Home স্মরণ কাজী নজরুল ইসলাম চির উন্নত শির । তনয় সালেহা

কাজী নজরুল ইসলাম চির উন্নত শির । তনয় সালেহা

কাজী নজরুল ইসলাম চির উন্নত শির । তনয় সালেহাকবি নজরুলের কথা ভাবলেই মনটা বিরাট হয়ে ওঠে। আকাশের সমান হয়ে ওঠে। হয়ে ওঠে আকাশের চেয়েও বড়। আকাশের ওপারের আকাশগুলো যেন জমা হয় বুকের ভেতর। চাঁদ জোছনা জমে ওঠে এই বুকে। এখানে এই হৃদয়ে। জমে ওঠে এ কারণে যখন নজরুল বলেন
“পাতাল ফুঁড়ে নামবো আমি উঠবো আমি আকাশ ফুঁড়ে
বিশ্ব জগৎ দেখবো আমি আপন হাতের মুঠোয় পুরে।”
আহা কী কল্পনা! কী ভাবনা! কী বিশালতা। গোটা বিশ্বজগৎ হাতের মুঠোয় ধরার সাহস আর কোন্ কবি করেছেন! কোন কবি বলেছেন আকাশ ফুঁড়ে উঠবো। নামবো পাতাল ফুঁড়ে। না বলেননি কেউ! এমন করে ভাবেনওনি কেউ আর। এমন ভাবনার বরপুত্র নজরুল। আমাদের প্রিয়কবি নজরুল। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম।
তাঁর উদারতা ছিলো বিশাল। সাহস ছিলো সীমাহীন। স্বপ্ন ছিলো আকাশের চেয়েও বড়। সপ্ত আকাশ ভেদ করার কথা তিনিই বলেছেন। তিনি সত্যের ব্যাপারে ছিলেন আপসহীন। মিথ্যা পচা জীর্ণতার বিরুদ্ধে ছিলো তাঁর প্রতিবাদ। তাঁর বিদ্রোহ। তিনি বিদ্রোহ করেছেন অন্যায়ের বিরুদ্ধে। অসুন্দরের বিরুদ্ধে। মিথ্যা ও কলুষতার বিরুদ্ধে। মানুষের প্রতি ছিলো তাঁর অপরিসীম ভালোবাসা। গরিব দুঃখী অসহায়ের প্রতি ছিলো দারুণ মমতা। তিনি এসব মানুষের পক্ষে কবিতা লিখেছেন। এসব অধিকারহীন মানুষের অধিকারের কথা লিখেছেন। বঞ্চিতজনের কথা লিখেছেন। যারা মানুষের ওপর নির্যাতন করে, মানুষের অধিকার লুট করে, মানুষকে মানুষ হিসেবে গণ্য করে না তাদের বিরুদ্ধে কবিতায় উচ্চারণ করেছেন দ্রোহ। তাদের শাস্তি চেয়েছেন। তাদের বলেছেন মানুষের দুশমন। মানবতার দুশমন। সমাজে অবহেলিত মানুষের প্রতি তার প্রচণ্ড ভালোবাসা ছিলো। তিনি এসব মানুষের স্বাধীনতার কথা বলেছেন তীব্রভাবে।
নজরুল আমাদের স্বাধীনতার প্রতীক। আমাদের সাহসের উপমা এবং আমাদের সুন্দরের প্রতিনিধি। কবিতায় গানে এসব সুন্দরের কথা বলেছেন তিনি। গেয়েছেন সুন্দরের গান। তাঁর গানে স্বপ্ন আছে। আশার আকাশ আছে। প্রেরণার উচ্ছ্বাস আছে। আছে ন্যায় ও নতুনের পথে যাত্রার সাহস। সীমানা ভেঙে চলার বলার এবং গ্রহণ বর্জনের স্বচ্ছতা আছে। যারা জীবনকে জীবনের মতো করে দেখতে চায়, জানতে চায় এবং মানতে চায় তাদের জন্য কবি নজরুল আদর্শবান। ঘুমিয়ে থাকা জাতিকে তিনি জাগরণের বাণী শুনিয়েছেন। পিছিয়ে পড়া জাতিকে তিনি এগিয়ে চলার মন্ত্র শিখিয়েছেন। বলেছেন-
“থাকবো না কো বদ্ধ ঘরে
দেখবো এবার জগৎটাকে
কেমন করে ঘুরছে মানুষ
যুগান্তরের ঘূর্ণিপাকে।”
হ্যাঁ তাইতো! বদ্ধঘরে কেন থাকবো! কেন সঙ্কীর্ণতার চোরাগলিতে বসত করবো। কেন ছোটখাটো বিষয় নিয়ে কামড়া কামড়ি করবো। এমন সঙ্কীর্ণতা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। আসতে হবে নিজেদের প্রয়োজনে। যে সঙ্কীর্ণমনা অথবা ছোট মনের মানুষ, তার পক্ষে বড় কোনো কাজ করা সম্ভব নয়। নয় কোনো বড় স্বপ্ন দেখা। এমনকি মানুষকে মন থেকে ভালোবাসাও সম্ভব নয়। মানুষকে ভালো বাসতে না পারে যদি তবে পৃথিবীতে তার কোনো ভূমিকা নেয়ার ক্ষমতাই থাকবে না। নজরুল আমাদের শিখিয়েছেন মানুষকে ভালোবাসার মন্ত্র। মানুষকে সম্মান দেয়ার বাণী। তাইতো তিনি বলেছেনÑ
“গাহি সাম্যের গান
মানুষের চেয়ে বড় কেউ নয়
নহে কিছু মহীয়ান।”
সৃষ্টির ভেতর মানুষই সবচেয়ে বড়। স্রষ্টা মানুষকে এমন বড় করে মহান করে পাঠিয়েছেন দুনিয়ায়। দুনিয়ার আর যত সৃষ্টি সবই মানুষের জন্য। আর মানুষকে বানানো হয়েছে স্রষ্টার গুণগানের জন্য। স্রষ্টার প্রশংসায় ডুবে থাকার জন্য। স্রষ্টার সৌন্দর্য অনুধাবন করে তা প্রচারের জন্য। তার বিরাটত্ব এবং মহানত্ব অনুভবের জন্য।
মানুষ যখন সত্যিকারে মানুষ হয়, তার মতো মহৎ পৃথিবীতে আর কিছু হতে পারে না। হয় না। এবং হবেও না। মানুষই মহৎ হতে পারে। মানুষই পারে অফুরন্ত সম্মান কুড়াতে। এর জন্য মানুষকে কাজ করতে হবে। পরিশ্রম করতে হবে। অসুন্দরের চর্চা পরিহার করতে হবে। জেগে উঠতে হবে সুন্দরের দিকে। নতুন দিনের দিকে। নজরুল এ কথাই তো বলেছেন। বলেছেন কী চমৎকারভাবেÑ
আমরা যদি না জাগি মা
কেমনে সকাল হবে
তোমার ছেলে উঠলে মাগো
রাত পোহাবে তবে।”
কী মজার কথা! কী আনন্দের এবং উৎসাহের কথা! আমরা না জাগলে সকাল কী করে হবে! সকাল আনার জন্য আমাদের জাগতে হবে। জেগে উঠতে হবে স্বপ্ন বুকে করে। আশার আকাশ বুনে জাগতে হবে। জাগতে হবে প্রেরণার উচ্ছ্বাস থেকে। যারা বেহুঁশ তাদের চেতনা নেই। এমন বেহুঁশ এবং চেতনাহীন মানুষের বিরুদ্ধে নজরুল লিখেছেন নাড়া দেয়া গান কবিতা। পরিষ্কার করে বলেছেন-
“ঘুমাইয়া কাজা করেছ ফজর
তখনো জাগোনি যখন জোহর
হেলায় ফেলায় কাটিল আসর
মাগরিবের ঐ শুনি আজান
জামাতে শামিল হওরে এশাতে
এখনো জামাতে আছে স্থান।”
আহা কী অদ্ভুত বাণী! কী বিস্ময় চেতনা! কী ভালোবাসার উচ্চারণ। সময় গড়িয়ে গেছে। সব শেষ হয়ে গেছে তবুও আশা আছে। হে মানুষ জাগো। জেগে ওঠো সুন্দরের দিকে। সত্যের দিকে। এভাবে নজরুল জাগিয়েছেন মানুষকে। জেগে ওঠার কথা বলেছেন। লিখেছেন। গেয়েছেন। উচ্চারণ করেছেন অসাধারণ বাণী। সাবধান করেছেন গোটা জাতিকে। তার ভাষায়-
দুর্গম গীরি কান্তার মরু দুস্তর পারাবার
লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি নিশীথে যাত্রীরা হুঁশিয়ার।”
কাজী নজরুল ইসলাম চির উন্নত শির । তনয় সালেহাগোটা জাতিকে তিনি ডেকে বলেছেন এ কথা। বলেছেন তোমাদের সামনে দুর্গম পাহাড়। মরু। এবং ঝড় ঝঞ্ঝা। এসব পাড়ি দিতে হবে। পাড়ি দিয়ে যেতে হবে সাফল্যের কাছে। যেতে হবে গন্তব্যে। অমারাত্রির সমস্ত বাধা উপেক্ষা করে যেতে হবে। পথের সকল দুর্গমতা কাটিয়ে যেতে হবে। এবং নিশি রাতের ঘোর কাটিয়ে যেতে হবে। অতএব হুঁশিয়ার হে যাত্রীদল। তোমাদের অনেক বিবেচনা করে যেতে হবে। সাহস বাঁধতে হবে বুকে। হৃদয়ে রাখতে হবে ঝড় মোকাবেলার হিম্মত। তবেই তোমাদের পথ হবে রাজপথ। তোমাদের সাফল্য হবে বিশাল। এবং তোমাদের গন্তব্য হবে স্বচ্ছতায় উদ্ভাসিত। বীরদের ভালোবাসতেন নজরুল। যারা পথ চলে বুক ফুলিয়ে। যারা ভয়কে জয় করে ছোটে এবং যারা উদার দৃষ্টিতে চলে পথ। এমন মানুষেরা নজরুলের আকাক্সক্ষার মানুষ। এমন মানুষদের নজরুল খুঁজেছেন আজীবন। এ বিষয়ে তার কোনো দ্বিধা ছিলো না। ভণিতা ছিলো না। ছিলো স্বচ্ছতার আরশি। তার কথা দিয়েই তাকে চেনা যায়-
“বল বীর,
বল চির উন্নত মম শির।”
চির উন্নত শিরই ছিলো নজরুলের। তাই নজরুলও উন্নত শিরওয়ালাদের ভীষণ ভালোবাসতেন। এমন মানুষদের প্রতি নজরুলের ছিলো দারুণ পক্ষপাত। মহাবিদ্রোহী ঘোষণা দিয়ে বলেছেন –
“বিদ্রোহী রণ ক্লান্ত
আমি সেই দিন হব শান্ত
যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন রোল
আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না
অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ
ভীম রণভূমে রণিবে না।”
কী বিস্ময়কর উচ্চারণ! কী সাহসী উচ্চারণ! এবং মানুষের প্রতি তাঁর মমতা ভালোবাসা কতটা গাঢ়। নির্যাতিতদের পক্ষে তিনি ছিলেন ঢালস্বরূপ। আর যারা অত্যাচারী তাদের জন্য ছিলেন আণবিক বোমার মতো ভয়াবহ।
নজরুলকে তার সময়ের অপরাধীরা ভীষণ ভয় পেতো। অত্যাচারী শাসকের তিনি ছিলেন ভয়ের বিষয়। তাঁর ভয়ে শাসকশ্রেণি বুকে কম্পন অনুভব করতো। যে কারণে তাঁকে বারবার জেলে পুরেছে শাসকগোষ্ঠী। তাঁর প্রতিটি লেখায় কেঁপে উঠতো শাসকগোষ্ঠীর গদি। অত্যাচারীদের বুক কম্পনের নাম কবি নজরুল। তাঁর কবিতা সেই সাক্ষ্যই দেয়-
“উহারা চাহুক দাসের জীবন
আমরা শহিদী দরজা চাই
নিত্য মৃত্যু ভিতু ওরা মোরা
মৃত্যু কোথায় খুঁজে বেড়াই।”
যে কবি মৃত্যু খোঁজেন। যে কবি শহিদী দরজা খোঁজেন, তাকে মৃত্যুর ভয় কাবু করবে কী করে! তাঁর ঘোষণা তাই বিশ্ব ছড়ানো-
“আমি মহা বিদ্রোহী বীর
বিশ্ব ছাড়ায়ে উঠিয়াছি একা- চির উন্নত শির। ”

SHARE

Leave a Reply