রোববারের সকালটাতে ভীষণ মন খারাপ হয় ডাব্বুর।
চলে যাওয়া শুক্র আর শনিবার দু’টি দিন রাতের জন্য ভারী কান্না পায় ওর। বৃহস্পতিবারের বিকেল থেকে উপচে ওঠা খুশিতে ছোট্ট বুকের ভেতরটা টইটম্বুর হয়ে ওঠে। চিন্টুমামু বেড়াতে আসে। মা আর পাপার সাথে শিশুপার্কে নয়তো ওয়ান্ডারল্যান্ডে যায় ডাব্বু। এ দু’দিন পড়া ছাড়া আর সব কিছু হতে থাকে। ছুটির দু’টি দিন ভীষণ মজার।
রোববার সকালটা ভারী বিচ্ছিরি। এবার শুধু ছোটার পালা। জানালা দিয়ে তাকিয়ে ঝকঝকে নীল আকাশটাকে দেখতে দারুণ লাগে। মাঝে মাঝে বকের পালকের মতো টুকরো মেঘ।
ফাল্গুন মাস। হিমেল হাওয়া কোথায় যেন উধাও হয়ে গেছে আচমকা। আর শৈত্যপ্রবাহ? এর কথা ভাবলেই ডাব্বুর সারা শরীরটা শিরশির করে ওঠে, যা বাব্বা: টা টা বাই বাই করে বিদায় নিয়েছে ওরা। এখন শীত নেই। গরম এখনও জাঁকিয়ে বসেনি।
রিনা বলেছে, এখন বসন্তকাল, বুঝলে ডাব্বু! বসন্ত হলো ঋতুর রাজা।
– ঋতুর রাজা কী মা?
– ছয়টি ঋতু তো আমাদের বাংলাদেশে।
ডাব্বু বলে, আমি জানি সব জানি। টিপটিপ ম্যাডাম সব শিখিয়েছেন। গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত ও বসন্ত।
রিনা ছেলের মুখের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকে। তার ছেলে দুষ্টু সবাই বলে। কিন্তু মিষ্টিও তো কম নয়। খুব তাড়াতাড়ি সব শিখে নিতে পারে।
রিনা বলে, বসন্ত হলো সবচেয়ে সুন্দর ঋতু। ফুল ফোটে, পাখি গায়, শীত পালিয়ে যায়- আর কী বলোতো ডাব্বু।
ডাব্বু বলে, গরম এখনও আসেনি, তাই ঘামাচিও হয় না।
খুব ঘামাচি হয় ওর। মা কিছুক্ষণ পর পর প্রিকলি হিট পাউডার আদর করে মাখিয়ে দেয়।
ওপাশে শজনে, সুপারি আর নারকেল গাছের দিকে তাকিয়ে ওসব কথা মনে পড়তে থাকে ওর। ঘুমের ভাবটা কিছুতেই কাটতে চায় না। এই কাঁচা ভোরে।
মা গান গাইতে গাইতে এদিকেই আসছে।
‘প্রাণ ভরিয়ে তৃষা হরিয়ে
মোরে আরও আরও দাও প্রাণ’-
ফাল্গুনের এই চমৎকার ভোর মায়ের সুর মেখে আরও সোনালি হয়ে ওঠে।
– ও ডাব্বু, ওঠো ওঠো। সোয়া সাতটা বাজে তো। সোমনাথ, ডাব্বুর দাদু- কলেজে সাইকোলজি পড়াতেন। বড়দের মন শিশুমন ভালো বুঝতে পারেন।
বলেন, গোল্লুকে কেন ডিসটার্ব করছ?
ছেলেটা গাবলু গুবলু বলে সোমনাথ নাতিকে গোল্লু বলেই ডাকেন।
দাদুই শুধু তাকে বোঝে, আর কেউ তাকে বুঝতেই চায় না। দু’দিন একটানা ছুটির পর রোববারে ছোট মন যে বিষাদে ভরে যায়- তা মা, পাপা- চিন্টুমামু, স্কুলের টিচার- কেউ বোঝে না।
মায়ের তাড়ায় হাই তুলে বিছানা ছাড়তে হয় ওর।
এরপর শুরু হয় ইঁদুর-বেড়াল খেলা। ব্রাশে পেস্ট লাগাও, ওয়াশরুমে ঢুকো, চোখে-মুখে জলের ঝাপটা দিয়ে ঘুমপাড়ানো মাসী-পিসিকে তাড়াও।
বেসিনের সামনে দাঁড়িয়ে ডাব্বু দেখে ওর ঝকঝকে দাঁত। এখন ডাব্বু হারিয়ে যাবে, স্কুলের নাম ওর মাল্যবান। মাল্যবান, মাল্যবান।
আয়নাকে বিড়বিড় করে বলে, আবার তোমার সঙ্গে দেখা হবে স্কুল থেকে ফিরলে। তখন কথা হবে, কেমন? রিনার ডাকাডাকি শুরু হয়।
– কি রে ডাব্বু, ওয়াশরুমে ফ্রিজ হয়ে গেলি নাকি? আয় বাইরে আয়।
টেবিল ঘিরে বসা সবাই। পাপা, দাদান, চিন্টুমামা।
প্লেট থেকে ঘিয়ে ভাজা পরোটার গন্ধে ডাইনিং স্পেসটি ভরে আছে। বুক ভরে নিঃশ্বাস নেয় সে।
রোজ সে পাউরুটি-মাখন, পাউরুটি জেলি, ফলের রস খেয়ে স্কুলে যায়। আজ অন্যরকম খাবার, বিশেষ করে ডাব্বু পরোটা খেতে ভীষণ পছন্দ করে।
স্কুল ড্রেসের ওপর মা টাওয়েল চড়িয়ে দিয়েছেন, নয়তো পরোটার টুকরো, ওমলেটের পেঁয়াজ টম্যাটো লেগে একসা হয়ে যাবে ড্রেস।
রিনা কাজ করছে, নিজে তৈরিও হচ্ছে। ছেলেকে স্কুলে দিয়ে নিজে কাজের জায়গায় যাবে। হাইস্কুলে পড়ায় রিনা।
ছেলেকে নিয়ে রিকশায় উঠে সবে গুছিয়ে বসেছে রিনা। পাশের বাড়ির সরফরাজ আংকেল বলেন, ক্যায়া হুয়া বেটি?
ওরা দিল্লির লোক। অনেক বছর আগে থেকে ইস্কাটন গার্ডেন রোডে থাকেন। সোমনাথ দাদানের বয়সের কাছাকাছি। দু’জনে মিলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাবা খেলে কাটিয়ে দেন।
– কী আর হবে আংকেল। স্কুলে যাবার সময় মুখ এমনই গোমড়া থাকে ওর ।
ঠা ঠা করে সকালের বাতাস কাঁপিয়ে সরফরাজ হাসেন।
– আরে ভাইয়া, স্কুল ছোড়ো, ডাঙ্গুলি খেল। এটা কিন্তু আমারও হতো ডাব্বু সাহেব।
পাপড়ি ঘেরা বড় বড় চোখ তুলে ডাব্বু তাকায়। এ জন্য বুড়ো এই দাদানকে ওর ভালো লাগে।
পাশে থেকে গাজালা দিদুন বলে, তোমার বাত তো খতম হোবে না, চলো চলো ওদের তাড়া আছে। রিকশা চলতে শুরু করেছে।
ডাব্বু বলল, মা দেখেছ- সরফরাজ দাদানেরও স্কুলে যাবার সময় মন খারাপ হতো।
রিনা স্নিগ্ধ সুরে বলেন, বড়রা ছোটদের সামনে ওরকম বলেই থাকেন।
ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে আদুরে গলায় মা বলে, আচ্ছা ডাব্বু, স্কুলে কত খুশির ব্যাপার রয়েছে, তারপরও তুমি স্কুলে যেতে মন খারাপ করো, ব্যাড, ভেরি ব্যাড।
ছেলে অবাক হয়ে বলে, স্কুলে আমার কোনো খুশির ব্যাপার ঘটেনি মা।
– ইয়ু আর লায়িং।
রিনা বলে, মনে নেই তোমার? স্কুলের ঝুমঝুম ম্যাম বলেছিলেন- তোমরা কে কে ঢেঁকি চেন বলতো? হাত তোল।
– হ্যাঁ হ্যাঁ। মাথা নাড়ে ডাব্বু।
– তুমি আর তোমার বন্ধু তাথৈ হাত তুলেছিলে।
– হ্যাঁ হ্যাঁ মা, এবার মনে পড়েছে। আমি নেচে নেচে গানও গেয়েছি-
‘ও ধান বানি রে। ঢেঁকিতে পাড় দিয়া
ঢেঁকি নাচে আমি নাচি। হেলিয়া দুলিয়া।
মা মিষ্টি করে চোখ পাকিয়ে বলেন, বানি নয় রে বোকা, হবে ধান ভানি রে।
খুব হাসে ডাব্বু। নট বানি ইট ইজ ভানি। ভানি ভানি ভানি।
– ম্যাম তোমার মতোই কারেক্ট করে দিয়েছেন। কিন্তু মা, আমি কি করব। বিনিমাসী তো নেচে নেচে ওভাবেই গায়।
রিনা বলে, ভাগ্যিস তুমি মামাবাড়ি গেছিলে। না হলে তো ঢেঁকি দেখতেই পেতে না। তবে বিনির প্রোনানসিয়েশন ঠিক না।
– তা অবশ্য ঠিক। মাথা নাড়ে ডাব্বু।
– আরও আনন্দের ব্যাপার আছে।
– কই, আমার তো মনে পড়ছে না, মামণি।
– এই তো তোমার দোষ ডাব্বু, তুমি সব ভুলে যাও, ছবি আঁকার ক্লাসে মধুরা ম্যাম গাছ আর বুনো ঝোপের ছবি আঁকতে দিয়েছিলেন। আনন্দের মুহূর্তগুলোকে মনে রাখতে হয়।
– ইয়েস মা। সবাই কী চমৎকার সবুজ রঙ দিয়ে পাতাগুলো এঁকেছিল। আমি কেমন বোকা বুদ্ধু দ্যাখো-
হাসিমুখে রিনা বলে, নো নো ডাব্বু, তুমি বোকা নও, বুদ্ধুও নও। ইয়ু আর ইনটেলিজেন্ট মাল্যবান।
– ইয়ু আর রাইট মা। আমি দিয়েছিলাম বিস্কিট রঙ। ক্লাসের বন্ধুরা সবাই হাসাহাসি করেছে। ইয়ু আর নাম্বার ওয়ান ফুল মাল্যবান। মধুরা ম্যাম বলেছেন, নো নো- মাল্যবান মোটেও ফুল নয়। ওর ভাবনাটা তোমাদের সবার চেয়ে একটু আলাদা। তোমাদের সবার ভাবনা এক, ওর অন্য রকম।
– কী রকম ম্যাম?
– যখন শীত শেষ হয়ে আসে, গাছ থেকে পাতা ঝরে তখন কি আর পাতাগুলো সবুজ থাকে?
– নো নো ম্যাম।
– তাহলে? মাল্যবান ঝরে যাওয়া শোকনো পাতা এঁকেছে! কী চমৎকার বিস্কিট রঙ করেছে। ওর ভাবনাকে আমি স্যালুট করি।
– হ্যাঁ মামণি। (ডাব্বুর মন ভালো থাকলে তাকে তাই ডাকে) আনন্দের কথাগুলো আমি ভুলে যাই। ভুল করলে ম্যামরা বকুনি দেন। অ্যাপ্রিসিয়েটও করেন।
স্কুলের গেটের সামনে রিকশা থামে। রিনা বলে,- বাই ডাব্বু, ভালো হয়ে থেকো।
ছেলের গোমড়া মুখটি আলোর আভায় ভরে উঠেছে।
বিনি নামের মাঝবয়সী মেয়েটি বাড়িতে রাঁধে বাড়ে। ও এই পরিবারের একজন হয়ে গেছে। একেবারে আপনজন।
বিনিমাসীর হাত ধরে রিকশা থেকে নামে ডাব্বু। ব্যাস এরপরই শুরু হয় দাপাদাপি, ঝাঁপাঝাঁপি।
দৌড়ে গিয়ে লিফটের ঘরে ঢুকে যায় ও।
– ডাব্বু, ও ডাব্বু, না বাবা, আর পারি না, তিন তলায় বাসা। কেন, সিঁড়ি ভেঙে যেতে পারো না?
– না পারি না।
ডাব্বুর কথা শেষ হতে না হতেই লিফটের দরজা বন্ধ হয়ে যায়।
বিনিমাসী একা একা গজগজ করতে করতে সিঁড়ি ভাঙে। পত্রিকায় খবর এসেছে লিফটের দড়ি ছিঁড়ে মারা গেছে দু’জন, আহত হয়েছে সাত-আটজন। টিভিতে সেদিন দেখিয়েছে এই খবরটি।
মা-বাবার সাথে লিফটে একশ বার উঠো ক্ষতি নেই, আমার সঙ্গে সিঁড়ি ভেঙে আসতে দোষটা কোথায় শুনি? তিনতলা বৈ তো নয়।
বাসার দরজার সামনে দাঁড়িয়ে হি হি করে হাসে ডাব্বু।
– তোমার আগে এসে গেছি মাসী।
– বেশ করেছ।
বিনি গম্ভীর মুখে স্কুল ড্রেস পাল্টে বাসার প্যান্ট গেঞ্জি পরিয়ে দেয়। এবার লেবুর শরবত দেয়ার পালা।
– না না লেবুর শরবত আমি খাবো না, খাবো না।
ফ্রিজ খুলে কোকাকোলার বোতল বের করে গ্লাসে ঢালে ডাব্বু।
বিনি বলে, কেন অমন করো সোনা, তোমার না ঠাণ্ডায় এলার্জি। এই তো ঠাণ্ডা খেলে তোমার সর্দিকাশি হবে।
দাদুর ঘরে সরফরাজ আর সোমনাথ দাবার ঘুঁটি সাজিয়ে বসেছেন।
– এসে গেছ গাবলুগুবলু?
– হ্যাঁ দাদান।
– বিনির কথা শুনছ না কেন? ও তোমার চেয়ে বড়, তোমাকে ভালোবাসে। মা-বাবা যখন ঘরে থাকে না তোমাকে খেতে দেয়। সরফরাজ বলেন, ইয়ে আচ্ছি বাত নেহি হে ডাব্বু, বিনিকে বলো চায়ে ওর নাশতা লানে কো লিয়ে।
নাশতা, ওফ্ দারুণ।
মা সরফরাজ দাদানের জন্য মতিচুরের লাড্ডু ঘরে রাখেন। ও নিজেও খুব পছন্দ করে।
খুশ খুশি গলায় বলে, ও মাসী, দাও – লেবুর শরবতটা দাও তো, ঠাণ্ডা এখন খাবো না। দাদানদের যখন লাড্ডু, পাঁপর দেবে আমাকেও দিয়ো।
– সে তো দেবোই বাবা, যাও ঘরে বসে ছবি আঁকো তো। লাড্ডু আর মুচমুচে পাঁপর খেতে খেতে ভাবতে থাকে ও।
কী আঁকবে? আকাশের নানা রঙের মেঘ! চড়ুই শালিক পাখি, গাছগাছালি।
জানালা দিয়ে রোদমাখা আকাশটির দিকে তাকায়। ঝকঝকে আকাশে কিছু সাদা মেঘ, কিছু গোলাপি মেঘ, কিছু ধূপছায়া রঙের।
কী রঙ দেবে ও? নানা রঙের মেঘ এঁকে মাল্টিকালার করে দেবে ছবির পাতা।
কিচির মিচির করছে দু’ চারটে চড়ুই পাখি। দুটো শালিক এসে জুটেছে ওদের সাথে। চড়ুইগুলো টবের গাছে কী যেন খুঁটে খুঁটে খাচ্ছে।
– হ্যালো ডাব্বু, মন খারাপ নাকি।
মা-পাপা যখন থাকে না, দাদান যখন তার নিজের ঘরে সরফরাজ দাদান নয়তো রবিউল দাদানের সাথে দুনিয়ার গপ্পোতে মেতে থাকেন, বিনিমাসী এই ভরপুদুরে ছ্যাঁক ছ্যাঁক ছ্যাঁক করে মাছ ভাজে, এলাচি-লবঙ্গ-দারুচিনি আর ঘি দিয়ে মুরগির ঝোল রান্না করে- তখন ডাব্বু একা, ভীষণ একা। তখন ওর বুকের ভেতরটা ফাঁকা হয়ে যায়।
[চলবে]