কান্নার সময় আমাদের চোখে পানি আসে। আবার আমরা যখন অনেক খুশি থাকি তখনও আমাদের চোখে পানি আসে। চোখে পানি আসার আরেকটি প্রধান কারণ হলো খুব ঠাণ্ডা বা গরম। শীতের রাতে বাইরে বেশি ঘুরাফেরা করলে অনেকেরই চোখের পানিপড়া রোগ হয়। আবার ভরদুপুরে খররোদে চলাফেরা করলে বেশির ভাগ লোকেরই চোখে পানি আসে। জ্বালা করে চোখ। ধোঁয়া বা ঝাঁঝালো জিনিসের সংস্পর্শেও চোখের মণি পানিতে টলটলায়মান হয়। বেশি আলোতে টিভি, ভিসিআর দেখলেও চোখে পানি আসে। এই পানির উৎস কোথায়! কেমন করে তাৎক্ষণিকভাবে চোখে পানি আসে!
চক্ষুগোলকের ওপরে হাড়ের খোলসের নিচে, বাদামের মতো এক ধরনের গ্রন্থি থাকে। নাম অশ্রুগ্রন্থি বা লেকরিমাল গ্ল্যান্ড। ল্যাটিন শব্দ লেকরিমা মানে অশ্রু। গ্রন্থিতে যে তরল পদার্থ থাকে সেটাই আমাদের চোখের পানি। চোখের পানি খানিক নোনতা। চোখের পানিতে তাই রয়েছে লবণ, পানি আর লাইসোজাইম নামক একটি এনজাইম। এটি মূলত প্রোটিন জাতীয় পদার্থ। এর কাজ চোখের ক্ষতিকর জীবাণুগুলোকে ধ্বংস করে ফেলা। অজস্র চিকন নালি বেয়ে গ্রন্থি থেকে ক্ষরিত রস নাকের পাশের কোনায় এসে জমে। সেখানে থাকে লেকরিমালসেক বা অশ্রুথলি। সেখান থেকে পরে আরেকটি মোটা নালি পথে সে অশ্রু নাকে এসে পড়ে। সাধারণ অবস্থায় চোখের পানি ওপরের পাতা বন্ধ হওয়ার সময় চোখের বাইরের অংশ নেত্রবর্ত্নকলা ধুয়ে দেয়। তাতে চোখ ভেজা থাকে। এ ছাড়াও চোখ রক্ষা পায় ক্ষতিকর জীবাণুর হাত থেকে। গ্রন্থি হতে পানির ক্ষরণ নিয়ন্ত্রণ করে ব্রেইনের মুক্ত কেন্দ্র হতে আগত কিছু স্নায়ুবার্তা।
চোখের পানি শুধু পানিই নয়। এটি এক আশ্চর্য সৌন্দর্যের রহস্য। অতি সাধারণ কিছু থেকে মাঝে মধ্যে অসাধারণ এমন কিছুও পাওয়া যায় যা আমাদের কল্পনার বাইরে। চোখের পানিও ঠিক তেমন। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের একজন নান্দনিক আলোকচিত্রী মরিস মিকার চোখের পানির ওপর এক গবেষণা চালান। তিনি তার বৈজ্ঞানিক চিন্তাশক্তি কাজে লাগিয়ে সমান্য চোখের পানির এক একটি ফোঁটাকে করে তুলেছেন অসাধারণ।
তিনি গবেষণাগারে চোখের পানি নিয়ে গবেষণা করেছেন। তিনি চোখের পানিকে এবটি অণুবীক্ষণ যন্ত্রের নিচে রেখে দেখলেন যে, এক এক ফোঁটা চোখের পানি খুব কাছ থেকে দেখলে একটি অন্যটি থেকে ভিন্ন হয়। যা আপাতত প্রথম দৃষ্টিতে কারো কাছে ফসলের জমি বা সাজানো ফুলগাছের মতো লাগবে। তিনি প্রতিদিন বিভিন্নভাবে চোখের পানি সংগ্রহ করে পরীক্ষা করতে শুরু করলেন এবং প্রতিদিনই নানারকম চিত্রের দেখা পেতেন। পরবর্তীতে তিনি সেগুলো ছবি তুলে সংগ্রহ করে রাখতেন।
চোখের পানি সাধারণত তিন রকমের হয়ে থাকে। প্রথমটি হলো যা চোখের ভিতরে থাকে, দ্বিতীয়টি চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ার সময়টুকু এবং তৃতীয়টি যখন চোখ থেকে গড়িয়ে পড়ে। কারণ চোখের পানিতে শুধু যে পানি থাকে তা কিন্তু নয়। চোখের পানিতে যে উপাদানগুলো থাকে সেগুলো এক এক জায়গায় এক এক রকম কাজ করে এবং বাতাসের সংস্পর্শে এলে তা অন্য একটি রাসায়নিক পদার্থের সঙ্গে ক্রিয়া করে। ফলে এক এক অবস্থানের চিত্র একেক রকম হয়।
যদিও এটা বিশ্বাস করা খুব কষ্টসাধ্য যে চোখের পানি থেকে এটা কিভাবে সম্ভব, তাই ওই আলোকচিত্রী অনেক পরীক্ষা নিরীক্ষার পর চোখের পানির এই অপরূপ সৌন্দর্য সবার সামনে তুলে ধরার জন্য একটি সেমিনারের আয়োজন করেন। সেখানে প্রজেক্টর লাগিয়ে হাজার মানুষের সামনে অণুবীক্ষণ যন্ত্রের নিচে চোখের পানির এই সৌন্দর্য তুলে ধরা হয়। চোখের পানির সঙ্গে রঙ মেশালে চিত্রগুলো আরো আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। সেমিনারে উপস্থিত থাকা হাজার হাজার দর্শনার্থী ছবিগুলো দেখে নিজেদের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। মিকার বলেন, এখন থেকে আর চোখের পানি নষ্ট করা যাবে না বরং তা সংরক্ষণ করে ছবি তুলে ঘর সাজানোর কাজে ব্যবহার করতে পারেন।
তবে চোখের সঠিক যত্ন না নিলে এই সৌন্দর্য ব্যাহত হতে পারে। চোখের পানি সবসময় সঠিকভাবে প্রবাহিত হয় না। অনেক সময় অশ্রুথলি ও অশ্রু নালীতে জীবাণু সংক্রমণের কারণে পানি প্রবাহের স্বাভাবিক গতি ব্যাহত হয়। তাই সর্বদাই পানি চোখ দিয়ে উপচে পড়ে। এর নাম ডেকোরিওসিসটাইটিস। এটা একটা জটিল রোগ। এর চিকিৎসায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন পড়ে। সে জন্য আমাদের চোখের যত্ন নিতে হবে।