(গত সংখ্যার পর)
আসসালামু আলাইকুম বন্ধুরা। কেমন আছো তোমরা? নিশ্চয়ই ভালো। আমিও তোমাদের দোয়ায় আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। তোমরা নিশ্চয়ই জানো, ফেব্রুয়ারি মাস ভাষার মাস। ফেব্রুয়ারি মাস বইয়ের মাস, বইমেলার মাস। প্রতি বছর ফেব্রুয়ারির এক মাস ঢাকার বাংলা একাডেমিসহ সারা দেশের বড় বড় শহরগুলোতে বইমেলার আয়োজন হয়ে থাকে। এটা শুরু হয়েছিল ১৯৭২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি এবং এখনো বেশ জাঁকজমকপূর্ণভাবে চলছে। তারই ধারাবাহিকতায় এবারো বইমেলা হচ্ছে ঢাকাসহ সারা দেশে। ফেব্রুয়ারি যেহেতু বইয়ের মাস, বইমেলার মাস সেহেতু আজো তোমাদের সাথে বই নিয়েই কথা বলতে চাই।
আমাকে যদি প্রশ্ন করা হয় পৃথিবীর মধ্যে শ্রেষ্ঠ বন্ধু কে? আমি বলব বই। যদি বলা হয় দুঃখ-দুর্দশা ও নিঃসঙ্গতায় কে আমাকে সবচেয়ে বেশি সঙ্গ দেয়, আমি বলব বই। আমাকে যদি আমার জীবনের সুন্দর মুহূর্তগুলো বর্ণনা করতে বলা হয় তখন আমি বলব, বইপড়ার মুহূর্তগুলো সবচেয়ে সুন্দর। নানা ঘাত-প্রতিঘাতে মানুষ যখন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে, হতাশার চোরাবালিতে ডুবে যায়। এই চোরাবালি থেকে মানুষকে উদ্ধার করতে পারে একটি ভালো বই। মানুষের আনন্দ লাভের পথ বহু বিচিত্র। গ্রন্থপাঠ আনন্দ লাভের শ্রেষ্ঠ পথ। এটি কর্মক্লান্ত দিনের ব্যস্ততা ও হানাহানির মধ্যে ক্লিষ্ট-পীড়িত চিত্তের ক্লান্তি দূর করে এনে দেয় অনাবিল প্রশান্তি। এ জন্যই ভিনসেন্ট স্টারেট (১৫৮১-১৬৬০) বলেছেন, ‘When we buy a book, we buy pleasure.’ বিখ্যাত ঔপন্যাসিক লিও টলস্টয় (১৮২৮-১৯১০) বলেছেন, ‘Three things are essential for life & these are books books and books.’
মনীষী কার্লাইল (১৭৯৫-১৮৮১) তাঁর ‘On the choice of books’ প্রবন্ধের এক জায়গায় বলেছেন- ‘The true University of our days is the collection of book.’
সমস্ত প্রাণিজগতের সাথে মানুষের পার্থক্য এইখানে যে, মানুষ তার জ্ঞানকে, বোধকে অক্ষরের ভাষায় লিপিবদ্ধ করে বইয়ের মাধ্যমে মানুষের জ্ঞানার্জন ও আনন্দ লাভের জন্য রেখে যেতে পারে।
বিশ্বের মহামূল্য গ্রন্থগুলো মানুষের জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্প-সাহিত্য সাধনার নির্বাক সাক্ষী। এগুলোর মধ্য দিয়েই মানুষ লাভ করেছে তার আপন অন্তরতম সত্তার পরিচয়। আমাদের বৃহত্তর জীবনের যাত্রাপথের সবচেয়ে বড় সঙ্গী বরেণ্য মনীষীদের লেখা মূল্যবান বই। প্রতিটি মানুষের জীবনী অনুসন্ধান করলে তোমরা দেখতে পাবে তাদের জীবনের বেশির ভাগ সময় কেটেছে বই পড়ে।
অ্যামেরিকার সবচেয়ে জনপ্রিয় প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট (১৮৫৮-১৯১৯) অন্য লোকদের সাথে কথোপকথনের সময়েও ফাঁক দিয়ে বই পড়তেন। আর নেপোলিয়ন (১৭৬৯-১৮২১) যুদ্ধে গেলেও তাঁর সাথে থাকতো একটি চলমান লাইব্রেরি। হযরত আলী (রা.) (৫৯৮-৬৬১) এর ব্যক্তিগত হাদিস সঙ্কলন ‘সহিফা’ সংরক্ষিত রাখতেন তাঁর তলোয়ারের খাপের ভেতর।
ক্যাডম্যান (১৮৮১-১৯৪৬) বারো বছর বয়স থেকে আহারের সময়ও পড়া চালিয়ে যেতেন। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর (১৮৯২-১৯৬৩) কোষ্ঠকাঠিন্য থাকায় টয়লেটে খুব বেশি সময় লাগত। তাই কমোডে বসেই প্রতিদিনের পত্রিকাগুলো পড়ে শেষ করতেন। সুতরাং বইয়ের সাথে না থাকলেও চব্বিশ ঘণ্টা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে পড়ালেখার সাথে নিজেকে ইনভলভ রাখা যায়।
এবার দেখবো পাঠ্যবইয়ের বাইরে তোমাদের জ্ঞানের সীমা কতটুকু। এ ক্ষেত্রে আমি তোমাদের একটি কুইজ ধরবো। বলোতো, বারকিনাফাসো, লেসোথা, ডোমিনিকা ও কসোভো- এগুলো কিসের নাম? কোনো ব্যক্তির নাম? ট্যাবলেটের নাম? নাকি কোনো দেশের নাম? যদি উত্তরগুলো জানা থাকে তাহলে আজই ডায়েরিতে লিখে রাখো। আর জানা না থাকলে অনুসন্ধানে লেগে যাও।
সারাদিন যারা শুধু পাঠ্যবই নিয়েই পড়ে থাকে তাদের চিন্তার জগৎ হয়ে যায় একেবারে সঙ্কীর্ণ। তারা অ্যাকাডেমিক ভালো রেজাল্ট করতে পারে ঠিক কিন্তু জীবনে বড় কিছু করতে পারে না। জীবনে তোমাদের নানা বই পড়তে হবে, অজানাকে জানতে হবে, অচেনা পথে হাঁটতে হবে। তোমার সমগ্র জীবনে হয়তো বিশ-পঁচিশটি পথে হাঁটা হবে সেখান থেকে পাঁচটি রাস্তা বেরিয়ে আসবে এবং যা পরবর্তী সময়ে চমৎকার মহাসড়কে পরিণত হবে। কিন্তু তোমাকে মনে রাখতে হবে যে বিশটা রাস্তা হাঁটা হয়েছে, কিন্তু পরবর্তী সময়ে মহাসড়কে পরিণত হয়নি, সেই রাস্তাগুলোতে হাঁটা না হলে এই পাঁচটি রাস্তা মহাসড়কে পরিণত হতে পারতো না। তাই বারবার বলি শুধু অ্যাকাডেমিক পড়াশোনার মধ্যেই জীবনকে সীমাবদ্ধ রাখলে জীবনের আসল পথ ধরতে পারবে না। যারা শুধু অ্যাকাডেমিক বিষয়াদি নিয়েই ব্যস্ত থাকে তারা জীবনের মানে ও আসল রাস্তা ধরতে পারে না। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে তারা থেকে যায় মায়ের কোলের সদ্যপ্রসূত শিশুর মতোই। সুতরাং তোমাদের পাঠ্যবইয়ের ফাঁকে ফাঁকে আদর্শ চরিত্র গঠনের জন্য ধর্মীয় গ্রন্থ পড়বে। সাধারণ জ্ঞানের জন্য পত্রিকা। অনুপ্রেরণার জন্য মহামনীষীদের জীবনী। মাঝে মধ্যে তাঁদের বিশেষ কিছু বাণী ডায়েরিতে লিখে রাখবে। এতে করে পাঠ্য বইটিও ভালোভাবে রপ্ত হবে। যেমন শুধু গোশত রান্না করলেই কিন্তু খাওয়া যায় না, তার সাথে প্রয়োজন তেল, লবণ, মরিচ, আদা, রসুন, পেঁয়াজ, গরম মসলা ইত্যাদি। তবেই তা হয় মুখরোচক আর হজমদায়ক।
তবে কিছু চালবাজ ধূর্ত লোক বই পাঠকে ঘৃণা করে। সাধারণ লোকেরা বই পাঠের প্রশংসা করে, জ্ঞানী লোকেরা ব্যবহার করে। জ্ঞানী লোকেরা অভিজ্ঞতার মারফত বুঝতে পারে পাঠার্জিত জ্ঞানকে কিভাবে বাস্তব জীবনে কাজে লাগাতে হবে। পাঠ কাউকে নাকচ করার জন্য নয়; কোন কিছুকে স্বতঃসিদ্ধরূপে গ্রহণ করার জন্য নয়; বাদানুবাদের জন্যও নয়। পাঠ হবে বিচার-বিবেচনার জন্য।
কিছু বই পড়বে স্বাদ নেয়ার জন্য। কিছু বই গিলে ফেলার জন্য। কতিপয় বই চিবিয়ে খেয়ে হজম করে ফেলতে হয় অর্থাৎ মনোযোগ ও নিষ্ঠার সাথে পুরোটা পড়তে হয় বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করার জন্য।
এবার চলো দেখি, মহামনীষীরা বইপড়া সম্পর্কে কী বলেছেন। স্পিনোজা (১৬৩২-১৬৭৭) বলেছেন. ‘ভালো খাদ্যবস্তুতে পেট ভরে কিন্তু ভালো বই মানুষের আত্মাকে পরিতৃপ্ত করে।’ ইউরোপ কাঁপানো নেপোলিয়ন কী বলেছেন জানো? তিনি বলেছেন, ‘অন্তত ষাট হাজার বই সাথে না থাকলে জীবন অচল।’ মারকুস টুলিয়াস (১৮৬৪-১৯২১) বলেছেন, ‘A room without books is like a body without soul.’ জেমস রাসেল (১৮১৯-১৮৯১) বলেছেন- ‘বই হলো এমন এক মৌমাছি যা অন্যদের সুন্দর মন থেকে মধু সংগ্রহ করে পাঠকের জন্যে নিয়ে আসে।’ ফ্রান্স কাফকা (১৮৮৩-১৯২৪) বলেছেন, ‘আমাদের আত্মার মাঝে যে জমাটবাঁধা সমুদ্র, সেই সমুদ্রের বরফ ভাঙার কুঠার হলো বই।’
গ্যাটে (১৭৪৯-১৮৩২) বলেছেন- কতগুলো বই সৃষ্টি হয় আমাদের শিক্ষা দেয়ার জন্য নয়; বরং তাদের উদ্দেশ্য হলো আমাদের এই কথা জানানো যে, বইগুলোর স্রষ্টারা কিছু জানতেন।’ ভলতেয়ার (১৬৯৪-১৭৭৮) বলেছেন একটি মজার কথা- ‘সে দেশ কখনো নিজেকে সভ্য বলে দাবি করতে পারবে না যতদিন না তার বেশির ভাগ অর্থ চুইংগামের পরিবর্তে বই কেনার জন্য ব্যয় হবে।’ লিমনি সানকেট বলেছেন, ‘Never trust anyone who has not brought a book with them.’ আর সবচাইতে চরম কথাটি বলেছেন নর্মান মেলর (১৮৯৩-১৯৬৯)- ‘আমি চাই, বই পাঠরত অবস্থায় যেন আমার মৃত্যু হয়।’ আর রাসূল (সা) বলেছেন সবচাইতে মহামূল্যবান কথাটি, ‘জ্ঞান হচ্ছে তোমাদের হারানো স¤পদ, সুতরাং যেখানে তা পাও কুড়িয়ে নাও।’
আমার সাথে ঘটে যাওয়া একটি মজার ঘটনা দিয়ে আজকের পাঠ শেষ করছি। কয়েক মাস আগের কথা। বাংলাবাজার বইয়ের দোকানে হাঁটছি, কিছু বই কিনব বলে। হঠাৎ বইয়ের দোকানের সামনে রিডিং ক্লাবের বায়জিদ ভাইয়ের সাথে দেখা। হাতে তার সাত-আটটি মোটাতাজা বই, দোকানে আরো বই দেখছেন। আমাকে দেখে জিজ্ঞেস করলেন- বই কিনতে আসছো?
আমি বললাম, সব ভালো ভালো বই তো আপনিই কিনে ফেলেছেন, আমি আর কী কিনব? উনি যেমন পড়ুয়া টাইপের তেমনি খুব রসিক লোক। আমার অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে বললেন, শোন, অন্যের বই সর্বদা ভালো আর অন্যের বউ সবসময় ‘সুন্দর’। বায়জিদ ভাই ‘অন্যের বউ’ বলার পর ‘সুন্দর’ শব্দটা ব্যবহার করেননি। কী ব্যবহার করেছেন তা বুঝতে পারা তোমাদের বিচক্ষণতার ওপর ছেড়ে দিলাম। সবাই ভালো থাকবে, সুস্থ থাকবে। মার্চে তোমাদের সাথে সাক্ষাতের আশা নিয়ে আজকের মতো বিদায় নিচ্ছি।