লেখালেখি একটি আর্ট। একটি নান্দনিক শিল্প। এর গুরুত্ব অপরিসীম। একদা লেখালেখিই ছিল পৃথিবীর সূর্য প্রতিম চির সত্য। লেখালেখি, রচনা, গবেষণা, অনুবাদ, কাব্য, বিজ্ঞান, দর্শন, সাহিত্যের অতুল সৃষ্টিতে আমাদের পূর্বসূরিগণ পৃথিবীকে দেখিয়েছিলেন আলোর পথ, সভ্যতার পথ। তাদের এই কলমবিপ্লব জ্ঞান ও গ্রন্থে কতটা সমৃদ্ধশালী ছিল তা জানলে আপনি অবাক হবেন। তারা লেখালেখিতে এমন বিস্ময়কর রেকর্ড করেছেন যা আমাদের প্রচলিত বুদ্ধি বিবেক বিকল করে দেয়। বক্ষ্যমাণ প্রবন্ধমালায় জ্ঞান-বিজ্ঞানের ইতিহাসে আলো ছড়ানো আমাদের যুবরাজদের নিয়ে আলোচনা করার ইচ্ছে রাখছি বুকের গহিন তলে, আর এ জন্য বিশ্বপ্রভুর খাশ দরবারে রহমত চাচ্ছি মুষলধারে।

ইবনে সিনা বিজ্ঞানের ইতিহাসে আলো ছড়ানো একটি নক্ষত্রোজ্জ্বল নাম। আরব সভ্যতার খ্যাতিমান, মৌলিক ও বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী ছিলেন তিনি। বিজ্ঞান চর্চায় মুসলমানদের নাম এলে প্রথমেই তাকে স্মরণ করা হয়। পাশ্চাত্য বিশ্বও তার মনীষা আলোয় আলোকিত। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে তার বই পাশ্চাত্যের মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে অবশ্য পাঠ্য ছিল। ইবনে সিনার মনীষা দ্যুতি হারিয়ে যাওয়ার নয়। জানা যায়, ইবনে সিনা রাতদিন অধ্যয়নে মগ্ন থাকতেন। নিদ্রা যাতে জ্ঞানার্জনে ব্যাঘাত সৃষ্টি করতে না পারে সে জন্য তিনি নিদ্রা প্রতিরোধকারী এক রকম পানীয় পান করতেন। দাশর্নিক, চিকিৎসক, গাণিতিক, জ্যোতির্বিদ, ভাষাবিদ, জ্যামিতিক, শিল্পকলা, ধর্মতত্ত্ব, সঙ্গীত এবং কাব্যের ওপর তার ছিল অগাধ পাণ্ডিত্য। এ সকল শাখার ওপর তিনি অনেক মূল্যবান গ্রন্থাবলি রচনা করেন। তিনি ১২৫টি, কারো কারো মতে ১৮০টি গ্রন্থ রচনা করেছেন। এ সকল গ্রন্থের জন্য তিনি যুগ যুগ ধরে অমর হয়ে থাকবেন।

আজকের বিশ্বে যে সকল বিজ্ঞানী, শিল্পী, সাহিত্যিক ও গুণীজনেরা তাদের স্ব স্ব অবদানের জন্য স্মরণীয় ও বরণীয় হয়ে আছেন তাদের মধ্যে আল ফারাবি অন্যতম। তার প্রতিভার বিস্ময়তা, সৃষ্টির বিশালতা ও উদ্ভাবনার উন্মাদনাকে নানাভাবে স্বাগত জানাতে হয়। মুসলিম মনীষী আল ফারাবি এক অনন্য সাধারণ মহা দাশর্নিক, ভাষাবিদ ও বিজ্ঞানী ছিলেন। তার পুরো নাম আবু নাছের আল ফারাবি। যিনি তৎকালীন দুনিয়ায় ৭০টি ভাষায় অনর্গল কথা বলতে পারতেন। একমাত্র ভাষাবিজ্ঞানী হিসেবেই যদি তার প্রতিভার বিচার করা হয় তাহলে বলতে হয়, এ রকম বহু ভাষাবিদ তার সময়কার পৃথিবীতে ছিলেন কিনা বা বর্তমান পৃথিবীতে আছেন কিনা তার খোঁজ নেয়া বড় দুর্লভ ব্যাপার। পৃথিবীতে জন্ম গ্রহণকারী মনীষীদের এক বিস্ময় ছিলেন আল ফারাবি। তাকে বলা হয় প্রাচ্যের মুসলমানদের মধ্যে সেরা দাশর্নিক। দর্শনশাস্ত্রের ওপর অসামান্য অবদানের জন্য তিনি দর্শনের Second Aristotle বা ‘দ্বিতীয় এরিস্টটল’ নামে পরিচিত। ঐতিহাসিকরা লিখেছেন, আল ফারাবি তৎকালীন সময়ে প্রচলিত সকল বিজ্ঞানে পণ্ডিত ও পারদর্শী ছিলেন। এরিস্টটল সম্পর্কেই তিনি প্রায় ৫০টির বেশি বই লিখেছেন। এই বিখ্যাত মনীষী প্রায় ১৬০টির বেশি গ্রন্থ রচনা করেন। বিশ্ব মনীষার জগতে ফারাবির স্থান চির অম্লান হয়ে আছে।

হাসান ইবনুল হাইছাম বিজ্ঞানজগতে এক উজ্জ্বল আলোকবর্তিকার নাম। চশমা আবিষ্কারের জনক হলেও তিনি পদার্থবিদ্যা, জ্যোতির্বিদ্যা ও গণিতশাস্ত্রে অমূল্য অবদান রেখেছেন। তিনি ২০৮টি গ্রন্থ রচনা করেছেন। পাশ্চাত্যে আলোড়ন সৃষ্টিকারী হিসেবে ইউরোপের বহু ভাষায় তার বই অনূদিত হয়েছে। ল্যাটিন, হিব্রু, স্প্যানিশ, ফরাসি, জার্মান প্রভৃতি ভাষায় অনূদিত হয় তার প্রায় ২৫টি বই। বিশ্বের খ্যাতনামা মিউজিয়াম ও লাইব্রেরিসমূহে রক্ষিত আছে তার মূল গ্রন্থের অর্ধশতাধিক পাণ্ডুলিপি।

পৃথিবীর ইতিহাসে পূর্ণিমার মতো উজ্জ্বল এক নাম আল কিন্দি। তিনি ছিলেন একাধারে দাশর্নিক, জ্যোতির্বিদ, রসায়নবিদ, গণিতবিদ, চিকিৎসাবিজ্ঞানী, রাজনীতিক এবং সঙ্গীতজ্ঞ। তবে আরব দাশর্নিক হিসেবে কিন্দি ছিলেন অত্যন্ত পরিচিত। তিনি প্রায় ২৬৫টি বই লিখেছিলেন বলে জানা যায়। তবে বিশ্বের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য জ্ঞান বিশ্বকোষ এনসাইক্লোপিডিয়া অব ব্রিটানিকা ২৭০টি গ্রন্থের নাম উল্লেখ করেছেন। প্রখ্যাত ঐতিহাসিক অধ্যাপক কে আলী লিখেছেন, তিনি কমপক্ষে ৩৬১টি গ্রন্থ রচনা করেছেন। কিন্দি দর্শনশাস্ত্রে ৩৩টি, জ্যোতিষশাস্ত্রে ১০টি, আকাশ বিজ্ঞানে ১৯টি, চিকিৎসাবিজ্ঞানে ২৮টি, গোলক সম্পর্কে ৮টি, মনস্তত্ত্বে ৯টি, রাজনীতি নিয়ে ১২টি, আবহাওয়া বিষয়ে ১০টি, ভবিষ্যদ্বাণী সম্পর্কে ১৭টি এবং ধর্মীয় বিতর্কমূলক ১৬টি গ্রন্থ রচনা করেছেন। তার বইগুলো অদ্ভুত আর চিত্তাকর্ষক ঘটনাপূর্ণ।

যুগে যুগে বিভিন্ন মুসলিম মনীষী আমাদের চিন্তা-চেতনাকে সমৃদ্ধ করার জন্য নিরলস কাজ করেছেন। এদের মধ্যে জাবির ইবনে হাইয়ান অন্যতম। রসায়নশাস্ত্রে যিনি সবচেয়ে বেশি অবদান রাখতে সক্ষম হয়েছেন তিনি হচ্ছেন জাবির ইবনে হাইয়ান। তিনি অনেকগুলো বই লিখেছেন। ইবনে নাদিম জাবির ইবনে হাইয়ানের লেখা গ্রন্থসংখ্যা দুই হাজারের বেশি বলে উল্লেখ করেছেন। অতিশয়োক্তি মনে হলেও এতে আশ্চর্যের কিছু নেই। কারণ তা প্রাপ্ত গ্রন্থগুলোর অনেকটার গড় পৃষ্ঠা ৮-১০ এর মতো এমনকি অনেকগুলোর পৃষ্ঠা সংখ্যা মাত্র ২টি। আমরা যাকে পুস্তিকা বলি, তাই ছিল তার বেশির ভাগ রচনা। তিনি রসায়ন বিষয়ে লিখেছেন ৩০০টি, যুদ্ধাস্ত্র বিষয়ে ৩০০টি, চিকিৎসাবিষয়ে ৫০০টি। দাশর্নিক যুক্তিখণ্ডন বিষয়ক ৫০০টি, জ্যোতির্বিজ্ঞান, জ্যামিতি ও অন্যান্য ৫টি। তবে রসায়নবিষয়ক রচনা জাবির ইবনে হাইয়ানকে চির অমর করে রেখেছে। তিনি বলতেন, ‘আমার ধনদৌলত টাকা পয়সা আমার ছেলেরা ভাইয়েরা ভোগ করবে। কিন্তু জ্ঞানের সাধনা করে আমি যা পেয়েছি লোকে আমাকে কেবল তার জন্যই চিনবে। সত্যিই তিনি আমাদের কাছে অত্যন্ত স্মরণীয় ব্যক্তিত্ব।

আল রাজি নামটি কমবেশি সবার নিকটই পরিচিত। তার পুরো নাম মুহাম্মদ ইবনে জাকারিয়া আল রাজি। তবে সুধীজনেরা আল রাজি বলেই চেনেন। তিনি আনুমানিক ২৫১ হিজরিতে ইরানের প্রসিদ্ধ ‘রে’ শহরে জন্মগ্রহণ করেন। ছোটবেলা থেকেই জ্ঞানের প্রতি আল রাজির প্রবল ঝোঁক ছিল। তিনি মোট দুই শতাধিক গ্রন্থ রচনা করেন। তার মধ্যে ১০০ খানা চিকিৎসাবিষয়ক। তিনি বসন্ত ও হাম রোগের ওপর ‘আল জুদাইরি ওয়াল হাসবাহ’ নামক একখানি গ্রন্থ রচনা করেন। যে গ্রন্থখানা দেখে চিকিৎসাবিজ্ঞানের লোকেরা খুব আশ্চর্যান্বিত হয়েছিলেন। তার আর একটি বিখ্যাত গ্রন্থ হলো ‘আল মানসুরী’। এটি ১০ খণ্ডে রচিত। এ গ্রন্থখানি আল রাজিকে চিকিৎসাশাস্ত্রে অমর করে রেখেছে। এ বইটি ইউরোপীয় বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো হতো। তার গুরুত্বপূর্ণ অবদানসমুহের কারণে তাকে আরব্য মেডিসিনের পিতা বলা হয়। তাঁকে ব্যতীত চিকিৎসা বিজ্ঞানের ইতিহাস রচনা করা অসম্ভব।

ইসলামী বিশ্বের প্রখ্যাত বিজ্ঞানী নাসির উদ্দিন আল তুসি। তার পুরো নাম আবু জাফর মুহাম্মদ ইবনে আল হাসান। তবে আল তুসী নামেই তিনি পরিচিত ছিলেন। একজন মুসলিমবিজ্ঞানী হিসেবে ইসলামের ইতিহাসে তার নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা রয়েছে।
দর্শন, জ্যোতির্বিজ্ঞান, অঙ্কশাস্ত্র, সাহিত্য, অধিবিদ্যা, ধর্মশাস্ত্র ইত্যাদি বিষয়ে তার বিভিন্ন কর্ম আজ পর্যন্ত বিভিন্নভাবে সারা দুনিয়ায় সমাদৃত। তিনি বিভিন্ন বিষয়ে ১৫০টি বই সম্পাদনা করেছেন। যা বিশ্ব ইতিহাসে আজও অমর ও অক্ষয় হয়ে আছে।

ইবনে জারির তাবারি ছিলেন বিপুল জ্ঞানের অধিকারী বিদগ্ধ গবেষক এবং বরেণ্য আলিম। তার বয়ঃপ্রাপ্ত হওয়ার পর থেকে মৃত্যু পর্যন্ত দিনও তার হাতে লিখিত পাতার হিসাব করে দেখা গেছে যে, গড়ে প্রতিদিন ১৪ পাতা করে লিখেছেন। তার জন্ম ২২৪ হিজরিতে এবং মৃত্যু ৩১০ হিজরিতে। জীবনকাল ৮৬ বছর। প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পূর্বকাল তথা প্রায় ১৪ বছর বাদ দেয়া হলে বাকি থাকে ৭২ বছর। এর প্রতিদিন ১৪ পাতা করে লেখা হলে তার মোট লেখার পরিমাণ দাঁড়ায় ৭২ গুণ ৩৬০ গুণ ১৪=৩,৬২,৮৮০ পাতা। গভীরভাবে বিবেচনা করলে মনে হবে তা যেন বহু শাস্ত্র ও বিষয় সংবলিত এক বিশ্বকোষ।
জ্ঞানের আকাশে অন্তহীন আলো ছড়ানো এক নাম ইমাম আবুল ফায়াজ ইবনুল জাওযি (রহ:)। যার জীবনকাল ছিল ৮৯ বছর। এই ৮৯ বছরের জীবনে তিনি প্রায় ৫০০টি গ্রন্থ রচনা করেছেন। যে গ্রন্থগুলো সহজেই ম্লান হওয়ার নয়।

বিশ্ববিখ্যাত তাফসির বিশারদ, নীতিশাস্ত্রবিদ, আইনবিদ ও ধর্মতত্ত্ববিদ ফখরুদ্দীন আল রাজি। তিনি ৬৩ বছর পৃথিবীতে বেঁচে ছিলেন। এ সময়ের মধ্যে তিনি প্রায় ২০০ এর অধিক বই লিখেছিলেন। এর কোনো কোনোটি বিশ থেকে ত্রিশ খণ্ডের। ভাবতেই মাথা নত হয়ে আসে।
দূরের কথা তো অনেক হলো, এবার কাছের কথা শুনি, এইতো মাত্র একশ বছর আগের কথা। হিন্দুস্তানের প্রসিদ্ধ ব্যক্তি আব্দুল হাই লাখনাবি যিনি ১৩০৪ হিজরিতে মাত্র ৩৯ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেছেন। অথচ তার রচিত গ্রন্থসংখ্যা শতাধিক। তার মধ্যে অনেকগুলো আছে বড় বড় কয়েক খণ্ডের।
এরপর আসা যাক হাকিমুল উম্মত মাওলানা আশরাফ আলী থানভি (রহ:) এর কথায়। তিনি গত হয়েছেন মাত্র কয়েক দশক হলো। তার সংকলিত গ্রন্থ সংখ্যা তো হাজারেরও অধিক। জীবন মাত্র কয়েক দশক, কিন্তু কর্মপরিধি বিশাল ব্যাপ্ত সমৃদ্ধ।
কাজী আবু বকর মুহাম্মদ বিন তাইব-যিনি প্রতি রাতে আশি রাকাত নামাজ আদায় না করে এবং সর্বনিম্ন ৩৫ পাতা না লিখে ঘুমাতেন না। এটাই ছিল তাঁর প্রতিদিনকার নিয়মিত রুটিন।
ইমাম আবু মুহাম্মদ আলি ইবনে হাযম (রহ:) এর রচনা সম্ভারে রয়েছে প্রায় ৪০০ খণ্ড সমৃদ্ধ গ্রন্থ, যাতে রয়েছে প্রায় ৮০,০০০ পৃষ্ঠা।
বাতিলের আতঙ্ক ইমাম ইবনে তাইমিয়া (রহ:) সংকলিত গ্রন্থের সংখ্যা বিভিন্ন বিষয়ে ও শাস্ত্রে প্রায় ৩০০ খণ্ড।
তাফসিরে জালালাইনের লেখক আল্লামা জালালিদ্দীন সুয়ুতী (রহ:) এর রচনা ও সঙ্কলন প্রায় চারশরও অধিক। তাফসিরশাস্ত্রের ইতিহাসে তিনি এক অমর ব্যক্তিত্ব।

বিশ্বের শ্রেষ্ঠ ভূগোলবিদ আবু আল রায়হান মোহাম্মদ ইবনে আহমদ আল বেরুনী। তাকে মধ্যযুগের শ্রেষ্ঠতম মুসলিম পণ্ডিত হিসেব গণ্য করা হয়। বীজগণিতে ‘লগারিদম’ পদ্ধতির উদ্ভাবক তিনি। গণিত, জ্যোতির্বিজ্ঞান, পদার্থবিজ্ঞান ও প্রাকৃতিক বিজ্ঞানে তিনি পারদর্শী ছিলেন। আল বেরুনিই প্রথম এ সত্য আবিষ্কার করেন যে শব্দের চেয়ে আলোর গতি অনেক বেশি। তিনি চাঁদের হ্রাস বৃদ্ধির সঙ্গে সমুদ্রের জোয়ার ভাটার সম্পর্ক আবিষ্কার করেন। নির্ভুলভাবে দ্রাঘিমাংশ ও অক্ষাংশ নিধার্রণ করেছিলেন। তিনি পৃথিবীর প্রথম মানচিত্র অঙ্কন করেছিলেন। আল বেরুনি মোট ১১৪টি বই রচনা করেছেন। ১০৪৮ সালে মুসলিম ইতিহাসের এ অবিস্মরণীয় বিজ্ঞানী গজনীতে ইন্তেকাল করেন। তার ইন্তেকালে বিশ্বের কতটুকু ক্ষতি হয়েছিল অধ্যাপক সাকায়ের একটি মন্তব্য থেকে তা আঁচ করা যায়, ‘আল বেরুনি হলেন বিশ্বের এ যাবৎকালের সর্বশ্রেষ্ঠ জ্ঞানী ব্যক্তি।
পরিশেষে বলা যায় যে, সুুন্দর এ পৃথিবীকে গড়ে তোলার জন্য আমাদের পূর্বসূরি জ্ঞানী, গুণী, সাহিত্যিক, বিজ্ঞানীদের লেখনী, হিম্মত, ধৈর্য ও সঙ্কল্প ছিল উঁচু স্তরের। এর উজ্জ্বল প্রমাণ তাদের সুবিশাল রচনাসম্ভার। যেগুলো তাদের জীবনকালে ঘামঝরা অর্জিত জ্ঞান -বিজ্ঞানের সার নির্যাস। তাঁরা জ্ঞান বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় বিপ্লব ঘটিয়ে গেছেন। এরই ধারাবাহিতায় আধুনিক বিজ্ঞানী মনীষীরা বর্তমান প্রযুক্তির পৃথিবী জন্ম দিয়েছে। বর্তমান পৃথিবীর এই সার্বিক উৎকর্ষের মূলে রয়েছে ইসলাম ও মুসলিম বিজ্ঞানীদের মৌলিক অবদান।
মুসলমানদের বিজ্ঞান চর্চার পথ ধরেই পরবর্তীতে ইউরোপে রেনেসাঁ সাধিত হয়। তাই বিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী মাটন বলতে বাধ্য হয়েছেন-‘তাদের (মুসলমানদের) কাজগুলো খুবই মৌলিক, খুবই মূল্যবান এবং সমৃদ্ধ। এ কথার প্রতিধ্বনি আমরা খ্যাতিমান ঐতিহাসিক পি কে হিট্টির মুখেও শুনতে পাই। তিনি লিখেছেন, ‘অষ্টম শতাব্দীর মাঝামাঝি হতে ত্রয়োদশ শতাব্দীর প্রারম্ভ পর্যন্ত আরবি ভাষাভাষী লোকেরা সমগ্র বিশ্বের সভ্যতা ও সংস্কৃতির প্রধান আলোর দিশারি ছিলেন। তাদের মাধ্যমে প্রাচীন বিজ্ঞান ও দর্শন এমনভাবে পুনরুজ্জীবিত, সংযোজিত ও সম্প্রসারিত হয় যে এর ফলে পশ্চিম ইউরোপে রেনেসাঁর উন্মেষ সম্ভবপর হয়। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে মুসলমানদের সেই গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা আজ আর নেই। তাদের সেই বিপুল গ্রন্থ সম্ভার, সমৃদ্ধ জীবন ও সুব্যাপ্ত জ্ঞানের নির্যাস আজ বিলুপ্তির পথে। বলা যায় অধিকাংশই বিলুপ্ত হয়ে গেছে। যৎ সামান্য যা আছে তাও কোন সংরক্ষিত গ্রন্থশালার কাচের বেষ্টনীতে চিড়িয়াখানার প্রাণীর মত দর্শনীয় বস্তু হয়ে। এখন যদি আমরা আবার বিশ্বমাঝে শীর্ষ হতে চাই তাহলে বর্তমান মুসলিম উম্মাহকে অতীত ইতিহাস থেকে অনুপ্রেরণা নিয়ে জ্ঞান-বিজ্ঞানে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনের জন্য প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হতে হবে এবং স্বীয় প্রতিভার আলো ছড়াতে হবে। অধিকতর অধ্যয়নে ও লেখালেখিতে মগ্ন ও নিমগ্ন থাকতে হবে। নতুবা ব্যক্তি ও উম্মাহর অপূরণীয় ক্ষতি সাধিত হবে। ইসলামী রেনেসাঁর কবি ফররুখ আহমদ কী সুুন্দর করে তিনি আমাদের জেগে ওঠার আহবান জানাচ্ছেন-
‘আজকে তোমার পাল ওঠাতেই হবে,
ছেঁড়া পালে আজ জুড়াতেই হবে তালি,
ভাঙা মাস্তুল দেখে দিক করতালি
তবুও জাহাজ ছোটাতেই হবে।’
কিংবা
‘চেয়ে দেখো আজ, এসেছে আবার
দিন বদলের দিন
নয়া জামানার মিনারে মিনারে
ডাকিছে মুয়াজ্জিন।’
তাই এসো আমাদের পূর্বসূরিদের ন্যায় জ্ঞান-বিজ্ঞান ও আধুনিক প্রযুক্তির বিভিন্ন শাখায় অবদান রাখার চেষ্টা করে যাই। সেই অনুযায়ী জীবন গড়ে দেশ জাতি ও বিশ্বকে সমৃদ্ধির পথে হাঁটি হাঁটি পা পা করে এগিয়ে নিয়ে যাই।