[গত সংখ্যার পর]
কথায় কথায় বাড়তে লাগলো রোদের তাপ। হুজুর যাওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। স্যার সবিনয় অনুরোধ করলেন দুপুরে দুটো ডাল-ভাত খেয়ে যেতে। শেষে হুজুর সে কথার জবাব না দিয়ে সবার জন্য দোয়া করলেন। স্যার বললেন, হুজুর গরিবের দিকে একটু খেয়াল রাখলে ধন্য হবো।
আমি দৌড়ে রিক্সা নিয়ে এলাম, স্যার বললেন, সালু ভাই, খুব সাবধানে যাবেন। হুজুরের যেনো কষ্ট না হয়। হুজুরকে নিয়ে আমি রিক্সাতে বসলাম।
ফিরে আসার সময় ঢুকে পড়লাম রমনায়। তখনো চলছে, এসো হে বৈশাখ, এসো এসো। সারা পার্ক জুড়ে মানুষ আর মানুষ। ইয়াং ছেলে-মেয়েদের ভিড়ে পথ চলা দায়। ছোটরাও কম না। বুড়োরাও এসেছে। তবে, দেশ, মাটি ও জাতির চেয়ে টাকা আর প্রাচুর্যই যাদের কাছে বড় তারা খুব একটা উৎসাহ দেখান না এদিকে। দলে দলে গানের শিল্পীরা এসেছেন। গোটা রমনা এলাকা জুড়ে ভাওয়াইয়া, ভাটিয়ালি, পল্লী, বাউল এবং জারি-সারি গান গাইছেন শিল্পীরা। এদের অনেকেরই অন্ন নেই, বস্ত্র নেই, বাসস্থান নেই, তবু মনের মধ্যে এতোটুকু ভাবনা নেই। দেশ আর জাতিকে ভালোবেসে প্রাণ উজাড় করে গান গেয়েই যেনো তাদের শান্তি।
ঘুরে ফিরে যখন বাসায় এলাম-তখন দেখি সবাই চুপচাপ। আমি ভেবে ছিলাম হুজুরকে নিয়ে কত কী গল্প শুনবো। আমাকে কেউ কোনো প্রশ্নও করলেন না। আমিও নিজের থেকে কিছু বলতে গেলাম না।
সপ্তাহ খানেক পর বিকালের দিকে স্যার বললেন, সালু ভাই চলুন একটু ঘুরে আসি। আমি তখনই তৈরি হয়ে গেলাম। রিক্সা না নিয়ে দু’জন হাঁটতে হাঁটতে চলে গেলাম বড় রাস্তা পর্যন্ত। যেতে যেতে স্যার বললেন, সালু ভাই, হুজুরকে আপনার কেমন মনে হলো। আমি বললাম, উনি সৎ এবং ধার্মিক মানুষ, আমার ক্ষুদ্র জ্ঞান দিয়ে তাকে বিশ্লেষণ করা উচিত হবে না।
ও সব আমিও জানি। মানুষের প্রতি দয়ামায়া আছে বলে কি মনে হয়?
ভালো মানুষদের দয়ামায়া তো থাকতেই হয়।
আল্লাহ্ ভরসা।
স্যারের এই আল্লাহ ভরসার অর্থটা আমি বুঝলাম না। রিক্সা ঠিক করা হলো পুরান ঢাকা পর্যন্ত। মাগরিবের আযানের পরপরই আমরা পৌঁছে গেলাম হুজুরের বাড়িতে। হুজরের বৈঠকখানার পাশেই মেহমানদের বসবার জন্য ছোট্ট রুম। স্যার বললেন, সালু ভাই, আপনি এখানে একটু বসেন। আমি হুজুরের সাথে দুটো কথা বলেই চলে আসবো।
আমি অপেক্ষায় থাকলাম। ঘরের পার্টিশনটা পুরনো টিনের। জং ধরে দু’এক জায়গায় ছিদ্র হয়ে গেছে। সেখানে চোখ রাখলেই সব দেখা যায়। তা ছাড়া হুজুরের অবস্থান খুব দূরে নয় বলে ও ঘরের কথাবার্তাও বেশ কানে আসে। আমি চোখ রাখলাম ছিদ্রপথে।
মহব্বত স্যার হুজুরের সামনে যেনো মোমের মতো গলে গলে পড়তে লাগলেন। অনেক ভণিতার পর স্যার বললেন, হুজুর বেয়াদবি মাফ করবেন। অনেক আশা নিয়ে আপনার কাছে ছুটে এসেছি। হঠাৎ একটা বিপদে পড়ে গেলাম।
কী এমন বিপদে পড়লেন আপনি।
কথাটা যে কিভাবে বলি!
লজ্জা কিসের বলুন।
হুজুর সামান্য কয়টা টাকার জন্য…
সামান্য মানে কত টাকারে বেটা!
মাত্র দশ হাজার হলেই আমার চলবে। এই মাসটা শেষ হলে দুই তারিখেই টাকাটা আপনার হাতে পৌঁছে দিতে পারবো। আমি নিজে এসে দিয়ে যাবো।
হুজুর টাকার অঙ্কটা শুনে একটু নরম হয়ে গেলেন। বললেন, মহব্বত সাহেব তা না হয় দিলেন কিন্তু এখন তো আমার হাতে দশ হাজার টাকা নেই। স্যারও করুণ আর অসহায় দৃষ্টি মেলে বললেন, হুজুর, আমি যে বড় আশা নিয়ে এসেছি।
আচ্ছা দেখি। আমার মেয়ের কয়টা টাকা রয়েছে আমার কাছে, দেখি তা দিয়ে হয় কি না।
কিছুক্ষণ পরই খুশি খুশি মনে স্যার বেরিয়ে এলেন। এতক্ষণে আমি ‘আল্লাহ্ ভরসা’র অর্থটা আঁচ করতে পারলাম। স্যার বললেন, সালু ভাই চলুন, এখানকার বড় বাজারটা একটু ঘুরে যাই। রিক্সায় যেতে যেতে তিনি বললেন, এখানে কি বড় মাছ পাওয়া যাবে?
বড় বাজার যখন, তখন বড় মাছ তো থাকারই কথা। তা ছাড়া বড় বড় বাজার সন্ধ্যার পরই জমে ওঠে।
কথা মিথ্যা নয়। বাজারে ঢুকেই দেখি বড় বড় ইলিশ, রুই এবং পাঙ্গাশ ছাড়াও টাটকা সব মাছে বাজার পরিপূর্ণ।
সবচেয়ে বড় একটা রুই মাছ কিনে ফেললেন স্যার। আগের মতো বিশেষ কোনো দাম-দর করলেন না। তারপর বললেন, নয়নের জন্য কিছু গলদা চিংড়ি নিয়ে যাই। ও খুব পছন্দ করে।
জি। গলদা চিংড়ি পেলে পেট ভরে দুটো ভাত খাবে নয়ন।
তারপর ছোট মাছ, মাছের উপযোগী টাটকা কিছু তরকারি কিনে দু’তিনটি ভারী ব্যাগ নিয়ে আমরা বেবিতে বসলাম।
বাড়ি পৌঁছেই স্যার ভাবীকে ডেকে বললেন, নয়নের মা এদিকে এসো। ভাবী এলেন। স্যার হাসতে হাসতে বললেন, দেখোতো মাছটা কেমন হলো। বাবা নয়ন তোমার জন্য গলদা চিংড়ি এনেছি। বাজারটা সত্যি ভালো।
ভাবী বললেন, কোন বাজারে গিয়েছিলে?
আর বলো নাÑ ঠাটারি বাজার। ইরানির মাকে বলো, বড় মাছটা সুন্দর করে কেটে সবার জন্য একটা করে পেটির মাছ ভাজতে। কী আর খাবো। আল্লাহ্ যখন যা জুটায় তাই খেতে হয়।
তারপর মাস শেষ হয়ে গেলো। স্যার হুজুরের বাড়িতে গিয়েছিলেন কি না তা আমি জানি না। তবে, প্রায় দু’মাস পর একটি লোক ঠিকানা হাতে খুঁজতে খুঁজতে স্যারের বাড়িতে এলো। গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আমাকে দেখেই বললো, এই যে ভাই এটাই তো মহব্বত সাহেবের বাড়ি!
জি। আপনি হুজুরের বাড়ি থেকে এসেছেন? হুজুর, কেমন আছেন?
ভালো।
এই লোকটা চা-নাস্তা এনে আপ্যায়ন করেছিলো আমাদের। লোকটা বললো- মহব্বত সাহেবের সাথে একটু দেখা করবো। উনি বাড়িতে আছেন?
জি আছেন। আপনি বসুন, আমি ডেকে দিচ্ছি।
ভিতরে গিয়ে স্যারকে বললাম, হুজুরের বাড়ি থেকে লোক এসেছে। স্যার বললেন, আপনি কী বলেছেন?
লোকটা জিজ্ঞেস করলো আপনার কথা। আমি বললাম, স্যার আছেন, আপনি একটু বসুন।
কথাটা বলতেই স্যার একটু রাগে রাগেই বললেন, কেনো তা বলতে গেলেন। সব সময় সত্যি কথা বলতে হয় না। স্যারের মুখে এমন কথা শুনে আমি অবাক হলাম ঠিকই কিন্তু আমার মধ্যে তার প্রকাশ ঘটতে দিলাম না।
লোকটা বকুল গাছের ছায়ায় বসে আছে। স্যারও একটা চেয়ারে বসতে বসতে মধুর হেসে লোকটাকে বললেন, কেমন আছেন? হুজুর কেমন আছেন?
ভালো।
আমি বড়ই লজ্জিত, আপনি কতো কষ্ট করে এতোটা পথ এসেছেন।
সেই মুহূর্তে লোকটাও কেমন গদগদ হয়ে উঠলো। পরে বললো, হুজুর আপনার অপেক্ষায় থেকে থেকে শেষে আমাকেই পাঠালেন। ঠিক তখনই স্যার আমাকে বললেন, সালু ভাই টেবিলের ওপর টাকা আছে। দু’প্যাকেট সিগারেট নিয়ে আসেন তো। আমি টাকা আনতে গিয়ে দেখি টেবিলে তখনো দু’প্যাকেট সিগারেট বর্তমান। কিন্তুু সিগারেট নিয়ে ফিরে এসে দেখি বকুলতলা শূন্য। দরজার কাছে যেতেই কানে এলো, বেটা হুজুর দু’টাকা দিয়েই মহব্বতজানের মাথা কিনে নিয়েছে। আরে বেটা একি তোর পরিশ্রমের টাকা? ফুঁ-ফা দিয়ে পরের কাছ থেকে নিয়েছিস, আমিও তোর কাছ থেকে নিলাম। এর মধ্যে আবার চাওয়া-চাওয়ির ঝামেলা কেনো।
মহব্বত স্যার যখন রেগে যান তখন তিনি সিগারেটের পর সিগারেট জ¦ালাতে থাকেন। সিগারেট জ্বেলে দু’টান দিয়েই সেটা ফেলে দেন এবং সাথে সাথে আবার একটি জ্বালেন। আর একা একাই বলে যান মনের কথা। অবস্থার প্রেক্ষিতে বুঝতে পারলাম, হুজুরের এটাই অপরাধ যে, তিনি কেনো টাকা দিয়ে টাকা চাইতে লোক পাঠালেন।
যাহোক, একমাত্র ছুটির দিন ছাড়া বাসাতে কেউ থাকে না। সকালে ভাবীর সাথে নয়নও স্কুলে চলে যায়। তখন বাড়িটা থাকে আমার দখলে। আমার পছন্দ মতো বাজার আনার পর ইরানির মা রান্নার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। সে সময়টা বই আর ম্যাগাজিন পড়ে কাটাই আমি। ভাড়াটিয়ারা সবাই বাঙালি খ্রিষ্টান। সবাই কোনো না কোনো মিশনারি অথবা এনজিওতে কাজ করে। এ বাড়ির ডাইনে বাঁয়ে অনেক খ্রিষ্টানরাই ভাড়া থাকে।
তেরো চৌদ্দ বছরের একটি খ্রিষ্টান ছেলে এই নিরিবিলি সময়টাতে এ বাসায় আসে। ছেলেটি দেখতে সুন্দর। মাথায় বাবরি চুল। কখনো প্যান্ট শার্ট পরে আসে, কখনো মেয়েদের মতো কাপড়। বকুলতলা চেয়ারে বসে সিগারেট খায়। আবার আমার ঘরে এসে আমার কাছ থেকেও সিগারেট চেয়ে খায়। আমি বলি তুমি সিগারেট খাও কেনো? তোমার বাবা-মা রাগ করেন না। সে বলে, বাসায় খাই না। কখনো সে একা আসে কখনো ছোট্ট একটা বোন থাকে তার সঙ্গে।
আমার রুমটার ওপাশে বড় একটা রুম ভাড়া দেয়া। তাদের আলাদা পাকঘর। এই ছোট পরিবারটি মুসলিম। সেই ভাবী একদিন হাসতে হাসতে বললো, সালু ভাই, খুব আনন্দেই আছেন তাহলে।
কেনো ভাবী? এভাবেই তো আমার দিন যায়। শুকনাও বারো আঁটি ভিজাও বারো আঁটি।
না, আমি কিছু ভেবে বলিনি। ঘরে বসেই আপনাদের গল্প-সল্প শুনি তো, তাই বলছিলাম।
আপনি কি জেসির কথা বলছেন?
হ্যাঁ।
ও ছেলেটা তো সব সময়ই আসে। আমার কাছ থেকে সিগারেট চেয়ে খায়। গলির মাথার বাড়িটাই ওদের।
জেসি ছেলে নয়, মেয়ে।
বলেন কি!
হ্যাঁÑ ও মেয়ে।
কিন্তু …
ভাবী কিছু না বলে, কেবল হাসে আর হাসে।
একদিন সন্ধ্যায় নয়ন বললো, সালু চাচা- পরশু সকালে আমরা শিকারে যাবো।
শিকারে! কোথায়?
বাড্ডার বিলে।
পাখি না মাছ।
পাখি।
পাখি তো বুঝলাম, কিন্তু বন্দুক ছাড়া শিকার হবে কী করে!
কেনো- আমাদের বন্দুক আছে না!
পরদিন আলমারি থেকে বন্দুক বের করে তেল-সিঁদুর দিতে লেগে গেলেন স্যার। এক সময় কলকব্জা এঁটে-কাঁধের ওপর রেখে চোখ ছোট করে দু’একবার মিস ফায়ারও করলেন। তখন আমার মনে পড়ে গেলো মুক্তিযুদ্ধের সময়ের কথা। এমনি একটি বন্দুক হাতে নিয়ে আমাদের স্কুলের হেড স্যার গড়াই নদীর তীরে পজিশন নিয়ে থাকতেন রাজাকার আর পাক মিলিটারি মারার জন্য। সঙ্গে অবশ্য আরো আট-দশ জন মুক্তিযোদ্ধা থাকতো। তখন প্রায়ই খবর পাওয়া যেতো যে, লঞ্চ ভরে রাজাকাররা এ গ্রাম সে গ্রাম লুটপাট করে বেড়াচ্ছে। মানুষও মরছে। ভয়ে নদীর ওপারের হিন্দুরা সব ফেলে, দল বেঁধে পালাচ্ছে।
আমরা তখন হাইস্কুলে পড়ি। আমরা ছুটোছুটি করে চারদিকের খবর আনা নেয়া করতাম। একদিন স্যারের গ্রামের একটি কাচারিতে জরুরি আলোচনা বসেছে। কাচারি ঘরটা সদর রাস্তার সঙ্গে প্রায় লাগোয়া। ঘরটার সামনের দিকে খোলা। তখন একটি রাইফেল আর দু’টি বন্দুকই ছিলো দলের অস্ত্রভাণ্ডার। সেখানে আমিও উপস্থিত ছিলাম। স্যারই আমাদের লিডার। আমার কেবলই মনে হচ্ছিল এমন খোলা জায়গায় কখনো গোপন আলাপ হওয়া ঠিক না। তা ছাড়া স্যার রাস্তার দিকে পিঠ দিয়ে বসেছেন। পাশে বন্দুক হাতে দু’জন বডিগার্ড। আমরা এদিকে বসে রাস্তার সব দেখছি কিন্তু স্যার এবং দু’জন বডিগার্ড কিছুই দেখছেন না। কেমন যেনো বেঠিক মনে হচ্ছিলো আমার কাছে।
মনে মনে ভাবলাম আমি ছোট মানুষ, আমার কি সাজে সে কথা বলা।
তখন হঠাৎ একজন বডিগার্ড বলে উঠলো-স্যার এভাবে বসাটা মনে হয় ঠিক হচ্ছে না। আপনি এদিকে বসুন। আমরা পাশে দাঁড়িয়ে সজাগ দৃষ্টি রাখি বাইরের দিকে।
তখনই রবি ঠাকুরের জুতা আবিষ্কার কবিতাটা মনে পড়ে গেলো আমার। আমি মন্ত্রী হলাম বটে, তবে সে কথা আর বলতে পালাম না যে, বেটা চামার, আমার মনের কথা তুই জানলি কেমন করে!
কথায় কথায় কোথায় চলে এসেছি। এবার ফিরে যাচ্ছি পাখি শিকারে। যাহোক, পরদিন বাসার সবাই সারা দিনের খাবার সঙ্গে নিয়ে বেবি করে বাড্ডার বিলের সামনে গিয়ে হাজির হলাম। যতো দূর দৃষ্টি যায় কেবল পানি আর পানি। মাঝে মাঝে দ্বীপের মতো এক একটা বাড়ি। সারা দিনের জন্য ঠিক করা হলো-ছইওয়ালা একটি নৌকা।
বিলের মধ্যে ফুটে আছে অসংখ্য শাপলা। কোথাও কোথাও আমন ধানের এক হাত লম্বা মাথা, পানির ওপর দোল খাচ্ছে বাতাসে। কোথাও বালি হাঁসের ঝাঁক নজরে এলো না। দু’চারটি কাচিকাটা আর কোরাল দেখা গেলো যত্রতত্র। মহব্বত স্যার লুঙ্গি পরে গায়ের গেঞ্জিটা মাথার ওপর দিয়ে পানির মধ্যে মাথাটা জাগায়ে অনেক চেষ্টায় একটা ফায়ার করার সুযোগ পেলেন। ঐ এক ফায়ারে দুটো কাচিকাটা (কালো-পা লম্বা পাখি) ডানা ঝাপ্টাতে লাগলো শাপলা ফুলের পাতার ওপর। পাখি দুটো নৌকায় এনে একটু রেস্টের জন্য নৌকা গিয়ে ভিড়লো একটা বাড়ির ঘাটে।
আমাদের দেখে বাড়ির মানুষ ছুটে এলো। একটা বড় টিনের ঘরে গিয়ে বসলাম আমরা। ভাবী এবং নয়ন আলাদা ঘরে চলে গেলো বিশ্রাম নিতে। আমাদের নিয়ে যাওয়া খাবার খেলাম। তারপর ভিড় করা লোকদের কাছে নানান রকম শিকারের গল্প শুরু করলেন স্যার।
স্যারের অমায়িক ও শ্রুতিমধুর বাক্যালাপে অতিশয় মুগ্ধ হয়ে গেলেন সেই পরিবারসহ গোটা বাড়ির মানুষ। ভাবী কালো, বাড়িওয়ালার মুখের সাথে ভাবীর মুখের কতটুকু মিল রয়েছে তা সঠিক করে বলা না গেলেও, রং-এ যে মিল আছে একথা সত্য। সাথে সাথে দুটো মুরগি জবাই হয়ে গেলো। তার সাথে বিলের টাটকা মাছ তো আছেই। সদ্য দহন করা কালো গাই-এর দুধ এলো গ্লাসে গ্লাসে। খাওয়া দাওয়ার পরও ছাড়তে চায় না তারা। এদিকে বেলা প্রায় ডুবু ডুবু।
ঠিক এক সপ্তাহ পর শুক্রবার বেলা এগারোটার দিকে বিলপাড়ের সেই লোকটি বাসায় এসে হাজির। সঙ্গে এনেছে মুড়ি, চিঁড়া, লাড়– এবং খাঁটি ঘি। সত্যি কথা বলতে কি, আমি তখনই লোকটার ভবষ্যিৎ ভেবে মনের মধ্যে বড় কষ্ট পাচ্ছিলাম।
আমার বিশ্বাস, ঊর্ধ্বে ছয় মাস, তার পরই গ্রাম্য সহজ-সরল লোকটা আর আসবে না এখানে। মনের দুঃখে আমার স্যার মহব্বতজানের মুখও দর্শন করবে না। কেননা, বেশি সরল মানুষরা বড় অভিমানী হয়।
শেষে হলোও তাই। চার পাঁচ মাস পর্যন্ত লোকটা ঘুরাঘুরি করার পর আর আসেনি স্যারের বাসার দিকে। এর মধ্যে, অর্থাৎ পাখি শিকারের পরের মাসে আমরা আবার সদলবলে গিয়েছিলাম সেই বাড়িতে। সারা দিন কাটিয়ে সন্ধ্যায় ফিরে এসেছিলাম।
আমার যতদূর ধারণা, লোকটার কাছ থেকে যতদিন পর্যন্ত স্যার মোটা অঙ্কের টাকা নিতে পারেননি, ততদিনই তার নামের সাথে ব্যবহারেরও যথার্থ মিল ছিলো। তারপর কাজ হাসিল হলেই তিনি হয়ে যান বিপরীত অর্থের এক মানুষ।
দশ কাঠা জায়গা তো আর কম নয়। তাই আরো একটি ঘর তুলে ভাড়া দেয়ার কথা ভাবলেন স্যার। একদিন অফিসে যাওয়ার সময় তিনি আমাকে সঙ্গে নিয়ে গেলেন মগবাজারের একটি ইট-সিমেন্টের দোকানে। আমাকে বিস্তারিত বুঝায়ে ক্যাশে কিছু টাকা জমা দিয়ে স্যার চলে গেলেন অফিসে। বুঝলাম, দোকানির সাথে আগেই কথা বলে গেছেন তিনি। দোকানের মালিক নিজে থেকে ইট, বালু এবং সিমেন্ট পাঠিয়ে দিলেন ঠেলা গাড়িতে। আমি পথপ্রদর্শক এবং মাল যথাস্থানে আনলোড করার তদারকি করলাম। পরদিন রাজমিস্ত্রি এলো এবং কাজও শুরু হয়ে গেলো।
ঘরের দেয়াল তখনো ছাদ পর্যন্ত গাঁথা হয়নি। এক দুপুরে ভ্যান বোঝাই নলি বাঁশের বেড়া এলো ঘরের ছাদ করার জন্য। যে লোকটি মাল পৌঁছে দিতে এসেছে, তার চেহারার দিকে একবার তাকিয়ে নয়ন সেই যে ঘরে গিয়ে ঢুকলো-আর বের হলো না। বড় বড় লাল চোখ। তার ওপর দুচোখের মণি দু’দিকে ছড়ানো। মনে হলো লোকটা ডবল টেরা। কথা বলার সময় চোখের মনি যখন নড়াচড়া করে, তখন সুস্থ মানুষ অসুস্থ হয়ে যাওয়াটা মোটেই অস্বাভাবিক নয়। লোকটা কালো এবং মাথার অর্ধেকেরও বেশি টাক। পান চিবানো রসালো ঠোঁট।
এইডা কি মহব্বতজান স্যারের বাড়ি।
আমি বললাম, জি।
লোকটা বকুলতলা চেয়ারে বসলো। অনুসন্ধানী চোখ মেলে চারদিকটা একবার দেখে বললো, উনি কখন আসবেন।
তা চারটা তো বাজবেই।
আসলে বলবেন, কাওরান বাজার থেইকা সব মালই দিয়া গেছে। এ সপ্তাহের মধ্যেই যেনো বাকি টাকা দোকানে দিয়ে আসে।
জি বলবো।
কথা শেষ, কিন্তু লোকটা চলে যাচ্ছে না। আমার মনে হলো লোকটা বুঝি স্যারের বাড়িতে সৌজন্যমূলক এক কাপ চা খেতে চায়। কিন্তু স্যারকে আমি দেখেছি, কোনো পাওনাদারকে কখনো আপ্যায়ন করেন না তিনি। যতো তাড়াতাড়ি বাড়ি থেকে বিদায় করা যায় ততই ভালো। আর এ লোকটার বেলায় সে নিয়ম আরো কড়াকড়ি হওয়াটাই স্বাভাবিক।
দুপুরে রাজমিস্ত্রিরা লাঞ্চ করতে চলে গেলো। ইরানির মা বললো, সালু ভাই খাবেন না? খাইলে আসেন।
খাবো না মানে, পেটের মধ্যে এখন খাই খাই শুরু হয়ে গেছে। আমি গোসল সেরে আসছি। তুমি খাবার রেডি করো।
দেখতে দেখতে একদিন ঘরের কাজ প্রায় শেষ হয়ে এলো। ক’দিন পরই সে ঘরে ছোট্ট একটি খ্রিষ্টান পরিবার এলো ভাড়ায়। ভাড়াটিয়ারা সবাই একে অন্যের পরিচিত। ছুটির দিনে বাড়িটায় যেনো আনন্দের হাট বসে যায়।
আমার দায়িত্ব পালন এবং কাজের নৈপুণ্যে শুধু স্যারই নয়- বাড়ির ভাড়াটিয়ারাও মুগ্ধ। অবশ্য এর মধ্যেই পার হয়ে গেছে দু’টি বছর। আমাকে নিয়ে আমার পরিবারের ভাবনা হওয়ার কথা নয়। কারণ, বিত্তহীন পরিবারের অনেকগুলো সন্তানের মধ্যে দু’চারটি হারিয়ে গেলে কিছু যায় আসে না। অভাবে সন্তানদের প্রতি মানুষের মমত্ববোধ অনেকখানি হালকা হয়ে যায়। তবে, সন্তান কাছে দূরে যেখানেই থাক, বেঁচে থাক, মনে মনে এই কামনা। বাহ্যিক বিলাপ শুধু এদেশের চলমান সামাজিকতা।
একবার বাড়িতে এলেন এক বড় লোক। গাড়ি বাড়ি ও টাকা-পয়সা সবই আছে ভদ্র লোকের। আর আছে একটি শ্যামলা বরণ মিষ্টি মেয়ে। তো মেয়েটির চোখে কিভাবে যে আমি অন্য রকম হয়ে গেলাম, সে কথা আমিও বুঝতে পারলাম না। মেয়েটি বায়না ধরলো, আমাকে সে তাদের বাড়িতে নিয়ে যাবে। শুধু নিয়ে যাওয়া হলে ভাবনা ছিলো না। আমাকে সেখানেই থাকতে হবে। ভদ্রলোক এবং ভদ্র মহিলাও বললেন, সালু তুমি কি আমাদের বাড়িতে যেতে চাও? আমার মেয়েটা তোমাকে খুব পছন্দ করে ফেলেছে। স্যার বললেন, এ সব শুভ্রার ছেলে মানুষী। ভাবী বললেন, সালু ভাই সত্যি ভালো ছেলে। লোভ নেই হিংসা নেই, তার মধ্যে কোনো কৃত্রিমতাও নেই।
কেনো জানি না হঠাৎ আমার মনে হলো, দাসপ্রথা তো অনেক আগেই উঠে গেছে। সভ্যতার আড়ালে আমি যেনো সেই দাসদেরই একজন। শেষে তাদের গাড়িতে চড়ে আমিও গেলাম অনেক দূর পর্যন্ত। তারপর ফিরে এলাম। আসার সময় ভদ্রলোক বললেন, তুমি একদিন বাসায় বেড়াতে এসো।
কোন পথে দিন আসে, কোন পথে রাত যায় কিছু বুঝার আগেই রাত পোহায় দিন যায়। এমনি করে গড়ায় বছর। হঠাৎ জীবনের কথা ভাবতে শুরু করলো মন। এমন ভাববার অবকাশ কখনই হতো না, যদি না সেদিন পথে আলতুর সাথে দেখা হয়ে যেতো। প্রথম ওই আমাকে চিনতে পেরে মালিবাগে একটি রেস্টুরেন্টে নিয়ে বললো, সালু ভাই, তুমি যে দেশান্তরি হয়েছিলে- তারপর আর বাড়িতে যাওনি?
আমার কথা থাক, তোর খবর বল।
আলতু ওর বিশাল ইতিহাস শোনালো কাট-ছাঁট দিয়ে। আমার চেয়েও নিঃশ্ব ছিলো এই আলতু। পা ধরলে মাথা নেই, মাথা ধরলে পা নেই। সেই আলতু ঢাকা এসে গাড়ি, বাড়ি, রাজকন্যা সবই পেয়েছে। সুযোগের সদ্ব্যবহার করেছে। ওর বুদ্ধি আছে। এখন আর আলতুর অভাবের জ্বালা নেই, তবে অভাবের কমতি নেই। আর আমার নেই নেই-এর মধ্যে অভাব নিজের ইচ্ছাতেই- কেটে পড়েছে। ওর সাথে দেখা হওয়ার পর এটাই আমি বুঝেছি যে, আমরা দুই ভুবনের দুই বাসিন্দা। আমার যন্ত্রণা আছে, যা ওর নেই। আমি যা দেখি, ও তা দেখতে পায় না। আমার লোভ নেই, তাই মরে গিয়ে বেঁচে থাকতে চাই। আর আলতুর লোভ আছে, তাই ও না মরে বেঁচে থাকতে চায়।
একদিন বেলা দশটার দিকে ইট বালু দোকানের মালিক বাড়িতে এলো। লোকটার ভাবসাব ভালো মনে হলো না। ছুটির দিন স্যার বকুল তলাতেই ছিলেন। দোকানের মালিক বললো, মহব্বত সাহেব আমার টাকাটা কিন্তু এখনো পেলাম না। আপনাকে ভালো মানুষ ভেবেছিলাম। কিন্তু …
স্যার বললেন, আরে ভাই বিপদ-আপদ তো মানুষেরই হয়। আমি তো বলিনি, আপনার টাকা আমি দেবো না।
দেবো না বললেই কি আপনাকে ছেড়ে দেবো ভেবেছেন?
স্যারের সম্মানে একটু লাগলো বোধ হয়। স্যার জোর দিয়ে বললেন, ঠিক আছে আপনাকে আর আসতে হবে না। আগামী সপ্তাহেই টাকাটা আমি পাঠায়ে দেবো। তারপর বেশ হাসি-খুশিতেই স্যারের দিন যায়। আমি মনে মনে বেশ খুশিই হলাম। টাকাটা তাহলে স্যার দিয়ে এসেছেন। টাকা দিতে বাধা কোথায়। স্যারের কি টাকার অভাব আছে?
কিন্তু পর সপ্তাহেই লোকটা আবার এসে হাজির। এসেই গরম সুরে বললো, কই, আপনি তো টাকাটা পাঠালেন না। স্যার বললেন, কিছু টাকা পাওয়ার কথা ছিলো কিন্তু টাকাটা পাইনি। তাই কথা রাখতে পারিনি। আপনি যান টাকাটা হাতে এলেই আমি দিয়ে আসবো। আর আমি যদি নাও যেতে পারি, তাহলে সালু ভাই দিয়ে আসবে। আপনি হিসাবটা আমাকে দিয়ে যান।
আমি তখন পরিষ্কার বুঝতে পারি যে, এসব স্যারের মিথ্যা কথা। আমি ভাবি, স্যারের শরীরের চামড়া এতোটাই শক্ত যে, সে চামড়া ভেদ করে লজ্জা-শরম ভিতরে ঢুকতে পারে না। কিন্তু লোকটা নাছোড়। সে টাকা নিয়েই যাবে। শেষ পর্যন্ত লোকটা বললো, আপনাকে টানতে টানতে নিয়ে যাবো দোকানে। আমি সে ব্যবস্থা করেই এসেছি।
স্যার বিচক্ষণ ব্যক্তি। কেলেঙ্কারি হওয়ার আগেই পুরা টাকার একটা চেক লোকটার হাতে দিয়ে দু’চার কথা শুনায়ে দিলেন। লোকটা তবু খুশি। মাঝখানে আমিও খুশি হলাম। যাক বাবা, রাগ না লক্ষ্মী। অশান্তি দূর হলো।
সৃষ্টিকর্তার বিচিত্র সৃষ্টি লীলা-খেলা বুঝা কি এতই সহজ? একই মাটিতে একই জায়গায় জন্মাচ্ছে কতো নামের কতো আকারের বিচিত্র সব গাছ-পালা। একই রকমের আমগাছে ফলছে হরেক রকমের আম। আকারে, স্বাদে ও গন্ধেও এসব একটা অন্যটির মতো নয়। তাই বলছি, নামে আমরা সবাই মানুষ কিন্তু …
পরদিনই ইট-বালু দোকানের মালিক আবার এলো সদলবলে। দেখেই আমার মাথার মধ্যে চক্কর দিলো- এদের আবার কী হলো! লোকগুলো মহব্বতজানকে ডেকে বললো, আপনি ইস্ত্রি করা কাপড় গায়ে দিয়ে ভদ্রলোক হয়ে চলাফেরা করেন, অথচ ভিতরে আপনি পাক্কা জালিয়াত।
স্যার ভীষণ রেগে গিয়ে বললেন, স্টপ। আর একটি কথাও বলবেন না। আপনি টাকার অঙ্ক যা বলেছেন তাই তো দিয়েছি। আবার এসেছেন কেনো।
দোকানের মালিক বললেন, টাকার অঙ্ক আপনি ঠিকই লিখেছেন কিন্তু আপনার অ্যাকাউন্টে তো দু’শ টাকার একটি পয়সাও বেশি নেই। এখন আপনিই বলুন, আপনাকে পুলিশে দেবো না এই মহল্লার সব লোক ডেকে সালিশ বসাবো।
স্যার বুঝি সত্যি এবার লজ্জা পেলেন। জিভ কেটে বললেন, স্যরি ভাই আর লজ্জা দিবেন না। আমার তো বিশ^াস ছিলো যে, এ কয়টা টাকা অ্যাকাউন্টে ঠিকই আছে।
কিন্তু আমার আর বুঝতে বাকি রইলো না যে, মহব্বতজানের এই লজ্জা পাওয়াটা যথার্থই কৃত্রিম। শেষে, ভাবী তার নিজের অ্যাকাউন্ট বরাবর চেক লিখে দিলেন।
[চলবে]