বাংলাদেশের ফুটবল অঙ্গনে গত কয়েক বছর একটি কৌতুক চালু হয়ে গিয়েছিল। সেটি হচ্ছে, ‘বাংলাদেশের ডাবল সেঞ্চুরি কবে হবে?’ এই কৌতুকটির সাথে মিশে ছিল অনেক দুঃখ, হতাশা আর কষ্ট। এর দ্বারা মূলত বোঝানো হতো কবে বাংলাদেশ ফিফার ফুটবল র্যাংকিংয়ে দুই শ’তে নামবে।
এক সময় দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম সারির ফুটবল শক্তিই ছিলো বাংলাদেশ; কিন্তু সেটি এখন আর নেই। সাফ ফুটবলের শিরোপা সর্বশেষ জিতেছে ২০০৩ সালে। এরপর একমাত্র সাফল্য ২০১০ সালের দক্ষিণ এশীয় গেমসে স্বর্ণপদক জয়। এরপর আর কোন শিরোপা জেতা হয়নি।
১৯৯৩ সালে র্যাংকিং চালু হওয়ার সময় বিশ্বের ফুটবল খেলুড়ে দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিলো ১১৬তে। ক্রমশই সেই অবস্থান থেকে পিছিয়েছে বাংলাদেশ। তবে সবচেয়ে বেশি পিছিয়েছে গত দশ বছরে। এতটাই যে র্যাঙ্কিংয়ে দুই শ’র কাছাকাছি চলে গেছে। ২০০৯ সালেও বাংলাদেশের অবস্থান ছিলো ১৪৯; কিন্তু ২০১৭ সালে বাংলাদেশ চলে যায় ১৯৭ নম্বরে। ফিফার সদস্য দেশের সংখ্যা ২১১। আর র্যাঙ্কিংয়ে আছে ২০৭টি দেশ। তাই দুই শ’ বা তার নিচে নামা যে কতটা অপমানজনক তা না বললেও বুঝতে কারো কষ্ট হওয়ার কথা নয়। তখনই অনেক কষ্টের সেই ‘ডাবল সেঞ্চুরির’ কৌতুকটি চালু হয়।
অথচ এই সময়ে দেশের ফুটবলের দায়িত্ব ছিল দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় তারকা ফুটবলারের কাঁধেই। ২০০৮ সালের এপ্রিলে ফুটবল ফেডারেশনের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব নেন সাবেক তারকা ফুটবলার কাজী সালাউদ্দিন। এরপর থেকে টানা তিন মেয়াদে তিনি দায়িত্ব পালন করছেন। দশ বছর আগে সালাউদ্দিন যখন দায়িত্ব নিয়েছিলেন তখন বাংলাদেশের ফিফা র্যাঙ্কিং ছিল ১৫০-এর নিচে। এটা সত্যি যে সালাউদ্দিন যুগে ঘরোয়া ফুটবল নিয়মিত অনুষ্ঠিত হয়েছে; কিন্তু প্রতিভাবান নতুন ফুটবলার খুঁজে আনার চেষ্টা যথাযথ ছিল না।
এ বিষয়ে একটি জাতীয় দৈনিক লিখেছিল, ‘গত দশ বছরে অনেক পরিকল্পনা তিনি করেছেন, অনেক স্বপ্ন তিনি দেখিয়েছেন; কিন্তু অবস্থার কেবল অবনতিই হয়েছে। তিনি তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলেন, দশ বছরে ঘরোয়া ফুটবল নিয়মিত মাঠে গড়িয়েছে বলে; কিন্তু নতুন খেলোয়াড় তৈরির কোনো উদ্যোগ ফেডারেশন বা দেশের কোনো ক্লাবের কাছ থেকে পাওয়া গেছে কি না এসব প্রশ্নে কর্তারা নিশ্চুপ।’
শেষ পর্যন্ত অবশ্য ‘ডাবল সেঞ্চুরির’ কলঙ্ক লাগেনি বাংলাদেশের ফুটবলে। তবে ভুটানের কাছে হারা, দীর্ঘদিন কোন শিরোপা জিততে না পারাসহ অনেক হতাশার গল্প লেখা হয়েছে। বেশ কয়েক বছর ধরেই বাংলাদেশ সরাসরি বিশ্বকাপ ফুটবলের বাছাইপর্বও খেলতে পারে না। নিচের সারির দলগুলোর সাথে প্রাক-বাছাই পর্ব খেলতে হয়। সেখানে ভালো করতে পারলে সুযোগ হয় বাছাই পর্বে।
তবে আশার কথা হলো ২০১৮ ও ’১৯ সালে দেশের ফুটবল কিছুটা হলেও উন্নতির দিকে চলতে শুরু করেছে। বর্তমানে র্যাঙ্কিংয়ে বাংলাদেশের অবস্থান ১৮৩-তে। ইংল্যান্ডের কোচ জেমি ডে জাতীয় দলের দায়িত্ব নেয়ার পরই এই উন্নতির ছোঁয়া লেগেছে। জাতীয় দলের জন্য কঠোর অনুশীলনসহ বিভিন্ন সুযোগ সুবিধাও বৃদ্ধি করা হয়েছে। এবার প্রাক-বাছাই পর্বের বাধা পেরিয়ে বাংলাদেশ জায়গা করে নিয়েছে ২০২২ কাতার বিশ্বকাপের বাছাই পর্বে। সেখানেও অন্তত দু’একটি জয় পাওয়ার আশা তৈরি হয়েছে। কাতার বিশ্বকাপের প্রাক-বাছাই পর্বে বাংলাদেশের প্রতিপক্ষ ছিলো পূর্ব এশিয়ার দেশ লাওস। দেশটিকে তাদের মাটিতে হারিয়ে এবং ঢাকায় ফিরতি ম্যাচ ড্রতে বাংলাদেশ সুযোগ করে নেয় বাছাইপর্বে।
২০১৮ রাশিয়া বিশ্বকাপের বাছাইপর্বেও খেলেছিল বাংলাদেশ। তবে সেখানে পারফরম্যান্স মোটেই ভালো ছিল না। একটি মাত্র ম্যাচ ড্র, বাকি সবগুলোতে হেরেছে। অস্ট্রেলিয়ার কাছে ৫-০ ও ৪-০, জর্দানের কাছে ৮-০ ও ৪-০, কিরগিজস্তানের কাছে ৩-১ ও ২-০ এবং তাজিকিস্তানের কাছে ১-১ ও ৫-০ তে ধরাশায়ী হয় লর্ড উইক ডি ক্রুয়েফের বাংলাদেশ দল। বিশ্বকাপ বাছাইয়ে বাংলাদেশ সর্বশেষ জিতেছিল ২০০১ সালে সৌদি আরবের মাটিতে মঙ্গোলিয়ার বিপক্ষে ৩-০তে।
তবে এবার জেমি ডের ছোঁয়ায় সেই চিত্র কিছুটা পাল্টানোতেই দেখা যাচ্ছে আশার আলো। এশিয়ান গেমস, সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ ও বঙ্গবন্ধু গোল্ড কাপে বেশ কয়েকটি জয় পেয়েছে দল। সর্বশেষ এএফসি অনূর্ধ্ব-২৩ ফুটবলে দারুণ খেলেছে বাংলাদেশ দল। প্রথমবারের মতো খেলেছে দ্বিতীয় রাউন্ডে।
কাতার বিশ্বকাপের বাছাই পর্ব একই সাথে আগামী এশিয়া কাপেরও বাছাইপর্ব। এই পর্বে বাংলাদেশর অবস্থান ‘ই’ গ্রুপে। এ মাসেই বাছাই পর্বের ম্যাচ শুরু হবে। বিরতি দিয়ে চলবে প্রায় এক বছর পর্যন্ত। চার প্রতিপক্ষের বিপক্ষে হোম অ্যান্ড অ্যাওয়ে পদ্ধতিতে বাংলাদেশ খেলবে মোট ৮টি ম্যাচ।
বাংলাদেশের গ্রুপের দলগুলো হলো, বিশ্বকাপের স্বাগতিক কাতার, ভারত, আফগানিস্তান ও ওমান। ১০ সেপ্টেম্বর আফগানিস্তান গিয়ে তাদের বিরুদ্ধে খেলার কথা লাল-সবুজ জার্সিধারীদের। তবে নিরাপত্তা সমস্যা থাকলে নিরপেক্ষ কোন দেশে হতে পারে ম্যাচটি। বাছাই পর্বের প্রতিপক্ষের মধ্যে একমাত্র কাতারই শক্তিশালী দল।
এশিয়া অঞ্চল থেকে বিশ্বকাপে দল সুযোগ পায় ৫টি। এ অঞ্চলের ৪০টি দেশ আট গ্রুপে বিভক্ত হয়ে খেলবে বাছাই পর্বে। প্রতি গ্রুপের চ্যাম্পিয়ন এবং সেরা চার রানার্সআপ দল খেলবে বাছাইপর্বের দ্বিতীয় রাউন্ডে। ফুটবলে বাংলাদেশের যা অবস্থান তাতে এখনই বিশ্বকাপে সুযোগ পাওয়ার আশা নেই। তবে বাছাই পর্বের দ্বিতীয় রাউন্ডে খেলতে পারলেই সেটি হবে বড় পাওয়া। আর সেই আশাতেই আছেন দেশের ফুটবল ভক্তরা। এ ছাড়া এই ৪০ দলের মধ্য থেকে সেরা ১২ দল ২০২৩ সালের চীন এশিয়ান কাপে সুযোগ পাবে।
বাংলাদেশের গ্রুপের সেরা দল কাতার। তারা শুধু আগামী বিশ্বকাপেরই স্বাগতিক নয়। এবারের এশিয়ান কাপের শিরোপাজয়ী দলও। সম্প্রতি তারা কোপা আমেরিকা খেলে এসেছে আমন্ত্রিত দল হিসেবে। ফিফা র্যাংকিংয়ে তাদের অবস্থান ৫৫। কাতারের সিনিয়র দলের বিপক্ষে বাংলাদেশের জয়ের রেকর্ড নেই। তবে তাদের অনূর্ধ্ব-২৩ ও অনূর্ধ্ব-১৬ দলকে সর্বশেষ মোকাবেলায় হারিয়েছে বাংলাদেশ।
এ ছাড়া ফিফা র্যাংকিংয়ে ওমানের অবস্থান ৮৬, ভারত ১০১ ও আর আফগানিস্তান ১৪৯ নম্বরে। তাই বলা যায় কিছুটা সহজ গ্রুপেই পড়েছে বাংলাদেশ। তা ছাড়া কোচ জেমি ডের অধীনে ও সুইডেন প্রবাসী ফুটবলার জামাল ভূইয়ার নেতৃত্বে বাংলাদেশ দল যেন গত কিছুদিনে গা ঝাড়া দিয়ে উঠেছে। তাই বাছাইপর্বে ভালো কিছু দেখার আশায় সমর্থকরা। তেমনটি হলে এ দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা ফুটবল আবার হয়তো প্রাণ ফিরে পাবে।