Home গল্প একটু হাসি একটু খুশি -ঝর্ণা দাস পুরকায়স্থ

একটু হাসি একটু খুশি -ঝর্ণা দাস পুরকায়স্থ

ছোটবেলায় আমি অনেক ভুলভাল কাজ করেছি। এ জন্য মাঝে মাঝে খুব মন খারাপ হয় আমার। বাবার মারও খেয়েছি প্রচুর। টুকটুকে ফর্সা রাঙা মামু বরাবরই খুব কাছের। আমার কষ্টের কথা বুঝে পিঠ চাপড়ে বলে, দূর বোকা, ছেলেবেলায় কে ভুলভাল করেনি বল। আরে বাবা বড় বয়সে জেনে শুনে মানুষ যাচ্ছে তাই ভুল করে বসে। আসল কথা, কোনো মানুষই পারফেক্ট নয়।
রাঙামামুর কথায় মনটা ভালো হয়ে যায়। তারপরও কিছু কিছু দিনের কথা কিছু ঘটনা মন থেকে মুছে যেতে চায় না।
ক্লাস ওয়ানে পড়ি তখন। বয়স সাড়ে সাত। একদিন সন্ধ্যায় বাবা চোখ রাঙিয়ে কাছে আসেন। আমি থত্থর করে কাঁদতে থাকি। হুঙ্কার দিয়ে বাবা বলেন, তুমি ভয়ঙ্কর খারাপ কাজ করেছ। এই শিক্ষা দিয়েছি তোমাকে! তোমার কোনো ক্ষমা নেই। আম্মু মিষ্টি সুরে জিজ্ঞেস করেছেন, কি এমন খারাপ কাজ করেছে রন্তুম? অফিস থেকে ফিরে ওর ওপর হামলে পড়লে কেন?
– কী করেছে- তাই না? জিজ্ঞেস করো তোমার গুণধর পুত্রকে। পরীক্ষায় ফার্স্ট-সেকেন্ড হলে বাবার ছেলে, কোনো দোষ করলে সে মায়ের ছেলে হয়ে যায়।
বাবার এই অদ্ভুত থিয়োরি আমি কোনোদিন বুঝতে পারিনি।
মা কিছুটা বিরক্ত হয়ে বলে, কি করেছে রন্তুম তা তো বলবে।
– কী করেছে তুমি আবার জিজ্ঞেস করছ? তোমার মতো মায়েদের জন্যই ছেলেপুলে নষ্ট হয়।
এরপর বাবা আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। নিয়মিত ব্যায়াম করা মজবুত শরীর তার। কিল-ঘুষি-থাপ্পড়-লাথি আমার শরীরে বৃষ্টির মতো ঝরতে থাকে।
আচমকা এই হামলায় ডুকরে কাঁদি। চেঁচিয়ে উঠে, কিছুক্ষণ পর ক্লান্ত হয়ে পড়ি।
কী করেছি আমি তখনও বুঝে উঠতে পারিনি। মা ঝাঁপিয়ে পড়ে বলেন, কি করছটা কি তুমি? তুমি কি মানুষ?
– সরে যাও, সরে যাও বলছি।
রাগলে বাবা ভয়ঙ্কর। তিনি তখন অচেনা মানুষ হয়ে ওঠেন। আম-আমলকী-কৃষ্ণচূড়া-বট আর নিমের ছায়াঘেরা সেই মফস্বল শহরে আমার কান্না ছড়িয়ে পড়েছে সে রাতে। ব্যাপারটা নতুন কিছু নয়। বাবা ছেলেকে শাসন করছে। এর মাঝে বলার কী আছে? শাসন না করলে ছেলেপুলেরা কি ভাল হয়? এ খুব স্বাভাবিক ব্যাপার।
ভয়ঙ্কর রাগী বাবার শাসন না জানা দূর দেশে ফেরারি হয়ে গেছে।
সেই ছোট বয়সে লজ্জা ব্যাপারটি মাথায় আসেনি। হাতে-পিঠে অগুনতি কালশিটে নিয়ে ভাবতে থাকি-কী করেছি-আমি? কেন মার খেলাম?
পাশের বাড়ির ডাব্বুর মা-বাবা শুনবে, রিংকুর দাদু ফিকফিক করে হেসে বলবে, কিরে, কাল রাতে কী হয়েছিল? জবর পিঠে পুলি খেয়েছিস-তাই না?- এসব কথা ভেবেও লজ্জা পাচ্ছি না।
মা হঠাৎ করে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন বাবার ওপর।
– কি করছটা কি শুনি? তুমি কি মানুষ? সরে যাও তুমি, সরে যাও বলছি।
হাঁফিয়ে গেছেন বাবা! চেয়ারে বসে বলতে থাকেন, এই স্কাউন্ড্রেলটার জন্য; এই রাসকেলটার জন্য স্কুলে আমাকে কল করেছে। ফাহিমকে তুই মেরেছিস কি না বল।
ওহ- এই ব্যাপার! গভীর রাত। কান্না আমার থেমে গেছে, গাল বেয়ে ঝরে পড়া কান্না মা ভেজা টাওয়েল দিয়ে মুছিয়ে দিয়েছেন।
সেদিন আমি মায়ের পাশে শুয়েছি। বড় ভাই অন্তুম দাদা একা একা শুয়েছে। দুষ্টুমির হাসি হেসে বলেছে- বুঝলি রন্তুম, আজ মার খেয়েছিস তো কাল বাড়িতে ঠিক দই মিষ্টি আনবে বাবা। আয় আজকের রাতটাকে সেলিব্রেট করি।
– অন্তুম- গর্জে ওঠেন মা।
– ছোট ভাইয়ের সংগে ফান করছ? ছি: ছি- শেম অন ইয়ু। অন্তুম দাদা ধমক খেয়ে মশারির ভেতরে ঢুকে গেল।
মা সিগ্ন্ধ স্বরে বলে, এবার বলো কি অন্যায় করেছ তুমি। গার্জেন কল করল কেন?
আমি ধীরে ধীরে বলি, ফাহিমকে আমি সত্যিই মেরেছি মা।
– তুমি মেরেছ ছেলেটাকে? স্কুলে তুমি মারপিট করো রন্তুম?
– মা তুমি শান্ত হয়ে শুনবে তো। ফাহিম রোজ আমার খাতার পাতা ছিঁড়ে দেয়, পেনসিল-বলপেন বাইরে ফেলে দেয় যাতে আমি না লিখতে পারি। প্রথম দিন স্কুলে যাবার সময় বলে দিয়েছিলে, খবরদার কারো সাথে ঝগড়া করবে না মারামারি করবে না। তোমার কথা আমি শুনেছি মা। ফাহিম ধাক্কা মেরে ফেলে দিত, পা দিয়ে ল্যাং মারত। রোজ রোজ এমন করত মা।
মা আমার দিকে অপলক তাকিয়ে বলে, তুমিতো কখনও এসব কথা বলোনি। আমাকে বলবে তো?
– বলিনি তোমার মন খারাপ হবে বলে। কিন্তু রোজ রোজ এসব সহ্য করা যায়- তুমিই বলো। কালকেই আমি ওকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়েছি। এই প্রথম এ কাজটি করেছি মা, আর কখনো এমন করিনি।
মা সে রাতে চমৎকার একটি গল্প বলেছেন।
– শোনো তাহলে, এক গাঁয়ে একজন সন্ন্যাসী ছিলেন। তিনি আপন মনে তার কাজকর্ম করতেন। গাঁয়ের লোকজন যখন হাটে যেত, নদীতে নাইতে যেত তখন উনি জিজ্ঞেস করতেন- কেমন আছেন আপনারা। গাঁয়ের লোকরা একদিন ওর কাছে এসে বলল, হে সন্ন্যাসী- আমরা তো এক বিষাক্ত সাপের জালায় বড় বিপদে পড়েছি। কাউকে সে তাড়া করে, কোনোদিন ছোবল দেয়- এ নিয়ে আমরা বড় আতংকে আছি। বিষাক্ত সেই সাপের জালায় সারাক্ষণ আমরা ভয়ে ভয়ে থাকি।
সন্ন্যাসী বলেন, ওকে আমার কাছে আসতে বলো।
সাপকে দেখে তিনি বলেন, মানুষকে এত জালাচ্ছিস কেন, ওদেরকে শান্তিতে থাকতে দিবি। কাউকে তাড়া করবি না, ছোবল দিবি না, তোর বিরুদ্ধে আমি যেন কোনো নালিশ না শুনি।
এরপর থেকে গাঁয়ের মানুষ তো মহাখুশি। সন্ন্যাসীকে বলে, হে সন্ন্যাসী- আপনি শাসিয়ে দেয়ার পর আমরা খুব শান্তিতে আছি। সাপটি একেবারে শান্ত হয়ে গেছে, কাউকে জালায় না।
সাপ একদিন এসে হাপুস চোখে কাঁদতে শুরু করে। আমাকে গোটা গাঁয়ের লোক আসতে যেতে লাঠি দিয়ে পেটায়, ইট ছুঁড়ে মারে, লাথি দেয়। আমি আর সইতে পারছি না সন্ন্যাসী বলেন, দ্যাখ- আমি তোকে ছোবল মারতে আর তাড়া করতে নিষেধ করেছি, ফনা তুলে ফোঁস ফোঁস করা বাদ দিলি কেন?
মায়ের গল্প শুনে আমি হেসে উঠি, দাদাও হাসে। মা বলে, দ্যাখো রন্তু ফাহিম রোজ তোমাকে ধাক্কা দেয়, ল্যাং মারে খাতার পাতা ছিঁড়ে দেয়, তুমি কিছুই বলো না- তাইতো? আমি বলি- হ্যাঁ মা।
– তোমার একটু হলেও প্রতিবাদ করা উচিত ছিল। প্রতিবাদ করলে ফাহিম রোজ তোমার সাথে অমন করত না। গল্পটি বুঝেছ তো? অন্যায়ের প্রতিবাদ সব সময় করতে হয়, মুখ বুজে বসে থাকলে অন্যায় করা আরও বেড়ে যায়।
মায়ের গল্প থেকে অনেক কিছু শিখলাম আমি। বাবার মারের কথা বেমালুম ভুলে গেছি। বুকের ভেতরটা আমার হালকা হয়ে এল। আমার গায়ে মা তার কোমল হাত বুলিয়ে দিতে থাকেন। ঘটনার পরদিন বাবা পদ্মার ইলিশ নিয়ে এলেন। বুকে পাথর বেঁধে মাকে রাঁধতে হয়েছে। সবাইকে নিয়ে খেতে বসেছেন বাবা, যতটুকু খান তার চেয়েও সেদিন বেশি ভাত নিয়েছেন। মাকে বলেছেন, রিনা, আমার প্লেটে দু’চামচ ভাত দিয়ে যাও তো, আর এক পিস মাছ দাও। দারুণ হয়েছে মাছটা, তবে আগে যে পদ্মার ইলিশ খেয়ে স্বাদ পেয়েছি এখন আর তেমনটি নেই।
অবলীলায় গল্প করছেন বাবা। বাড়িতে সবাই খাবে আনন্দ করবে, হৈ চৈ হবে শুধু আমি কোনো আনন্দে শরিক হতে পারব না। বাবার শাস্তি এমনই।
মা সব সময় মৃদু গলায় বলেন তোর বাবাকে সবাই ভয় পায় ভালবাসে না। রন্তুম তুই এমন ভালো হবি, সবাই যেন তোকে ভালবাসে। মিছেমিছি মানুষ ভয় পাবে কেন তোকে দেখে?
বাবা ভরপেট খেয়ে ঘুমোতে গেলে মা জুঁই ফুলের মত সাদা ভাতে ইলিশ ভাপা মেখে আমাকে খাওয়াতে এলেন। মা ভাত মেখে আমার মুখে দেয়। মা কাঁদে আমিও কাঁদি।
দুদিন পর বাবার রাগ কমে গেলে সন্দেশ আর মিষ্টি দই এনেছেন, আদরও করেছেন বাবা। এরপরও আমার সেই বালক বয়সে ছোট্ট এক আলপিনের মত কাঁটা বিঁধেছিল বুকে।
অন্তুম দাদা বলল, দেখেছিস, বাবা তোকে মারে তারপর মিষ্টিও আনে- ঠিক বলিনি?
মা গম্ভীর গলায় বলেন, অন্তুম তুমি খুব ভালো ছাত্র, অঙ্কে ফুল মার্কস পাও, তা বলে ভেবনা তুমি ভাল মানুষ হবে।
বাবার কঠোর শাসন, অন্তুম দাদার গায়ে লাগা কথায় খুব কষ্ট হয় আমার, সব কষ্ট ধুয়ে মুছে যায় রিংকুর দাদুর কথায়।
মায়া ভরা সুরে দাদু বলেছেন, বাবা খুব মেরেছে? লেগেছে খুব? তোর বাবার তো সেই একগুঁয়ে ধারণা- স্পেয়ার দ্য রড স্পয়েল দা চাইল্ড। কথাটি কিন্তু ঠিক নয়। ছোটদের আদর করে বুঝিয়ে বলতে হয়, গায়ে হাত দেয়া ঠিক নয়।
দাদুর মিষ্টি আর মোলায়েম কথায় চোখ আমার ভিজে ওঠে। অন্তুম দাদা বাবার খুব আদরের। ক্লাসের ফার্স্ট বয়, অঙ্কে ফুলমার্কস পায়। একটু আধটু বকুনি শুধু দিতেন ওকে।
মা সেই ভোর থেকে রাত বারোটা পর্যন্ত সংসারের দেখাশোনা করে, এর কোনো মূল্যই ছিল না বাবার কাছে।
বাড়িতে নতুন দামি সোফা এসেছে। ঠিক সাদা নয় কিছুটা ছাইরঙ ঘেঁষা। খুব পছন্দ হয়েছিল আমার। একটু পর পর দেখি, বার বার দেখেও আশ মিটে না।
বাবা হুকুম দিলেন, দুলি, এ্যাই দুলি- রোজ সকালবেলা ভালো করে ডাস্টিং করবি। রাতে ঝেড়ে মুঝে ঢেকে রাখবি। দুলি মাথা নাড়ে।
এর মাঝে মায়ের কোথাও যাবার দরকার পড়েছে, শাড়ি ইস্ত্রি করছেন মা। তাড়াহুড়োতে খেয়াল না করে গরম ইস্ত্রি সোফার মাঝে রেখে দিলেন। ব্যস, হয়ে গেল। ইস্ত্রির মাপের জায়গাটুকু পুড়ে একসা।
ফ্যাকাসে হয়ে গেছে মায়ের মুখ। নতুন সোফা, বাবা কি বাসার কাউকে আস্ত রাখবেন! মায়ের কষ্ট হবে কি বাবার ভয়ে তার মুখ শুকিয়ে এইটুকুন হয়ে গেল। মায়ের ছাইরঙা একটি কাপড় দিয়ে জায়গাটি ঢেকে রাখি তখনকার মতো।
রাঙা মামু বেরিয়ে গেলে ভালো কারিগরের খোঁজে।
এসে বলল, তুই এত ভয় পাচ্ছিস কেন দিদি? ভালো কারিগর পেয়েছি, একেবারে নতুনের মতো করে দেবে।
– কখন আসবে রে রাঙা?
– আজ আসতে পারবে না দিদি। অনেক করে বললাম, অন্য জায়গায় কাজের জন্য চলে গেছে। কাল সকাল এগারোটায় আসবে। জামাইবাবু অফিসে বের হয়ে যাবার পর।
মায়ের সময় আর কাটে না। আনুমাসী রেঁধে বেড়ে আমাদের খাওয়াল। দুলি ঘরের খুঁটিনাটি কাজগুলো করল। মা সেই সকাল থেকে ঠায় বসা।
অফিস থেকে ফিরে বাবা বললেন, কোনোদিন তো অফিস থেকে এসে তোমাকে এমন করে বসতে দেখিনি, কি হলো কি তোমার?
মামু বলল, দিদির আরথ্রাইটিসের ব্যথাটা বেড়েছে।
– তাহলে বসে কেন ডাক্তারের কাছে নিয়ে যা।
পোড়া জায়গাটুকুতে মায়ের শাড়ি দেয়া, তার ওপরে মা বসা। উঠে গেলেই তো বাবার অভিজ্ঞ চোখে তা ধরা পড়ে যাবে।
মা তড়িঘড়ি করে বলেন, ওষুধ তো খেয়েছি, বসে থাকলেই কমে যাবে।
সে রাতে রাঙা মামু বাবাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে রাখেন ডাইনিং টেবিল ঘিরে জমাটি আড্ডাতে। বেডরুমে এসে টিভি খুলে দিয়ে প্রোগ্রাম নিয়ে কথা বলতে থাকেন মামু।
-দারুণ নাটক হচ্ছে, আপনি এসব দেখেনই না। বাবা বোকার মত বলতে থাকেন, কী ব্যাপার- বলতো রাঙা? তোমার দিদি ড্রয়িং রুমে বসা। তুমি আমাকে একটার পর একটা কথার মারপ্যাঁচে ভুলিয়ে রাখছ, কিছু ঘটেছে নাকি বাড়িতে! সত্যি করে বলতো!
ভাগ্যিস অন্তুম দাদা তখন খেলতে গেছে নয়তো ব্যাপারটি বাবার কানে যেতে এক পলকও বয়ে যেত না।
রাঙা মামু মলিন মুখে বলে, বাড়িতে কিছু ঘটলে আপনি জানতেন না জামাই বাবু? আমাকে আপনি সন্দেহ করেন?
– না না আমি ওসব ভেবে বলিনি। তুমি মাইন্ড করলে নাকি রাঙা? স্যরি ভাই।
বাবা এই প্রথম বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়েছেন। সাব্বাস মামু। মনে মনে আমি দারুণ খুশি হয়েছি।
পরদিন বাবা অফিসে আমরা দু’ভাই স্কুলে-এ সময়টাতে সোফার কারিগর এসে পোড়া জায়গাতে নতুন কাপড় লাগিয়ে একেবারে ঠিকঠাক করে দেয়। বাবা জানতেই পারলেন না ঘটনাটি কেউ বলেনি তাকে। কারণ তাকে সবাই ভয় পায়। আজ মায়ের স্বাভাবিক সিগ্ধ মুখ।
এরপর কেটে গেছে দিন-মাস-বছর। অন্তুম দাদা আর আমি দুজনেই বড় হলাম। আমার প্রতিদিন কানে বাজত শুধু মায়ের কথা। তোমাকে যেন সবাই ভালবাসে রন্তুম। কেউ যেন ভয় না পায়।
বাবা চাকরি থেকে রিটায়ার করার পরই স্ট্রোক করল তার। অন্তুম দাদা তখন কানাডার ক্যালগেরি ইউনিভার্সিটিতে জয়েন করেছে। মা-বাবা আর বাড়ি দেখাশোনা করার দায়িত্ব আমার।
সরকারি কলেজে জয়েন করেছি আমি। কলেজে যাবার আগে রোজ বাবার পাশে কিছুক্ষণ বসি। বাবা আমার হাতে হাত রাখেন। মা খাইয়ে দেন। আমরা দু’জনেই বাবাকে যতœ করি। শান্তিতে রাখার চেষ্টা করি। বাবার ক্লান্ত ঘোলাটে চোখের দিকে তাকিয়ে মনে হয়, কেন বাবা আমাকে সেদিন কাছে ডেকে আদর করে একবারও জিজ্ঞেস করলেন না,- কেন তুই ফাহিমকে মারলি রন্তুম?
আমি তো সব খুলে বলতে পারতাম, যেমন মাকে বলেছি। মায়ের মতো বাবাও তো আমায় বুঝিয়ে দিতে পারতেন।
মনে মনে প্রতিজ্ঞা করি, আমি অমন ভুল করব না। মা রাঁধতে ভালোবাসেন বলে ফোর বার্নার গ্যাস ওভেন কিনে দিয়েছি মাকে। মিক্সি মাইক্রোওয়েভ সব কিনে দিয়েছি। মায়ের চোখে আনন্দের টলমল পানি দেখি।
এত জিনিস কেনার কি দরকার ছিল শুনি? খুব খারাপ রন্তু। মুখে মা বললেও আমি জানি মা দারুণ খুশি হয়েছেন। আমি মনে মনে বলি, তুমি খুশি হয়েছ তো মা?
বিকেলে আমার কাছে ছেলেমেয়েরা ইংরেজি পড়তে আসে। কলেজে বা বাসায় পড়াতে পড়াতে আমি একটুও ক্লান্ত হই না।
বাড়িতে সারাক্ষণ শান্তির সুবাতাস খেলা করে। সবাই মন খুলে কথা বলি। কেউ কাউকে ভয় পাই না।
অন্তুম দাদা বিদেশের ভার্সিটিতে কম্পিউটার সায়েন্সের টিচার। মাঝে মাঝে এসে দেড়-দু’মাস থেকে যায়। কী আনন্দ তখন। বাবার সামনে বসে সবাই মিলে গল্প করি, ঠা ঠা করে হাসি।
পোষা ময়না পাখিটি বলে ওঠে- হাসো হাসো বেশি করে হাসো। অন্তুদা হেসে গড়িয়ে পড়ে।
– আনন্দে ভরে আছে মা বাড়িটা। আগে তো এমন ছিল না। সবাই হাসি খুশি, ব্যাপার কি মা? তুমি কি ম্যাজিক জানো!
তুলি কফি নিয়ে এসেছে। সবাই আয়েশ করে চুমুক দিচ্ছি। দুলির ছোট বোন তুলি জিজ্ঞেস করে বড়দা ছোড়দা কফিতে দুধ-চিনি ঠিক হয়েছে তো? দাদা আর আমি একসাথে বলি, একেবারে পারফেক্ট হয়েছে। সব ঠিকঠাক হয়েছে বলায় তুলি দারুণ খুশি।
মা বলে, তুই ম্যাজিকের কথা বললি না অন্তুম? ম্যাজিকটা রন্তুম জানে। বুকের ভেতরটা আনন্দে উপচে পড়ে আমার।
আমরা দুভাই অবাক হয়ে মাকে নতুন করে দেখি। মা তুলির প্লেটে ইলিশ মাছের মুড়ো তুলে দেন, আর মাছের ল্যাজ খেতে দেন।
তুলির চোখ থেকে কান্নার দানা ঝরে।
হেসে বলি, দূর বোকা-কাঁদছিস কেন? কালকেই আমি ইলিশ আর আড় মাছ নিয়ে আসব। অন্তুম দাদাকে আড় মাছ দিও ও তো ইলিশের কাঁটা বেছে খেতে পারে না, আমাকে ইলিশের মুড়োটা দিও। এবার হলো তো বোকা মেয়ে? খা এবার খাতো।
অন্তুম দাদা ছুটির প্রতিটি মুহূর্ত এনজয় করে।
– আজ কি রেঁধেছ মা?
-মুরগির কোরমা রেঁধেছি রে
কাঁচের বাটি ভর্তি ঘি-এলাচ-দারুচিনি আর মশলায় ডুবানো অনেকগুলো মুরগির রান।
অন্তুম হাসি মুখে বলে, রোজই ম্যাজিক দেখাচ্ছ মা, মুরগির তো দুটি রান মা, এতগুলো রান হলো কী করে?
পোষা ময়না শিস দিয়ে বলে, ড্রামস্টিক খাও, ড্রামস্টিক খাও, -ময়না ড্রামস্টিক বলে,দারুণ তো।
বাবা জড়ানো গলায় বলেন, রন্তু রন্তু শিখিয়েছে।
সবার প্লেটে পোলাও আর মুরগির রান তুলে দিচ্ছে মা।
– এ ম্যাজিকটাও শিখিয়েছে রন্তুম।
অন্তুম খেতে খেতে বলে, দারুণ হয়েছে মা। এবার রন্তুমের ম্যাজিকের কথা বলো।
মা হাসিমাখা মুখে বলে, চারটে করে মুরগি এনে ডিপফ্রিজে রেখে দেয় রন্তু। রহিমা বুয়া কুটে প্যাকেট করে দেয়। রানগুলো এক প্যাকেটে রাখে। রন্তু বলে সবাই আমরা একসঙ্গে রান খাব।
তুলি রান চিবোচ্ছে খুশি খুশি মুখে। মুখভর্তি পোলাও খেতে খেতে বলে, আমরা একসঙ্গে সবাই রান খাই বড়দা।
বুয়া রান্নাঘর পরিষ্কার করে, বাসন মেজে শেষ করেছে। বলে, আমি অহন যাইগা আম্মা।
– সে কি? তুমি খাবার নিয়ে যাবে রহিমা।
বাবা, সবাই দেখে মায়ের নিপুণ হাতের কাজ যত্ন করে পোলাও বাড়ছেন মা, টিফিন বক্সে দুটি রান, আলু গাজর মেশানো অনেকখানি কোরমা।
রহিমা বুয়ার ভেজা ভেজা চোখ। কান্না ভাঙা অস্ফুট গলায় ও বলে, পোলাডারে লইয়া মুরগির রান খাওয়ার সখ আমার অনেক দিনের আম্মা।
ময়না বলে, রহিমা বুয়া বাড়িতে যাও, রহিমা বুয়া বাড়িতে যাও। অন্তুদা বলে, ক্যালগেরি আর ফিরে যেতে ইচ্ছে করছে না। এত আনন্দ মা বাড়িতে। মা খুশি হয়ে বলেন, থাক না রে অন্তু, সবাই মিলে একসঙ্গে থাকব, কত আনন্দ হবে।
সে রাতে বাবাকে ঘিরে বসেছি সবাই। মোবাইলে মিষ্টি সুরে গান বাজছে। মা ধীরে ধীরে বলতে থাকেন, মানুষ উদাহরণ দিলে বিদ্যাসাগর মশাইয়ের কথা বলে। কী মাতৃভক্তি তার। মায়ের প্রতি তার কি অতুলনীয় ভক্তি। মায়ের আদেশে তিনি দামোদার নদী পার হয়ে মাকে দেখতে এসেছিলেন। আমার রন্তুমের কথা তো কোনো বইয়ে লেখা হবে না।
এই সংসারের জন্য রন্তুমের কাছে শুধু শান্তি-সুখ চেয়েছিলাম। বাড়িটি যেন হাসি-খুশিতে ভরে থাকে। ও তাই দিয়েছে আমাকে। কেউ কাউকে ভয় পায় না, সবাই সবাইকে ভালোবাসবে। উজাড় করে সব আমাকে দিয়েছে রন্তু।
অনেক হাসি অনেক খুশি ভরা বাড়িতে বসে মায়ের চোখ থেকে কান্না ঝরে। আমি আর দাদাও আনন্দে কাঁদি।
কী আশ্চর্য! বাবার ক্লান্ত-ঘোলাটে দুটি চোখও কান্নায় ভেসে যাচ্ছে।

SHARE

Leave a Reply