Home গল্প আজব কাণ্ড -আহমেদ বায়েজীদ

আজব কাণ্ড -আহমেদ বায়েজীদ

‘খুনটা হয়েছে গতকাল রাতে, বুঝলে জামাল!’
নিজের কাজে মগ্ন ছিল চন্দ্রদ্বীপ থানার হেড কনস্টেবল জামাল উদ্দিন। বুঝতে পারেনি ইন্সপেক্টর ইমতিয়াজের কথাটা। তাই আবার জানতে চাইল ‘কী বললেন স্যার?’
‘বাংলাতেই তো বলেছি! খুনটা গতকাল রাতে হয়েছে।’ আবার বললেন ইন্সপেক্টর।
‘কোন খুনটার কথা বলছেন স্যার?’
‘তুমি যেটার আলামত সংগ্রহ করছো। এটা একটা মার্ডার কেস।’ কিছুটা বিরক্তি নিয়ে বললেন ইন্সপেক্টর।
কয়েক সেকেন্ড বসের দিকে চেয়ে থাকল জামাল, কিছু বলল না। তার স্যার কম কথার মানুষ। এরই মধ্যে কথাটা দু’বার বলেছেন। আবার জানতে চাইলে রেগে যাবেন; কিন্তু তার কথা মাথায় ঢুকছে না জামালের। এই সাতসকালে তারা এসেছে একটি দুর্ঘটনার খবর পেয়ে। পুকুরে পড়ে গেছে একটি প্রাইভেটকার। গাড়ির মধ্যেই পানিতে ডুবে মৃত্যু হয়েছে ড্রাইভিং সিটে থাকা লোকটির। খবর পেয়ে থানা থেকে ইন্সপেক্টর ইমতিয়াজের সাথে পাঠানো হয়েছে জামালসহ তিনজন কনস্টেবলকে।
থানা সদর থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরে বাড়িটি। মূলত একটি বাগান বাড়ি। ঢাকার ধনী ব্যবসায়ী কায়েস দস্তিদার কয়েক বছর আগে বাড়িটি কিনেছেন। গ্রাম হলেও এলাকাটির রাস্তাঘাট পাকা। বাড়িটাকে নির্জনই বলা চলে, আশপাশের বাড়িগুলোও একটু দূরে। তাই নিরিবিলি অবসর কাটানোর আদর্শ জায়গা। বাড়িতে একটা মাত্র পুরনো আমলের বিল্ডিং। সামনে একটা ছোট্ট মাঠ আর একপাশে পুকুর। দস্তিদার মাঝে মধ্যে দু-একদিনের জন্য আসেন বেড়াতে, কখনো পরিবার নিয়ে, কখনো বন্ধু-বান্ধব নিয়ে। একটু আগে গাড়ি থেকে তারই লাশ তোলা হয়েছে।
গতকাল রাতেই বন্ধু খবির হোসেনকে নিয়ে এখানে এসেছেন দস্তিদার। সকালে দুর্ঘটনার খবর থানায় জানিয়েছেন খবির হোসেন। তার মতে, নাস্তা আনতে পার্শ্ববর্তী বাজারে যাওয়ার জন্য গাড়ি নিয়ে বের হয়েছিলেন দস্তিদার। খবির ঘরেই ছিলেন। পানিতে বড় কিছু পতনের শব্দ শুনে বাইরে আসেন। এসে দেখেন গাড়িসহ পানিতে পড়ে গেছেন দস্তিদার। নিজে সাঁতার না জানায় বন্ধুকে বাঁচানোর চেষ্টা করতে পারেননি। তিনিই ফোন করেছেন থানায়।
ফায়ার সার্ভিসের লোকেরা এসে লাশসহ গাড়ি উদ্ধার করেছে। ইন্সপেক্টর ইমতিয়াজ দাঁড়িয়ে থেকে সব কিছু তদারকি করছেন। অনেকক্ষণ ধরে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে গাড়ি আর লাশ পরীক্ষা করেছেন ইন্সপেক্টর। লাশ ময়নাতদন্তের জন্য পাঠানোর নির্দেশ দিয়ে বাড়ির ভেতরটা দেখতে চাইলেন। বৃদ্ধ কেয়ারটেকার তাকে নিয়ে গেল বিল্ডিংয়ের ভেতর। যাওয়ার আগে কনস্টেবল জামালকে আবারো বললেন,সব কিছু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে টুকে নাও নোট বুকে। থানায় গিয়ে মার্ডার কেস ফাইল করতে হবে।
জামালের মাথায় তালগোল পাকিয়ে গেছে ইন্সপেক্টরের কথায়। সে জানে ইন্সপেক্টর ইমতিয়াজ অপ্রয়োজনীয় কথা বলার লোক নয়। দুই বছর হলো মফস্বলের এই থানায় এসেছেন। তদন্ত কাজে তার মতো এত দক্ষ লোক আগে দেখেনি জামাল। সামান্য ক্লু থেকেও তিনি আপাতদৃষ্টিতে অসম্ভব রহস্যের সমাধান করতে পারেন; কিন্তু কেন এমন অদ্ভুত কথা বলছেন মাথায় ঢুকছে না জামালের।
বেশি না মিনিট পনেরো সময় নিলেন ইন্সপেক্টর বাড়ির ভেতরটা দেখতে। বাইরে এসে বললেন,কায়েস দস্তিদারের সাথে যে লোকটি এসেছে সে কোথায়?
‘বন্ধুর মৃত্যুতে ভীষণ ভেঙে পড়েছে স্যার। ওই যে ওখানে। হাত দিয়ে বাড়ির একটি অংশে দেখাল জামাল। গাছের নিচে চেয়ার পেতে বসে আছে খবির হোসেন। কয়েকজন গ্রামবাসী ঘিরে আছে তাকে। ইন্সপেক্টর বললেন, ওকে নিয়ে যেতে হবে আমাদের সাথে। সন্দেহভাজন খুনি।
জামাল চোখ বড় করে তাকিয়ে রইলো ইন্সপেক্টরের দিকে। বললো,আপনি কী বলছেন বুঝতে পারছি না স্যার। দুর্ঘটনা ঘটেছে আজ ভোরে। আপনি বললেন খুন, তাও নাকি হয়েছে গতকাল রাতে! আপনার মাথাটা কি ঠিক আছে স্যার! বলেই জিবে কামড় দিলো। বুঝলো এবার তার খবর আছে; কিন্তু রাগলেন না ইন্সপেক্টর।
দাঁড়াও বলছি। এটুকু বলে থামলেন। যেন জামালকে ধোঁয়াশার মধ্যে রেখে মজা পাচ্ছেন তিনি। অন্য দু’জন কনস্টেবলকে ইশারায় খবির মিয়াকে আটক করতে বললেন। তারপর জামালের দিকে ফিরে বললেন, এখন কয়টা বাজে? সোয়া নয়টা। হাতঘড়ি দেখে বললো জামাল।
গুড, কায়েস দস্তিদারের গাড়ির ড্যাশ বোর্ডের সাথে একটা ঘড়ি লাগানো আছে খেয়াল করেছো নিশ্চয়ই। গাড়িটা পুকুরে পড়ার পর পানি ঢুকে ঘড়িটা নষ্ট হয়ে গেছে। ঘড়ির কাঁটাটা থেমে আছে দশটা পঁচিশ এর কাছে। তার মানে আজ ভোরে তো আর দশটা পঁচিশ বাজেনি এখনো, বেজেছে গত রাতে।
তাই তো! মুখ হাঁ হয়ে গেছে জামালের। তাহলে কি স্যার, গাড়িটা পানিতে পড়েছে গতকাল রাত দশটা পঁচিশ বা তার কিছু আগে?
পড়েনি, গাড়িটাকে ফেলে দেয়া হয়েছে। পানি ঢুকে ঘড়ি নষ্ট হতে পাঁচ থেকে দশ মিনিট লাগতে পারে। তাই নয়টা ২০-২৫ এর দিকে গাড়িটাকে পুকুরে ফেলে দিয়েছে খুনি।
কিন্তু স্যার শুধু এইটুকু ক্লুর ওপর নির্ভর করে এতবড় একটা বিষয়ে সিদ্ধান্তে আসা যায়? ঘড়িটা আগে থেকেও তো নষ্ট থাকতে পারে। জামালের কণ্ঠে সন্দেহ।
তা পারে। তবে গাড়ির কাগজপত্র দেখেছি আমি, মাত্র চার মাস আগে কেনা হয়েছে ব্র্যান্ডনিউ প্রাইভেট কারটি। এমন নতুন আর দামি গাড়ির ঘড়ি নষ্ট থাকার কথা নয়। আরেকটা ক্লু বলি তোমাকে। একটু থেমে আবার বললেন ইন্সপেক্টর- গাড়িটার গিয়ার নিউট্রাল করা ছিলো, সেটাও তুমি খেয়াল করোনি। চলতে গিয়ে গাড়ি পানিতে পড়লে ফ্রন্ট গিয়ারে থাকবে, নিউট্রাল করা থাকবে না নিশ্চয়ই! তার মানে হচ্ছে পুকুর পাড় পর্যন্ত চালিয়ে নিয়ে গাড়িটা ঠেলে পানিতে ফেলেছে কেউ। ফেলে দেয়ার আগে দস্তিদারকে বসিয়ে দিয়েছে ড্রাইভিং সিটে। গিয়ার নিউট্রাল করা না থাকলে গাড়ি ঠেলে নেয়া যায় না সেটা তো জানো নাকি!।
তাই তো! বিস্ময়ে হাঁ হয়ে গেছে জামালের মুখ। ‘কিন্তু সেটা কিভাবে সম্ভব স্যার, দস্তিদার বাধা দেয়নি?
তাকে কোন কিছুর সাথে মিশিয়ে ঘুমের ঔষধ খাওয়ানো হয়েছিলো বলে ধারণা করছি। ঘরের ভেতর আলনায় ঝোলানো একটি স্যুটের পকেটে ঘুমের ঔষধ পেয়েছি আমি। এমন কিছু খুঁজতেই ঘরটা সার্চ করেছি। পোস্টমর্টেম রিপোর্ট এলে জানা যাবে দস্তিদারের মৃত্যু কখন হয়েছে এবং শরীরে ঘুমের ওষুধ ছিলো কি না। আসা করি তখন তোমার সব প্রশ্নের জবাব পাবে। আর এসব করার জন্য খবির হোসেন ছাড়া এখানে কাউকে দেখছি না।
জামাল বললো, তার মানে হচ্ছে, গত রাতে খবির তার বন্ধুকে ঘুমের ঔষধ খাইয়ে ড্রাইভিং সিটে বসিয়ে গাড়িটা ঠেলে পুকুরে ফেলেছে! আর থানায় জানিয়েছে সকালে দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতো মহা চালাক লোক।
‘যত চালাকই হোক, অপরাধীরা স্নায়ুর চাপে কিছু ভুল করে অপরাধের প্রমাণ রেখে যায়। প্রথমে গাড়ির ঘড়িটা দেখেই আমার সন্দেহ হয়েছে। তারপর অন্যগুলো খুঁজে বের করেছি। আর বন্ধুর হাতে খুন হওয়ার ঘটনা তো নতুন কিছু নয়।
কী কারণ থাকতে পারে এই খুনের পেছনে, স্যার?
তা জানতে হলে দু’জনের সম্পর্কে বিস্তারিত খোঁজ নিতে হবে। প্রয়োজনে ঢাকায় যেতে হবে তদন্তের কাজে। তোমাকেও যেতে হতে পারে আমার সাথে, প্রস্তুত থেকো।’
‘ইয়েস স্যার!’ বলেই ইন্সপেক্টর ইমতিয়াজকে স্যালুট করলো জামাল। চেহারায় একরাশ খুশি আর মুগ্ধতা।

SHARE

Leave a Reply