গল্পটা রাসেলকে নিয়ে। গ্রাম্য বালক রাসেল। দুষ্ট বালকের তালিকায় রাসেলের স্থান প্রথম। আবার পরোপকারীও বটে। কোন কাজ সে করতে পারবে কী পারবে না সেটা বিবেচনা করা গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং সবার আগে সে এগিয়ে যাবে এটাই তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। তার জীবনে সবচেয়ে কষ্টের বিষয় ছিল, সে পড়াশোনা একেবারেই করতো না। অবশ্য পারত না বললে ভুল হবে, করার আগ্রহ ছিল না। এখন চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ে। বিগত তিন বছর কাটিয়েছে তৃতীয় শ্রেণীতে। প্রথম শ্রেণী থেকে দ্বিতীয় শ্রেণীতে উঠতে তিন বিষয়ে অকৃতকার্য হলো। এরপরও দ্বিতীয় শ্রেণীতে ওঠার প্রমোশন পেল। সরকারি স্কুল বলে কথা। এরপর দ্বিতীয় শ্রেণী থেকে তৃতীয় শ্রেণীতে উঠতে পাঁচ বিষয়ে অকৃতকার্য হলো। এবার আর শিক্ষকরা ভর্তি করালেন না। অনেক চিন্তা-ভাবনা করে তার বাবা আলিয়া মাদ্রাসায় নিয়ে ভর্তি করালেন তৃতীয় শ্রেণীতে। কিন্তু রাসেলের পড়াশোনার কোন প্রকার উন্নতি হলো না। পরের বছর মাদ্রাসা থেকে নিয়ে এসে ঐ স্কুলেই তৃতীয় শ্রেণীতে ভর্তি করালেন। বহু কষ্টে শিক্ষকরা তাকে ভর্তি করাতে রাজি হলো। প্রত্যেক বছরের শুরুতে তার মায়ের মুখে একটা কথা শুনা যেত “আগে যা হবার হয়েছে এবার কিন্তু পড়াশোনায় মন দিতে হবে। তা না হলে চা দোকানে চাকরি করতে হবে। নতুন বছর, নতুন সহপাঠী, আর নতুন বইয়ের ঘ্রাণে কিছু দিন বেশ ভালোই পড়াশোনা করতো রাসেল। কিন্তু কিছু দিন পর আবার সেই অবনতি হতে থাকতো তার পড়াশোনার। ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠে আরবি পড়তে যেত। সেখান থেকে এসে নাশতা করে বের হয়ে যেত। কারণ তখন স্কুলে যাওয়ার সময় হতো। আর যখন স্কুলে যাওয়ার সময় ফুরিয়ে যেত, ঠিক তখনই ঘরে ফিরতো। মা কিছুক্ষণ বকাঝকা করতেন। এরপর সারাদিন এদিক সেদিক ঘোরাঘুরি করে কাটিয়ে দিত। বর্ষা ঋতুতে বৃষ্টি আসার সাথে সাথে ফুটবল নিয়ে বের হয়ে যেত। কোন খেলাই রাসেলকে ছাড়া জমে উঠতো না। ব্যাট, বল, স্ট্যাম্প সব থাকতো রাসেলের ঘরে। পাড়ার ছেলেরা কারণে অকারণে রাসেল এর গাঁয়ে হাত তুলতো। কিন্তু রাসেল এগুলো পরোয়া করতো না। শীতের সময় রাসেলকে দিয়ে সবাই পৌষ ধানের খড় চুরি করাতো। আর খড় পুড়িয়ে সবাই শীত নিবারণ করত। আর যখন আমের সময় আসতো, দিনের বেশির ভাগ সময়ই থাকতো সে আম বাগানে। পকেটে থাকত আম কাটার একটা যন্ত্র। আর কাগজে পেঁচানো লবণ-মরিচ। সব মিলিয়ে প্রকৃতির অত্যন্ত কাছে ছিল রাসেল।
এভাবেই কাটতো তার দিনগুলো। যারা রাসেলকে পড়ালেখার কথা বলতো, তারা ছিল তার পরম শত্রু। এভাবে তৃতীয় শ্রেণীতে দুই বছর পার করে দিল। শেষের বছরও একই অবস্থা। বাবা আর সহ্য করতে না পেরে ঢাকায় নিয়ে গেলেন। সত্যি একটা চা দোকানের কাজে দিয়ে দিলেন। প্রথমে রাসেল ভাবলো অনেক মজা হবে। ইচ্ছে মতো চা, বিস্কুট, কেক, কলা খেতে পারবে। আর যাই হোক পড়ালেখা নামক বিষয়টা তাকে আর বিরক্ত করবে না। কিন্তু বাস্তবে যা দেখলো তা ভিন্ন। ভোরে ঘুম থেকে উঠে দোকান খুলতো। ঝাড়– দেয়া থেকে শুরু করে ক্যাটলি পরিষ্কার করা, পানি আনা, চুলায় চা বসানো ইত্যাদি। এগুলো করতে করতেই সে ক্লান্ত হয়ে যেত। কিন্তু কিছুই করার ছিলো না। মালিক আসা পর্যন্ত বসতে হতো দোকানে। এরপর মালিকের চোখ রাঙানো কথা। আর প্রত্যেকটি টাকার হিসাব দিতে দিতে ভেঙে পড়তো রাসেল। আর যখন দোকানের সমানে দিয়ে তার বয়সী ছেলেরা স্কুলে যেত, বুকভরা কষ্ট নিয়ে ছেলেগুলোর মুখ পানে চেয়ে থাকতো। সারাদিন কাজ করার পর ক্লান্ত শরীর নিয়ে রাসেল যখন বালিশে মাথা রাখতো, মনে পড়তো ফেলে আসা গ্রামের দিনগুলো। চোখের পানিতে ভিজে যেত বালিশ। কিন্তু কী করবে, সবে তো মাত্র এক সপ্তাহ হলো। কবে সে ফিরে যাবে তার স্বপ্নের গ্রামে? শুধু এই চিন্তা। যদিও কোলাহলপূর্ণ এলাকা। কিন্তু সে ছিল একা। কারণ যেদিকে তাকায় সবাই অচেনা। বাবা বলেছিল পনেরো দিন পরে তাকে দেখতে আসবে। এর মাঝে বাবা মালিকের সাথে মোবাইলে কথা বলতো। রাসেলের কথা জিজ্ঞাস করলেই এটা সেটা বলে বুঝিয়ে দিত। চরম তিক্ততা আর অমানবিকতার মধ্য দিয়ে সে প্রায় বারো দিন পার করলো। পরের দিন তার বাবা এলো। বাবাকে জড়িয়ে ধরে ব্যাপক কান্না শুরু করলো। শুধু একটি কথাই বাবা আমাকে নিয়ে চলো। আমি ঠিকমতো পড়াশোনা করবো। আমাকে রেখে যেও না বাবা। বাবার মন নরম হয়ে গেল। পরের দিন রাসেলকে নিয়ে গ্রামে চলে যায় তার বাবা। অসম্ভব খুশি হয়ে পড়াশোনা শুরু করলো। আর বার্ষিক পরীক্ষায় দেখা গেল রাসেল এর স্থান পঞ্চম। শুরু হলো তার পড়াশোনা নিয়ে সাজানো নতুন জীবন ।।