[গত সংখ্যার পর]
আরো সামনে এগুলে আরো বড় বাস্তা, মাও জে দং এভিনিউ। চীনা বিপ্লবের নেতা মাওয়ের নামে নাম।
ফারহাতের তাদের নেত্রী রাবেয়া কাদেরের কথা মনে পড়ে আবার। তিনি এখন সবার দাদীমা। বয়স হয়েছে, জীবনে উইঘুরদের জন্য অনেক লড়াই সংগ্রাম করেছেন। জেলও খেটেছেন। তবে তিনি দমবার পাত্র ছিলেন না। উইঘুরদের রক্ষায় কৌশল হিসেবে কমিউনিস্ট পার্টির খাতায় নামও লিখিয়ে ছিলেন। আহা বেচারী। কত কষ্টই না করেছেন। সারা বিশ^কে জানিয়েছেন উইঘুরদের দুঃখের কথা। তার মনটা অনেক বড়। কই তার নামে তো রাস্তার নাম হচ্ছে না। উনি তো এখন দেশেও থাকতে পারেন না। চলে গেছেন আমেরিকায়। সেখানে উইঘুর সংগঠনের সভানেত্রী হয়েছিলেন। সেখান থেকেও অবসর নিয়েছেন।
প্রথম প্রথম চীনারা তাকে সমীহ করতো। এখন আর করে না। পারলে আটকে রাখে। নানা হুমকি দেয়। তিনিও দমবার পাত্র নন। নেতা নেত্রী তো এমনই হওয়া উচিত। যেমন তিব্বতিদের নেতা দালাই লামা। সংগ্রাম শুরু করে ব্যর্থ হওয়ার পর পাড়ি জমিয়েছেন আরেক দেশে, ভারতে। সেখানে গড়ে তুলেছেন প্রবাসী প্রশাসন। লাসা বা তিব্বত পূর্ণ স্বাধীনতা পায়নি, পায়নি নিজ ধর্ম পালনের পূর্ণ অধিকার। পেয়েছে স্বায়ত্তশাসনের ক্ষমতা। আর উইঘুররা তো স্বায়ত্তশাসনও পূর্ণভাবে পায়নি।
সাত.
: কিরে ফারহাত। কী হয়েছে দোস্ত, এই সকালে। তাকে দেখেই ইয়াং লি প্রশ্ন করে।
: না না এমনি। তোর কথা মনে হলো তাই চলে এলাম।
ইয়াং লির ভাবনা তবু যায় না। শুধু শুধু তো সাতসকালে ওর এভাবে আসার কথা নয়। স্কুল বন্ধ। দেখা হয় না কদিন। তবে কি ও যা বলছে তাই ঠিক। ভাবে লি।
: সত্যি করে বল। তোর চোখ মুখ শুকনো লাগছে।
: নারে তেমন কিছু না। সত্যি বলছি। তবে মনটা ভালো নেই। তাই তোর কাছে এলাম।
: মন খারাপের কারণ?
: তুই কয়টা শুনবি? বাদ দে তো। কাজের কথা বল।
ওরা দু’জন একই ক্লাসের ছাত্র। তবে স্কুল আলাদা। একবার এক অনুষ্ঠানে দু’জনের ভাব জমে যায়। সেই থেকে বন্ধুত্ব। একজন আরেক জনের মনের কথা খুলে বলে। আর ইয়াং লি চীনা হান বংশের ছেলে। ওর বাবা পার্টির বড় নেতা। তবে লির মনটা ফারহাতের মতোই। উইঘুর বলে ফারহাতকে আলাদা করে দেখে না। মায়ের সাথে পরিচয় পর্যন্ত করিয়ে দিয়েছে। লি মা বাবার একমাত্র সন্তান। লি কে অত্যাচারী হানদের মতো মনে হয় না।
সামান্য ভাব বিনিময়ের পর একটু খানি নাস্তা মুখে তুলে লির বাড়ি থেকে বের হয়ে পড়ে ফারহাত। সত্যি কি চলছে তার মনের ভেতর তা সে চেপে যায়। লিকে সব বলা ঠিক হবে না।
ফেরার পথে আবার সেই মাও জে দং এভিনিউ। এবার সামনে পড়ে গেল আহমেত রাসুলের সামনে। সে তার স্কুলের বন্ধু। ক্লাস মেট। ওকে পেয়ে তো আহমেত বাগবাগ।
: ইয়ার। স্কুলের ছুটি তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করছিস?
: না রে দোস্ত। ব্যাপার মোটেও তা নয়। উইঘুরে কি সব ঘটছে আমার ভালো ঠেকছে না। মনের কথা বলার জন্য লোক খুঁজছি, পাচ্ছি না। লির কাছে গিয়েছিলাম, কিন্তু বলা হলো না।
ফারহাতের সাথে সেই অনুষ্ঠানে আহমেত রাসুলও ছিল। লির কথা তার জানা। তবে আহমেত অনেকটা আমুদে স্বভাবের, সব সময় হাসি আনন্দে থাকতে চায়, হেঁয়ালি করে। কোন কিছুকেই সিরিয়াসভাবে নেওয়ার অভ্যাস তার কম।
: তুই আমাকে খুলে বল। এবার আহমেতের মুখভঙ্গি যথেষ্ট গম্ভীর।
: শুনবি।
: বল না !
: আমার দুই চাচাকে সেনারা তুলে নিয়ে গেছে সাত দিন হলো। কাশগড় তুরপানসহ চার দিক থেকে প্রতিদিনই এরকম নিখোঁজ লোকের খবর আসছে। বিষয়টা আতঙ্কের নয়?
: হ্যাঁ। তাইতো। আমাদের পাশের বাড়ির চারজন পনের দিন ধরে নিখোঁজ। সবাই ভাবছে বেড়াতে বা আত্মীয় বাড়ি গেছে। ব্যাপারটা খোঁজ নিয়ে জানতে হবে। তুই তো তাজ্জব কথা বললি।
: কি বলছি তাহলে! শোন আব্বা কয়েক দিন ঘোরাঘুরি করেও আমার চাচাদের কোন হদিস করতে পারেনি।
: যা যা বাড়ি যা। চাচি ভাববে। আমি একটু পাত্তা লাগিয়ে দেখি মানুষগুলো গেল কোথায়। এক সঙ্গে একগুলো লোক নিখোঁজ। গুম হয়নি তো।
: যাচ্ছি আহমেত। কিছু জানতে পারলে আমাকে জানাস।
ওরা কথা বলার মুহূর্তে একটা সেনা লরি পাশ কাটিয়ে গেল। চালক একা। কোন সৈন্য নেই। যাক বাঁচা গেল।
আহমেত রাসুলের বাবা মেহমেত জাওয়াদাতও একজন ব্যবসায়ী। উরুমকির বড় মসজিদের সামনে তার একটি বই আর কাপড়ের দোকান আছে। দোকানে থরে থরে সাজানো থাকে নানান বই। ফাঁকে ফাঁকে দু’ একটি কোরআন শরীফ ও ইসলামী বই। জাওয়াদাত সাহেব ভয় পান না। তার সাফ কথা, আমরা মুসলমান, কোরআন শরীফ আমাদের পবিত্র গ্রন্থ। এছাড়া আমরা বাঁচি কী করে। আর ইসলামী বই কোরআনের পথে চলতে শেখায়। আংকেল বেশ সাহসী। চীনা সেনাদের সাথে এ নিয়ে কতবার তর্ক বেঁধেছে, কোন কোন বার ধরেও নিয়ে গেছে। কমিউনিস্ট পার্টির এক নেতা তার বন্ধু। তার সুবাদে আর তার নিজের অকাট্য যুক্তির কাছে হার মানতে হয়েছে। তবে সে পরিবেশ দিন দিন নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এখনকার সেনা সদস্যরা কোন যুক্তি শুনতে রাজি নয়।
আহমেত রসুল তাড়া দেয়-
: আর কি বলবি বল না! ওর মনে কোন দুশ্চিন্তা আছে বলে মনে হচ্ছে না।
: বলছি বলছি। দেখ আমার মনটা খুব খারাপ।
: কেন কী হয়েছে?
: জানিস না! আমার দুই চাচাসহ এ তল্লাটের বহু লোককে ধরে নিয়ে গেছে চীনা সেনারা।
: চিন্তা করিস না। ছেড়ে দেবে। দেখিস না আমার আব্বাকে ধরে নেয়, আর ছেড়ে দেয়।
: না বিষয়টা সে রকম না দোস্ত।
: কী রকম। আহমেত রসুল জানতে চায়।
: তাদের কোন পাত্তাই পাচ্ছি না। কোথায় নিয়ে গেছে কেউ জানে না। বন্দিশিবির, কনসেনট্রেশন ক্যাম্প না সংশোধন কেন্দ্র কিছুই জানতে পারছি না। সেটাই তো ভয়ের কারণ। বিভিন্ন এলাকা থেকে উইঘুর তরুণ যুবা ও উঠতি বয়সের লোকেরা উধাও হয়ে যাচ্ছে। একজন দু’ জন নয় শত শত হাজার হাজার।
: তাহলে তো চিন্তার কথা। এবার বললো আহমেত রসুল। তার কপালে চিন্তার ভাঁজ। আবার বললো,
: তুই খাওয়া দাওয়া করে বাসায় চলে যা। আব্বাকে বিষয়টা জানাচ্ছি।
আহমেত রাসুলের মা মারিয়াম জাওয়াদাত ফারহাতকে নিজের ছেলের মতই দেখেন। সব শুনে তিনিও চিন্তায় পড়লেন। তার পরও দু’জনকে যত্ন করে নাস্তা খাওয়ালেন। ওর বাবা মায়ের খোঁজ নিলেন। অবস্থা যে ভালো না বুঝতে পারলেন। আর সব দিক থেকে তার কানে এরকমই খবর আসছে। কত বড় দেশ চীন। আর এত বড় দেশের নেতাদের মন কত ছোট। একটা মানুষের ধর্ম বিশ^াস- তার ধর্মীয় রীতিনীতি পালন ওরা সহ্য করতে পারছে না। তার মনটাও খারাপ হয়ে যায়। দ্রুত নাস্তা খাওয়া শেষ করে চলে যায় ফারহাত।
ফারহাতের ইচ্ছে জাওয়াদ চাচার দোকানের সব বই পড়ে ফেলার। চাইলে তিনি দেন। একটা দুটো পড়ে আবার ফেরত দিয়ে দেয়। লুকিয়ে পড়তে হয়, সেনা বা কমিউনিস্ট পার্টির লোকেরা দেখলে পরিস্থিতি ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে কতক্ষণ। মেহমেত জাওয়াদাত অনেক বড় আলেম। ধর্মের প্রতি তার খুব টান। সবাইকে সবক দেন, নামাজের তাগিদ দেন। তার দুরন্ত সাহস। সাহসী বলে সবাই তাকে ভয় পায়। বড় মসজিদের ইমাম সাহেবও তাকে খুব পছন্দ করেন। ইমাম সাহেব আর জাওয়াদ সাহেবের সাফ কথা-
: ওরা আমাদের ধর্ম ভুলিয়ে দিতে চায়। কিন্তু আমরা তা হতে দিতে পারি না। স্বায়ত্তশাসিত এলাকা হিসেবে নিজ ধর্ম পালনের অধিকার তো আমাদের আছে। একটু সময় করে মহান প্রভুকে ডাকবো তারও উপায় নেই। আল্লাহর নাম ওরা সহ্য করতে পারে না। নামাজ পড়া তো নয়ই দাড়ি রাখতে দেবে না এমনকি রোজা পর্যন্ত রাখতে দিতে চায় না। খোঁড়া যুক্তি, রোজা রাখলে দুর্বল হয়ে যাবে। ফলে কাজ কম করবে, ফাঁকি দেবে। কর্মঘণ্টা নষ্ট হবে। এগুলো আসলে বাজে কথা।
জাওয়াদ চাচার এক কথা : এই বুকে একবার যখন দ্বীন ইসলামের আলো জ¦লেছে তাকে আর কোন দিন কেউ নিভিয়ে ফেলতে পারবে না।
ফারহাত ভাবে এমনই তো হওয়া উচিত। আর এটাই ঈমানের দাবি। এতে যদি জীবন চলে যায় যাক। মৃত্যু তো একদিন আছে। দ্বীনের জন্য শহীদ হওয়া এতো মহৎ কাজ।
সুহানা চাচিও একই কথা বলেন। এটা একটা বাজে অজুহাত। তার কথা: আমি কাজের ফাঁকে অল্প কিছু সময়ের জন্য আল্লাহর ডাকে সাড়া দেবো, নামাজ পড়বো। মন প্রফুল্ল থাকবে। মন থেকে পাপবোধ দূর হবে। যে মহান প্রভু আমাকে সৃষ্টি করেছেন তার প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাবো। মন প্রফুল্ল থাকলে কর্মক্ষেত্রের কাজও ভালো হবে, কাজে বরকত আসবে। এতে তো আর সারা দিন লাগে না। মহান প্রভুই তো বলেছেন, নামাজ শেষে তোমরা রিজিকের সন্ধানে নিজ নিজ কর্মে ফিরে যাও। সুহানা ফারহাতের চাচা রুস্তামের পত্নী। ফারহাতের আব্বার ছোট রুস্তাম। আর সবার ছোট তানজিল। তারা দু’জনই এক সপ্তাহ ধরে নিখোঁজ।
সুহানা চাচি বলেই চলেন, আর মুসলমানরা তো কাজ কম করে না। তাদের উৎপাদনশীলতা তো অন্য চীনাদের চেয়ে কম নয়। তবে কেন এই অপবাদ?
বলতে গেলে উরুমকি তো বটেই কাশগড়সহ ঝিনজিয়াং এর সমস্ত স্থানে মুসলমানদের লুকিয়ে চুরিয়ে নামাজ পড়তে হয়, রোজা রাখতে হয়। তা না হলে ধরে নিয়ে সংশোধন কেন্দ্রে রেখে দেবে।
আট.
চীনের রাজধানী বেইজিং যাওয়ার ফারহাতের খুব শখ। শুনেছে সেটা অনেক বড় শহর। আর দেখতে যেতে ইচ্ছে করে চীনের মহাপ্রাচীর। যার জন্য পৃথিবীব্যাপী চীনের নাম। কত দূর দেশে থেকে এই মহাপ্রাচীর দেখতে লোকজন আসে। চীনের মহাপ্রাচীর ‘দি গ্রেট ওয়াল অব চায়না’ নামে খ্যাত। চীনা ভাষায় নাম ছাং ছং। অর্থ দীর্ঘ প্রাচীর। পাথর মাটি দিয়ে তৈরি দীর্ঘ প্রাচীর সারি এই গ্রেট ওয়াল। এই প্রাচীর খ্রিষ্টপূর্ব পঞ্চম শতক থেকে ১৬ শতক পর্যন্ত চীনের উত্তর সীমান্ত রক্ষা করার জন্য তৈরি। এ রকম অনেক প্রাচীর তৈরি করা হয়েছিল তবে ২২০ খ্রিষ্ট পূর্বাব্দ থেকে ২০০ খ্রিষ্ট পূর্বাব্দ মধ্যবর্তী সময়ে চীনে প্রথম স¤্রাট কিন শি হুয়াওয়ের অধীনে নির্মিত প্রাচীরই সবচেয়ে বিখ্যাত। এটি বর্তমান প্রাচীরের অনেক উত্তরে অবস্থিত এবং খুব সামান্যই অবশিষ্ট আছে। বর্তমান প্রাচীরটি মিং রাজবংশের আমলে নির্মিত।
চীনের মহাপ্রাচীর মানুষের হাতে তৈরি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় স্থাপত্য। এটা ভাবলে ফারহাতের বুকটা গর্বে ফুলে ওঠে। তেমনটা হয় আহমেত রসুল বা তার অন্য বন্ধুদেরও। কিন্তু তা আবার সঙ্গে সঙ্গেই মিলিয়ে যায়। উইঘুর মুসলমানরা পদে পদে লাঞ্ছিত। এই গৌরব কি তাদের প্রাপ্য? যদিও ঝিনজিয়াং চীনের অংশ কিন্তু তবু কিসের যেন একটা বাধা। বাধার কারণ উইঘুররা নয়, চীনা আর হানরা। এর পরও বুকের মধ্যে ভিন্ন একটা অনভূতি এনে দেয় চীনের মহাপ্রাচীর। হোক না তারা স্বাধীনতা বঞ্চিত, তারা তো চীনেরই, আর এই মহাপ্রাচীর তাদের ঐতিহ্য। বইয়ে পড়েছে ফারহাত এই প্রাচীর প্রায় পাঁচ থেকে আট মিটার উঁচু এবং ৬৫৩২ কিলোমিটার লম্বা। এটি শুরু হয়েছে সাংহাই পাস এ এবং শেষ হয়েছে লোপনুর নামক এলাকায়। এর মূল অংশের নির্মাণকাজ হয়েছিল খ্রিস্টপূর্ব ২০২ সালে। নির্মাণ শুরু হয় কিং সা¤্রাজ্যের সময়। চীনের প্রথম স¤্রাট কিন সি হুয়াং এটি প্রথম ব্যবহার করেন। শত্রুর হাত থেকে দেশ রক্ষায় সা¤্রাজ্য রক্ষায় তিনি এই প্রাচীর দীর্ঘ করে নির্মাণ করেন। বিভিন্ন অঞ্চল পাহারায় ও উত্তর চীনের উপজাতি সুইং নু বা হান জাতি গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে এটি প্রথম স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল। হান সুই, নবদান ও জিন সা¤্রাজ্যের সময় ইতিহাসেও যে কারণে তারা এটি তৈরি করেছিলেন বলে উল্লেখ আছে ঠিক একই কারণে চীনের প্রাচীরের পরিবর্তন, পরিবর্ধন, সম্প্রসারণ ও পুনর্নির্মাণের উল্লেখ আছে। দেয়ালটিতে নিয়মিত বিরতিতে পর্যবেক্ষণ চৌকি আছে। যা অস্ত্র সংরক্ষণ সেনা অবস্থান যে কোন সংকেত প্রদানে কাজে লাগতো। সেনা ঘাঁটি ও প্রশাসনিক কেন্দ্র আছে দূরে দূরে। এ ছাড়া দেখার সুবিধার জন্য আছে সংকেত টাওয়ার।
নয়.
চীনা ভাষা বড় বিচিত্র। কোন অক্ষর নেই। বর্ণচিত্র বা পিকটোগ্রাফই হচ্ছে এই ভাষার অক্ষর। এ রকম ১৫০০ বর্ণচিত্র আছ্ েযা একেকটি ভাব প্রকাশ করে। চীনাদের এগুলো মুখস্থ করতে হয়। চীনা তিব্বতীয় ভাষা পরিবারের চীনা শাখার ভাষা। চীনা শাখার ভাষারসমূহ অনেক সময় চীনা নামে পরিচিত। যদিও ম্যান্ডারিন বা চীনা ভাষা গণচীন ও চীনা প্রজাতন্ত্রের (তাইওয়ান) একমাত্র সরকারি ভাষা। কথ্য চীনা ভাষার বিভিন্ন রূপ আছে। ভাষা বিজ্ঞানীদের মতে চীনা ভাষা গোষ্ঠীতে সাত থেকে পনেরোটি ভাষা বা উপভাষা আছে। অনেক উপভাষা এখনো সঠিকভাবে শ্রেণীকরণ হয়নি। উইঘুর ভাষাকে চীনারা তেমন মর্যাদা দেয় না। আরবি শিখতে চাইলে তো ভয়ানক বিপদ। উইঘুর ভাষার পাশাপাশি ঝিনজিয়াংবাসীকে ম্যান্ডারিন ভাষাও শিখতে হয়।
দশ.
সব শুনে ফারহাতের আরেক বন্ধু উলহানের কপালেও ভাঁজ পড়ে।
: চিন্তারই কথা। কোথায় যেতে পারে তারা।
: খোঁজ করে দেখেছি কোথাও যায়নি।
: তবে তো বাড়ি ফিরে আসবে।
: কই আসছে না তো।
: তুই কি করবি ঠিক করেছিস। থানায় যাবি। বাবাকে বলবো?
: না না। থানায় গিয়ে হুজ্জত বাড়িয়ে কাজ নেই বন্ধু। আরো কিছুদিন দেখি।
: তোর যা ইচ্ছে। তুই চাস তো বাবাকে বলে পার্টি লেভেলে পাত্তা লাগাতে পারি। অসহায়ের মতো বলে থামে ছেলেটি। শিন উলহান হান জাতিভুক্ত। কিন্তু ফারহাতের খুব ভালো বন্ধু। উইঘুর বলে ফারহাতকে আলাদা করে দেখে না। ওর একটাই চিন্তা ফারহাতের দুই কাকা বহুদিন নিখোঁজ। এটা তো ভাববারই কথা। বন্ধুকে কিভাবে সান্ত¡না দেবে ভাষা খুঁজে পায় না শিন।
: কে কে? ভেতর থেকে শিনের মায়ের গলা। ওকে খেয়ে যেতে বলিস। আদেশের সুরে বললেন শিনের মা। পৃথিবীর সব মা-ই মনে হয় একই রকম। ফারহাতের মনে পড়ে যায় মায়ের সোহাগ মাখা মুখখানি। তার আদরের দুই দেবর নিখোঁজ। তাই তারও দুঃখের সীমা নেই।
এতক্ষণ কথা হচ্ছিল বাড়ির আঙ্গিনায়। শিনের মা বোধ হয় আড়াল থেকে সব কথা শুনেছেন। শিনের মা একটা স্কুলের ম্যাডাম। বাচ্চাদের পড়ান। বাচ্চাদের নিয়েই তো তার কারবার। বাচ্চাদের মন তিনি ভালো বোঝেন। ফারহাতকে তিনি ছেলের মতো দেখেন। ভালোবাসেন। ফারহাতের মা তার সাথে স্কুলে পড়েছে। ফারহাতের মাও শিক্ষক, আরবি শিক্ষক। শিক্ষক আর ক্লাসমেট বলে কথা। সম্পর্কের সূত্র সে থেকেই। তার স্বামী শিন কিম ইয়াং ছোটখাটো ব্যবসা করেন। পার্টিতেও সময় দিতে হয়। তিনি অন্য প্রদেশের মতো ফুলটাইমার নন। কমিউনিস্ট পার্টির ফুলটাইমারেদের কোন চাকরি করতে হয় না। পার্টির কাজে পুরো সময় দিতে হয়। এটা অটোনোমাস এলাকা তাই এখানে ফুলটাইমার ছাড়াও পার্টি কর্মী আছে। ব্যবসাতেও নানান ঝক্কি। পার্টির লোকদের সামাল দিতে হয়, পুলিশ আর্মিকে টাকা পয়সা থেকে শুরু করে নানা তথ্য দিতে হয়। স্বাধীনতা বলতে কিছু নেই।
এখানেও কাজ হলো না। চাচাদের ভাগ্য সম্পর্কে কিছুই জানা যাচ্ছে না। অল্প কিছু মুখে তোলে। বেশি খেতে পারে না। শিনের মা পাশে দাঁড়িয়ে দু’ বন্ধুর খাওয়া দেখেন। হানদের খাবার স্টাইলও অন্য চীনাদের মতো। তবে ভিন্নতাও আছে। অনেকে চপস্টিকে খায়। আবার কেউ কেউ হাতেও খায়। হাতে খাওয়া ওরা শিখেছে উইঘুরদের কাছ থেকে। দু’ বন্ধু খেতে বসে চুক চুক করে খাচ্ছে। দেখতে ভালো লাগে শিনের মা মিসেস শিন ইয়াং এর। তিনি লক্ষ করেন ছেলেটা তেমন খেতে পারেছে না। আহা বেচারা।
: কি অতো ভাবনা। দেখো তোমার দুই চাচা ঠিক বাড়ি ফিরে আসবেন। তোমার মা কেমন আছেন?
ফারহাত ভাবে যাক ভালোই হলো। তাকে অতো বুঝাতে হচ্ছে না। আড়াল থেকে সব শুনেছেন তিনি।
: আম্মা ভালো আছেন আন্টি। আর আপনি ঠিকই বলেছেন। আল্লাহ চাহে তো তারা যেন ঠিক ঠিক ফিরে আসেন।
: যাও বাড়ি যাও। আমি শিনের বাবাকে বলে একটা খবর বের করার চেষ্টা করবো।
: তাই করুন আন্টি। আর আপনার কথা যেন সত্য হয়।
এক সময় শিনদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ে ফারহাত। এবার বাড়ি ফিরতে হয়। আম্মা ভাববেন। ছেলেটা কোথায় গেল।
এগারো.
পথে দেখা হয়ে গেল আরেক চীনা বন্ধুর সাথে।
: নি হা অ। শুরু করে চীনা ভাষায়। যাকে বলে ম্যান্ডারিন। মানে ভালো আছ? চীনা বংশোদ্ভূতদের সাথে ম্যান্ডারিন বা স্থানীয় চীনা ভাষায় কথা বলে উইঘুর মুসলমানরা। এই ভাষা ওদের রপ্ত করতে হয়। ফারহাতেরও তা জানা। অবশ্য নিজেদের মধ্যে ওরা উইঘুর ভাষাই ব্যবহার করে।
ওর নাম ইয়ে লিং। ছেলে হিসেবে ভালো। মানুষের প্রতি ওর মমত্ববোধ ভালো লাগে ফারহাতের। উইঘুর বলে কাউকে আলাদা করে দেখতে সে রাজি নয়। বয়সে ফারহাতের চেয়ে কিছু ছোট হবে। এক সাথে খেলতে খেলতে পরিচয়। ওরা মুসলিম বলে দূরে ঠেলে দেয় না।
: নি হা অ। অর্থাৎ তুমিও ভালো আছ? ইয়ে লিং এর সাথে চীনা ভাষায় জবাব দেয় ফারহাত।
: হাও মিঅ বুজিয়ান। মানে অনেক দিন দেখা হয়নি। এটা বলে চঞ্চল হয়ে পড়ে ইয়ে লিং।
: জিয়ে জিয়ে জিয়ে নি। ধন্যবাদ, তোমাকে ধন্যবাদ। ফারহাতের খোঁজ খবর করায় সে ধন্যবাদ জানায় ইয়ে লিংকে।
: বু ইয়ং জিয়ে। ধন্যবাদের প্রয়োজন নেই। ডুইবুকি। মানে দুঃখিত তোমার সাথে বহু দিন দেখা হয়নি। বলে আফসোস করে লিং।
: মেই গুয়াংজি। মেই গুয়াংজি। শিঅ। অসুবিধা নেই, অসুবিধা নেই বন্ধু। জবাবে বলে ফারহাত। আবার বলে-
: যহুদি শেং বি কুযাইলে। শুভ জন্মদিন। তোমাকে জন্ম দিনের শুভেচ্ছা। হ্যাপি বার্থ ডে। চীনারা আজকাল কিছু কিছু ইংরেজি শিখছে। গ্রিটিংস আর হ্যাপি বার্থ ডে ইত্যাদি তাদের জানা। তবু চীনা ভাষায় গ্রিটিংস জানালো ফারহাত।
আজ লিং এর জন্মদিন। ফারহাত এটা মনে রেখেছে। জেনে ভালো লাগলো ইয়ে লিং এর। সে খুব খুশি হয়। তার চোখ আনন্দে চিক চিক করে ওঠে। জন্মদিনে অভিনন্দন পেতে কার না ভালো লাগে।
: তুমি মনে রাখলে কী করে। জানতে চায় লিং।
: আমার সব কিছু মনে থাকে বন্ধু। অবাক হচ্ছো? বললো ফারহাত।
: যাই জিয়াং। আবার দেখা হবে। ডুঅ বাওঝং। ভালো থেকো। যে¤েœ লে। মানে কী হয়েছে? তোমার মুখটা শুকনো লাগছে।
: না না কিছু না। কথা কাটায় ফারহাত। ছোট মানুষ লিং। তাকে তার দুঃখের কথা শুনিয়ে কী লাভ।
তারা দু’জন পাশের একটা আইসক্রিম পার্লারে ঢোকে। আইসক্রিম দু’জনেরই পছন্দ। উইঘুর মুসলিম আর চীনা হান হলে কী হবে এ জায়গায় তাদের মিল আছে। এই সময়টা ঠাণ্ডা একটু কম। আইসক্রিম নিশ্চিন্তে খাওয়া যায়।
জন্মদিন উপলক্ষে লিংকে কী গিফট দেওয়া যায় ভাবছে ফারহাত। শেষ পর্যন্ত একটা কলম কিনলো। জন্মদিন উপলক্ষে সেটা পেয়ে খুব খুশি ইয়ে লিং। হোক না একটা কলম। গিফট তো গিফটই। এ যে অমূল্য।
ফারহাতেরও ভালো লাগছে ছোট্ট হলেও একটা উপহার দিতে পেরে। লিং কি বুঝে গেছে তার মনের অবস্থা। তাকে সব কিছু বলে দেওয়া ঠিক হবে? ওর বাবা পার্টি ক্যাডার, মানে ফুলটাইমার। পার্টির স্থানীয় নেতা। ভালো না খারাপ হবে সাত পাঁচ ভাবতে আর বলা হয় না।
আইসক্রিম পার্লারের বিল মিটিয়ে দিল ইয়ে লিং। ফারহাতই দিতে চেয়েছিল। কোন মতেই তাকে দিতে দিল না।
: আমার জন্মদিনে গিফট দিলে, ধরো এটা আমার পক্ষ থেকে উপহার। চাইলে আরো কিছু খেতে পার। বললো লিং।
: না না আমি দেব বিল। আমি তোমাকে খাওয়াব। জোরাজুরিতে কাজ হলো না। বিল মিটিয়ে রাস্তায় নেমে আসে দু’জন।
বাতাসের ঝাপ্টায় দোকানের সামনে টবে রাখা গাছের পাতা দুলছে। ছোট্ট বাঁশজাতীয় গাছ। চিরল চিরল পাতা। খুব সুন্দর দেখায়। চীনে বাঁশ গাছ আর চেরি ফল গাছের খুব সমাদর। আর টবে টবে আছে চায়না বট গাছ। সবখানে দেখা যায়।
ওরা রাস্তায় নামতেই একটা মিলিটারি ভ্যান শাঁ করে বড় রাস্তার দিকে এগিয়ে গেল। ভেতরে কয়েকজন বন্দী। কে জানে আবার কাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। অজানা আশঙ্কায় আবার আবার মনটা ভারি হয়ে আসে ফারহাতের। তবে লিংকে বুঝতে দেয় না। এখানে আবেগ প্রকাশের জায়গা নয়।
বিদায় বলে দু’জনে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। আলাদা গন্তব্যে হাঁটা দেয়।
বারো.
আরো কিছু নিখোঁজ লোকের বিষয় জানা গেছে। নাজমিদিন রেমান নেদারল্যান্ডস প্রবাসী উইঘুর মুসলিম। বাড়ি কাশগড়ে। তার পরিবারের ৪ জন সদস্য ৪ বছর ধরে নিখোঁজ। ফেসবুকে সে তাদের খুঁজে বেড়াচ্ছে। তার আকুল আবেদন ‘আমার পরিবারের লোকদের খুঁজে দিন’। কে দেবে? কে করবে এ কাজ। তার মায়ের নাম ফেরকাত জাওয়াদাত। বোন সিনাওয়ার তুরসুম।
তুরস্কে থাকে মেমেত তোহতি আতাউল্লাহ। তার ভাই রুজি মেহমেত আতাউল্লাহ দু‘বছর ধরে নিখোঁজ। নেদারল্যান্ডসে আছে আরো এক উইঘুর ছেলে শেফকাত হেকিম। তার পরিবারের চার সদস্যেরও কোন খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। কাশগড় শহর থেকে মা এ বছর আগে শেষ বারের মতো কথা বলেছেন। মা জানিয়েছেন, আর কল করো না। হানরা বোধ হয় জেনে গিয়েছিল তার ফোন কলের কথা। কত হারামি হলে মাকে বলতে পারে ছেলে যেন আর কল না দেয়। শুধু বাঁচার তাগিদে এই কথা শত ব্যথা বুকে চেপে ছেলেকে বলতে হয়েছে। তার পর শুধু কান্না। তিন বছর পর শেফকাত খবর পায় তার দাদা আর বেঁচে নেই। ২০১৬ সালে তাকে কাশগড় বন্দিশিবিরে নেওয়া হয়। তিনি সেখানে অসুস্থ হয়ে এক মাসের মধ্যে বলতে গেলে বিনা চিকিৎসায় মারা যান। শেফকাতের দুঃখের এখানেই শেষ নয়। ২০১৯ সালের মার্চে তার বাবা মারা যায় ক্যাম্পে। তার মা, ছোট ভাই, আরো দুই বোনসহ অনেক আত্মীয় বন্দিশিবিরে আছে। হাজার হাজার বন্দী সেখানে। বন্দিশিবিরের পোশাকি নাম সংশোধন কেন্দ্র। আসলে মগজ ধোলাই কেন্দ্র, আর তা পারা না গেলে মানুষ মারা কেন্দ্র। শেফকাত কাশগড় শহরের এক থানায় ফোন করে কিছু জানতে পারেনি। পরে সে নেদারল্যান্ডসে চীনা দূতাবাসে যোগাযোগ করে এবং তার পরিবারের সঙ্গে মিলিত হওয়ার সুযোগ চায়। কিন্তু চীনাদের কাছ থেকে কোন সাড়া পায়নি। এখন কান্নাই তার সম্বল। মা বাবা দাদা ও ভাই বোনের জন্য কান্না।
আবদুর রাহিম গনি একজন সয়েল অ্যানালিস্ট। কাশগড় থেকে বেরিয়ে সেও গেছে নেদারল্যান্ডস। তার পরিবারের সদস্যদেরও একই অবস্থা। তার পরিবারের সাকুল্যে ১৫ জন নিখোঁজ। তারা এখন কোথায় সে জানতে পারেনি। এখন কেঁদে কেঁদে জীবন পার করছে।
নরওয়েবাসী বাহদিয়ার ওমর উইঘুর মুসলিম। প্রবাসজীবনে তারও সঙ্গী কান্না। তুরপান শহরে সে বাবা মাসহ সবাইকে রেখে এসেছিল। তার পরিবারের সদস্যদের এখন কোন খবর নেই। উইঘুর টাইমস অনলাইন থেকে এসব খবর জানা যায়। এগুলো শুধু জানতে পারে প্রবাসীরা।
ভাগ্য ভালো থাকলে কেউ কেউ ফোন কলে আত্মীয়দের জানাতে পারে। উইঘুরে সে সুযোগ নেই, কেননা সেখানে ইন্টারনেট পরিষেবা বন্ধ। ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগের সব মাধ্যমই এখন বন্ধ। বাইরের মিডিয়ার সাথে সব যোগাযোগ বন্ধ। গোপনে গোপনে এসব খবর পেয়ে যায় উইঘুর পরিবারগুলো।
তেরো.
দশ দিন হয়ে গেল। তার পর পনেরো দিন। না, ফারহাতের কোন চেষ্টাই সফল হলো না। কী করা যায়। আর কোথায় যাবে সে। থানায় অভিযোগ দিলে কোন লাভ হবে না। এটা ঠিক। কী করবে ভেবে পাচ্ছে না।
ড্রইংরুমে একাকী বসে ফারহাত।
: ভাইয়া, তোর কি হয়েছে বল তো! ছোট বোন রিহানা এসে পাশে দাঁড়ায়। আরো বলে-
: আয়নায় দেখ তোর চেহারাটা।
: রাখ তো তোর আয়না। কাকারা ভোজবাজির মতো উধাও। ১৫ দিন। আর তুই বলছিস আমার কী হয়েছে?
: তুই একা কী করবি ভাইয়া। আমরা কি কম চিন্তা করছি। দাদী আর চাচিরা তো নাওয়া খাওয়াই ছেড়ে দিয়েছে। তুই, আব্বা, বড় ভাইয়া তোরা সবাই উদভ্রান্তের মতো ছুটে চলেছিস। এটা ঝিনজিয়াং। আমরা কমিউনিস্টদের হাতের পুতুল। আর এটাই আমাদের ভাগ্য। ভাগ্যকে মেনে নিতেই হবে রে ভাই।
: তুই এসব কথা কবে শিখলি? বোনের কথায় অবাক না হয়ে পারে না ফারহাত।
: কিছু মুখে দিয়ে কোথায় যাবি যা। বলে থামে রিহানা। তার চোখের কোণেও চিক চিক করে পানি। বোঝা যাচ্ছে সে কম দুঃখে কথাগুলো বলেনি।
কোন রকমে সামান্য পরিমাণ খাবার খেয়ে আবার বেরিয়ে পড়ে ফারহাত। কোথায় যাবে জানে না।
চৌদ্দ.
অনেকক্ষণ পার্কে বসে থাকলো ফারহাত। বাড়ি ফিরে যাবে না। কতক্ষণ টেনে টেনে গাছের পাতা ছিঁড়লো। কে একজন এসে খবর দিল-
: তুই এখানে বসে আছিস আর তোদের বাড়িতে কেয়ামত চলছে।
: কী বলছিস। আমি এই ঘণ্টাখানেক আগে বাসা থেকে এসেছি।
দ্রুত বাড়ি ফিরলো ফারহাত। এসে দেখে রক্তারক্তি কারবার। আম্মা আর রিহনার লাশ রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে আছে সোফায়। দাদী নিজের ঘরে হাউ মাউ করে কাঁদছে। সারা বাড়ি তছনছ। আব্বা আর বড় ভাইয়াসহ দুই চাচিকে ধরে নিয়ে গেছে চীনা সেনারা। সাথে পার্টির লোকরাও ছিল। ছিল ইয়াং লির বাবা। সে-ই সব দেখিয়ে দিয়েছে। পার্টির বড় নেতা বলে কথা। ছি: ছি: ভাবতেও কষ্ট হচ্ছে।
এটা নাকি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের ঘাঁটি। তাই এই অভিযান। ওদের সবাইকে ধরে নিয়ে গেছে থানায়। সেখান থেকে নেওয়া হবে বন্দিশিবিরে। যেখানে আটক রয়েছে লাখ লাখ উইঘুর মুসলমান। তারা কবে ফিরবে, আদৌ ফিরবে কি না কেউ জানে না। ফারহাত লুটিয়ে পড়লো রক্তাক্ত নিথর মায়ের কোলে।
: আম্মা কথা বলো, কী করে হলো এসব? ওরা এত নিষ্ঠুর কেন? আমাকে মেরে ফেললো না কেন। রক্তে ভিজে যাচ্ছে ফারহাতের শার্ট প্যান্ট। সে দিকে তার ভ্রুক্ষেপ নেই। রিহানার লাশ সোফার ওপর আলতো করে পড়ে আছে। জামা কাপড় রক্তে মাখা। তার চোখ দুটি খোলা। যেন ভাইকে প্রশ্ন করছে, ভাইয়া চাচাদের কোন খবর পেলি? বোনের লাশের দিকে চেয়ে আর্তনাদ করে উঠলো ফারহাত। মনে হলো সমগ্র উরুমকি কাঁদছে। কখন এই কান্না থামবে কেউ বলতে পারে না। একটু পর বড় মসজিদের ইমাম সাহেব ঘরে ঢুকলেন। তিনি রিহানার চোখ দুটোর পাতা বুজিয়ে দিলেন পরম যতেœ। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। লাশ দুটোর দাফনের ব্যবস্থা করতে হবে। [সমাপ্ত]