলা দিতে পারে। শরতের সুখ মেখে এভাবেই কাটে এ দেশের মানুষের জীবন। ছন্দময়, গতিময় এক অনাবিল শান্তির ঋতু শরৎ। এই শরতে আমাদের মন আন্দোলিত হয় বারবার। তাই শরৎ ঋতুর রানি- শরৎ সুন্দর, শরৎ প্রাণোচ্ছল, শরৎ সজীব। শরতের সাথে জড়িয়ে রয়েছে সৌন্দর্যের ছোঁয়া। শরতের বর্ণনা দিতে গিয়ে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘শরৎ, তোমার অরুণ আলোর অঞ্জলি/ ছড়িয়ে গেল ছাপিয়ে মোহন অঙ্গুলি/শরৎ, তোমার শিশির-ধোয়া কুন্তলে/বনের-পথে-লুটিয়ে পড়া অঞ্চলে/আজ প্রভাতের হৃদয় ওঠে চঞ্চলি’। শুধু রবীন্দ্রনাথ নন, শরৎ নিয়ে আরও অনেক কবি কাব্য রচনা করেছেন। শরতের মন ভোলানো প্রকৃতিতে মন যে কী চায় তা বোঝা বড়ই মুশকিল! রোদ আর বৃষ্টির লুকোচুরি খেলায় মনেও যেন জমে মেঘ, আবার কখনও হয়ে ওঠে রৌদ্রকরোজ্জ্বল। বাংলাদেশের শরৎ ঋতুর সব সৌন্দর্যের প্রতীকই চিরন্তর প্রহরী। পথিকদের স্বাগতম জানান দেয় শরৎঋতু। বলা যায় শরতের ছোঁয়ায় বাংলাদেশ শুধু সুন্দরই নয়, অপূর্ব, অতুলনীয় ও অসাধারণ সুন্দর হয়ে ওঠে।