Home দেশ-মহাদেশ কুয়েত মধ্যপ্রাচ্যের তেলসমৃদ্ধ ছোট্ট দেশ । মুহাম্মদ আশরাফুল ইসলাম

কুয়েত মধ্যপ্রাচ্যের তেলসমৃদ্ধ ছোট্ট দেশ । মুহাম্মদ আশরাফুল ইসলাম

kwiet
কুয়েতের
পার্লামেন্ট ভবন

কুয়েত পশ্চিম এশিয়ার একটি আরব দেশ। সরকারি নাম দৌলত আল কুয়েত বা কুয়েত রাষ্ট্র। কুয়েতের রাজধানী ও বৃহত্তম শহর কুয়েত সিটি। কুয়েত পারস্য উপসাগরের সরু প্রান্তে আরব উপদ্বীপের উত্তর-পূর্ব কোণে অবস্থিত। কুয়েত ভূমির আয়তনের দিক দিয়ে বিশ্বের অন্যতম সবচেয়ে ছোট দেশ। ইরাক ও সৌদি আরবের সাথে এ দেশের স্থলসীমান্ত রয়েছে এবং সমুদ্রসীমান্ত রয়েছে ইরাক, সৌদি আরব ও ইরানের সাথে। কুয়েতের বেশির ভাগ জুড়ে রয়েছে সমতল, বালুকাময় আরব মরুভূমি। কুয়েত সাধারণভাবে নিম্নভূমি এবং এ দেশের সর্বোচ্চ স্থান সমুদ্র স্তর থেকে ৩০৬ ফুট ওপরে।

শেখ জাবের আল-আহমদ সাংস্কৃতিক কেন্দ্র
শেখ জাবের আল-আহমদ সাংস্কৃতিক কেন্দ্র

কুয়েতের নয়টি দ্বীপ আছে। এগুলোর মধ্যে একমাত্র ফাইলাকা দ্বীপ ছাড়া বাকি সবগুলোই জনবসতিহীন। ৮৬০ বর্গকিলোমিটার (৩৩০ বর্গ মাইল) আয়তন বিশিষ্ট বুবিয়ান কুয়েতের বৃহত্তম দ্বীপ এবং ২,৩৮০ মিটার (৭,৮০৮ ফুট) দীর্ঘ একটি সেতুর মাধ্যমে দেশের অবশিষ্ট অংশের সাথে যুক্ত। কুয়েতের ০.৬ শতাংশ ভূমি আবাদযোগ্য এবং এর ৪৯৯ কিলোমিটার (৩১০ মাইল) উপকূল রেখায় বিক্ষিপ্ত গাছপালা দেখা যায়। কুয়েত সিটি কুয়েত উপসাগরে অবস্থিত। আর কুয়েত উপসাগর হচ্ছে একটি প্রাকৃতিক গভীর পানির পোতাশ্রয়।

কুয়েতের জাতীয় জাদুঘর
কুয়েতের জাতীয় জাদুঘর

কুয়েতের আয়তন ১৭ হাজার ৮১৮ বর্গ কিলোমিটার (৬,৮৮০ বর্গমাইল)। জনসংখ্যা ৪৪ লাখ ৩৭ হাজার ৫৯০ জন। এদের মধ্যে কুয়েতি ১৩ লাখ এবং প্রবাসী ২৯ লাখ। অর্থাৎ দেশটির মোট জনসংখ্যার ৭০ শতাংশই প্রবাসী। জাতিগত গ্রুপের মধ্যে রয়েছে ৬০ শতাংশ আরব (৩১ শতাংশ কুয়েতি এবং ২৯ শতাংশ অন্যান্য আরব), ৩৭.৮ শতাংশ দক্ষিণ এশীয় এবং ১.৯ শতাংশ আফ্রিকান। প্রধান ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে রয়েছে মুসলিম ৭৪.৬ শতাংশ, খ্রিষ্টান ১৮.২ শতাংশ এবং অন্যান্য ৭.২ শতাংশ।
কুয়েতে ১৯৩৮ সালে বাণিজ্যিক পরিমাণে তেলের মজুদ আবিষ্কৃত হয়। ১৯৪৬ সাল থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত এদেশে ব্যাপক আকারে আধুনিকায়ন হয়। ১৯৮০’র দশকে পুঁজিবাজার ধসের পরিপ্রেক্ষিতে কুয়েতে ভূরাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও অর্থনৈতিক সঙ্কট দেখা দেয়। ১৯৯০ সালে প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনের নেতৃত্বে ইরাক কুয়েতে আগ্রাসন চালায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে একটি সামরিক কোয়ালিশনের হস্তক্ষেপের ফলে ১৯৯১ সালে কুয়েতে ইরাকি দখলের অবসান ঘটে। কুয়েত যুক্তরাষ্ট্রের একটি প্রধান অ-ন্যাটো মিত্র। কুয়েত আসিয়ানেরও বড় মিত্র এবং চীনের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখে চলে।
আধা-গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থাসহ কুয়েত একটি সাংবিধানিক সার্বভৌম রাষ্ট্র। সরকারব্যবস্থা একক সাংবিধানিক রাজতন্ত্র। আমির রাষ্ট্রপ্রধান। এদেশের বিদ্যমান রাজনৈতিক ব্যবস্থা নির্বাচিত পার্লামেন্ট এবং নিযুক্ত সরকারে বিভক্ত। বর্তমান আমির সাবাহ আহমদ আল-সাবাহ এবং প্রধানমন্ত্রী জাবের মুবারক আল-সাবাহ। পার্লামেন্টের নাম জাতীয় পরিষদ বা ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি। কুয়েতের পার্লামেন্ট পঞ্চাশ জন নির্বাচিত সদস্য নিয়ে গঠিত এবং প্রতি চার বছর অন্তর এর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। পার্লামেন্টের তত্ত্বাবধান ক্ষমতা রয়েছে। পার্লামেন্ট সরকারের কাজকর্মের ব্যাপারে অনুসন্ধান চালাতে পারে এবং অনাস্থা প্রস্তাব পাস করতে পারে বিধায় কুয়েতে ক্ষমতার ভারসাম্য বজায় রয়েছে। সাংবিধানিক বিধানের ভিত্তিতে কতিপয় শর্তে পার্লামেন্ট ভেঙে দেয়া যেতে পারে। সাংবিধানিক আদালত ও আমির উভয়েরই পার্লামেন্ট ভেঙে দেয়ার ক্ষমতা রয়েছে, তবে সাংবিধানিক আদালত আমিরের পার্লামেন্ট ভেঙে দেয়ার সিদ্ধান্তকে অবৈধ ঘোষণা করতে পারে।
কুয়েত একসময় ইংরেজদের অধীনে ছিল। ১৯৬১ সালে ইংরেজদের কাছ থেকে দেশটি স্বাধীনতা লাভ করে। কুয়েতের সংবিধান ১৯৬২ সালে প্রণয়ন করা হয়। নাগরিক স্বাধীনতা ও রাজনৈতিক অধিকারের দিক দিয়ে কুয়েত মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে মুক্ত দেশ। কুয়েতের প্রশাসনিক এলাকা ছয়টি গভর্নরেটে বিভক্ত। সেগুলো হলো আল আসিমাহ, হাওয়ালি, ফারওয়ানিয়া, মুবারক আল-কাবির, আহমদি ও জাহরা। গভর্নরেটগুলো আবার বিভিন্ন এলাকায় বিভক্ত।
বিশ্বের ষষ্ঠ বৃহত্তম তেল মজুদের সুবাদে কুয়েত একটি উচ্চ আয়ের অর্থনীতির দেশও বটে। কুয়েতি দিনার বিশ্বের সর্বোচ্চ মূল্যের মুদ্রা। বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী দেশটির মাথাপিছু আয় বিশ্বে চতুর্থ সর্বোচ্চ। উপসাগরীয় সহযোগিতা সংস্থায় কুয়েত কাতারের পর দ্বিতীয় সবচেয়ে ধনী দেশ। পেট্রোলিয়াম এদেশের প্রধান রফতানি পণ্য। জিডিপির অর্ধেক এবং সরকারি আয়ের ৯০ শতাংশ আসে পেট্রোলিয়াম থেকে। পেট্রোলিয়াম বহির্ভূত শিল্পের মধ্যে রয়েছে আর্থিক সেবা।
কুয়েতের আবহাওয়া খুবই বৈচিত্র্যময়। মার্চে বসন্তকালে আবহাওয়া উষ্ণ থাকে এবং প্রায়ই বজ্রসহ ঝড় হয়। উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে ঘনঘন শীতকালে ঠাণ্ডা এবং গ্রীষ্মকালে গরম বাতাস আসে। জুলাই ও অক্টোবর মাসের মধ্যবর্তী সময়ে দক্ষিণ-পূর্ব দিক থেকে আর্দ্র বাতাস আসে। জুন ও জুলাই মাসে শামল নামে উত্তর-পশ্চিম দিক থেকে এক ধরনের বাতাস আসে যার ফলে নাটকীয় বালুঝড় হয়। গ্রীষ্মকালে কুয়েত যেন পৃথিবীর সবচেয়ে গরম স্থান। এখানে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে ৫৪.৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস, যা এশিয়ায় রেকর্ডকৃত সর্বোচ্চ তাপামাত্রা। ইরাক ও ইরানের উত্তরে অবস্থানের কারণে কুয়েতে উপসাগরীয় সহযোগিতা সংস্থার দেশগুলোর তুলনায় বেশি ঠাণ্ডা পড়ে।
ফুটবল কুয়েতের সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা। কুয়েত ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন (কেএফএ) হচ্ছে দেশটির ফুটবল খেলা পরিচালনা সংস্থা। কুয়েত প্রিমিয়ার লিগে ১৮টি দল অংশগ্রহণ করে থাকে। কুয়েত ১৯৮০ এএফসি এশিয়ান কাপে চ্যাম্পিয়ন, ১৯৭৬ এএফসি এশিয়ান কাপে রানার্স-আপ এবং ১৯৮৪ এএফসি এশিয়ান কাপে তৃতীয় স্থান লাভ করে। কুয়েত ১৯৮২ সালে ফিফা বিশ্বকাপে অংশ নেয়, তবে তারা ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডের কাছে হেরে যাওয়ার আগে চেকোস্লাভিয়ার সাথে ১-১ গোলে ড্র করে। এ ছাড়া কুয়েতে বাস্কেটবল, ক্রিকেট ও আইস হকি খেলাও হয়ে থাকে।

নান্দনিক অবয়বের কুয়েত টাওয়ার
নান্দনিক অবয়বের
কুয়েত টাওয়ার

কুয়েত বিশ্বের একমাত্র দেশ যেখানে কোনও পুকুর বা জলাশয় নেই। এখানকার মানুষ সমুদ্রের নোনা পানিকে পানযোগ্য করে তোলে, এতে প্রচুর পরিমাণে অর্থও খরচ হয়, এখানে এক বোতল পানির দাম তেলের চেয়েও বেশি কিন্তু তা সত্ত্বেও এদেশে প্রচুর পানির প্রয়োজন হয় এমন কোন উচ্চাভিলাষী প্রকল্প থেমে নেই।
১৯৬৫ সালে কুয়েত সরকার কুয়েত সিটির পানি সরবরাহ ব্যবস্থা আধুনিকায়নের জন্য একটি পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নের জন্য সুইডেনের একটি প্রকৌশল কোম্পানিকে নিয়োগ করে। কোম্পানিটি নানা আকারে ছয়টি গুচ্ছে মোট ৩৪টি পানির টাওয়ার নির্মাণ করে। এগুলোর মধ্যে মাশরুম আকৃতির ৩১টি পানির টাওয়ারের পাঁচটি গুচ্ছ ‘কুয়েত ওয়াটার টাওয়ার’ নামে পরিচিত এবং তিনটি সরু টাওয়ারের একটি গুচ্ছ ‘কুয়েত টাওয়ার’ নামে পরিচিত। কুয়েত টাওয়ার পারস্য উপসাগরে একটি জমিতে দাঁড়িয়ে আছে। এটি আনুষ্ঠানিকভাবে ১৯৭৯ সালের মার্চ মাসে উদ্বোধন হয় এবং আধুনিক কুয়েতে একটি ল্যান্ডমার্ক বা প্রতীক হিসেবে গণ্য করা হয়।

আলহামরা টাওয়ার বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু ভাস্কর্য টাওয়ার
আলহামরা টাওয়ার বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু ভাস্কর্য টাওয়ার

প্রধান টাওয়ারটি ১৮৭ মিটার (৬১৪ ফুট) উঁচু এবং দু’টি গোলক বহন করে। নিচের গোলকটি তার তলার অর্ধেকে ৪,৫০০ ঘন মিটার (১,২০০,০০০ মার্কিন গ্যালন) ধারণক্ষমতাসম্পন্ন একটি পানির ট্যাঙ্ক এবং ওপরের অর্ধেকে একসাথে ৯০ জনের বসার ব্যবস্থাসহ একটি রেস্তোরাঁ, একটি ক্যাফে, একটি লাউঞ্জ ও একটি অভ্যর্থনা হল ধারণ করে আছে। ওপরের গোলকটি সমুদ্রস্তর থেকে ১২৩ মিটার (৪০৪ ফুট) উঁচুতে অবস্থিত এবং এটি প্রতি ৩০ মিনিটে পুরো এক পাক ঘোরে। এই গোলকটি একটি কাফে ধারণ করে আছে। দ্বিতীয় টাওয়ারটি ১৪৭ মিটার (১৮২ ফুট) উঁচু এবং এতে একটি গোলক আছে, যা পানির টাওয়ার হিসেবে কাজ করে। তৃতীয় টাওয়ারটি পানি ধারণ করে না বরং বড় দু’টি টাওয়ারকে আলোকিত করার সরঞ্জাম বহন করে। এখানকার দুইটি পানির টাওয়ার একত্রে ৯ হাজার ঘনমিটার (২,৪০০,০০০ মার্কিন গ্যালন) পানি ধারণ করে। এখানে তিনটি টাওয়ার থাকলেও এই কাঠামোকে প্রায়ই একবচনে কুয়েত টাওয়ার বলা হয়।
১৯৮০ সালে কুয়েত টাওয়ারসহ কুয়েত ওয়াটার টাওয়ার্স সিস্টেম আগা খান স্থাপত্য পুরস্কার লাভ করে।

SHARE

Leave a Reply