বন্ধুরা, এই লেখা যখন তোমাদের হাতে পৌঁছেছে তখন বিশ্বকাপ ফুটবলের এবারের আসর অনেকটাই শেষের পথে। ইতোমধ্যেই তোমরা হয়তো জেনে গেছ প্রথম রাউন্ড শেষে কোন দলগুলো উঠেছে দ্বিতীয় রাউন্ডে। হয়তো জেনে গেছ দ্বিতীয় রাউন্ড ও কোয়ার্টার ফাইনাল শেষে কারা খেলছে সেমি ফাইনালে। অপেক্ষা করছো জমজমাট একটি ফাইনালের।
বিশ্বকাপ ফুটবলের প্রথম রাউন্ড শেষে শুরু হয় সেরা ১৬ দল নিয়ে দ্বিতীয় রাউন্ড। এখান থেকেই শুরু হয় নকআউট পদ্ধতিতে খেলা। অর্থাৎ যারা হারবে তারা বিদায় নেবে টুর্নামেন্ট থেকে আর বিজয়ী দল যাবে পরের রাউন্ডে। তাই নির্ধারিত সময়ে কোন খেলা অমীমাংসিত থাকলে অতিরিক্ত ৩০ মিনিট খেলা হয়। তাতেও কোন দল জিততে না পারলে প্রয়োগ করা হয় পেনাল্টি শুট আউটের মাধ্যমে টাইব্রেকিং পদ্ধতি। টাইব্রেকার এমন এক নাম যেখানে এলে নীরব হয়ে যায় উত্তেজনাময় ফুটবলের সব উদ্দামতা, থমকে যায় স্টেডিয়ামসহ পুরো ফুটবল দুনিয়া। গোল লাইন থেকে ১২ গজ দূরত্বের একটি বিন্দুর মধ্যে পেন্ডুলামের মত দুলতে থাকে ম্যাচের ভাগ্য।
মুহূর্তে নির্ধারিত হয়ে যায় দলের ভাগ্য। কেউ হিরো হয় কেউ বা ভিলেন। কিক নিতে যাওয়া খেলোয়াড়টি কিংবা প্রতিপক্ষ দলের গোলরক্ষক দু’জনকেই দিতে হয় চরম পরীক্ষা। হার্টবিট বেড়ে যায় দর্শকের। একটি দলকে হতাশা ও অন্য দলকে উচ্ছ্বাস উপহার দেয় এই পর্বটি। টাইব্রেকারকে অনেকে ‘কিক অব ডেথ’ বলেও সম্মোধন করে থাকেন। ১৯৯৪ বিশ্বকাপের ফাইনালে ইতালির বিপক্ষে জয়সূচক কিকটি নেয়ার পর ব্রাজিল দলনেতা দুঙ্গা বলেছিলেন, ‘ব্রাজিলিয়ানরা পেনাল্টিকে এতই গুরুত্বপূর্ণ ভাবে যে, তাদের মতে কেবল দেশের প্রেসিডেন্টকেই এই শট নিতে পাঠানো উচিত।’
যেভাবে শুরু
ফুটবল ইতিহাসে প্রথম পেনাল্টি নিয়েছিলেন ওলভহার্মটন ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের জন হিথ। ১৮৯১ সালের সেপ্টেম্বরে এক ম্যাচে একরিংটন স্ট্যানলির বিপক্ষে। গোলপোস্টের সামনে গুরুতর ফাউল ঠেকাতেই সে সময় ফুটবলে পেনাল্টি চালু করা হয়। পরবর্তীতে এই পেনাল্টিকেই টাইব্রেকার হিসেবে ব্যবহার শুরু হয়। আর আন্তর্জাতিক ম্যাচে প্রথমবারের মতো টাইব্রেকার হয় ১৯৭৬ সালে ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে। চেকোস্লাভাকিয়া ৫-৩ ব্যবধানে হারায় পশ্চিম জার্মানিকে।
১৯৭৮ সালের আর্জেন্টিনায় অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপে প্রথম প্রচলন হয় টাইব্রেকারের। অবশ্য সেবার কোন ম্যাচে টাইব্রেকারের দরকার হয়নি। ১৯৮২ সালের স্পেন বিশ্বকাপে দ্বিতীয় সেমিফাইনালে ফ্রান্স ও পশ্চিম জার্মানির ম্যাচটি বিশ্বকাপ ইতিহাসে প্রথম টাইব্রেকারে মীমাংসা হয়। নির্ধারিত সময়ে খেলায় ৩-৩ গোলে সমতা ছিল। ফ্রান্সের পক্ষে স্তাইলাইক তৃতীয় শট এবং ম্যাক্সিম বসিস ষষ্ঠ শটটা মিস করেন। জার্মানির পক্ষে চতুর্থ শট মিস করেন দিদিয়ের সিক্স। ৫-৪ ব্যবধানে জিতে যায় জার্মানরা।
এ পর্যন্ত বিশ্বকাপ ইতিহাসে মোট ২৬টি ম্যাচ গড়িয়েছে টাইব্রেকারে। ১৯৮৬ সালের মেক্সিকো বিশ্বকাপে তিন-তিনটি কোয়ার্টার ফাইনালের নিষ্পত্তি হয়েছিল টাইব্রেকারে। সেবারও ফ্রান্সকে নামতে হয়েছিল এই পরীক্ষায়। তবে তাতে তারা উতরে যায় ভালোভাবেই। ব্রাজিলকে তারা টাইব্রেকারে হারায় ৩-৪ ব্যবধানে। ১৯৯০ বিশ্বকাপে সেমিফাইনালের জমজমাট ম্যাচে ইংল্যান্ডের কপাল পোড়ে জার্মানির কাছে টাইব্রেকারে হেরে। অন্য সেমিফাইনালেও ইতালিকে টাইব্রেকারে পরাজিত করে দিয়াগো ম্যারাডোনার আর্জেন্টিনা। ১৯৯৪ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত সব আসরেরই ২য় রাউন্ডের একটি করে ম্যাচের ভাগ্য নির্ধারিত হয়েছিল টাইব্রেকারে।
বিশ্বকাপ ফাইনাল ম্যাচ টাইব্রেকারে মীমাংসা হওয়ার ঘটনা এ পর্যন্ত দু’টি। ঘটনাক্রমে দুবারই ইতালি ছিল এই ঘটনার সাক্ষী। ১৯৯৪ যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বকাপে রবার্তো ব্যাজিওর কিক মিস হলে চতুর্থবার শিরোপার স্বাদ পায় ডুঙ্গার ব্রাজিল (৩-২)। ২০০৬ সালের বিশ্বকাপ ফাইনালে আবারও টাইব্রেকার পরীক্ষায় নামতে হয় ইতালিকে। এবার অবশ্য ফ্রান্সকে ৫-৩ ব্যবধানে হারিয়ে শেষ হাসি হাসে আজ্জুরিরা। ২০১৪ বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে টাইব্রেকারে নেদারল্যান্ডসকে হারিয়ে ফাইনালে যায় আর্জেন্টিনা। সে আসরে দ্বিতীয় রাউন্ডে ব্রাজিল হারিয়েছিলো মেক্সিকোকে।
কারা সবচেয়ে সফল
টাইব্রেকারে দল হিসবে সবচেয়ে সফল জার্মানি। চারবার এই অগ্নিপরীক্ষায় নেমে প্রতিবারই হাসিমুখে মাঠ ছেড়েছে তারা। আর সবচেয়ে ব্যর্থ দল ইংল্যান্ড। এখন পর্যন্ত তিনটি বিশ্বকাপে টাইব্রেকারে অংশ নিতে হয়েছে ইংলিশদের। একবারও জয় নিয়ে মাঠ ছাড়তে পারেনি তারা।
আর্জেন্টিনা মোট পাঁচবার টাইব্রেকারে অংশ নিয়ে জয়ী হয়েছে চারবার। এর মধ্যে ১৯৯০ বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে যুগোস্লাভিয়াকে ৩-২ ব্যবধানে হারানোর পর সেমিফাইনালে ইতালিকে ৪-৩ ব্যবধানে পেছনে ফেলে ফাইনালে চলে যায়। ১৯৯৮ বিশ্বকাপের দ্বিতীয় রাউন্ডে বাতিস্তুতার আর্জেন্টিনা ৪-৩ ব্যবধানে হারায় ইংল্যান্ডকে। অন্য দিকে ২০০৬-এ জার্মানির কাছে কোয়ার্টার ফাইনালে হেরে যায় ৪-২ ব্যবধানে। আবার ২০১৪ সালে সেমিফাইনালে হারায় নেদারল্যান্ডসকে। ব্রাজিল চারবার মুখোমুখি হয় টাইব্রেকারের। এর মধ্যে প্রথমবার ১৯৮৬-র কোয়ার্টার ফাইনালে ফ্রান্সের কাছে ৩-৪ ব্যবধানে হারে। এরপর ১৯৯৪-এর ফাইনালে ইতালিকে (৩-২) আর ১৯৯৮ সেমিফাইনালে হারিয়েছিল নেদারল্যান্ডসকে (৪-২)। নেদারল্যান্ডসের জন্যও সেটি বিশ্বকাপে টাইব্রেকারের একমাত্র ঘটনা। ব্রাজিল গত বিশ্বকাপের দ্বিতীয় রাউন্ডে হারিয়ে ছিলো মেক্সিকোকে।
টাইব্রেকার ভাগ্যটা মোটেও সুবিধার নয় ইতালির। চার বারের মধ্যে তিনবারই হারতে হয়েছে তাদের। ১৯৯০ বিশ্বকাপ সেমিফাইনালে আর্জেন্টিনার বিপক্ষে ৩-৪, ১৯৯৪-এর ফাইনালে ব্রাজিলের সঙ্গে ২-৩ আর ১৯৯৮-র কোয়ার্টার ফাইনালে ফ্রান্সের বিপক্ষে তারা হারে ৩-৪-এ। অবশ্য ২০০৬ এর ফাইনালে তারা টাইব্রেকারে ফ্রান্সকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়।