এই সময়টাতে মাথার ভেতর নানা রঙের ভাবনারা এসে জমা হয়। আকাশের গোলাপি সাদা মেঘ, চড়ুই আর শালিক পাখিগুলো তখন ওর বন্ধু হয়। কাছে আসে, জিজ্ঞেস করে,-
– হ্যালো। ডাব্বু, মন খারাপ তোমার?
– হ্যাঁ, মন তো আমার বেশির ভাগ সময়ই খারাপ থাকে। স্কুলে যাবার সময় মন খারাপ হয়, বাসায় ফিরে একা একা ভালো লাগে না,- তখন আরও মন খারাপ হয়।
– ভালো লাগে কখন?
শালিক দুটোর সাথে চার-পাঁচটা চিকির মিচির চড়ুই ও সারি সারি এসে দাঁড়িয়েছে। ছোট্ট আর একা মানুষটির কথা খুবই মন দিয়ে শোনে ওরা।
– ভালো লাগে? চনমনে হয়ে ওঠে ডাব্বু।
– যখন টিভিতে টম অ্যান্ড জেরি দেখি, কার্টুন ফিল্ম কিং কংকে দেখি।
– আর?
– ডিসকভারি চ্যানেল দেখতেও দারুণ লাগে। সাপ-ব্যাঙ, বাঘ-সিংহ- হরিণ দেখতে বেশ লাগে। তবে মা কি আর দেখতে দেয়? স্কুলে যে গাদা গাদা হোমটাস্ক দিয়ে দেয়।
পাখিরা অতশত বোঝে না।
চড়ুই কিচিরমিচির করে বলে, তোমাদের কত কিছু করার আছে, আমাদের সেই সকাল থেকে এখান থেকে ওখানে উড়ে যাওয়া, খাবার খোঁজা। এই করে দিন বয়ে যায়।
পাখিদের করুণ নিঃশ্বাস শুনতে গিয়ে ডোরবেলের আওয়াজ শোনে সে।
মা এসেছে মা এসেছে।
শালিক আর চড়ুই পাখির দল মন খারাপ করে।
ওদের খুব হিংসে হয় ডাব্বুকে। ওর টম অ্যান্ড জেরি আছে, কার্টুন ফিল্ম আছে। ডিসকভারি চ্যানেল, ইশকুল ও ইশকুলের বন্ধুরা আছে, আমাদের কিছুই নেই।
– কেন, আমাদের দু’টি ডানা আছে।
হ্যাঁ তাইতো ডানা দিয়ে আমরা উড়ে যেতে পারি। রিনা ঘরে ঢুকতেই ওরা একসাথে উড়াল দিয়ে হারিয়ে যায়। মা বলে, কি রে, কি ছবি আঁকলি? কাগজ আর রঙ পেনসিল দিয়ে ঘরটা তো ছৈ ছত্রাকার করে রেখেছিস।
মা কখনোই ডাব্বুর ভালো কিছু দেখতে পায় না। ছবি আঁকতে গেলে ভাবতে হয় না? মেঘের রঙ কী হবে? ভাবতে ভাবতেই তো সময় চলে যায়।
মলিন মুখে টাওয়েল নিয়ে ওয়াশরুমে ঢোকে ডাব্বু, সঙ্গে মা।
এ সময় ‘না না মা, সাবান আমি মাখব না। শ্যাম্পু দেবো না, চোখ জ্বালা করে যে- এটি ডাব্বুর গলা।
রিনার গলা শোনা যায়- কী নোংরা ছেলে রে বাবা, মুখে কালি লাগল কোত্থেকে শুনি? এমা সারা মুখে লাল-নীল রঙ, দ্যাখো কেমন ভূত সেজেছে।
বিশ-পঁচিশ মিনিট মা-ছেলের কথাবার্তার পর ঝকঝকে হয়ে বের হয়ে আসে ডাব্বু।
রিনা, সোমনাথ আর ডাব্বু খেতে বসে তখন। আলুভাজি আর ডাল প্রিয় খাবার ওর। এ খেয়েই তো পেট ভরে যায় ওর।
দাদানের বয়স হয়েছে, ধীরে-সুস্থে কাঁটা বেছে খান। মা এত চমৎকার করে গুছিয়ে খায়- দেখতে ভারী ভালো লাগে ডাব্বুর। ডাল ভাজি দিয়ে খাওয়া শেষ করে রিনা বলে বাবা-আপনাকে অল্প করে কাঁটা চচ্চড়ি দিই!
– দাও একটু, খেয়ে দেখি।
রিনা সোমনাথের পাতে তরকারি দিতে দিতে বলে, বাবা,- এটা ইলিশ মাছের কাঁটা চচ্চড়ি। বিনি খুব ভালো করে পাকায় এটা।
দাদু অসহায়ের মতো বলেন, চশমা তো আনিনি বউমা, কী করে কাঁটা বাছব।
মিষ্টি হেসে মা বলে, আমি এনে দিচ্ছি। রিনা গুন গুন করে গেয়ে ওঠে –
অমল ধবল পালে লেগেছে
মন্দ মধুর হাওয়া-
চশমা এনে দাদুর চোখে পরিয়ে দেয় মা।
এ সময় মাকে দেখতে একেবারে অন্যরকম লাগে। বুড়ো মানুষ, চোখে কম দেখেন। তার যাতে কষ্ট না হয় খুব খেয়াল রাখে মা।
রিনা একদিন বলেছে, বুড়ো মানুষ আর শিশুরা এক রকম- জানো ডাব্বু? একটু বকুনি দিলে তুমি যেমন মুখ গোমড়া করো, বয়স্করাও খুব অভিমান করেন।
চশমা চোখে দিয়ে দাদান মনোযোগ দিয়ে কাঁটা বেছে খাচ্ছেন।
রিনা বলে, মুরগির ঝোল পরে নিও ডাব্বু। এখন অল্প করে ইলিশের কাঁটা চচ্চড়ি খাও তো।
ডাল আর আলু ভাজি দিয়ে ওর খাওয়া তো শেষ, বলল মুরগির রান আর এক টুকরো আলু দিয়ে দাও। মাছের আঁশের তরকারি আমি খাবো না।
দাদান, মা, বিনিমাসী হেসে ওঠে।
– আঁশের তরকারি কোথায় রে? ও হলো কাঁটা চচ্চড়ি। মাছের কাঁটায় ক্যালসিয়াম থাকে তা জানো। শরীরে যে হাড় আছে তা বয়স হলে এক সময় ক্ষয় হতে থাকে, এ জন্যই তো মাংসের হাড়, মাছের কাঁটা চিবিয়ে খেতে হয়।
– খাও দাদুভাই, খেতে ভালো হয়েছে।
অল্প করে প্লেটে দিলো মা। রিনা এমনই। করলা-উচ্ছে এগুলো খেতে হয়, ওসব তো লিভারের খাদ্য। বিশেষ করে ফাল্গুন-চৈত্র মাসে নিমপাতা, করলা, শজনে ডাঁটা ওগুলো বেশি করে খেতে হয়। তুমি বলবে, এগুলো খেতে ভাল্লাগে না। তবে শরীরের যাতে উপকার হয়- এগুলো তো তোমাকে খেতেই হবে ডাব্বু।
সোমনাথ বলেন, ছোটবেলা আমিও মায়ের কথা শুনিনি। মাছের কাঁটা, মাংসের হাড় চিবিয়ে আমি খাব? আমি কি বেড়াল?
দ্যাখো, এখন আমি কী কষ্ট পাচ্ছি হাড়ের ব্যথায়।
রিনা চচ্চড়ি কাঁটা বেছে খাইয়ে দিতে থাকে।
– এখন গিয়ে হোমটাস্কগুলো সেরে ফেল।
গালভর্তি ভাত নিয়ে গুড্ডু বলে, এখন একটু ঘুমোব মা। এত খাওয়ালে কেন? বেশি খেলেই তো ঘুম পায়। আলু ভাজি, ডাল, ইলিশের কাঁটা চচ্চড়ি, মুরগির ঝোল আর আমের চাটনি। ছোটরা এত খেতে পারে বলো?
– আর একটি হাঁসের ডিম, তারপর একটি মুরগির ডিম-
রিনার কথা কেড়ে নিয়ে ঘুম ঘুম চোখে ডাব্বু বলে এরপর ঘোড়ার ডিম-
সোমনাথ ঠা ঠা করে হাসেন।
– দূর বোকা, ঘোড়ার আবার ডিম হয় নাকি?
সবার হাসিতে ঘুমটা চোখ থেকে চটকে যায়। রিনা ছেলের মুখ ধুয়ে টাওয়েল দিয়ে মুখ মুছিয়ে কোলে তুলে নেয়। হাজারো কার্টুন আঁকা বিছানায় টানটান হয়ে শুয়ে থাকে ডাব্বু। বিড়বিড় করে বলতে থাকে, – হোমটাস্ক, ঘোড়ার ডিম, কাঁটা চচ্চড়ি, হোমটাস্ক, নিমপাতা, করলা, শজনে ডাঁটা-
দিনটা যদি হয় শুক্রবারের বিকেল, মা যদি ঘরে বাদাম-নারকেল কুচো দিয়ে শিঙ্গাড়া তৈরি করেন, বেশ একটা ফুরফুরে খুশি ডাব্বুর ছোট্ট বুকের ভেতরটাতে খেলা করে- ঠিক সেই সময় রঙচঙে শাড়ি পরে টিনামাসী যদি ছেলে ইভানের হাত ধরে আসে তখন দারুণ লাগবে না ওর?
বাড়িতে কেউ বেড়াতে এলে পড়াশোনা ডকে ওঠে যায়, খুব হইচই হয়, ভালো খাবার দাবার হয়- শুধুই মজা শুধুই খুশি।
ইভান দাদা ক্লাস ফাইভে পড়ে। অনেক কিছু জানে, বোঝেও।
রিনা হাসিমুখে বলে, এত হাসিখুশি কেন দিদি ভাই? নিশ্চয়ই কোনো ব্যাপার আছে।
টিনা বলে, হ্যাঁ রে, এবার বইমেলায় আমার একটি বই এসেছে।
সবাই তাজ্জব!
মা-পাপা-দাদান সবাই মিলে হাততালি দিলো।
– দারুণ ব্যাপার।
পাপা বললেন, বাহ- এতো কাছে থেকে আমরা একজন লেখককে দেখতে পাচ্ছি- থ্যাংক গড। কী ভাগ্যি আমাদের!
রবিউল দাদানও এসেছেন আজ। পারিবারিক বন্ধু। টেবিলে টিনামাসী রেখেছেন আইসক্রিম, ইগলু, ক্যাডবেরি, স্পঞ্জ রসগোল্লা।
রিনা ভীষণ ব্যস্ত। ফিসফিস করে কানে কানে কথা বলছে ছেলে।
– আহ ডাব্বু, জ্বালাসনে তো।
ঠোঁট ফুলিয়ে ডাব্বু বলে, আমি তো বাজে কিছু বলছি না মা, সবাই এসেছে, তুমি এত কিছু রাঁধছো, দিল্লির দাদানকেও ডাকি? রিনা হাসিমুখে বলে, তা ডাক না, আমি কি মানা করেছি!
রিনা অনেক সময় বেশ কিছু ব্যাপারে মানা করে, বারণ করে দিদুন মারা যাওয়ার পর দাদান একেবারে একলা। তার বন্ধুরা এলে মা খুব খুশি হন। মায়ের এ ব্যাপারটি খুব ভালো লাগে। মা তো বলে, বয়স হলে মানুষ শিশুদের মতো হয়ে যায়। অল্পতেই অভিমান করে। ওদের মনে কষ্ট দিতে নেই।
ডাব্বুর ঘরের পাশেই সরফরাজের বেডরুমের জানালা।
– শুনছ দিল্লির দাদান? জানালার কাছে এসো। চশমা পরা গাজালা দিদুনের হাসিমুখ দেখা যায়।
– ক্যায়া হুয়া বেটা!
– দাদানকে ডাকো।
হাসিমুখ সরফরাজের।
– জরুরি এত্তেলা কিঁউ?
– তুমি এক্ষুনি চলে এসো আমাদের বাড়ি।
সরফরাজ আসতেই জমে যায় আসর। টিনা বলে, তুই মিছেমিছি এত ঝামেলা করছিস কেন বলতো রিনা।
– আরে বাবা, কিছু রাঁধছি না। একসঙ্গে দু’টি ভাত খাবো সবাই মিলে। তোমার বই বেরোনে উপলক্ষ্যে একটু সেলিব্রেট করা আর কি!
খুব খুশি আজ সোমনাথ। এই সন্ধ্যেটা বড় ভালো লাগছে, কথা বলার লোক তো নেই। সবাই ব্যস্ত। আজ দু’জন সাথীর সাথে এলেবেলে গল্প করে সময় কেটে যাচ্ছে। নয়তো সময় যেন কাটতেই চায় না। সময়টা ভারী পাথরের মতো সোমনাথের বুকে চেপে বসে থাকে।
পোলাও-এর ম ম গন্ধ আর জমাটি গল্পে ভরে আছে ফ্ল্যাটটি।
হালকা লিকারের চা আর অল্প বাদাম নিয়ে আসে রিনা।
সরফরাজ খুশিমাখা গলায় বলেন, মজা আ গ্যায়া।
রবিউল বলেন, মনটা চা চা করছিল রিনা, চা না হলে কি আর গল্প জমে?
সোমনাথ বলেন, চা খেয়ে কি ভাত খেতে পারব? রিনা হাসিমুখে বলে, খুব পারবেন বাবা, সবে তো আটটা বাজে, ন’টায় ভাত দেবো।
ডাব্বু আর ইভান বলে, তুমি ভাত খাবে দাদান?
টিনা বলে, কেন খাবেন না? মাঝে মাঝে অনিয়ম করা যেতেই পারে।
হ্যাঁ- ডিসিপ্লিন ডিসিপ্লিন অ্যান্ড ডিসিপ্লিন। মাই গড। মাই ফুট!
ডাব্বু ভাবে, এই তো আজ সন্ধ্যায় রোজকার পড়া নেই, হোমটাস্ক নেই- এই যে অনিয়ম এতেই দারুণ কাটছে আজকের সন্ধ্যা। এমন মাঝে মাঝে হলে বেশ হয়।
ইভানের বাবা রাজেশের সঙ্গে রিনা কাজকর্মের ফাঁকে ফাঁকে হাসিমুখে ঠাট্টা করছে। রাজেশ মজার জবাব দিচ্ছেন।
খবরদার ডাব্বু, এটা করবে না, ওখানে যাবে না, হোমটাস্ক শেষ না করে উঠবে না- এমন বলতে থাকা মা কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। আজকের মা একেবারেই অন্যরকম। ডাব্বু মনে মনে বলে, আমার মা সব পারে, আমার মা সব জানে।
বুকের ভেতরটা ভরে ওঠে ডাব্বুর। মনে মনে বলতে থাকেও,- আমার মা সব পারে। আমার মা সব জানে।
ঠিক নটায় মা ডিনার সার্ভ করে। বিনিমাসী তো রয়েছে, টিনামাসীও সাহায্য করেছে মাকে।
মটরশুঁটি ছড়ানো পোলাও, ডিমের চপ, আলু দিয়ে বাটার চিকেন আর পায়েস।
ডাব্বুর বাবা সৌম্য- তিন বন্ধুকে ডাইনিং টেবিলের সামনে ঠিকঠাক মতো বসিয়ে দিলেন। ইভান আর ডাব্বু বসল ওদের পাশে।
তিন বন্ধুই রাতে রুটি আর হলকা সবজি খান, আজ অল্প করে ভাত খাবেন। এটাই ডাব্বুর কাছে উৎসব। সোমনাথ বলেন, এটা কি হলো রিনা? তোমরা খাবে না? রিনা বলে ড্রয়িংরুমে চেয়ার আছে, মোড়াও তো রয়েছে বাবা। সাইড টেবিলে সব খাবার রেখে দিয়েছি। এই দেখুন। টিনা বলে, বুফে সিসটেম আর কী।
রবিউল খেতে খেতে বলেন, দারুণ রেঁধেছ তো বউমা। রিনার মুখ আলোয় ভরে যায়।
– খান আংকেল, যা ভালো লাগে খান।
রাজেশ বলেন, রিনা, তুমি শুধু ডাব্বু খুব দুষ্টু, সারাদিন খেলা খেলা, একদম পড়াশোনা করে না বলো, এবারের পরীক্ষায় ইভান কী করেছে জিজ্ঞেস করো।
রিনা খাচ্ছে ডান হাতে, বাঁ হাতে সার্ভ করছে। পায়েসের বাটি এগিয়ে দিতে দিতে বলে, কি রে ইভান- কি করেছিস শুনি? দুষ্টুমি করেছিস?
ওর বাবা রাজেশ বলেন, পরীক্ষায় রচনা এসেছে ‘গাছগাছালির উপকারিতা’, আমি ওকে পড়াবার সময় তো পাই না। তবে মাঝে মাঝে বলেছি- এ ধরনের প্রশ্নের উত্তরে তুমি যদি কোটেশান দাও, তবে ভালো নম্বর পাবে।
সরফরাজ বাটি থেকে এক চামচ পায়েস মুখে দিয়ে বলেন, ওয়াও, তারপর বলেন, ইয়ে সাচ্চি বাত হ্যায় টিনা বিটিয়া। রবিউল আর একটি চপ নিয়ে ভেঙে ভেঙে খাচ্ছেন, বলে ওঠেন-
– আরে ব্যাটা, সারাক্ষণ হিন্দি বাত কিঁউ, বাংলা বলো বাংলা। জানো তো- আমার ভাষা তোমার ভাষা, বাংলা ভাষা। সরফরাজ হাসিমুখে বলেন, আরে ইয়ার- আমি তোমাদেরই লোক। ভেঙে ভেঙে সুন্দর করে বলেন কথাগুলো।
সবাই হাততালি দিয়ে ওঠে।
দারুণ দারুণ।
সোমনাথ বলেন, ব্যাপারটি কি জানো? নিজের ভাষায় কথা বলতে দারুণ লাগে। আমি মাঝে মাঝে তেনার ক্যানি, কাঁকইর, জাম্বুরা, আমলি বলি, বেশ ভালোই লাগে।
– আমলি কি দাদু?
– আমলি হলো তেঁতুল।
সৌম্য বলেন, ইভানের পরীক্ষার কথা বলো এবার। নানা কথায় ধামাচাপা পড়ে যাচ্ছে।
– ওহ ইয়েস।
রাজেশ বলেন, কোটেশান দিতে হবে অথচ কিছুই মনে পড়ছে না। নিজেই বানিয়ে নিলো কোটেশান।
– কী রকম!
– পরীক্ষায় খাতায় লিখল- ‘জর্জ অ্যালেক্স বলেছেন- সবুজ গাছগাছালি দেখলে চোখের আরাম হয়, মনেও আনন্দ জাগে।’
– বাহ্ –
রাজেশ বলেন, শেষ হয়নি সৌম্য, আরেকটি কোটেশান আছে। আইভি স্টোন, যিনি গাছপালা নিয়ে অনেক গবেষণা করেছেন, উনার বেডরুম-ড্রয়িংরুমে কত যে ইনডোর প্ল্যান্ট- উনি বলেছেন, ‘এই ছোট ছোট গাছগুলো আমাকে আনন্দে বাঁচিয়ে রেখেছে।’
রবিউল বলেন, এ দেখছি ওয়ান্ডার বয়। ভালোই তো। মা বলে, জর্জ অ্যালেক্স, আর আইভি স্টোনের নাম প্রথম শুনলাম, কোন বই থেকে কোটেশানগুলো নিলি রে ইভু?
ইভান মুরগির রান চুষতে চুষতে বলে, এগুলো আমার বানানো নাম রিনামাসী।
– বলছিস কী রে?
নির্বিকার সুরে বলে, আমাদের দেশের কারো নাম দিলে স্যাররা খুব একটা খুশি হন না, তাই বিদেশী নামই দিলাম।
– কেয়া বাৎ- সরফরাজ চেঁচিয়ে ওঠেন।
সোমনাথ বলেন, ক্লাস ফাইভেই খেল দেখালি নাতি- বড় হলে কী করবি?
হাসির রোলের মাঝে সৌম্য বলেন, দিদি ভাইয়ের বইটির নাম জানা হলো না।
– ছোটদের বই, নাম হলো- লাল গালিচার জাদু। সবাই দশখানা বই হাতে, হাতে নিয়ে দাঁড়াল, ছবি ওঠানো হলো মোবাইলে। ফেসবুকে দেয়া হবে।
মিষ্টি পানের ব্যবস্থা আগেই করে রেখেছে রিনা। ভারী খাওয়া-দাওয়ার পর পান না চিবোলে ভালো লাগে না।
সোমনাথ বলেন, অনেক দিন পর চমৎকার স্বাদের পায়েস খেলাম। রিনা বলে, রোজই তো জিরো ক্যাল দিয়ে করি বাবা, আজ সবার জন্য চিনি-বাতাসা দিয়ে যে পায়েস করেছি তা থেকেই দিলাম। মাঝে মাঝে নিয়ম থেকে একটু অনিয়ম করতে হয়। ভালো হয়েছে বাবা?
– উফ দারুণ।
সরফরাজ বলেন, মাঝে মাঝে যে অনিয়ম করতে হয় তা তোমার আন্টিকে সমঝে দিও রিনা।
সবাই চলে গেছে এখন। রাত সাড়ে দশটা বাজে। বিনিমাসী পেয়ালা-প্লেট কাচের বাটিগুলো ধুয়ে মুছে রাখছে, শুধু তারই টুংটাং আওয়াজ।
ইভানদাদার কথা মনে করে ফিক করে হেসে ফেলে ডাব্বু। মায়াভরা এলোমেলো চুল, চোখে লটর পটর চশমা- ঠিক যেন হ্যারিপটার।
একটি কথা মনে পড়ে বারবার। দাদান যেমন বুড়ো হয়েছে মা-পাপাও কি এমনই বুড়ো হয়ে যাবে? চুল সাদা হয়ে যাবে বরফের মতো, পাপার মাথায় টাক পড়বে। কুঁজোও হয়ে যাবে অনেকটা।
মা যেমন আদুরে কথায় দাদানকে দেখে শুনে রাখেন, বলেন- বয়স হলে বুড়োরা শিশুর মতো হয়ে যায়, একটুতেই অভিমান হয়- তাদের কখনও আঘাত দিতে নেই।
নীল আলো জ্বলা ঘরে, মশারির নিচে শুয়ে ডাব্বু ঠোঁট নাড়ে- আমি কখনো মা-পাপাকে কটু কথা বলব না। ওদের বুকের সাথে জড়িয়ে রাখব।
মোবাইলে খবর এলো কুমিল্লা থেকে নিরুপিসি আসবেন। অসুখ-বিসুখে খুব ভুগছেন। ছেলে নির্মল তাকে নিয়ে আসবে। দাদানের ছোট বোন, সৌম্যর নিরুপিসি।
কথাটি শোনার পর থেকেই ডাব্বুর মন খারাপ।
– বাইরের লোক আসবে বাসায়?
দাদান বলে, আসবে না? মানুষ একা একা থাকতে পারে নাকি? আর বাইরের লোক কিরে? বাইরে থেকে লোক এলে সে-ই তো ঘরের লোক হবে। ও তোর আপনজন, আমার ছোটবোন।
আজ আর খেলাতে একদম মন বসছে না ওর। চড়ুই আর শালিক দুটি ডাকাডাকি করে ফিরে যায়। একগাদা খেলনাগাড়ি সাজিয়ে আনমনা হয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকে ডাব্বু।
রিনা সৌম্যকে বলে, দেখেছ – একা থাকতে থাকতে ছেলেটা কেমন হয়ে গেছে। নিরুপিসি আসবে শুনেই ছেলের মুখ গোমড়া।
বিনি বলে, ওনি এলে তোমার পাশে শোবেন, রাতে যে কেঁদো ভূত, মামদো ভূত, শাকচুন্নি আসে-
প্রিয় গাড়িগুলো ছুড়ে ছুড়ে ছৈ ছত্রাকার করে ডাব্বু।
– চুপ করো বিনিমাসী, ভূত বলে কিছু নেই, তুমি আজগুবি গল্প বলো নাতো!
– কে বলেছে ভূত নেই? বৃষ্টির দিনে তাহলে মিয়াবাড়িতে কে এসেছিল শুনি?
হ্যাঁ করে বিনির মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে ডাব্বু।
– ঘোর বর্ষা তখন, শ্রাবণ মাস। ঝড়-বৃষ্টি একসাথে নেমেছে। মিয়াবাড়ির নতুন বউ সবে খিচুড়ির ডেকচি চুলো থেকে নামিয়েছে।
– তারপর?
– তারপর আর কী। পাশের চুলোয় আলু-পটোল ভাজছে রহিমা। নতুন বউ কড়াইয়ের ডুবো তেলে ভাজছে পদ্মার ইলিশ। অমনই খোঁনা গলায় কেউ বলল, একা একা মাছ ভাজা খাবি? আমাকে দেঁ, আমাকে দেঁ-
সোমনাথের ঘুম ভেঙে যায়। বলেন, এই বিনি- কি শেখাচ্ছিস গোল্লুকে? ভূত কোথায় রে? দেখেছিস কোনোদিন?
– হ্যাঁ বড় বাবু, ভূত আছে। আমাদের গায়ের মহীন তার দুদু মিয়া আছে না, ওদের মাছের চুবড়ি থেকে শনিবার-মঙ্গলবারে সব মাছ খেয়ে ফেলে।
সোমনাথ সব সময় আস্তে করে কথা বলেন। আজ রেগে বলেন, চুপ একদম চুপ বিনি। যত সব আজগুবি কথা। ভূতের বানানো গল্প কখনো বলবি না, নিজেও বিশ্বাস করবি না।
বাইরে সোনালি বিকেল।
এবার দাদান আর নাতির গল্পদাদুর আসর বসবে। হৈ হৈ করে এ সময় আসে চিন্টুমামু।
ডাব্বু বলে, ভালোই হলো। এবার দাদান গল্প শুরু করবে। তাই না দাদান?
এ সময় চিকেনের টুকরো আর ডিমের ঝুরি মেশানো নুডলস নিয়ে এলো রিনা।
– ওয়াও।
এ খাবারটি দারুণ পছন্দ করে ডাব্বু। সোমনাথও পছন্দ করেন। সোমনাথ বলেন, এতক্ষণ তুমি বিনির কাছ থেকে ভূতের গল্প শুনেছ, এবার শোন অন্যরকম গল্প।
রিনা কিচেন থেকে চেঁচিয়ে বলে, আমি আসছি বাবা, তারপর শুরু করবেন।
ট্রেতে টিপট-পেয়ালা নিয়ে ছুটে আসে রিনা।
– এবারে বলুন বাবা।
– আজ দিয়েগো ম্যারাডোনার গল্প বলি। ডাব্বু বলে, ফুটবল প্লেয়ার তো দাদান।
– হ্যাঁ রে গোল্লু, এ নামে পৃথিবীতে শুধু একজনই আছে। ডোর বেল বাজতেই ছুটে যায় ডাব্বু।
– পাপা এসেছে, আমার পাপা এসেছে।
আসরে ফ্রেশ হয়ে এসে যোগ দিলেন সৌম্য। পাপার সঙ্গ খুব বেশি পায় না ছেলে। মালটি ন্যাশনাল কোম্পানিতে আছেন। খুবই ব্যস্ত থাকেন তিনি। ডাব্বু আজ তাই খুব খুশি। চায়ে রেলিনা করে চুমুক দেন সৌম্য।
বাহ! দিয়েগো ম্যারাডোনার গল্প হচ্ছে বুঝি? উনি তো ১৯৮৬ সালে বিশ্বকাপ খেলায় আর্জেন্টিনাকে জিতিয়ে দিয়েছিলেন। মজার ব্যাপার হলো ম্যারাডোনা যে গোলটি দিয়েছিলেন তা দিয়েছিলেন হাত দিয়ে। চোখ বড় বড় করে ডাব্বু বলে, – ফুটবল মানেই তো পায়ের খেলা।
চিন্টুমামু বলে, এরপর থেকে বলা হতো এটা ঈশ্বরের হাত। রিনা বলে, তোমরা কথা বলছ কেন? এটা হলো ডাব্বুর গল্পদাদুর আসর। দাদান গল্প বলবেন আর নাতি শুনবে। সোমনাথ বলেন, আমি বলছিলাম ম্যারাডোনার ফেয়ারওয়েল ম্যাচের গল্প।
ফেয়ারওয়েল? তার মানে বিদায় দাদান?
– হ্যাঁ রে, সবাইকেই তো একদিন তার কাজের জায়গা থেকে বিদায় নিতে হয়। ম্যারাডোনা খেলা থেকে বিদায় নেবেন। এটি ছিল তার ফেয়ারওয়েল ম্যাচ। তার খেলাটি দেখতে কে এসেছিলেন জানো!
– কে দাদান?
– এসেছিলেন পেলে। পৃথিবীর বিখ্যাত ফুটবল খেলোয়াড়। তিনি ব্রাজিলের মানুষ, তিনি ফরোয়ার্ডে খেলতেন।
চিন্টুমামু বলে, স্যরি, একটু বাধা দিলাম কথায়। পেলে আর ম্যারাডোনা- দু’জন খেলোয়াড়ের মাঝে নাকি দা-কুমড়ো সম্পর্ক ছিল? আর্জেন্টিনার ম্যারাডোনা আর ব্রাজিলের পেলে- দু’জনই ফুটবলের স্টার। সোমনাথ বলেন, ঠিকই শুনেছ চিন্টু, কিন্তু গুণীজনের গুণকে কিন্তু মানুষ সম্মান করে। ম্যারাডোনার খেলা দেখতে তিনি উপস্থিত ছিলেন মাঠে। বর্তমান আর্জেন্টিনা, যার ক্যাপ্টেন ছিলেন ম্যারাডোনা। এর সাথে খেলা হয়েছিল অলস্টার একাদশের মাঝে।
সৌম্য অসহায়ের মত বলেন, আমি তো ওসবের কিছুই জানি না বাবা। কে জিতেছিল শুনি।
– আর কে? বুঝতে পারছ না? আর্জেন্টিনা ৬-৩ গোলে জিতেছিল। ম্যারাডোনা নিজেই পেনাল্টি থেকে দুটো গোল দিয়েছিলেন। অতীত ও বর্তমানের সেরা ফুটবলার ম্যারাডোনা মাঠ থেকে চিরদিনের মতো বিদায় নেয়ার সময় মেয়ে ডালমার হাত ধরে কেঁদে ফেলেন, কান্না সামলাতে পারেননি। রিনার চোখে টলটলে জল।
ডাব্বু বলে, মামা তুমি কাঁদছ?
সোমনাথ বলেন, যারা গান গায়, যারা খেলে, গল্প-কবিতা যারা লেখে ওরা খুব আবেগপ্রবণ হয় ডাব্বু। আবেগে ভেসে যায় তারা। ব্যাপারটি ছুঁয়ে যায় সৌম্যকে। বলেন, এত বল সামলেছেন কিন্তু কান্না সামলাতে পারেননি। এ-ই হয়।
বিকেল শেষ হয়ে সন্ধ্যা নামছে। এক মধুর বিষাদে ঘরটি ভরে আছে।
রিনা বলে, বাবা আপনার মতো সুন্দর করে তো আমি বলতে পারি না, আমার গানের টিচার একদিন বলেছিলেন, তার ওস্তাদজি বেলায়েত হোসেন আমেরিকায় গিয়েছিলেন বাঙালিদের আমন্ত্রণে। ঘুরে ঘুরে কয়েকটি রাজ্যে উনি গান গেয়েছেন। নিউইয়র্কে এক সন্ধ্যায় স্টেজে তার শিষ্যরা তানপুরা, সুরবাহার নিয়ে সুর তুলছে। দরবারি রাগে ওস্তাদজি গান ধরেছেন-
‘কোয়েলিয়া মাত পুকারো’-
সারা দেশের লোকেরা এসেছিল গান শুনতে, ফাংশান শেষে ওস্তাদজির সঙ্গে গ্রিনরুমে দেখা করতে এসেছিল তিনজন বিদেশী মেয়ে। ওরা জিজ্ঞেস করেছিল- ওস্তাদজি আপনি কি সুরে গান বাজিয়েছেন জানি না- কিন্তু আপনার সুরে আমাদের চোখে কান্না এসে গেল কেন,- বলুন তো!
হ্যাঁ- তাইতো, ওরা ভাষা জানে না কিন্তু সুরের ছোঁয়া এমনই- তাতে কান্না এসে যায়।
সোমনাথ উচ্ছ্বসিত হয়ে বলেন, চমৎকার গল্প শুনলাম বউমা। দরবারি রাগটা এমনই মানুষকে কাঁদিয়ে যায়।
এবার সবাইকে উঠতে হবে।
বিনিমাসী ভাত রান্না করবে, দাদানের জন্য রুটি হবে। সবাই মিলে এখন টিভি দেখবে। ডাব্বু থাকবে শুধু বই-খাতাপত্তর নিয়ে। স্কুলের পড়া আর হোমওয়ার্ক নিয়ে জেরবার হয়ে যাবে।দাদান মাঝে মাঝে তার কাছে চলে আসেন। পিঠে আদুরে হাত বোলান। ক্লাস ওয়ানের ছাত্র, বই একগাদা।
[চলবে]