Home তোমাদের গল্প মাটির মায়া । মতিউর রহমান মিয়াজি

মাটির মায়া । মতিউর রহমান মিয়াজি

মাটির-মায়া২আনমনা হয়ে মেঘনার পাড়ে বসে আছে মুজাহিদ। সি-ট্রাক ছাড়তে এখনো ১ ঘণ্টা দেরি। এখনো টিকিট কাটা হয়নি। সময় কাটাতেই যে তার বসে থাকা তা নয়। অন্য দিনের মতো নদীর উথাল-পাথাল ঢেউ দেখতেও বসেনি সে। আর না বসেছে পিঁপড়েদের মতো দলবাঁধা জাহাজের সারি দেখতে! এই সাতসকালে মেঘনার পাড়ে বসে সীতাকুণ্ডের পাহাড় দেখার ব্যর্থ চেষ্টাও করছে না। সে দেখছে আজ অন্য এক খেলা, ভাঙা-গড়ার খেলা। ইয়া বড়বড় ঢেউ আছড়ে পড়ছে দ্বীপের উপকূলে। ভেঙে পড়ছে বিশাল বিশাল মাটির চাক। গত পঞ্চাশ বছরের এই খেলায় দ্বীপ শুধু হারছেই। হারিয়েছে চার-চারটি ইউনিয়ন। তবু লড়ছে, লড়ে যাচ্ছে মেঘনার সাথে। মেঘনা তার ভয়ঙ্কর রূপ প্রকাশ করছে প্রতিনিয়ত। গিলে খাচ্ছে প্রিয় মাতৃভূমিকে। কিছুই করার মত সাধ্য নেই তার। কিছুক্ষণ এই ভাঙা-গড়ার খেলা দেখে এবার সে তাকালো তার বাবার দিকে। তাকিয়েই প্রশ্ন- আচ্ছা বাবা, সবাই বলে নদী ভাঙে। কথাটা কি ঠিক? আহনাফ সাহেব জবাব দিলেন না। শুধু তাকিয়েই রইলেন। তার চোখে অশ্রু। মুজাহিদ এবার নিজেই উত্তর দেয়, নদী ভাঙে কথাটা কিন্তু ঠিক নয়। নদী কই ভাঙে? ভাঙে তো এই হতভাগা দ্বীপ। এইটুকু বলে সে এবার ডান হাতে রাখা মাটির তৈরি বাড়িটির দিকে মনোযোগ দিলো।

মাটির তৈরি একটি বাড়ি। বাড়িটির চারপাশে ছোট ছোট নকশা করা নারকেল-সুপারির গাছ। আরো রয়েছে আতা, জারুল, খেজুর, কড়ই, মেহগনি, কুল, জাম, পেয়ারা ইত্যাদি। বাড়ির মাঝখানে একটি টিনের ঘর। ঘরের পেছনেই পুকুর। পুকুরের চারপাশে ছোট বড় নানা ধরনের ফল গাছ। সব মিলিয়ে এ যেন এক জীবন্ত বাড়ি!

এতক্ষণে সে কল্পনার রাজ্যে হারিয়ে গেছে। সেই ছোট্টবেলার স্মৃতিগুলো বারবার ভেসে উঠছে হৃদয়ের মনিটরে। চোখের পর্দায় তা বারবার ভিউ করছে। কী সুন্দর বাড়িটাই না ছিল! কিসের অভাব ছিলো এই বাড়িতে। কী সুন্দর একটা উঠোন! যেন ক্রিকেট খেলার মাঠ। বেগুন দিয়ে কত যে ক্রিকেট ফুটবল খেলেছে তার ইয়ত্তা নেই। ছোট্ট এই উঠোনটা স্টেডিয়ামে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। আশপাশের বাড়ি থেকে বন্ধুরা ছুটে আসতো খেলতে। ফুলটোক্কা, গোল্লাছুট, বউচুরি, কানামাছি, মাছমাছ, পাতাপাতা ইত্যাদি খেলায় মাতিয়ে রাখতো পুরো বাড়ি।

বারবার মনে পড়ছে সোহেল, মামুন, শরীফ, আরাফাত, রাকিবদের কথা। সবাইকে ছেড়ে চলে যেতে হচ্ছে বাড়ি বিক্রি করে।

পাটিবন, পুকুরপাড়, আমবাগান। আহা! কি মজার জায়গা। ঝোপের আড়ালে লুকোচুরি খেলা। কত যে মজা হতো! মুজাহিদ ভাবে, নতুন বাড়িতে কি কোনো খেলার সঙ্গী পাওয়া যাবে?

বাড়ির পেছনের পুকুরের কথা মনে পড়তেই কষ্টটা আরো বেড়ে গেল। গ্রীষ্মের দুপুরে তো সব বন্ধু মিলে পুকুরের পানিগুলো দই করে ছাড়তো।

ডুবাডুবি খেলা যে কতই না মজার ছিল!

-“ইগা কি?

– মরিচ।

– হাইল্লে আঁরে ধরিছ।”

এই কথা বলে একজনে ডুব দিয়ে পালাতো। আর বাকিরা তাকে ধরার জন্য পানিতে ঝড় তুলে তুলকালাম অবস্থা করে ফেলতো। দুপুর বেলা ডাব গাছে উঠে ইচ্ছে মতো ডাব পাড়তো। তারপর ডাব খেয়ে পুকুরে ঝাঁপ দিতো। সেই যে পুকুরে ঝাঁপ আর উঠার খবর নেই। বেলা গড়িয়ে বিকেল তিনটা। অবশেষে চোখ দুটো লাল করে তবেই ঘরে ফেরা। মায়ের বকা খাওয়ার মধ্য দিয়ে শুরু হতো দুপুরের খাবার। কতই না মধুর ছিল সেই দিনগুলো!

এখনতো আর পুকুরে সাঁতার কেটে আনন্দ করা যাবে না। নতুন বাড়িতে তো আর পুকুর থাকবে না। গোসল করতে হবে টিউবওয়েলের পানিতে। কী বিরক্তিকর! এভাবে কি গোসল হয়? অন্তত দু-এক ঘণ্টা পানিতে না থাকলে সেটা কি আদৌ গোসল! গ্রীষ্মের দিনে বাড়ির দক্ষিণ কোনে শীতল পাটি বিছিয়ে গল্প-গুজব করে কাটিয়ে দিতো পুরো বিকেলটা। আর আম মেখে খাওয়া হতো সব ভাইবোন মিলে। শীতের বিকেলটা কাটতো বাড়ির সামনের বাদাম ক্ষেতের পাশে। মা লেপ-কম্বল রোদে দিতেন। আর তারা সেখানে শুয়ে শুয়ে গল্প করতো।

হাজারো স্মৃতি তার মনের পর্দায় ভেসে উঠছে। আর সে নিজেও ভাসছে। ভাসছে কল্পনার মহাসমুদ্রে।

তাদের মূল বাড়ি হচ্ছে হাতিয়া পৌরসভায়। তার বাবা মিস্টার আহনাফ সাহেব একজন অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক। তার বড় ভাইয়েরা সবাই শহরে থাকে। দু’ভাই পড়াশোনা শেষ করে কর্মজীবনে প্রবেশ করেছে। আর দু’ভাই এখনো জ্ঞানরাজ্যে বিচরণ করছে। তাদের বাবা অবসরে যাওয়ার পর থেকেই ছেলেরা শহরে চলে আসার জন্য অনুরোধ করে আসছে। আর সেই সুবাদেই তিনি জেলা সদরে বাড়ি করলেন। আজই যাচ্ছেন সদরে। নতুন বাড়িতে। মুজাহিদ কিছুতেই মানতে পারছিল না এটা। হাজারো স্মৃতি বিজড়িত এই দ্বীপ ছেড়ে কিছুতেই যেতে ইচ্ছে করছে না তার। কিন্তু যাওয়া বৈ বিকল্প পথ খোলা নেই। তাই সে দীর্ঘ একমাস পরিশ্রম করে একটি মাটির বাড়ি তৈরি করলো। কিছুক্ষণ পরেই ছেড়ে দেবে সি-ট্রাক। তাই সে বসে বসে স্মৃতিচারণ করছে প্রিয় বাড়িটার।

‘এই ভাইয়া, বসে বসে কি ভাবছিস? সি-ট্রাক ছেড়ে দেবে তো। আব্বু ডাকছেন। তাড়াতাড়ি চল।’

ছোট বোনের ডাকে সে সম্বিত ফিরে পেলো। মাটির বাড়িটা হাতে নিয়ে হাঁটা শুরু করলো সি-ট্রাকের দিকে। শত শত মানুষের ভিড়ে ভাইবোন দু’জনে কাঠের সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগলো সি-ট্রাকে। সি-ট্রাক থেকে সাইরেন বেজে উঠলো। সবাই তাড়াহুড়ো করে উঠতে লাগলো সি-ট্রাকে। হঠাৎ কারো গায়ের ধাক্কা লেগে মুজাহিদের মাটির বাড়িটি হাত ফসকে পড়ে গেল নদীতে।

মুজাহিদের বাবা সিঁড়ির সম্মুখেই অপেক্ষা করছিলেন তাদের জন্য। মুজাহিদ চিৎকার করে কান্না জুড়ে দিলো। আমার বাড়ি, বাবা আমার বাড়ি…। আমার বাড়ি হারিয়ে গেল!

আহনাফ সাহেব দেখতে পেলেন, এক বিশাল ঢেউ আছড়ে পড়ছে মাটির বাড়িটির ওপর। এরপর সেটা চিরতরে তলিয়ে গেল মেঘনার করাল গ্রাসে। তিনি ভাবলেন, যেন মাটির বাড়ি নয় পুরো দ্বীপটাই গ্রাস করে ফেললো সর্বনাশী মেঘনা। মুজাহিদ তখনো বিলাপ করে কান্না করছে। সি-ট্রাকের যাত্রীরা ঘটনার আকস্মিকতায় ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো।

SHARE

Leave a Reply