রাশিয়া আয়তনের দিক দিয়ে বিশ্বের বৃহত্তম দেশ। দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ কানাডার চেয়ে এর আয়তন প্রায় দ্বিগুণ। পূর্ব ইউরোপ ও উত্তর এশিয়াজুড়ে রাশিয়া বিস্তৃত। তাই রাশিয়া একটি আন্তঃমহাদেশীয় রাষ্ট্র। দেশটির সরকারি নাম রুশ ফেডারেশন। রাজধানী মস্কো রাশিয়ার বৃহত্তম শহর এবং দেশের প্রধান প্রশাসনিক, বাণিজ্যিক, শিল্প ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। পৃথিবীর মোট আবাসযোগ্য জমির আট ভাগের এক ভাগ পড়েছে রাশিয়ায়। আয়তনের বিশালত্বের কারণে দেশটি নয়টি সময় অঞ্চলের (Time zone)) অন্তর্ভুক্ত। এখানে অনেক রকম ও বিস্তৃত পরিবেশের সমন্বয় ঘটেছে।
রাশিয়ার উত্তর-পশ্চিম থেকে দক্ষিণ-পূর্ব পর্যন্ত নরওয়ে, ফিনল্যান্ড, এস্তোনিয়া, লাটভিয়া, লিথুয়ানিয়া ও পোল্যান্ড (উভয় দেশই কালিনিনগ্রাদ অবলাস্ত সীমান্ত দিয়ে যুক্ত), বেলারুশ, ইউক্রেন, জর্জিয়া, আজারবাইজান, কাজাখস্তান, চীন, মঙ্গোলিয়া ও উত্তর কোরিয়ার সাথে রাশিয়ার সীমান্ত রয়েছে। দেশটির অখতস্ক সাগরের মাধ্যমে জাপানের সাথে ও বেরিং প্রণালীতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আলাস্কার সাথে সামুদ্রিক সীমানা রয়েছে।
রাশিয়া জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য এবং বিশ্বের পারমাণবিক শক্তিধর শীর্ষ পাঁচটি দেশের মধ্যে অন্যতম। দেশটি একসময় সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর পৃথক রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে রাশিয়া। আন্তর্জাতিকভাবে রাশিয়াকে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের উত্তরসূরি দেশ বলা হয়। সাংবিধানিকভাবে বিশ্বেরত প্রথম সমাজতান্ত্রিক দেশ রাশিয়া।
রাশিয়ার সরকারব্যবস্থা বহুদলীয় গণতন্ত্র। জনগণের সরাসরি ভোটে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করা হয়। দেশটির বর্তমান প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এবং প্রধানমন্ত্রী দিমিত্রি মেদভেদেভ। রাশিয়া হলো একটি আধা রাষ্ট্রপতি শাসিত দেশ যেখানে প্রেসিডেন্ট সর্বময় ক্ষমতার মালিক। তিনি প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ দিয়ে থাকেন। পার্লামেন্টের নাম ডুমা। ডুমা ১৭০ সদস্যের উচ্চকক্ষ এবং ৪৫শ সদস্যের নিম্নকক্ষ -এই দুই ভাগে বিভক্ত।
দেশটি আধা প্রেসিডেন্সিয়াল ফেডারেল প্রজাতন্ত্র। এদেশের প্রশাসনিক এলাকা ৮৫টি অঞ্চলে বিভক্ত। এগুলোর মধ্যে রয়েছে ৪৬টি অবলাস্ট (প্রদেশ), ২২টি স্বায়ত্তশাসিত রিপাবলিক (প্রজাতন্ত্র), ৯টি ক্রাইস (অঞ্চল), ৪টি স্বায়ত্তশাসিত জেলা, ১টি স্বায়ত্তশাসিত অবলাস্ট এবং ৩টি ফেডারেল সিটি (মস্কো, সেন্ট পিটার্সবার্গ ও সেভাসটোপল)।
রাশিয়ার মোট আয়তন ১ কোটি ৭১ লাখ ২৫ হাজার ২০০ বর্গ কিলোমিটার (৬৬ লাখ ১২ হাজার ১০০ বর্গমাইল) এবং জনসংখ্যা ১৪ কোটি ৬৮ লাখ ৭৭ হাজার ৮৮ জন। জনসংখ্যার দিক দিয়ে রাশিয়া বিশ্বের নবম জনবহুল দেশ। রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় ভাষা রুশ। প্রায় ৮০ শতাংশ লোক এ ভাষায় কথা বলে। দেশটির বিভিন্ন অঞ্চলে রুশ ছাড়া আরও ২৭টি ভাষা প্রচলিত আছে। এগুলোর মধ্যে কতগুলো ভাষার আঞ্চলিক সহসরকারি মর্যাদা আছে, যেমন চেচেন, চুভাশ, কালমিক, কাবার্দিয়ান, কোমি, মারি, মর্দভিন, ওসেটীয়, তাতার, তুভিন, উদমুর্ত, ইয়াকুত, অ্যাভার, বুরিয়াত, বাশকির ইত্যাদি। এ ছাড়া বেশ কিছু মধ্য ইউরোপীয় ভাষা যেমন জার্মান, পোলীয় এবং য়িডিশ ভাষা প্রচলিত আছে। জিপসি বা রোমানি ভাষায়ও অনেকে কথা বলে।
রাশিয়ার প্রধান ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে রয়েছে খ্রিষ্টান (৪৭%), মুসলিম (১৫%), বৌদ্ধ (০.৫%) ও ইহুদি। মুসলমানেরা প্রধানত থাকেন ভলগা তাতারস, বশখিরস ও তাতার অঞ্চলে। ইসলাম রাশিয়ার চারটি প্রধান ধর্মের মধ্যে অন্যতম। শুরু থেকেই রাস এবং এর উত্তরসূরি রাষ্ট্রসমূহ প্রতিবেশী, শাসক বা প্রজা হিসেবে মুসলিমদের সংস্পর্শে আসে। মুসলিম ভূমিসমূহ থেকে দূরপাল্লার রৌপ্য বাণিজ্য প্রথম রুশ রাষ্ট্রসমূহ প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেত এবং খ্রিষ্টধর্মের পূর্বে ইসলাম ধর্ম রুশ ভূমিতে পৌঁছায়। ৯৮৮ সালে কিয়েভান রাসের শাসক ভ্লাদিমিরের খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণের কয়েক দশক আগেই দশম শতাব্দীর মধ্যভাগে ভোলগা বুলগার রাষ্ট্রের শাসকরা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। ১২৩৬ থেকে ১২৩৭ সালের মধ্যে মোঙ্গলরা ভোলগা বুলগার রাষ্ট্র ধ্বংস করে দেয় এবং এরপর সমগ্র রুশ ভূমিকে পদানত করে। ১৩২৭ সালে গোল্ডেন হোর্ডের শাসক উজবেক খান ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন এবং এর ফলে এক শতাব্দীরও বেশি সময়ের জন্য রুশ ভূমিসমূহের কর্তৃত্ব মুসলিমদের হাতে ন্যস্ত হয়। এরপর মাস্কোভি ও গোল্ডেন হোর্ডের মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্যের পরিবর্তন ঘটতে থাকলে মস্কোর রাজপুরুষেরা ক্রমাগত গোল্ডেন হোর্ডের উত্তরাধিকার সংক্রান্ত সংঘর্ষে সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে পড়েন। ১৫৫২ সালে রাশিয়াত জার চতুর্থ আইভান গোল্ডেন হোর্ডের উত্তরসূরি রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য রাষ্ট্র কাজান দখল করেন এবং ভৌগোলিক সম্প্রসারণের এক সুদীর্ঘ প্রক্রিয়া আরম্ভ করেন। ক্রমে ক্রিমিয়া, ককেশাস এবং মধ্য এশিয়া রাশিয়ার পদানত হয় এবং এর ফলে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষদিকে বহু মুসলিম জাতি রুশ শাসনাধীনে আসে। ১৯৯৭ সালে রুশ সংবিধানে খ্রিস্টধর্ম, বৌদ্ধধর্ম এবং ইহুদিধর্মের পাশাপাশি ইসলাম ধর্মকেও রাশিয়ার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়। বর্তমানে রাশিয়ার মোট জনসংখ্যার প্রায় ১৫% ইসলাম ধর্মাবলম্বী।
রাশিয়া নামটি রুশ নামক মধ্যযুগীয় একটি রাষ্ট্র থেকে এসেছে। সেখানকার অধিকাংশ জনগণই ছিল ইস্ট স্লাভ গোত্রের অন্তর্গত। পরবর্তী ইতিহাসে এই নামটি আরও বিশিষ্ট হয়ে ওঠে। দেশটিকে এর জনগণ রুশকায়া যেমল্যা বলে ডাকতো যার অর্থ দাঁড়ায় রুশ ভূমি। রাশিয়া ও এই রাষ্ট্র হতে উদ্ভূত রাষ্ট্রের নামের পার্থক্য করার জন্য আধুনিক ইতিহাসে একে কিয়েভান রুশ বলে ডাকা হয়। রুশ নামটি রুশ নামের একটি গোত্র থেকে এসেছে যারা ছিল মূলত ভারাঞ্জিয়ানদের একটি দল (সম্ভবত সুইডিশ ভাইকিং) এবং এরাই প্রথম রুশ নামে একটি রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে।
রুশ শব্দটির পুরনো ল্যাটিন ভাষার একটি সংস্করণ ছিল রুথেনিয়া, যেটি দক্ষিণ ও পশ্চিম রুশে বেশি ব্যবহার করা হতো এবং এই অঞ্চলটা ক্যাথলি ইউরোপ সংলগ্ন ছিল। দেশটির বর্তমান নাম রাশিয়া কিয়েভান রাশ এর বাইজান্টাইন গ্রিক শব্দ রোসিয়া থেকে এসেছে। রাশিয়ার নাগরিকদের রুশ বলা হয়।
দেশটির ইতিহাস শুরু হয় তৃতীয় ও অষ্টম খ্রিষ্টাব্দের মধ্যবর্তী সময়ে। তখন পূর্ব স্লাভরা ইউরোপে একটি স্বীকৃতিযোগ্য জাতি হিসেবে আবির্ভূত হয়। পরবর্তীতে ভারাঞ্জিয়ান যোদ্ধা ও তাদের অধস্তন বংশধরদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত ও শাসিত মধ্যযুগীয় রাস রাষ্ট্রের উত্থান নবম শতকে শুরু হয়। ৯৮৮ খ্রিস্টাব্দে বাইজান্টাইন সাম্রাজ্য থেকে গোঁড়া খ্রিষ্টান রীতি গৃহীত হয়। এর ফলে বাইজান্টাইন ও স্লাভ সংস্কৃতির সংমিশ্রণ ঘটে যা পরবর্তী সহস্রাব্দ পর্যন্ত বহাল থাকে। রাশিয়া অনেকগুলো ছোট ছোট অঞ্চলে ভাগ হয়ে যায় এবং বেশির ভাগ জমি মোঙ্গলদের আক্রমণে পদদলিত হয় এবং যাযাবরদের জন্য স্বর্গ হয়ে ওঠে। মস্কোর গ্র্যান্ড ডিউক শেষ পর্যন্ত পার্শ্ববর্তী রুশ অঞ্চলে আধিপত্য বিস্তার করেন এবং যাযাবরদের কাছ থেকে স্বাধীনতা অর্জন করেন। অষ্টাদশ শতক পর্যন্ত এই জাতিটি বিজয়, কুক্ষিগতকরণ এবং অভিযানের মাধ্যমে ব্যাপকভাবে সাম্রাজ্য সম্প্রসারণ করে ইউরোপের পোল্যান্ড থেকে উত্তর আমেরিকার আলাস্কা পর্যন্ত বিস্তৃতি লাভ করে এবং ইতিহাসে তৃতীয় বৃহত্তম সাম্রাজ্যে পরিণত হয়।
রুশ বিপ্লবের পর রুশীয় সোভিয়েত যুক্তরাষ্ট্রীয় সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র সোভিয়েত ইউনিয়নের বৃহত্তম, নেতৃস্থানীয় ও প্রয়োজনীয় সদস্য হয়ে ওঠে, যা সংবিধান অনুযায়ী একটি সমাজতান্ত্রিক দেশ। এ সময় এটি অত্যন্ত শক্তিশালী দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। যেটি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নিষ্পত্তিমূলক ভূমিকা পালন করে। সোভিয়েত যুগ বিংশ শতকের কিছু উল্লেখযোগ্য প্রযুক্তিগত সাফল্য পেয়েছিল। যার মধ্যে ছিলত বিশ্বের প্রথম মহাকাশযান ও প্রথম নভোচারী। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়ার পর সোভিয়েতের রুশীয় প্রজাতন্ত্র রুশ ফেডারেশন হিসেবে গঠিত হয় এবং একক রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃত হয়।
বিশাল রাশিয়ার প্রকৃতি একই সাথে বৈচিত্র্যময় ও বৈচিত্র্যহীন। উত্তর থেকে দক্ষিণে তুন্দ্রা, তৈগা, স্তেপ ও অর্ধ-ঊষর মরুভূমি বিস্তৃত। দেশটিতে ইউনেস্কো ঘোষিত ৪০টি জীবমণ্ডল সংরক্ষণ এলাকা রয়েছে। রাশিয়া প্রথম শীতলতম দেশ বলে এ দেশে সারা বছর হিমশীতল এবং শৈত্যপূর্ণ আবহাওয়া বিরাজ করে। অতিরিক্ত আর্কটিক বরফাচ্ছন্ন পরিস্থিতি, অতি উচ্চভূমি এবং রুশ প্রকৃতির কারণ শৈত্যপ্রবাহ সৃষ্টি হয় এবং সারাদিন শৈত্যপ্রবাহ চলতে থাকে। এই দেশে বছরে ১০ মাস শৈত্যপ্রবাহ (সেপ্টেম্বর- মে) এবং ৮ মাস বরফাচ্ছন্ন (অক্টোবর- এপ্রিল) অবস্থা থাকে। রাশিয়ার সাইবেরিয়া এলাকায় সারাদিন ঠাণ্ডা ও শৈত্যপ্রবাহ থাকে এবং পশ্চিম- দক্ষিণাংশে গরম থাকে।
রাশিয়ার অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তি প্রাকৃতিক সম্পদ। তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস থাকার কারণে দেশটি ১৯৯৮ সালের অর্থনৈতিক সঙ্কট কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়। রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ‘গ্যাজপ্রম’ বিশ্বের সবচেয়ে বড় গ্যাস উৎপাদনকারী ও রফতানিকারী প্রতিষ্ঠান। ইউরোপের ক্রমবর্ধমান গ্যাস চাহিদা মিটিয়ে চলেছে গ্যাজপ্রম। দেশটির মুদ্রার নাম রুবল।
রাশিয়ার ব্যাপক খনিজ ও জ্বালানি সম্পদের মজুদ বিশ্বে বৃহত্তম। এটি বিশ্বের সর্বোচ্চ তেল ও গ্যাস উৎপাদনকারী দেশ। দেশটি পারমাণবিক শক্তিসম্পন্ন পাঁচটি স্বীকৃত দেশের মধ্যে অন্যতম এবং দেশটির বিশ্বের বৃহত্তম ধ্বংসাত্মক অস্ত্রভাণ্ডার রয়েছে। রাশিয়া একটি পরাক্রমশালী রাষ্ট্র যেটি জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য এবং জি ৮, জি ২০, দি কাউন্সিল অব ইউরোপ, দি এশিয়া প্যাসিফিক ইকোনমিক কো-অপারেশন, সাংহাই সহযোগিতা সংস্থা, ইউরেশীয় অর্থনৈতিক কমিউনিটি, ইউরোপ নিরাপত্তা সংগঠন কাউন্সিল (ওএসসিই) ও বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সদস্য। স্বাধীন রাষ্ট্রের কমনওয়েলথের অন্যতম সদস্য।
খেলাধুলায় রাশিয়া খুবই অগ্রসর। সর্বকালীন অলিম্পিক গেমসের পদক তালিকায় রাশিয়া দ্বিতীয় স্থানে অবস্থান করছে। ১৯৮০ গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিক ও ২০১৪ শীতকালীন অলিম্পিক রাশিয়ায় অনুষ্ঠিত হয়। ২০১৮ সালে দেশটি প্রথমবারের মতো ফিফা বিশ্বকাপ আয়োজন করে।