গোলাম আলি মন্ডল, মুখ বাঁকা, মাথা গোল; ছেলেদের এসব কথা শুনে গোলাম আলি মাস্টার কোনো দিকে না তাকিয়ে দ্রুত হেঁটে চলে যান স্কুলে। প্রথমদিকে তিনি বাজারের রাস্তা দিয়েই যেতেন। তাঁর মাথার ওপর কাল রঙের একটি ছাতা। তিনি অযথা কারো সাথে কথা বলতে যান না। কিন্তু তাকে দেখলেই উঠতি বয়সের ছেলেরা সমস্বরে বলতে থাকে “গোলাম আলি মন্ডল, মুখ বাঁকা মাথা গোল।” ছেলেদের কথায় তিনি রাগ করেন না। কিন্তু মনে-মনে কষ্ট পান। ছেলেরা অনেক সময় তার দিকে ঢিলও ছোড়ে। কখনো তিনি অতিষ্ঠ হয়ে বলেন, মুরব্বিদের প্রতি এ তোমাদের কেমন ব্যবহার? এতটুকুই। তবে, রাগলে তিনি কী করবেন আর কী করতে পারেন এ ধারণা অনেকেরই নেই।
এখন তিনি রেললাইন ধরে হাঁটেন। কিন্তু ছেলেদের চোখ এড়াতে পারেন না। ঐ এক বুলি তাকে শুনতেই হয়।
স্কুলের ছেলেরা ব্ল্যাকবোর্ডে ছাতা মাথায় একটি লোক এঁকে নিচে লিখে রাখে- “গোলাম আলি মন্ডল, মুখ বাঁকা মাথা গোল।” মাস্টারের মনটা খারাপ হয়ে যায়। তিনি ছাত্রদের বলেন, তোমরা বিদ্যা অর্জনের জন্য স্কুলে এসেছো। দুষ্টুমি চিন্তা যদি মনের মধ্যে বাসা বাঁধে তা’হলে বিদ্যা অর্জন করা সম্ভব হবে না। তা ছাড়া গুরুজনদের প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধা থাকা অবশ্যই কর্তব্য। আমার মুখটা একটু বাঁকা দেখালেও আমি তো তোমাদের ভুল শিক্ষা দেই না।
কিছু ছেলে আছে তারা সত্যি ভালো। মাস্টার দেশ-বিদেশের অনেক গল্প শোনায় ছেলেদের। আকাশে নক্ষত্রমণ্ডলী কে-কোথায় অবস্থান করছে, কার কী কাজ এবং গভীর সমুদ্রের তলদেশে কত রকম খনিজপদার্থ আছে সে সব কথাও তিনি বলেন। তিনি বাড়িতে প্রচুর বই-পত্র পড়েন। অনেক কঠিন-কঠিন বিষয় নিয়ে ভাবেন। যে কারণে তুচ্ছ বিষয়গুলো তিনি মন থেকে ঝেড়ে ফেলে দেন।
শুক্র ও শনিবার তিনি মোন্তাজ চেয়ারম্যানের বৈঠকখানায় যান। বলতে গেলে এটা তাঁর অভ্যাসে দাঁড়িয়েছে। সেখানে গ্রামের আরও পাঁচ-সাতজন ব্যক্তি উপস্থিত হয়। তারাও মন্ডলকে নিয়ে নানান রকম রসিকতা করে। কখনও তাঁর ছাতাটা লুকিয়ে রাখে, আবার কখনও তাঁর জুতার হদিস পাওয়া যায় না। এসব নিয়ে হর-হামেশাই হাসা-হাসি করে সবাই। মন্ডলের খুব রাগ হয় ঠিকই কিন্তু কাউকে কিছু না বলে রাতের বেলা অন্ধকার পথে একা-একা বাড়ি ফিরে আসেন।
রাতে জঙ্গলের পথ ধরে মাস্টার বাড়িতে ফিরে যান; এ নিয়েও তাকে কথা শুনতে হয়। কেউ বলে, মন্ডলের কি ভূতের ভয় নেই? মন্ডল উত্তরে বলেন, ভূত থাক্ আর নাইবা থাক্ তাকে নিয়ে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। মাস্টারকে ভূতের ভয় দেখাতে কেউ ভূতের মত সেজে ডোবার ধারে হিজল গাছের ডাল থেকে লাফিয়ে পড়েছে তার সামনে। মাস্টার সাহেব চম্কে উঠেছেন ঠিকই; কিন্তু ভয় পাননি। এই ছমির তুই কি ভূত? এ কথা বলতেই ছমির ভূত দৌড়ে পালিয়েছে।
আজ আড্ডায় স্যাটেলাইট নিয়ে তর্ক-বিতর্ক চলছিলো। সবুজ মাতবর বলছিলো, আজ সন্ধ্যার পর আকাশটা কেমন আগুনের মত হয়ে উঠলো। উত্তর দিকে কুন্ডুদের বিশাল বাঁশ-বাগানের ওপর দিকে একটা আলো দেখা গেলো। চোখের পল্কেই আবার হারিয়ে গেলো। বছরখানেক আগেও দেখা গিয়েছিলো অন্ধকার আকাশ আলোকিত করে একটা চক্র যেনো ঘুরছে। পরে জানা গেলো ওটা ছিলো রাশিয়ান স্যাটেলাইট। আরেকজন বললো, পৃথিবী থেকে প্রায় চারশত মাইল ওপর দিয়ে ঘুরছিলো সেটা। এখন কত দেশ রকেট ছাড়ছে, বিজ্ঞানের খেলা চলছে পৃথিবী জুড়্।ে উকিল সাহেব বললেন, এখন তো অন্য গ্রহ থেকেও মানুষ আসছে আমাদের পৃথিবীতে। আমরা দেখতে পাই না; কিন্তু তারা সব দেখতে পায়।
সোনামিয়া চুপ করেই ছিলো, সে হঠাৎ বললো, অন্য গ্রহের মানুষেরা আমাদের চেয়ে অনেক উন্নত। হাওয়ার গাড়িতে আসে আবার হাওয়ার গাড়িতে ভেসে চলে যায়।
গোলাম আলি মাস্টার আলোটা দেখেছে কুন্ডুদের বিশাল বাঁশ-বাগানের মধ্যে। বাগানের ওপর দিকে একটা নীল আলোর আভা ছড়িয়ে আছে। উকিল সাহেব বললেন, স্যাটেলাইট-ফাইট নিয়ে মাথা ঘামানোর দরকার কী। বিজ্ঞানের যুগ, কালে-কালে কত কিছু দেখা যাবে। আকাশে কি আলোর অভাব আছে? একটা কিছু দেখলেই পরদিন কাগজে তা নিয়ে ফলাও করে লেখা হচ্ছে।
বাবুল বয়সে অন্যদের চেয়ে ছোট- সে বললো, সবই তো মানুষেরই তৈরি তবে, সে মানুষ যে গ্রহেরই হোক; মহান সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টি নিয়ে ভাবতে গেলে মাথার মধ্যে গোলমাল শুরু হয়ে যায়। উকিল সাহেব বললেন, লোক নেই, জন নেই যন্ত্র চলচ্ছে। আর রকেট তো অজানা কত খবর পাঠাচ্ছে তা পাঠাক না। যদি আমাদের দেশে একটা কিছু তৈরি হতো, তা’হলে গর্ব করার বিষয় হতো। অন্য একজন বললো, অন্য গ্রহ থেকে সাপ, ব্যাঙ যাই আসুক সেটা আমাদের এই জঙ্গলা দেশে কেন আসবে? আমেরিকা, জাপান, ইংল্যান্ড আরও কত দেশ আছে গেলে তারা সেখানে যাবে। শত-বছরের পচা ডোবা থেকে আগুনের আভা উঠতেই পারে তা নিয়ে ভাবনার কী আছে। ভূতও তো আলোর পিণ্ড হয়ে এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় ছুটে বেড়ায়। এসব কথা বলে সবাই যে যার চায়ের কাপে ঠোঁট ছুঁয়ালো। মাস্টার সাহেব চুপ করে ভাবতে লাগলেন, বাইরের গ্রহ থেকে যারা আসবে তারা বড় শহরে কেন; বন-জঙ্গলেও আসতে পারে। নির্জন জায়গা তাদের জন্য বেশ নিরাপদ। তবে তারা ভূত নয়; আবার বাঘ, ভাল্লুকও নয়। এদেশের ভাষা না বুঝলেও তারা যথেষ্ট বুদ্ধিমান। কিন্তু তারা দেখতে যে কেমন, এটাই হলো বড় কথা। তবে মনে হয়, পৃথিবীর মানুষের মত পালোয়ান নয়। এ কথা তো সত্য যে যারা বেশি খায়, তাদের বুদ্ধি কম। বাঙালিরা খেয়ে আর রসিকতা করেই দিন কাটায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঠিকই বলেছেন, পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোর ঢেউ যখন আমাদের দেশে এসে লাগে তখনও আমরা লাউয়ের জাঙ্গলা নিয়ে ক্যাইজা আর মারামারি করি।
তিনি একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ভাবলেন, এসব কথা এদের কাছে বলে নিজেকে আর অপমানিত করতে চাই না। এবার উঠি বেশ রাতও হয়েছে আজ। সবাইকে উদ্দেশ করে তিনি বললেন, আজ বেশ রাত হয়ে গেলো এবার আমি চলি। সোনামিয়া বললো, বাঁকা যেতে চাচ্ছে যাক; তবে ভূতে ধরলে চিৎকার দিও।
আসলে মাস্টারের মুখটা একটু বাঁকা আর রাগের মাথায় বেশি কথা বলতে গেলে সব তালগোল পাকিয়ে যায়। সবার এলোমেলো কথায় মনটা তার বিশ্রি রকম খারাপ হয়ে গিয়েছিলো। মাস্টার সাহেব জঙ্গলা পথে এগিয়ে বাঁশ-বাগানের কাছাকাছি গিয়ে সত্যি একটা সবুজ আলো দেখতে পেলেন। যেন কোন হিরা থেকে একটা আলো চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। তিনি প্রথম ভাবলেন, শুকনো লতা-পাতায় বুঝি আগুন লেগেছে। বনের মধ্যে খানিকটা জায়গা ফাঁকা এবং নিচু। হঠাৎ তার মনে হলো; ঝিঁঝি পোকারা ডাকছে না, অন্য কোন সাড়া-শব্দও নেই জঙ্গলে। এমন নীরব অবস্থা তো আগে কখনও দেখিনি। কেমন যেন থম্থমে ভাব।
মাস্টার সাহেব কৌতূহল বশে বাঁশ-বাগানের সেই আলোটার দিকে এগিয়ে যেতে লাগলেন। ছড়ানো উজ্জ্বল আলোটা স্থির। তখনই চিঁচি একটা একটানা শব্দ তার কানে এলো। মাস্টার সাহেবের গাটা একটু ছম্ছম করে উঠলো। তবুও এগিয়ে চললেন তিনি। ডোবার থেকে বিশ-পঁচিশ হাত দূরে ঘন বাঁশঝাড়টা পেরোতেই তিনি দেখতে পেলেন বেশ বড় একটা কাচের বাটির মত জিনিস ডোবাটা জুড়ে উপুড় হয়ে পড়ে আছে। আর তার স্বচ্ছ ঢাকনার ভেতর থেকে মোহময় এক তীব্র কিন্তু ¯িœগ্ধ নীলচে আলো বিচ্ছুরিত হচ্ছে।
এমন অদ্ভুত দৃশ্য মাস্টার সাহেব স্বপ্নেও কখনও দেখেন নাই। অবাক হয়ে চেয়ে থাকলেন তিনি। জিনিসটা স্থির হলেও নির্জীব নয়। বুকের শ্বাস-প্রশ্বাসের মতই একটু একটু ওঠা-নামা করছে। আর একটু ভালো করে দেখার জন্যই তিনি একেবারে কাছেই চলে গেলেন। হঠাৎ তাঁর শরীরে বিদ্যুৎ প্রবাহ খেলে গেলো। তিনি অনুভব করলেন; অদৃশ্য কিছু দিয়ে তাঁর হাত এবং পা বেঁধে ফেলা হয়েছে। তাঁর আর নড়বার শক্তি নেই। তিনি না পারছেন এগোতে, না পারছেন পেছাতে।
কিছুক্ষণ এভাবে দাঁড়িয়ে থাকার পর জিনিসটার স্পন্দন থেমে গেলো। হালকা সেই শব্দটাও আর শোনা গেলো না। কাচের ঢাকনার একটা কপাট যেনো সরে গেলো আর মানুষের মত অত্যন্ত মিহি স্বরে চিৎকার এলো “ডং চিং ডাং মিলি পিলিং”।
মাস্টার সাহেব চম্কে উঠে কাঠের পুতুলের মত দাঁড়িয়ে থাকলেন। ভাবলেন, এ আবার কী রকম ভাষা? শব্দটা আবার হতেই মাস্টার সাহেবের বুকটা ধড়াস করে উঠলো। হু আর ইউ? হু আর ইউ?
মাস্টার বুঝলেন, তাকেই প্রশ্নটা করা হচ্ছে- তাই তিনি বললেন, আই অ্যাম গোলাম আলি মন্ডল স্যার।
প্রশ্ন এলো আর ইউ ইংলিশ?
গোলাপ আলি মাস্টার চেঁচিয়ে বললেন, নো স্যার- বাঙালি। এদেশের নাম বাংলাদেশ। পরাধীন ছিলাম, প্রায় পঁয়তাল্লিশ বছর হলো; স্বাধীনতা লাভ করেছি।
আর ইউ মুসলিম?
ইয়েস স্যার।
আস্সালামু আলাইকুম।
মাস্টার উত্তরে বললেন, ওয়ালাইকুম আস্সালাম।
অদ্ভুত এক প্রাণী। মাথাটা বেশ বড়। শরীরে তেমন মাংস নেই বললেই চলে। মাথা বাদ দিয়ে হালকা-পাতলা একটা গোলাপি কাপড়ে তার দেহটা ঢাকা। লোকটা এক’পা-দু’পা করে এগিয়ে এলো। সে এক দৃষ্টিতে মাস্টারকে দেখতে লাগলো। তারপর মিহি স্বরে বললো, তুমি মানুষ? ভয় পাওয়ার কিছু নেই।
মাস্টার বললেন, জি।
লোকটা বললো এটা তো পৃথিবী, তোমাদের দেশ বাংলাদেশ?
জি।
সে বললো, যাবার কথা ছিলো মঙ্গলে, অসাবধানে যন্ত্রপাতি গোলযোগের কারণে এসে পড়েছি বাংলাদেশে। এই বলে সে একটু মৃদু হাসলো। মাস্টার কী বলবে কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলো না। লোকটা একেবারে মাস্টারের কাছে তার লম্বা-লম্বা আঙুল ছোঁয়ালো মাস্টারের মুখে। তারপর তার গা, হাত, পাও টিপে-টিপে দেখতে আরম্ভ করলো লোকটা। শেষে বললো, আমি ক্রোসিয়ান গ্রহের অ্যাং। আমি মানুষের চেয়ে অনেক উচ্চ স্তরের প্রাণী।
মাস্টার মনে মনে হাসলেন। চার ফুট প্রাণী সে আবার মানুষের চেয়ে অনেক বুদ্ধিমান? কথাটা বুঝে ফেললো অ্যাং। সে বললো, তুমি কয়টি ভাষা জানো?
মাস্টার বললেন, বাংলা, ইংরেজি আর কিছুটা উর্দু।
অ্যাং বললো, তার মানে আড়াইটা, আর আমি জানি পনেরো হাজার ভাষা। তা ছাড়া ত্রিশটি গ্রহের ভাষা আমার জানা আছে। তোমার বয়স কত?
এবার পঞ্চান্নতে পড়েছে।
আমার বয়স সাতশত বিয়াল্লিশ। তোমরা মাংস খাও?
হাঁস, মুরগি, গরু, ছাগল মহিষ সবই খাই।
আমরা মাংস খাই না- সবজি খাই। তবে অনেক আগে মাংস খেতাম।
অ্যাং গোলাকার একটা ছোট পাথর দিলো মাস্টারের হাতে। সেটা হাতে ধরতেই মাস্টারের শরীরটার মধ্যে যেন বিদ্যুৎ খেলে গেলো। সে তখনই সেটা ফেরত দিলো অ্যাংকে। অ্যাং বললো, এটার এমন শক্তি যে কোন শত্রু মরবে না তবে সে অথর্ব হয়ে পড়বে। মাস্টার নির্বাক। অ্যাং বললো, তুমি কি কিছু দেখতে চাও? যা জীবনে দেখোনি? মাস্টার মনে মনে ভাবলো বাংলাদেশের কত জায়গাই তো এখনও দেখা হয়নি। তবে টেলিভিশনের মাধ্যমে অনেক জায়গা দেখেছি। শুনেছি সমুদ্রের তলদেশে কত কিছু আছে, তা- একবার নিজের চোখে দেখার বড় ইচ্ছা। অ্যাং ছোট একটি কাচের নল মাস্টারের হাতে দিয়ে বললো, এখানে চোখ রাখো দেখতে পাবে।
মাস্টার নলের মুখে চোখ লাগাতেই দেখলেন, গভীর সমুদ্রতলায় ছোট-বড় অনেক পাহাড়। সেগুলো সোনার মত ঝক্্মক করছে। তিনি বললেন, ঐ পাহাড়গুলি কি স্বর্ণের?
হ্যাঁ, সব স্বর্ণের পাহাড়।
হাদিস শরীফে এরকম সব কথা আছে। শুনেছি একদিন সমুদ্র সব শুকিয়ে যাবে আর ঐ স্বর্ণ নিয়ে পৃথিবীতে যুদ্ধ লেগে যাবে। লোভে পড়ে মানুষ শুধু একে অন্যের হাতে মরতেই থাকবে; তবু কেউ থেমে থাকবে না। মাস্টার আর চোখ রাখতে পারলেন না। মাথাটা বোঁ-বোঁ করছে। তিনি যন্ত্রটা ফেরত দিলেন।
অ্যাং বললো, এবার বুঝলে তো আমরা মানুষের চেয়ে শ্রেষ্ঠ।
মাস্টার বললেন, একশত ভাগ সত্য।
অ্যাং বললো, তোমায় দেখে, তোমার হাত, পা টিপে মনে হলো যে তুমি নিকৃষ্ট প্রাণী হলেও মানুষটা ভালো। তবে তোমার দোষ হচ্ছে যে, তুমি নিরীহ, তাই তুমি জীবনে উন্নতি করতে পারনি। অন্যায়ের প্রতিবাদ না করা তোমার দোষ। তুমি অপমান সহ্য করো- এটা কোন প্রাণীই করে না। তোমার সাথে কথা বলে বেশ ভালো লাগলো। আর সময় নষ্ট করা যাবে না- এবার আমাকে যেতে হবে।
মাস্টার কিছু বলার আগেই অ্যাং সেই গ্লোবের মত যন্ত্রটার ভেতরে ঢুকলো আর ঘূর্ণি বাতাস ছড়িয়ে চোখের পল্কে উধাও হয়ে গেলো। তারপরই বন জুড়ে ঝিঁঝি পোকারা ডাকাডাকি শুরু করলো, দূরে কোথাও হুতুম পেঁচাও ডেকে উঠলো। জোনাকিরাও আলো জ্বেলে ওড়াউড়ি শুরু করলো।
তারপর; মাস্টার বাড়ির পথে পা রাখতেই তার মনের মধ্যে একটা জোসের ঢেউ গড়ালো। তিনি মনে-মনে ভাবলেন, কী আশ্চর্য! কী অদ্ভুত! সারা পৃথিবীর কারোর সঙ্গে নয়; শুধু তার সঙ্গে দেখা দিলো, কথা বললো, সৌরজগতের এক অজানা গ্রহের একজন লোক- লোক মানে অ্যাং। নিজেকে অন্য এক মানুষ ভাবতে শুরু করলেন মাস্টার।
পরদিন ছিলো শনিবার। চেয়ারম্যানের বাড়িতে চলছিলো জমাট আড্ডা। গতকালের আলোর খবর কাগজে বেরিয়েছে। নেহাতই নগণ্য দু’চার কথা। সেটাকে ফ্যালিং সসার বা উড়ন্ত পিরিচের মত গুজবের মধ্যে টেনে আনা হয়েছে।
আজ কুন্ডু বাড়ির রবিও এসেছে। তার পঁচিশ বিঘা বাঁশবনের মধ্যে যে ডোবাটা আছে, তার চারপাশের বাঁশঝাড় নাকি রাতারাতি একেবারে ন্যাড়া হয়ে গেছে। এই বিষয়েই কথা হচ্ছিল, এমন সময় উকিল সাহেব হঠাৎ বলে উঠলেন, আজ গোলাম আলি মাস্টারের আসতে দেরি হচ্ছে কেন? ব্যাকা না থাকলে আড্ডাটা পুরোপুরি জমে না।
চেয়ারম্যান বললেন, তা বললে তো চলবে না- মাস্টারকে তো আসতেই হবে। বাবুল দরজা পর্যন্ত এগিয়ে যেতেই মাস্টার এসে হাজির। তিনি যেন ছোট-খাটো একটা দম্কা হাওয়া কাঁধে করে নিয়ে এসেছেন। উপস্থিত সবাই কেমন থম্কে গেলো।
তারপর; সত্যি যেন ঝড় উঠলো। মাস্টার পুরা এক মিনিট ধরে হো-হো করে অট্টহাসি হাসলেন। এমন হাসি এর আগে কেউ কখনও শোনেনি এমনকি মাস্টার নিজেও না।
হাসি শেষে মাস্টার একটা প্রচণ্ড গলা খাঁকরানি দিয়ে গভীর গলায় বলতে শুরু করলেন, উপস্থিত বন্ধুগণ, আমি খুবই আনন্দের সঙ্গে জানাচ্ছি যে, এই সন্ধ্যাকালীন আড্ডায় আজই আমার শেষ দিন। কেননা আপনারা সবাই অযথা বক্বক করেন। আপনাদের অন্যায় ছেলেমানুষি আমার মনটাকে তিক্ত করে দিয়েছে। প্রয়োজন হলে এই আসরে আমার মিনি বিড়ালটাকে পাঠিয়ে দিব।
ও-হ আজ দেখি রবি কুন্ডুও এসেছে। খবরটা সবাই শুনে রাখুন- গতকাল রাতে ক্রেসিয়ান গ্রহ থেকে একটা অ্যাং এসে ঐ বাঁশ-বাগানের নিচু জায়গাটির মধ্যে নেমেছিলো। আমার সঙ্গে তার আলাপ হয়েছে, সে সত্যি ভালো।
এইটুকু বলেই মাস্টার উকিলের পিঠে একটা তব্লার চাটি মেড়ে সদর্পে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।
সবাই হাঁ হয়ে তাকিয়ে থাকলেন তার গমন পথের দিকে। আজ কেউ তার মুখটা বাঁকা দেখলেন না; বা এত কথা বলার পরও কোথাও তার কথা আটকালো না। ঠিক তখনই চেয়ারম্যান সাহেবের হাতটা কাঁপতে-কাঁপতে গরম চা ঢেলে পড়লো তার সাদা ধপ্্ধপে পাঞ্জাবির ওপর। অন্য গ্রহের মানুষ
দেলোয়ার হোসেন
গোলাম আলি মন্ডল, মুখ বাঁকা, মাথা গোল; ছেলেদের এসব কথা শুনে গোলাম আলি মাস্টার কোনো দিকে না তাকিয়ে দ্রুত হেঁটে চলে যান স্কুলে। প্রথমদিকে তিনি বাজারের রাস্তা দিয়েই যেতেন। তাঁর মাথার ওপর কাল রঙের একটি ছাতা। তিনি অযথা কারো সাথে কথা বলতে যান না। কিন্তু তাকে দেখলেই উঠতি বয়সের ছেলেরা সমস্বরে বলতে থাকে “গোলাম আলি মন্ডল, মুখ বাঁকা মাথা গোল।” ছেলেদের কথায় তিনি রাগ করেন না। কিন্তু মনে-মনে কষ্ট পান। ছেলেরা অনেক সময় তার দিকে ঢিলও ছোড়ে। কখনো তিনি অতিষ্ঠ হয়ে বলেন, মুরব্বিদের প্রতি এ তোমাদের কেমন ব্যবহার? এতটুকুই। তবে, রাগলে তিনি কী করবেন আর কী করতে পারেন এ ধারণা অনেকেরই নেই।
এখন তিনি রেললাইন ধরে হাঁটেন। কিন্তু ছেলেদের চোখ এড়াতে পারেন না। ঐ এক বুলি তাকে শুনতেই হয়।
স্কুলের ছেলেরা ব্ল্যাকবোর্ডে ছাতা মাথায় একটি লোক এঁকে নিচে লিখে রাখে- “গোলাম আলি মন্ডল, মুখ বাঁকা মাথা গোল।” মাস্টারের মনটা খারাপ হয়ে যায়। তিনি ছাত্রদের বলেন, তোমরা বিদ্যা অর্জনের জন্য স্কুলে এসেছো। দুষ্টুমি চিন্তা যদি মনের মধ্যে বাসা বাঁধে তা’হলে বিদ্যা অর্জন করা সম্ভব হবে না। তা ছাড়া গুরুজনদের প্রতি ভক্তি-শ্রদ্ধা থাকা অবশ্যই কর্তব্য। আমার মুখটা একটু বাঁকা দেখালেও আমি তো তোমাদের ভুল শিক্ষা দেই না।
কিছু ছেলে আছে তারা সত্যি ভালো। মাস্টার দেশ-বিদেশের অনেক গল্প শোনায় ছেলেদের। আকাশে নক্ষত্রমণ্ডলী কে-কোথায় অবস্থান করছে, কার কী কাজ এবং গভীর সমুদ্রের তলদেশে কত রকম খনিজপদার্থ আছে সে সব কথাও তিনি বলেন। তিনি বাড়িতে প্রচুর বই-পত্র পড়েন। অনেক কঠিন-কঠিন বিষয় নিয়ে ভাবেন। যে কারণে তুচ্ছ বিষয়গুলো তিনি মন থেকে ঝেড়ে ফেলে দেন।
শুক্র ও শনিবার তিনি মোন্তাজ চেয়ারম্যানের বৈঠকখানায় যান। বলতে গেলে এটা তাঁর অভ্যাসে দাঁড়িয়েছে। সেখানে গ্রামের আরও পাঁচ-সাতজন ব্যক্তি উপস্থিত হয়। তারাও মন্ডলকে নিয়ে নানান রকম রসিকতা করে। কখনও তাঁর ছাতাটা লুকিয়ে রাখে, আবার কখনও তাঁর জুতার হদিস পাওয়া যায় না। এসব নিয়ে হর-হামেশাই হাসা-হাসি করে সবাই। মন্ডলের খুব রাগ হয় ঠিকই কিন্তু কাউকে কিছু না বলে রাতের বেলা অন্ধকার পথে একা-একা বাড়ি ফিরে আসেন।
রাতে জঙ্গলের পথ ধরে মাস্টার বাড়িতে ফিরে যান; এ নিয়েও তাকে কথা শুনতে হয়। কেউ বলে, মন্ডলের কি ভূতের ভয় নেই? মন্ডল উত্তরে বলেন, ভূত থাক্ আর নাইবা থাক্ তাকে নিয়ে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। মাস্টারকে ভূতের ভয় দেখাতে কেউ ভূতের মত সেজে ডোবার ধারে হিজল গাছের ডাল থেকে লাফিয়ে পড়েছে তার সামনে। মাস্টার সাহেব চম্কে উঠেছেন ঠিকই; কিন্তু ভয় পাননি। এই ছমির তুই কি ভূত? এ কথা বলতেই ছমির ভূত দৌড়ে পালিয়েছে।
আজ আড্ডায় স্যাটেলাইট নিয়ে তর্ক-বিতর্ক চলছিলো। সবুজ মাতবর বলছিলো, আজ সন্ধ্যার পর আকাশটা কেমন আগুনের মত হয়ে উঠলো। উত্তর দিকে কুন্ডুদের বিশাল বাঁশ-বাগানের ওপর দিকে একটা আলো দেখা গেলো। চোখের পল্কেই আবার হারিয়ে গেলো। বছরখানেক আগেও দেখা গিয়েছিলো অন্ধকার আকাশ আলোকিত করে একটা চক্র যেনো ঘুরছে। পরে জানা গেলো ওটা ছিলো রাশিয়ান স্যাটেলাইট। আরেকজন বললো, পৃথিবী থেকে প্রায় চারশত মাইল ওপর দিয়ে ঘুরছিলো সেটা। এখন কত দেশ রকেট ছাড়ছে, বিজ্ঞানের খেলা চলছে পৃথিবী জুড়্।ে উকিল সাহেব বললেন, এখন তো অন্য গ্রহ থেকেও মানুষ আসছে আমাদের পৃথিবীতে। আমরা দেখতে পাই না; কিন্তু তারা সব দেখতে পায়।
সোনামিয়া চুপ করেই ছিলো, সে হঠাৎ বললো, অন্য গ্রহের মানুষেরা আমাদের চেয়ে অনেক উন্নত। হাওয়ার গাড়িতে আসে আবার হাওয়ার গাড়িতে ভেসে চলে যায়।
গোলাম আলি মাস্টার আলোটা দেখেছে কুন্ডুদের বিশাল বাঁশ-বাগানের মধ্যে। বাগানের ওপর দিকে একটা নীল আলোর আভা ছড়িয়ে আছে। উকিল সাহেব বললেন, স্যাটেলাইট-ফাইট নিয়ে মাথা ঘামানোর দরকার কী। বিজ্ঞানের যুগ, কালে-কালে কত কিছু দেখা যাবে। আকাশে কি আলোর অভাব আছে? একটা কিছু দেখলেই পরদিন কাগজে তা নিয়ে ফলাও করে লেখা হচ্ছে।
বাবুল বয়সে অন্যদের চেয়ে ছোট- সে বললো, সবই তো মানুষেরই তৈরি তবে, সে মানুষ যে গ্রহেরই হোক; মহান সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টি নিয়ে ভাবতে গেলে মাথার মধ্যে গোলমাল শুরু হয়ে যায়। উকিল সাহেব বললেন, লোক নেই, জন নেই যন্ত্র চলচ্ছে। আর রকেট তো অজানা কত খবর পাঠাচ্ছে তা পাঠাক না। যদি আমাদের দেশে একটা কিছু তৈরি হতো, তা’হলে গর্ব করার বিষয় হতো। অন্য একজন বললো, অন্য গ্রহ থেকে সাপ, ব্যাঙ যাই আসুক সেটা আমাদের এই জঙ্গলা দেশে কেন আসবে? আমেরিকা, জাপান, ইংল্যান্ড আরও কত দেশ আছে গেলে তারা সেখানে যাবে। শত-বছরের পচা ডোবা থেকে আগুনের আভা উঠতেই পারে তা নিয়ে ভাবনার কী আছে। ভূতও তো আলোর পিণ্ড হয়ে এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় ছুটে বেড়ায়। এসব কথা বলে সবাই যে যার চায়ের কাপে ঠোঁট ছুঁয়ালো। মাস্টার সাহেব চুপ করে ভাবতে লাগলেন, বাইরের গ্রহ থেকে যারা আসবে তারা বড় শহরে কেন; বন-জঙ্গলেও আসতে পারে। নির্জন জায়গা তাদের জন্য বেশ নিরাপদ। তবে তারা ভূত নয়; আবার বাঘ, ভাল্লুকও নয়। এদেশের ভাষা না বুঝলেও তারা যথেষ্ট বুদ্ধিমান। কিন্তু তারা দেখতে যে কেমন, এটাই হলো বড় কথা। তবে মনে হয়, পৃথিবীর মানুষের মত পালোয়ান নয়। এ কথা তো সত্য যে যারা বেশি খায়, তাদের বুদ্ধি কম। বাঙালিরা খেয়ে আর রসিকতা করেই দিন কাটায়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঠিকই বলেছেন, পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোর ঢেউ যখন আমাদের দেশে এসে লাগে তখনও আমরা লাউয়ের জাঙ্গলা নিয়ে ক্যাইজা আর মারামারি করি।
তিনি একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে ভাবলেন, এসব কথা এদের কাছে বলে নিজেকে আর অপমানিত করতে চাই না। এবার উঠি বেশ রাতও হয়েছে আজ। সবাইকে উদ্দেশ করে তিনি বললেন, আজ বেশ রাত হয়ে গেলো এবার আমি চলি। সোনামিয়া বললো, বাঁকা যেতে চাচ্ছে যাক; তবে ভূতে ধরলে চিৎকার দিও।
আসলে মাস্টারের মুখটা একটু বাঁকা আর রাগের মাথায় বেশি কথা বলতে গেলে সব তালগোল পাকিয়ে যায়। সবার এলোমেলো কথায় মনটা তার বিশ্রি রকম খারাপ হয়ে গিয়েছিলো। মাস্টার সাহেব জঙ্গলা পথে এগিয়ে বাঁশ-বাগানের কাছাকাছি গিয়ে সত্যি একটা সবুজ আলো দেখতে পেলেন। যেন কোন হিরা থেকে একটা আলো চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। তিনি প্রথম ভাবলেন, শুকনো লতা-পাতায় বুঝি আগুন লেগেছে। বনের মধ্যে খানিকটা জায়গা ফাঁকা এবং নিচু। হঠাৎ তার মনে হলো; ঝিঁঝি পোকারা ডাকছে না, অন্য কোন সাড়া-শব্দও নেই জঙ্গলে। এমন নীরব অবস্থা তো আগে কখনও দেখিনি। কেমন যেন থম্থমে ভাব।
মাস্টার সাহেব কৌতূহল বশে বাঁশ-বাগানের সেই আলোটার দিকে এগিয়ে যেতে লাগলেন। ছড়ানো উজ্জ্বল আলোটা স্থির। তখনই চিঁচি একটা একটানা শব্দ তার কানে এলো। মাস্টার সাহেবের গাটা একটু ছম্ছম করে উঠলো। তবুও এগিয়ে চললেন তিনি। ডোবার থেকে বিশ-পঁচিশ হাত দূরে ঘন বাঁশঝাড়টা পেরোতেই তিনি দেখতে পেলেন বেশ বড় একটা কাচের বাটির মত জিনিস ডোবাটা জুড়ে উপুড় হয়ে পড়ে আছে। আর তার স্বচ্ছ ঢাকনার ভেতর থেকে মোহময় এক তীব্র কিন্তু ¯িœগ্ধ নীলচে আলো বিচ্ছুরিত হচ্ছে।
এমন অদ্ভুত দৃশ্য মাস্টার সাহেব স্বপ্নেও কখনও দেখেন নাই। অবাক হয়ে চেয়ে থাকলেন তিনি। জিনিসটা স্থির হলেও নির্জীব নয়। বুকের শ্বাস-প্রশ্বাসের মতই একটু একটু ওঠা-নামা করছে। আর একটু ভালো করে দেখার জন্যই তিনি একেবারে কাছেই চলে গেলেন। হঠাৎ তাঁর শরীরে বিদ্যুৎ প্রবাহ খেলে গেলো। তিনি অনুভব করলেন; অদৃশ্য কিছু দিয়ে তাঁর হাত এবং পা বেঁধে ফেলা হয়েছে। তাঁর আর নড়বার শক্তি নেই। তিনি না পারছেন এগোতে, না পারছেন পেছাতে।
কিছুক্ষণ এভাবে দাঁড়িয়ে থাকার পর জিনিসটার স্পন্দন থেমে গেলো। হালকা সেই শব্দটাও আর শোনা গেলো না। কাচের ঢাকনার একটা কপাট যেনো সরে গেলো আর মানুষের মত অত্যন্ত মিহি স্বরে চিৎকার এলো “ডং চিং ডাং মিলি পিলিং”।
মাস্টার সাহেব চম্কে উঠে কাঠের পুতুলের মত দাঁড়িয়ে থাকলেন। ভাবলেন, এ আবার কী রকম ভাষা? শব্দটা আবার হতেই মাস্টার সাহেবের বুকটা ধড়াস করে উঠলো। হু আর ইউ? হু আর ইউ?
মাস্টার বুঝলেন, তাকেই প্রশ্নটা করা হচ্ছে- তাই তিনি বললেন, আই অ্যাম গোলাম আলি মন্ডল স্যার।
প্রশ্ন এলো আর ইউ ইংলিশ?
গোলাপ আলি মাস্টার চেঁচিয়ে বললেন, নো স্যার- বাঙালি। এদেশের নাম বাংলাদেশ। পরাধীন ছিলাম, প্রায় পঁয়তাল্লিশ বছর হলো; স্বাধীনতা লাভ করেছি।
আর ইউ মুসলিম?
ইয়েস স্যার।
আস্সালামু আলাইকুম।
মাস্টার উত্তরে বললেন, ওয়ালাইকুম আস্সালাম।
অদ্ভুত এক প্রাণী। মাথাটা বেশ বড়। শরীরে তেমন মাংস নেই বললেই চলে। মাথা বাদ দিয়ে হালকা-পাতলা একটা গোলাপি কাপড়ে তার দেহটা ঢাকা। লোকটা এক’পা-দু’পা করে এগিয়ে এলো। সে এক দৃষ্টিতে মাস্টারকে দেখতে লাগলো। তারপর মিহি স্বরে বললো, তুমি মানুষ? ভয় পাওয়ার কিছু নেই।
মাস্টার বললেন, জি।
লোকটা বললো এটা তো পৃথিবী, তোমাদের দেশ বাংলাদেশ?
জি।
সে বললো, যাবার কথা ছিলো মঙ্গলে, অসাবধানে যন্ত্রপাতি গোলযোগের কারণে এসে পড়েছি বাংলাদেশে। এই বলে সে একটু মৃদু হাসলো। মাস্টার কী বলবে কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলো না। লোকটা একেবারে মাস্টারের কাছে তার লম্বা-লম্বা আঙুল ছোঁয়ালো মাস্টারের মুখে। তারপর তার গা, হাত, পাও টিপে-টিপে দেখতে আরম্ভ করলো লোকটা। শেষে বললো, আমি ক্রোসিয়ান গ্রহের অ্যাং। আমি মানুষের চেয়ে অনেক উচ্চ স্তরের প্রাণী।
মাস্টার মনে মনে হাসলেন। চার ফুট প্রাণী সে আবার মানুষের চেয়ে অনেক বুদ্ধিমান? কথাটা বুঝে ফেললো অ্যাং। সে বললো, তুমি কয়টি ভাষা জানো?
মাস্টার বললেন, বাংলা, ইংরেজি আর কিছুটা উর্দু।
অ্যাং বললো, তার মানে আড়াইটা, আর আমি জানি পনেরো হাজার ভাষা। তা ছাড়া ত্রিশটি গ্রহের ভাষা আমার জানা আছে। তোমার বয়স কত?
এবার পঞ্চান্নতে পড়েছে।
আমার বয়স সাতশত বিয়াল্লিশ। তোমরা মাংস খাও?
হাঁস, মুরগি, গরু, ছাগল মহিষ সবই খাই।
আমরা মাংস খাই না- সবজি খাই। তবে অনেক আগে মাংস খেতাম।
অ্যাং গোলাকার একটা ছোট পাথর দিলো মাস্টারের হাতে। সেটা হাতে ধরতেই মাস্টারের শরীরটার মধ্যে যেন বিদ্যুৎ খেলে গেলো। সে তখনই সেটা ফেরত দিলো অ্যাংকে। অ্যাং বললো, এটার এমন শক্তি যে কোন শত্রু মরবে না তবে সে অথর্ব হয়ে পড়বে। মাস্টার নির্বাক। অ্যাং বললো, তুমি কি কিছু দেখতে চাও? যা জীবনে দেখোনি? মাস্টার মনে মনে ভাবলো বাংলাদেশের কত জায়গাই তো এখনও দেখা হয়নি। তবে টেলিভিশনের মাধ্যমে অনেক জায়গা দেখেছি। শুনেছি সমুদ্রের তলদেশে কত কিছু আছে, তা- একবার নিজের চোখে দেখার বড় ইচ্ছা। অ্যাং ছোট একটি কাচের নল মাস্টারের হাতে দিয়ে বললো, এখানে চোখ রাখো দেখতে পাবে।
মাস্টার নলের মুখে চোখ লাগাতেই দেখলেন, গভীর সমুদ্রতলায় ছোট-বড় অনেক পাহাড়। সেগুলো সোনার মত ঝক্্মক করছে। তিনি বললেন, ঐ পাহাড়গুলি কি স্বর্ণের?
হ্যাঁ, সব স্বর্ণের পাহাড়।
হাদিস শরীফে এরকম সব কথা আছে। শুনেছি একদিন সমুদ্র সব শুকিয়ে যাবে আর ঐ স্বর্ণ নিয়ে পৃথিবীতে যুদ্ধ লেগে যাবে। লোভে পড়ে মানুষ শুধু একে অন্যের হাতে মরতেই থাকবে; তবু কেউ থেমে থাকবে না। মাস্টার আর চোখ রাখতে পারলেন না। মাথাটা বোঁ-বোঁ করছে। তিনি যন্ত্রটা ফেরত দিলেন।
অ্যাং বললো, এবার বুঝলে তো আমরা মানুষের চেয়ে শ্রেষ্ঠ।
মাস্টার বললেন, একশত ভাগ সত্য।
অ্যাং বললো, তোমায় দেখে, তোমার হাত, পা টিপে মনে হলো যে তুমি নিকৃষ্ট প্রাণী হলেও মানুষটা ভালো। তবে তোমার দোষ হচ্ছে যে, তুমি নিরীহ, তাই তুমি জীবনে উন্নতি করতে পারনি। অন্যায়ের প্রতিবাদ না করা তোমার দোষ। তুমি অপমান সহ্য করো- এটা কোন প্রাণীই করে না। তোমার সাথে কথা বলে বেশ ভালো লাগলো। আর সময় নষ্ট করা যাবে না- এবার আমাকে যেতে হবে।
মাস্টার কিছু বলার আগেই অ্যাং সেই গ্লোবের মত যন্ত্রটার ভেতরে ঢুকলো আর ঘূর্ণি বাতাস ছড়িয়ে চোখের পল্কে উধাও হয়ে গেলো। তারপরই বন জুড়ে ঝিঁঝি পোকারা ডাকাডাকি শুরু করলো, দূরে কোথাও হুতুম পেঁচাও ডেকে উঠলো। জোনাকিরাও আলো জ্বেলে ওড়াউড়ি শুরু করলো।
তারপর; মাস্টার বাড়ির পথে পা রাখতেই তার মনের মধ্যে একটা জোসের ঢেউ গড়ালো। তিনি মনে-মনে ভাবলেন, কী আশ্চর্য! কী অদ্ভুত! সারা পৃথিবীর কারোর সঙ্গে নয়; শুধু তার সঙ্গে দেখা দিলো, কথা বললো, সৌরজগতের এক অজানা গ্রহের একজন লোক- লোক মানে অ্যাং। নিজেকে অন্য এক মানুষ ভাবতে শুরু করলেন মাস্টার।
পরদিন ছিলো শনিবার। চেয়ারম্যানের বাড়িতে চলছিলো জমাট আড্ডা। গতকালের আলোর খবর কাগজে বেরিয়েছে। নেহাতই নগণ্য দু’চার কথা। সেটাকে ফ্যালিং সসার বা উড়ন্ত পিরিচের মত গুজবের মধ্যে টেনে আনা হয়েছে।
আজ কুন্ডু বাড়ির রবিও এসেছে। তার পঁচিশ বিঘা বাঁশবনের মধ্যে যে ডোবাটা আছে, তার চারপাশের বাঁশঝাড় নাকি রাতারাতি একেবারে ন্যাড়া হয়ে গেছে। এই বিষয়েই কথা হচ্ছিল, এমন সময় উকিল সাহেব হঠাৎ বলে উঠলেন, আজ গোলাম আলি মাস্টারের আসতে দেরি হচ্ছে কেন? ব্যাকা না থাকলে আড্ডাটা পুরোপুরি জমে না।
চেয়ারম্যান বললেন, তা বললে তো চলবে না- মাস্টারকে তো আসতেই হবে। বাবুল দরজা পর্যন্ত এগিয়ে যেতেই মাস্টার এসে হাজির। তিনি যেন ছোট-খাটো একটা দম্কা হাওয়া কাঁধে করে নিয়ে এসেছেন। উপস্থিত সবাই কেমন থম্কে গেলো।
তারপর; সত্যি যেন ঝড় উঠলো। মাস্টার পুরা এক মিনিট ধরে হো-হো করে অট্টহাসি হাসলেন। এমন হাসি এর আগে কেউ কখনও শোনেনি এমনকি মাস্টার নিজেও না।
হাসি শেষে মাস্টার একটা প্রচণ্ড গলা খাঁকরানি দিয়ে গভীর গলায় বলতে শুরু করলেন, উপস্থিত বন্ধুগণ, আমি খুবই আনন্দের সঙ্গে জানাচ্ছি যে, এই সন্ধ্যাকালীন আড্ডায় আজই আমার শেষ দিন। কেননা আপনারা সবাই অযথা বক্বক করেন। আপনাদের অন্যায় ছেলেমানুষি আমার মনটাকে তিক্ত করে দিয়েছে। প্রয়োজন হলে এই আসরে আমার মিনি বিড়ালটাকে পাঠিয়ে দিব।
ও-হ আজ দেখি রবি কুন্ডুও এসেছে। খবরটা সবাই শুনে রাখুন- গতকাল রাতে ক্রেসিয়ান গ্রহ থেকে একটা অ্যাং এসে ঐ বাঁশ-বাগানের নিচু জায়গাটির মধ্যে নেমেছিলো। আমার সঙ্গে তার আলাপ হয়েছে, সে সত্যি ভালো।
এইটুকু বলেই মাস্টার উকিলের পিঠে একটা তব্লার চাটি মেড়ে সদর্পে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।
সবাই হাঁ হয়ে তাকিয়ে থাকলেন তার গমন পথের দিকে। আজ কেউ তার মুখটা বাঁকা দেখলেন না; বা এত কথা বলার পরও কোথাও তার কথা আটকালো না। ঠিক তখনই চেয়ারম্যান সাহেবের হাতটা কাঁপতে-কাঁপতে গরম চা ঢেলে পড়লো তার সাদা ধপ্্ধপে পাঞ্জাবির ওপর।