সিঙ্গাপুর দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একটি সার্বভৌম দ্বীপ নগর-রাষ্ট্র। দেশটির দক্ষিণে ইন্দোনেশিয়ার রিয়াউ দ্বীপ এবং উত্তরে উপদ্বীপীয় মালয়েশিয়া। মালয়েশিয়ার মালয় উপদ্বীপের দক্ষিণ প্রান্তে বিষুবরেখার মাত্র ১ ডিগ্রি (১৩৭ কিলোমিটার বা ৮৫ মাইল) উত্তরে সিঙ্গাপুর অবস্থিত। সিঙ্গাপুরের ভূখণ্ড একটি প্রধান দ্বীপ এবং ৫৮টি ক্ষুদ্র দ্বীপ নিয়ে গঠিত। স্বাধীনতা লাভের পর থেকে সিঙ্গাপুর ব্যাপক ভূমি উদ্ধার প্রকল্পের মাধ্যমে তার ভূমি ২৩ শতাংশ বৃদ্ধি করেছে। এদেশের সরকারি নাম সিঙ্গাপুর প্রজাতন্ত্র। রাজধানী সিঙ্গাপুর সিটি। ‘সিঙ্গাপুর’ নামটি আসে মালয় ভাষার সিঙ্গাপুরা শব্দ থেকে। সিঙ্গাপুরা শব্দটি আসে সংস্কৃত ভাষা সিঁহাপুরা থেকে, যার বাংলা অর্থ সিংহপুর।
স্যার স্ট্যামফোর্ড র্যাফেলস ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাণিজ্য কেন্দ্র হিসেবে ১৮১৯ সালে আধুনিক সিঙ্গাপুরের গোড়াপত্তন করেন। ১৮৫৮ সালে কোম্পানির পতনের পর সিঙ্গাপুর ‘স্ট্রেইটস সেটেলমেন্ট’ নামে পরিচিত রাজকীয় উপনিবেশ হিসেবে ব্রিটিশ রাজার নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধকালে জাপান সিঙ্গাপুর দখল করে এবং এরপর ব্রিটেন তা পুনর্দখল করে। সিঙ্গাপুর ১৯৬৩ সালে মালয়েশিয়ার সাথে যোগ দিয়ে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। কিন্তু দু’বছর পর আদর্শগত পার্থক্যের কারণে আলাদা হয়ে যায় এবং ১৯৬৫ সালে পুরোপুরি একটি সার্বভৌম রাষ্ট্রে পরিণত হয়।
আসিয়ানের পাঁচ প্রতিষ্ঠাতা সদস্যের মধ্যে অন্যতম সিঙ্গাপুর। সিঙ্গাপুরে এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় সহযোগিতার (এপিইসি) সচিবালয় এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় সহযোগিতা পরিষদের (পিইইসি) সচিবালয় রয়েছে। সিঙ্গাপুর জাতিসংঘ, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা, পূর্ব এশিয়া শীর্ষ সম্মেলন, জোটনিরপেক্ষ আন্দোলন এবং কমনওয়েলথ অব ন্যাশন্সের সদস্য।
সিঙ্গাপুরের আয়তন ৭২৫ দশমিক এক বর্গ কিলোমিটার (২৮০ বর্গ মাইল)। জনসংখ্যা ৫৬ লাখ ৩৮ হাজার ৭০০। জনসংখ্যার ঘনত্ব প্রতিবর্গ কিলোমিটারে ৭,৭৯৭ জন (বর্গ মাইলে ২০,১৯৪ জন)। এদেশে জাতিগত গ্রুপের মধ্যে রয়েছে চীনা ৭৪.৩ শতাংশ, মালয় ১৩.৩ শতাংশ, ভারতীয় ৯.১ শতাংশ এবং অন্যান্য ৩.৩ শতাংশ। প্রধান ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে রয়েছে বৌদ্ধ ৩৫.৪ শতাংশ, মুসলিম ২২ শতাংশ, খ্রিস্টান ১৪.৬ শতাংশ, ধর্মহীন ১৪.৮ শতাংশ, তাওবাদী ও লোকধর্ম ৮.৫ শতাংশ, হিন্দু ৪ শতাংশ এবং অন্যান্য ০.৬ শতাংশ।

পরিবহন ও সরবরাহে এই ধরনের নৌকা ব্যবহার করা হতো
সিঙ্গাপুরের ৪টি দাফতরিক ভাষা রয়েছে। এগুলো হলো ইংরেজি, মালয়, চীনা মান্দারিন ও তামিল। সাধারণ ভাষা হিসেবে এখানে ইংরেজিই প্রচলিত। এ ছাড়াও ব্যবসা-বাণিজ্য, শিক্ষা ও সরকারি কর্মকাণ্ডে প্রধানত ইংরেজিই ব্যবহৃত হয়। মালয়ভাষী প্রতিবেশী রাষ্ট্র মালয়েশিয়া এবং ইন্দোনেশিয়ার সাথে বৈপরীত্যতা এড়াতে ব্রিটেনের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভের পর ১৯৬০ সালে সিঙ্গাপুর সরকার মালয়কে জাতীয় ভাষা হিসেবে গ্রহণ করে। সিঙ্গাপুরের জাতীয় সঙ্গীতও মালয় ভাষায় রচিত।
এছাড়াও এখানে আরও প্রায় ২০টি ভাষা প্রচলিত। এগুলোর মধ্যে জাপানি, কোরীয়, মালয়ালম, পাঞ্জাবি ও থাইভাষা উল্লেখযোগ্য। ইংরেজি ভাষা সার্বজনীন ভাষা বা লিঙ্গুয়া ফ্রাংকা হিসেবে ভূমিকা পালন করে। আন্তর্জাতিক কর্মকাণ্ডেও ইংরেজি ভাষা ব্যবহার করা হয়।

সিঙ্গাপুরের রাজনীতি একটি সংসদীয় প্রজাতন্ত্র কাঠামোর আওতায় পরিচালিত হয়। দেশটিতে মূলত একটি রাজনৈতিক দলের প্রভাব বেশি। প্রধানমন্ত্রী হলেন সরকারের প্রধান। বিচার বিভাগ নির্বাহী ও আইন প্রণয়ন বিভাগ থেকে স্বাধীন। আইন সভার সদস্যরা জনগণের ভোটে নির্বাচিত হন। রাষ্ট্রপতি রাষ্ট্রের প্রধান হলেও তার ভূমিকা মূলত আলংকারিক। তবে ইদানীং রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার পরিসর কিছু বাড়ানো হয়েছে। বর্তমান প্রেসিডেন্ট হালিমা ইয়াকুব এবং প্রধানমন্ত্রী লিসিয়েন লুং। প্রেসিডেন্ট সরাসরি গণভোটে নির্বাচিত হন এবং তার ক্ষমতার মেয়াদ ছয় বছর। পার্লামেন্টের সদস্য সংখ্যা ১০০ এবং মেয়াদ পাঁচ বছর।
১৯৫৯ সালের নির্বাচনের পর থেকে পিপল্স অ্যাকশন পার্টি নামের রাজনৈতিক দলটি সিঙ্গাপুরের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করে চলেছে। একাধিক বিরোধী দল উপস্থিত থাকলেও ক্ষমতায় তাদের প্রতিনিধিত্ব নেই বললেই চলে। তাই অনেক বিদেশী পর্যবেক্ষক সিঙ্গাপুরকে কার্যত একটি এক-দলীয় শাসনব্যবস্থা হিসেবে গণ্য করে থাকেন। তবে সিঙ্গাপুরের সরকার সবসময়েই একটি স্বচ্ছ, দুর্নীতিমুক্ত সরকার হিসেবে বহির্বিশ্বে পরিচিত। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের মতে সিঙ্গাপুর বহুদিন ধরেই এশিয়ার সবচেয়ে দুর্নীতিমুক্ত দেশ।

সিঙ্গাপুর একটি ক্ষুদ্র ও ব্যাপকভাবে নগরায়িত দ্বীপরাষ্ট্র। এটি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় মালয় উপদ্বীপের দক্ষিণতম প্রান্তে এবং মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার মাঝখানে অবস্থিত। সিঙ্গাপুরের উপকূলরেখার দৈর্ঘ্য ১৯৩ কিলোমিটার। এটি মালয়েশিয়া থেকে জোহর প্রণালী এবং ইন্দোনেশিয়া থেকে সিঙ্গাপুর প্রণালী দিয়ে বিচ্ছিন্ন।
সিঙ্গাপুরের মূল ভূখণ্ড একটি হীরক আকৃতির দ্বীপ, তবে এর প্রশাসনিক সীমানার ভেতরে আরও বেশ কিছু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দ্বীপ অবস্থিত। এগুলোর মধ্যে পেদ্রা ব্রাংকা নামের দ্বীপটি সিঙ্গাপুর থেকে সবচেয়ে বেশি দূরত্বে অবস্থিত। সিঙ্গাপুরের সীমানার অন্তর্গত কয়েক ডজন ক্ষুদ্রাকার দ্বীপের মধ্যে জুরং দ্বীপ, পুলাউ তেকোং, পুলাউউবিন ও সেন্তোসা উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বড়।
সিঙ্গাপুর দ্বীপের বেশির ভাগ এলাকা সমুদ্রসমতল থেকে ১৫ মিটারের বেশি উঁচু নয়। দেশটির সর্বোচ্চ স্থানের নাম বুকিত তিমাহ; এটি সমুদ্রসমতল থেকে ১৬৪ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত গ্র্যানাইট পাথরের শিলা। সিঙ্গাপুরের উত্তর-পশ্চিমে আছে পাললিক শিলার ছোট ছোট টিলা ও উপত্যকা, অন্য দিকে পূর্বভাগ মূলত বালুকাময় সমতল ভূমি দিয়ে গঠিত। সিঙ্গাপুরে কোন প্রাকৃতিক হ্রদ নেই, তবে সুপেয় পানি সরবরাহ ব্যবস্থার জন্য কৃত্রিম জলাধার নির্মাণ করা হয়েছে।

সিঙ্গাপুর প্রশাসন সমুদ্রতলের মাটি, পর্বত ও অন্যান্য দেশ থেকে মাটি সংগ্রহ করে দেশের স্থলভাগের আয়তন বৃদ্ধি করে চলেছে। ২০৩৩ সাল নাগাদ এর আয়তন আরও ১০০ বর্গকিলোমিটার বৃদ্ধি পাওয়ার কথা।
এখানকার আবহাওয়া নিরক্ষীয় প্রকৃতির। গ্রীষ্মমণ্ডলীয় বৃষ্টিবিধৌত জংলী আবহাওয়ার এই দেশে তেমন কোনো সুস্পষ্ট ঋতু নেই। এখানে আর্দ্রতা বেশি এবং বৃষ্টিপাত হয় প্রচুর। নভেম্বর থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত বেশি বৃষ্টিপাত হয়। তাপমাত্রা ২৫ থেকে ৩৫ ডিগ্রি সেলয়িাসের মধ্যে ওঠানামা করে। সারা দেশে তাপমাত্রার খুব বেশি হেরফের হয় না। ঘূর্ণিঝড় এদেশে বিরল ঘটনা।
১৯৬৫ সালে স্বাধীনতা লাভের পূর্বে সিঙ্গাপুর ব্রিটিশদের অধীনে একটি ‘ক্রাউন কলোনি’ অর্থাৎ রাজকীয় উপনিবেশ ছিল। এই দ্বীপটি পূর্ব এশিয়ায় ব্রিটিশ নৌবাহিনীর প্রধান ঘাঁটি ছিল। ব্রিটিশ ঘাঁটি থাকার কারণে সিঙ্গাপুরকে তখন ‘প্রাচ্যের জিবরালটার’ বলা হতো। ১৮৬৯ সালে সুয়েজখাল খোলার পর ইউরোপ এবং এশিয়ার মধ্যে সমুদ্রবাণিজ্য বৃদ্ধি পায়, ঠিক তখনই সিঙ্গাপুরকে বিশ্বের প্রধান সমুদ্র বন্দর হিসেবে ব্যবহার করা শুরু হয়।
১৯৬৫ সালে অর্থাৎ স্বাধীনতা লাভের বছরে এই দেশের মাথাপিছু আয় ছিল ৫১৬ মার্কিন ডলার। এটাই তখন ছিল পূর্ব এশিয়ার মধ্যে তৃতীয় সর্বোচ্চ। স্বাধীনতার পরে ইউরোপ থেকে বিনিয়োগ আসার মাধ্যমে সিঙ্গাপুরের অর্থনীতি ধীরে ধীরে শক্তিশালী হওয়া শুরু করে। আশির দশকের মাঝামাঝি এই দেশটি উন্নত রাষ্ট্রের মর্যাদা লাভ করে। জাতিসংঘের মানব উন্নয়ন সূচকে সিঙ্গাপুরের অবস্থান বিশ্বে নবম। এদেশের মুদ্রার নাম সিঙ্গাপুরি ডলার।
সিঙ্গাপুরের শিক্ষাব্যবস্থা প্রধানত রাষ্ট্র কর্তৃক পরিচালিত। একই সাথে বেসরকারি উদ্যোগ এবং অবস্থানও সেখানে স্বীকৃত। এখানে শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যম ইংরেজি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠদান, পরীক্ষা গ্রহণ সবকিছুই ইংরেজিতে পরিচালিত হয়। প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক। প্রাথমিক, মাধ্যমিক এবং প্রাক-বিশ্ববিদ্যালয়- এ তিনটি স্তরে সিঙ্গাপুরের শিক্ষাব্যবস্থা পরিচালিত হয়। ছয়টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় আছে, যার মধ্যে ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুর এবং নানইয়াং ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি বিশ্বের সেরা ২০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে অন্যতম। মানসম্মত শিক্ষাব্যবস্থার জন্য বিশ্বব্যাপী সিঙ্গাপুরের সুনাম রয়েছে।
বৈশ্বিক উদ্ভাবন সূচকে এই দেশ বিশ্বে ৮ম স্থানে রয়েছে। এশীয় অঞ্চলে যা সর্বোচ্চ।
পর্যটন সিঙ্গাপুরের অন্যতম প্রধান শিল্প এবং দেশটির অর্থনীতিতে ব্যাপক অবদান রাখে। প্রতি বছর কয়েক মিলিয়ন পর্যটক সিঙ্গাপুর ভ্রমণ করেন। এদেশের কয়েকটি পর্যটন আকর্ষণ হলো-
নাইটসাফারি : সিঙ্গাপুর চিড়িয়াখানা পৃথিবীর প্রথম ও একমাত্র নাইটসাফারি। নাইটসাফারিতে গভীর রাতে জঙ্গলের ভিতরের নানান পশুপাখিদের মাঝ দিয়ে ট্রামে করে পর্যটকরা বিচরণ করেন। বাঘ, হরিণ, ভালুক, হাতি, উট, কুমির এ সাফারির প্রাণীদের মধ্যে অন্যতম। এ সাফারিতে পশুপাখিরা উন্মুক্তভাবে ঘুরে বেড়ায়।
মারলাওন পার্ক : মারলিন বা সিংহ-মৎস্য হচ্ছে সিঙ্গাপুরিদের গর্ব ও বীরত্বের প্রতীক। কথিত আছে, বহুপূর্বে সিঙ্গাপুর যখন তেমাসেক বা সমুদ্রনগরী নামে পরিচিত ছিলো তখন প্রচণ্ড এক সামুদ্রিক ঝড় ওঠে দ্বীপে। অধিবাসীরা যখন সৃষ্টিকর্তার হাতে নিজেদের সঁপে দেয় ঠিক তখনই সমুদ্র থেকে সিংহ-মৎস্য আকৃতির এক জন্তু এসে ঝড়ের বিরুদ্ধে লড়াই করে বাঁচিয়ে দেয় অধিবাসীদের। আর সেই থেকে মারলিন নামের সিংহ-মৎস্য সিঙ্গাপুরিদের গর্ব আর বীরত্বের প্রতীক। মারলিনের মূর্তি ম্যারিনা বে’র মারলাওন পার্কে অবস্থিত।
সেন্টোসা আইল্যান্ড : সমুদ্রের মাঝে ছোট এক দ্বীপে গড়ে তোলা বিনোদন কেন্দ্র।