স্বাধীনতা বাঙালির সবচেয়ে গৌরবদীপ্ত সোনালি ইতিহাস। মহান একুশের রক্তধোয়া সিঁড়ি বেয়ে আসে জাতির স্বাধিকার চেতনা। সেই চেতনার পিলসুজ জ্বলছে জাগ্রত অস্তিত্বের আলোর শিখা। সেই শিখা আরো প্রজ্বলিত হয়ে একাত্তরে নতুন মুক্ত আকাঙ্ক্ষার সংগ্রামী পথ দেখিয়ে দেয়। অবশ্য বাস্তবে ১৯৭১ সালের আগুনঝরা মার্চে আমাদের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলেও বাঙালির মুক্তিসংগ্রাম চলেছে দীর্ঘ শতাব্দী ধরে। ফলে দেশমাতৃকার মুক্তির আকাঙ্ক্ষা আমাদের বহুদিনের। আর সেই মুক্তির স্বপ্নে বিভোর হয়ে আমাদের কবি-সাহিত্যিকগণ যুগ যুগ ধরে রচনা করে যাচ্ছেন স্বাধীনতার কবিতা। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় বাঙালি জীবনের নানা অধ্যায়, ঘটনা, দুর্ঘটনা এ সাহিত্যকে প্রভাবিত করেছে। বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠ যে কয়েকটি ঘটনা আছে এর মধ্যে একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধ অন্যতম। তাই স্বাধীনতা আমাদের জীবনের প্রতিটি পরতে পরতে মিশে আছে একাকার হয়ে। স্বাধীনতা আমাদের জীবনযাত্রাকে নানাভাবে, নানা আঙ্গিকে দোলায়িত করেছে। স্বাধীনতার ছোঁয়া আমাদের সাহিত্যাঙ্গনেও কানায় কানায় ভরপুর। বাংলা সাহিত্যের এমন কোনো শাখা নেই যেখানে স্বাধীনতার ছোঁয়া লাগেনি। গান, কবিতা, গল্প, উপন্যাস, ছড়া, প্রবন্ধ, সঙ্গীত, নাটকসহ সাহিত্যের প্রতিটি শাখায় এ চেতনাকে তুলে ধরেছেন আমাদের কবি সাহিত্যিকগণ। চলমান প্রবন্ধে আমরা কিশোর কবিতায় স্বাধীনতা নিয়ে আলোচনা করার প্রয়াস পাব ইনশাআল্লাহ।
২৫ মার্চের অন্ধকার রাতে হানাদার বাহিনী হিংস্র পশুর মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে নিরস্ত্র শান্তিপ্রিয় বাঙালিদের ওপর। নির্বিচারে হত্যা করতে থাকে এদেশের তরুণ, যুবক, প্রবীণ, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, কবি, সাহিত্যিক ও সংস্কৃতিকর্মীদের ওপর। বাংলা সাহিত্যের পল্লীকবি খ্যাত কবি জসীম উদ্দীনের কলম তাদের বিরুদ্ধে ট্যাংকবিধ্বংসী কামানের গোলার মত গর্জে ওঠে এভাবে-
‘কী যে কী হইল পশ্চিম হতে নরঘাতকেরা আসি
সারা গাঁও ভরি আগুনে জ্বালায়ে হাসিল অট্টহাসি।
মার কোল থেকে শিশুরে কাড়িয়া কাটিল যে খানখান
পিতার সামনে শিশুরে কাটিল করিল রক্তস্নান
কে কাহার তরে কাঁদিবে কোথায়, যুবকাষ্টের গায়
শত সহস্র পড়িল মানুষ ভীষণ খড়্গ ধায়।’
পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীদের নির্মম হত্যাযজ্ঞ, অমানুষিক জ্বালাও পোড়াও এর বিরুদ্ধে বাংলা মায়ের দামাল ছেলেরা বুক পেতে দিয়ে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছেন সহাস্যে। বাংলাদেশের খ্যাতিমান কবি রণাঙ্গনের অকুতোভয় সৈনিক বীর মুক্তিযোদ্ধা কবি আল মাহমুদ তুলে এনেছেন সেই বীভৎসতার একটি খণ্ডচিত্র। তিনি লিখেছেন-
‘কুষ্টিয়ায় ঝাঁপিয়ে পড়েছিল ছেলেটি
কুষ্টিয়ার কাস্টমস কলোনির পাশে
যেন ঝাঁপিয়ে পড়েছিল শত্রুদের জিপকে উড়িয়ে দিতে।
খণ্ড খণ্ড হয়ে উড়ে গিয়েছিল তার বাহু
ঊরু ও পিঠের কিছু অংশ।
হাসিবুল ইসলাম, আল্লাহু আকবার বলে সে আক্রমণ করেছিল।
তার বুক থেকে কলজে উড়ে গিয়ে ওই পতাকায় লেগে আছে।
লেখো তার শেষ উচ্চারণ আল্লাহু আকবার।’
মনুষ্যত্ব বিকিয়ে দিয়ে বাঙালি গোলামি মেনে নেবার বান্দা নয়। তাই সব বাধা পেরিয়ে মুক্তির সোনালি ভোর ছিনিয়ে আনতে বাংলার বীর জনতা যে হৃদ্যিক প্রচেষ্টা, স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা পোষণ করেছেন তার তরতাজা ছবি এঁকেছেন বাংলা সাহিত্যের আরেক বিখ্যাত কবি শহীদ কাদরী ঠিক এমনিভাবে-
‘মধ্য দুপুরে ধ্বংসস্তূপের মধ্যে একটা তন্ময় বালক
কাচ, লোহা, টুকরো ইট, বিদীর্ণ কড়ি-কাঠ
এক ফালি টিন
ছেঁড়া চট, জংধরা পেরেক
জড়ো করলো এক নিপুণ ঐন্দ্রজালিকের মতো যতো
এবং অসতর্ক হাতে কারফিউ শুরু হওয়ার আগেই
প্রায় অন্যমনস্কভাবে তৈরি করলো কয়েকটা অক্ষর
স্বা—-ধী —ন—-তা—’
স্বাধীনতার উন্মাদনা কবি সুফিয়া কামালের কবিতাকেও স্পর্শ করেছে। তরুণ কবি মেহেরুন নেসা, ষাটের দশকে এদেশের সাহিত্যাঙ্গনে একটি পরিচিত নাম ছিল। মুুক্তিযুদ্ধের শুরুতে তিনি মা ও দুই ভাইসহ নৃশংসভাবে নিহত হন পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে। বেগম সুফিয়া কামাল তাকে স্মরণ করেছেন অত্যন্ত দরদের সঙ্গে-
‘কুমারী কিশোরী শাহানা রঙে মেহেদী লাগানো হাতে
জালিম কাফের পিশাচেরা সেই হাতে
অসহায় মেয়ে মোর
শানিত ছুরিকা হানিয়া কণ্ঠে তোর
তাণ্ডবলীলা শুরু করছিল, রক্ত বাসনা তুই
পূত পবিত্র একমুঠি ফুল—–’
কবি মোহাম্মাদ মনিরুজ্জামান নয় মাস বাংলাদেশেই আত্মগোপন করেছিলেন, দেশ ত্যাগ করেননি, মুুক্তিযুদ্ধে তিনি হারিয়েছেন তার সহোদরকে, কিশোর ভাইকে। আপনজন হারানোর আবেগ ধরা পড়েছে সরাসরি তার কবিতার পঙক্তিতে।
‘কবিতায় কি বলব? / যখন আসাদ /
মনিরামপুরের প্রবল শ্যামল / হৃদয়ের তপ্ত রুধিরে করেছে রঞ্জিত, /
সারা বাংলায় আজ উড্ডীন / সেই রক্তাক্ত পতাকা। /
আসাদের মৃত্যুতে আমি / অশ্রুহীন, অশোক কেননা /
নয়ন কেবল বজ্রবর্ষী।’
বাংলাদেশের শিশু-কিশোর আন্দোলনের পথিকৃৎ বরেণ্য শিশুসাহিত্যিক, কবি রোকনুজ্জামান খান দাদাভাই লিখেছেনÑ
‘লাখো লাখো শহীদ হলো / বাংলাদেশের ছেলে, /
ও খোকা তুই নে হাতিয়ার / বই পত্তর ফেলে।’
আধুনিক বাংলা সাহিত্যের খ্যাতিমান কবি নির্মলেন্দু গুণের কবিতায় স্বাধীনতা এসেছে এভাবেÑ
‘বলো উলঙ্গতা স্বাধীনতা নয়, / বলো দুঃখ কোন স্বাধীনতা নয়, /
বলো ক্ষুধা কোন স্বাধীনতা নয়, / বলো ঘৃণা কোন স্বাধীনতা নয়। /
জননীর নাভীমূল ছিন্নকরা রক্তজ কিশোর তুমি
স্বাধীনতা, তুমি দীর্ঘজীবী হও। তুমি বেঁচে থাকো
আমার অস্তিত্বে, স্বপ্নে, প্রেমে বল পেন্সিলের / যথেচ্ছ অক্ষরে,
যৌবনে, / কবিতায়।’
যুগে যুগে দেশে দেশে আধিপত্যবাদীদের করাল গ্রাস থেকে স্বাধীনতার ভেলা মুক্তির মোহনায় নিরাপদ নোঙরের জন্য অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে স্বাধীনতা পাগল মুক্তিকামী মানুষের। দীর্ঘ নয় মাসের রক্তপিচ্ছিল পথ পাড়ি দিতে গিয়ে বাংলা মায়ের দামাল ছেলেদের যে অপেক্ষা, প্রবাহিত রক্ত নদীর যে নিমর্মতা, সতীত্ব হারানো নারীর যে বোবা কান্না তা তুলে এনেছেন মুক্তি সংগ্রামের আরেক প্রত্যক্ষদর্শী কবি শামসুর রাহমান। তিনি লিখেছেন-
‘আর রাইফেল কাঁধে বনে জঙ্গলে ঘুরে বেড়ানো
সেই তেজী তরুণ যার পদভারে
একটি নতুন পৃথিবীর জন্ম হতে চলেছে—-
সবাই অধীর প্রতীক্ষা করছে তোমার জন্যে, হে স্বাধীনতা।’
(তোমাকে পাওয়ার জন্যে, হে স্বাধীনতা /শামসুর রাহমান)
বাংলা সাহিত্যের সব্যসাচী কবি সৈয়দ শামসুল হক লিখেছেন-
‘মতিউরকে ভুলেই গেছি / কে যেন আসাদ– /
বাংলাদেশের আকাশ থেকে / পালিয়ে গেল চাঁদ। /
মিছিল মিছিল মিছিলে যাই / হাতেই হাত ধরি /
এবার বুঝি ধানে বোঝাই / হবে সোনার তরী।’
(একাত্তর /সৈয়দ শামসুল হক)
আপেল মাহমুদ লিখেছেন-
‘মাগো, কেনো রাখো আমায় শৃঙ্খলিত করে
দাও না একটু স্বাধীনতা, চলি নিজের মতো করে।
—–
মুক্ত আকাশে মুক্ত প্রাণে
বুক ভরে শ্বাস নিই, ভুলে সকল স্বাধীনতা।
ভালো মানুষ হবার পণে-
হীনতাকে পদদলিত করে ঘুচাববো তোমার দীনতা।
দাও মা একটু স্বাধীনতা
(কিশোর স্বাধীনতা /আপেল মাহমুদ)
যুদ্ধ করতে গিয়ে বাংলার কিশোর দামাল ছেলেরা পাকিস্তানিদের ওপর কিভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল তার নিটোল বর্ণনা শুনি কবি আকতার হুসেনের এই কবিতায়Ñ
‘সোনা-মানিক ভাইরা আমার সেই কবে কোন সনে
দানোর সাথে করতে লড়াই গিয়েছিলেন রণে।
রণের শেষে মায়ের কোলে আর ফিরেনি তারা
সেই দুখে মার দু’চোখ গেল অশ্রু বাঁধন হারা।’
(সোনা মানিক ভাইরা আমার/আকতার হুসেন)
ষাটের দশকের অন্যতম প্রধান কবি রফিক আজাদ তার কবিতায় স্বাধীনতার চিত্র এঁকেছেন এভাবেÑ
‘হাতিয়ার হাতে দুশমনের মোকাবেলা করলাম
বারুদের গন্ধ মাখলাম শরীরে
ক্রলিং করে শত্রুর বাংকারে গ্রেনেড ছুঁড়ে
টুকরো টুকরো করে দিলাম শত্রুর সোনালি স্বপ্নকে।’
কবি ওমর আলী রোমান্টিক প্রেমের কবি হলেও তার কবিতায় স্বাধীনতা উপেক্ষিত হয়নি। তিনি যুগ ও কাল সচেতন কবি বলেই তার কলমের আঁচড়ে স্বাধীনতা উঠে এসেছে বারবার। তিনি লিখেছেনÑ
‘আমরা আগুনের ক্রুদ্ধ মুঠো ছুড়ে দিয়েছিলাম
হানাদারদের মুখে তাদের বাধ্য করেছিলাম নতমস্তকে
আত্মসমর্পণ করতে রেসকোর্স মাঠে
এইতো আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চরম বিজয়
আমরা বন্দুকের নলে উড়িয়ে দিয়েছিলাম
স্বাধীন বাংলাদেশের মানচিত্র আঁকা প্রথম বিজয়ের গর্বিত পতাকা।’
বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শক্তিমান কবি মহাদেব সাহা জনৈক কিশোরকে স্বাধীনতার কাহিনী বয়ান করে শোনান তার কবিতার ভাষায়। তিনি লিখেছেন-
‘শোনো একদিন এই দেশটাতে / মুক্তিযুদ্ধ হয়—- /
আমাদের প্রিয় মাতৃভূমির / ঘোচাতে দুঃখ –ভয়; /
এই দুটি হাত / স্বাধীন অবাধ /
হয়ে ওঠে দুর্জয় — / হে কিশোর শোনো /
আমরা সেদিন যুদ্ধ করেছি জয়।’
এ সময়ের অন্যতম খ্যাতিমান কবি মোশাররফ হোসেন খান স্বাধীনতার ব্যাপারে মনের উচ্চাভিলাষ প্রকাশ করতে দেখি তাঁর “একাত্তরের কথা” কবিতায়-
“একাত্তরের কথা,
রক্ত দিয়ে পেলাম এই
দেশের স্বাধীনতা।
মুক্ত স্বাধীন পাখি,
সবুজ শ্যামল বাংলাদেশ
বুকের ভেতর রাখি।
দেশকে ভালোবাসি,
দেশের জন্য তাইতো জাগে
স্বপ্ন রাশি রাশি।
স্বাধীনতার সুখ,
সাগর ভাঙা স্বপ্ন সাহস
দামাল ছেলের মুখ।”
পরিশেষে সংক্ষিপ্ত আলোচনার বেলাভূমিতে দাঁড়িয়ে বলা যায়, স্বাধীনতার কবিতা থেমে নেই। চলছে তার যাত্রা। এই যাত্রাকে অব্যাহত রাখতে আরো অনেক কবি সাহিত্যিক লিখে চলেছেন বহতা নদীর মতো স্বাধীনতার গৌরবগাথা। যার ফলে বাংলাদেশের কবিতায় সৃষ্টি হয়েছে এক নতুন স্রোতধারা। গড়ে উঠছে স্বাধীনতার নতুন অধ্যায়। বস্তুত স্বাধীনতা আমাদের সৃষ্টির পুষ্প বাগানকে সুগন্ধে, সৌন্দর্যে সুশোভিত করেছে, এনে দিয়েছে পূর্ণতা ও গৌরব। অনাগতকালে এ ধারা অব্যাহত থাকলে বাংলাসাহিত্য আরো সমৃদ্ধ হয়ে উঠবে এর মধ্যে কোনো সন্দেহ নেই।