জনপ্রিয় ধারাভাষ্যকার মাইকেল হোল্ডিং একবার বলেছিলেন, ‘তাকে যদি নারকেল দিয়েও বোলিং করতে দেয়া হয়, আমি নিশ্চিত সে সুইং করাতে পারবে।’ কথাগুলো বলেছিলেন ইংলিশ ফার্স্ট বোলার জেমস অ্যান্ডারসন সম্পর্কে। পুরো নাম জেমস মাইকেল অ্যান্ডারসন হলেও ক্রিকেটবিশ্বে তিনি জিমি অ্যান্ডারসন নামেই সর্বাধিক পরিচিত।
এই সময়ে ক্রিকেট বিশ্বে কয়েকজন সেরা বোলারের নাম বলতে গেলে তার মধ্যে ওপরের দিকেই থাকবে অ্যান্ডারসনের নাম। অবশ্য ‘জিমি’ বর্তমানে খেলছেন শুধু টেস্ট ক্রিকেট, ২০১৫ সালে অবসর নিয়েছেন ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট থেকে। শুধুমাত্র এক ফরম্যাটে খেলার কারণে তার পুরো মনোযোগ এখন টেস্ট ক্রিকেটের দিকে, যার কারণে এই ফরম্যাটে তার পারফরম্যান্স ঈর্ষণীয়। বিশেষ করে ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া কিংবা দক্ষিণ আফ্রিকার মতো দেশগুলোতে- যেখানে পেস বোলারদের জন্য বাউন্সি পিচ তৈরি করা হয়, সেখানে এই ডানহাতি পেসার যেকোনো ব্যাটসম্যানের জন্য আতঙ্ক হয়ে দেখা দেন।
ইতোমধ্যেই ইংল্যান্ডের ইতিহাসে সবচেয়ে আগ্রাসী আর দক্ষ পেসার হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন পারফরম্যান্স দিয়ে। বর্তমানে খেলছেন এমন বোলারদের মধ্যে টেস্টে অ্যান্ডারসনের উইকেট সবচেয়ে বেশি। আর ইংল্যান্ডের হয়ে সর্বোচ্চ উইকেট দখলের রেকর্ড তো নিজের করে নিয়েছেন সেই ২০১৫ সালে। সে বছর ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরের সময় ছাড়িয়ে যান স্যার ইয়ান বোথামের ৩৮৩ উইকেটের মাইলফলক। ইংল্যান্ডের হয়ে টেস্টে ৪০০ উইকেট ও ৫০০ উইকেটের মাইলফলকে পৌঁছানো প্রথম বোলার তিনি। এ বছর আগস্ট-সেপ্টেম্বরে দেশের মাটিতে ভারতের বিপক্ষে হোম সিরিজ শেষে তার উইকেট সংখ্যা দাঁড়ায় ৫৬৪টি। এই সিরিজেও জিমি ছিলেন সর্বোচ্চ উইকেট শিকারি। ৫ টেস্টে নিয়েছেন ২৩টি উইকেট। ভারতের বিখ্যাত ব্যাটিং লাইনআপকে রীতিমতো নাকানিচুবানি খাইয়েছেন সুইং আর গতি দিয়ে।
টেস্ট ক্রিকেটে সর্বোচ্চ উইকেট শিকারির তালিকায় অ্যান্ডারসন আছেন চার নম্বরে। তার ওপরে আছেন মুত্তিয়া মুরালিধরন (৮০০), শেন ওয়ার্ন (৭০৮) ও অনিল কুম্বলে (৬১৯)। ভারতের সাথে সিরিজের শেষ ম্যাচে ভারতের শেষ ব্যাটসম্যান মোহাম্মাদ শামিকে আউট করার মধ্য দিয়ে ছাড়িয়ে গেছেন গ্লেন ম্যাকগ্রাকে। কাজেই পেস বোলারদের মধ্যে অ্যান্ডারসনই এখন টেস্টে সর্বোচ্চ উইকেটের মালিক।
২০০২ সালের ডিসেম্বরে অস্ট্রেলিয়া সফরে তৃতীয় দেশীয় সিরিজে ওয়ানডে ম্যাচের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক এই বোলারের। মাত্র তিনটি ঘরোয়া ওয়ানডে ম্যাচের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন তরুণ অ্যান্ডারসনকে অ্যান্ডি ক্যাডিকের বদলি হিসেবে পাঠানো হয় অস্ট্রেলিয়ায়। এতটাই তাড়াহুড়ো করা হয়েছিল যে, তার জার্সিতে নাম কিংবা জার্সি নম্বর কোনটাই লেখা ছিলো না সেই ম্যাচে। সেই সিরিজেই অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে একটি ম্যাচে ১০ ওভার বোলিং করে ছয়টি মেডেন ওভার দিয়ে প্রথম আলোচনায় আসেন জিমি। মাত্র ১২ রান খরচ করেছিলেন তিনি সেদিন অ্যাডাম গিলক্রিস্ট, মাইকেল বেভানদের সামনে। এই আগুনঝরা বোলিংই তাকে আলোচনায় আসতে সাহায্য করে।
এই সিরিজ শেষ করেই ইংল্যান্ড দল যায় ২০০৩ বিশ্বকাপ খেলতে, মাত্র নয় ম্যাচের অভিজ্ঞতা নিয়ে দলের সাথে দক্ষিণ আফ্রিকার বিমানে ওঠেন অ্যান্ডারসন। অস্ট্রেলিয়া সফরে তার প্রতিশ্রুতিশীল বোলিংয়ের কারণেই নির্বাচকরা আস্থা রাখেন এই তরুণের ওপর। প্রতিটি ম্যাচে দারুণ মিতব্যয়ী বোলিং করেন তিনি, সব মিলে নেন ১০ উইকেট, কেপটাউনে পাকিস্তানের সেই সময়ের বিখ্যাত ব্যাটিং লাইনআপ একাই গুঁড়িয়ে দেন। যা তার সামনে দরজা খুলে দেয় টেস্ট দুনিয়ার। এক মাস পরেই জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে টেস্ট অভিষেক হয় জিমির।
এতদিনে যেন নিজের আসল জায়গাটা খুঁজে পান ল্যাঙ্কাশায়ারের এই তরুণ। টেস্ট ক্রিকেটের বৃহৎ আঙিনায় নিজেকে উজাড় করে দেন। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে দুই টেস্টে নেন ১১ উইকেট। কদিন পর দক্ষিণ আফ্রিকা দল খেলতে যায় ইংল্যান্ডে। তাদের বিপক্ষে সিরিজে দখল করেন ১৫ উইকেট। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি জিমি অ্যান্ডারসনকে। তরতর করে বেয়ে উঠেছেন সাফল্যের সিঁড়ি। ইংল্যান্ড দলের হয়ে খেলে গেছেন সব ফরম্যাটের ক্রিকেটে। যদিও ইনজুরি বাধা হয়ে দাঁড়ায় তার এই ধারাবাহিকতার পথে। ২০০৬ সালের বেশির ভাগ সময় তাকে কাটাতে হয়েছে মাঠের বাইরে।
তবে প্রচণ্ড পরিশ্রমী সুশৃঙ্খল অ্যান্ডারসন আবার ফিরেছেন জাতীয় দলে। দীর্ঘদিন ইংল্যান্ড দলকে টানা সার্ভিস দিয়েছেন। ২০১৫ সাল পর্যন্ত ইংল্যান্ড ওয়ানডে দলেরও এক নম্বর বোলার ছিলেন জিমি, সে বছর বিশ্বকাপের পর সীমিত ওভারের ক্রিকেটকে বিদায় জানান। সিদ্ধান্ত নেন শুধুমাত্র টেস্ট খেলার। অবশ্য টেস্টের মতো ওয়ানডের পারফরম্যান্স ততটা উজ্জ্বল ছিলো না তার। বেশ মিতব্যয়ী বোলিং করলেও উইকেট সংখ্যা তার দক্ষতার তুলানয় অনেক কম। ১৯৪ ওয়ানডেতে তার উইকেট সংখ্যা ২৬৯টি। সর্বোচ্চ ২৩ রানে ৫ উইকেট। আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি খেলেছেন ১৯টি, উইকেট সংখ্যা ১৮টি।
আর টেস্টে অ্যান্ডারসনের কৃতিত্বের কথা তো লেখার শুরুতেই বলা হয়েছে। ২০১০ সালে টেন্টব্রিজে পাকিস্তানের বিপক্ষে দুই ইনিংসে ৫ ও ৬ উইকেট (মোট ১১) তার ক্যারিয়ার সেরা বোলিং। একই মাঠে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ইনিংসে ৭ উইকেট আছে তার ২০০৮ সালে। সব মিলে টেস্টে ১০ বা তার বেশি উইকেট নিয়েছেন ৩ বার, ৫ উইকেট ২৬ বার। ক্রিকেটের সবচেয়ে মর্যাদপূর্ণ দ্বিপক্ষীয় অ্যাশেজ সিরিজ তিনবার জিতিয়েছেন ইংল্যান্ডকে। ইংল্যান্ড দলকে আরো অনেক স্মরণীয় মুহূর্ত এনে দিয়েছেন এই পেসার। ফিটনেসের দিকে অত্যন্ত যতœবান অ্যান্ডারসন। পেস বোলাররা সাধারণত একটু বেশিই ইনজুরি আক্রান্ত হয়, সে দিক থেকে অ্যান্ডারসন ব্যতিক্রম। অবশ্য রঙিন পোশাকের ক্রিকেটের চাকচিক্য ছেড়ে শুধু টেস্ট খেলায় মনোনিবেশ করাও তার সুস্থ থাকার একটি বড় কারণ। ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টির এই যুগে টানা ম্যাচ খেলতে গিয়েই বেশির ভাগ ক্রিকেটার ইনজুরিতে পড়েন। কিন্তু সেই গ্ল্যামার আর টাকার হাতছানি উপেক্ষা করে অ্যান্ডারসন বেছে নিয়েছেন ক্রিকেটর সবচেয়ে অভিজাত ফরম্যাট টেস্টকে।
বর্তমানে বয়স চলছে ৩৬ বছর। যে ফিটনেস তাতে আরো অন্তত ২-৩ বছর খেলতে পারবেন অনায়াসে। সেক্ষেত্রে টেস্টে উইকেট দখলের রেকর্ডে অনিল কুম্বলেকে ছাড়িয়ে তিন নম্বরে ওঠার সুযোগ থাকবে তার সামনে। ভাগ্য ভালো হলে যেতে পারেন আরো অনেক দূর। আসলে পরিসংখ্যান দিয়ে অ্যান্ডারসকে বিচার করলেও ভুল হবে। তার বোলিং যারা দেখেছে তারা জানে, বল হাতে নিয়ে কতটা ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠেন তিনি। সুইং আর গতির মিশলে তার বোলিং দর্শকদের জন্য হয়ে ওঠে বড় বিনোদন।
এমনিতে চুপচাপ স্বভাবের মানুষ অ্যান্ডারসন। তবে মাঠে বেশ কয়েকবার ছোটখাটো বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন। এই তো ভারত-ইংল্যান্ড সিরিজেও বিরাট কোহলির বিরুদ্ধে এলবিডব্লিউয়ের আবেদন করার পর আম্পায়ার আউট না দিলে বিরক্তি প্রকাশ করে সমালোচিত হন। আগেও এমন ঘটনা রয়েছে তার ক্যারিয়ারে কয়েকবার।
তবে এসব কিছুর ঊর্ধ্বে ওঠে একজন নিষ্ঠাবান ক্রিকেটার হিসেবেই খ্যাত এই পেসার। টেস্ট ক্রিকেটকে উপভোগ্য করে তোলায় বর্তমান সময়ে যারা সবচেয়ে বেশি ভূমিকা পালন করছেন তাদের মধ্যে অ্যান্ডারসন অন্যতম।