কাঁধে বস্তা ঝুলিয়ে ছুটোছুটি চিৎকার চেঁচামেচি হই-হুল্লোড় কয়েক শিশু কিশোরের। একবার রাস্তার এ পাশে তো পরেরবার ওপাশে। আবার মাঝে মধ্যে দেখা যায় রাস্তার পাশে স্তূপকরা ময়লার ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে কী যেন খুঁজে বেড়াচ্ছে ওরা। কিছু পেয়ে গেলে কাঁধে ঝুলানো বস্তায় ঢুকিয়ে আবার দৌড়, ছুটোছুটি। রাস্তার পাশের এতসব কিছু চোখ এড়ায় না তাওসিফের। গাড়িতে বসে দামি গ্লাসের ভিতর থেকে আনমনে তাকিয়ে প্রায়শই দেখে তারই মত শিশু-কিশোরদের দুরন্তপনা। ছোট্ট তাওসিফ গুলশানের বিদ্যানিকেতনে পড়ে। প্রতিদিন গাড়িতে করে ওর আম্মু ওকে স্কুলে দিয়ে আসে স্কুল শেষে আবার গাড়িতে করেই নিয়ে আসে।
বিলাসবহুল বাসা আর স্কুল এর গন্ডির মাঝেই তাওসিফের জীবন। যতক্ষণ স্কুলে থাকে ততক্ষণ ক্লাসে পড়াশোনা নিয়েই ব্যস্ত। আবার যখন বাসায় ফেরে তখন চার দেয়ালের মাঝেই সারাক্ষণ মায়ের ব্যস্ততা তাকে নিয়ে। বাইরের জগৎ সম্পর্কে সে কিছুই জানে না। বিকেলে বাসার ছাদে তার মত ধনাঢ্য পরিবারের ছোট ছোট ছেলেদের সাথেই খেলাধুলা করে সে। এর বাইরে পড়াশোনার ফাঁকে কম্পিউটারে গেমস খেলে আর টিভিতে কার্টুন দেখেই সময় কাটে তাওসিফের।
কিন্তু তাওসিফের রাজ্যের বিস্ময় স্কুলে যাওয়া আসার পথে দেখা ফুটপাথের ওপর। সেখানে বসবাস করা দুরন্ত ছুটোছুটি করা শিশু-কিশোরদের ওপর। ফুটপাথের শিশুরা দেখতে অবিকল তারই মতো। স্কুলে যাওয়া এবং আসার পথে ট্রাফিক জ্যামে তাওসিফ গাড়ির গ্লাস নামিয়ে খুব মনোযোগ সহকারে দেখে তার মত শিশুরা কী করছে। মাঝে মধ্যে তাওসিফ তার আম্মুকে ফুটপাথে দেখা দুরন্ত শিশুদের ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করে জানতে চায় অনেক কিছু। তাওসিফের আম্মু প্রশ্নগুলোর জবাব তার মতো করেই দেয়ার চেষ্টা করেন।
তাওসিফ তার আম্মুর কাছেই জানতে পারে ওদের প্রচলিত নাম টোকাই। রাজপথের ধারে ফুটপাথই ওদের বাড়ি। পুরনো রিকশার টায়ার ওদের গাড়ি। ওদের নেই কোন পাঠশালা, নেই কোন আশ্রয়শালা। একদিন স্কুল থেকে ফেরার পথে ট্রাফিক জ্যামে পড়ে তাওসিফের গাড়ি। এ সময় টিপ টিপ বৃষ্টি হচ্ছিল। তাওসিফ গাড়ির গ্লাস নামিয়ে ফুটপাথের শিশুদের খেলাধুলা দেখাছিল। তারই মত ছোট্ট শিশুরা বৃষ্টিতে আনন্দ প্রকাশ করছে। হই-হুল্লোড় করছে। তাওসিফের কাছে খুবই ভালো লাগছিল তারই মত শিশুদের দুরন্তপনা। হঠাৎ মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হওয়ায় তাওসিফের আম্মু গাড়ির গ্লাস বন্ধ করতে চাইল। কিন্তু তাওসিফের ইচ্ছে গ্লাস খোলাই থাকুক, ফুটপাথের শিশুদের বৃষ্টিভেজা আনন্দের দৃশ্য তার ভালোই লাগছে।
গ্লাস খোলা থাকলে শরীরে বৃষ্টির পানি লাগবে, এতে জ্বর আসবে, অনেক অসুস্থ হতে হবে বলে তাওসিফের আম্মু গ্লাস তুলে দেন। তাওসিফ তখন তার আম্মুকে বলে, আচ্ছা বৃষ্টির পানি লেগে যদি আমার জ্বর হবে তাহলে টোকাইরাওতো বৃষ্টিতে ভিজে খেলাধুলা করছে, ওদের কি জ্বর হবে না? এমন প্রশ্নের জন্য তাওসিফের আম্মু মোটেও প্রস্তুত ছিলেন না। নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, বৃষ্টিতে ভিজলে তাদেরও জ্বর হবে। বৃষ্টি লাগলে তোমার মতো সবারই অসুস্থ হওয়ার আশঙ্কা থাকে। তাওসিফের পাল্টা প্রশ্ন তাহলে টোকাইদের আম্মুরা কেন ওদের বৃষ্টিতে ভিজতে নিষেধ করে না। তাওসিফের আম্মুর জবাব, ওদের হয়তো মা নেই। বিস্ময়ে তাওসিফ বলে, কি বলো আম্মু ওদের কি তোমার মত এমন একটা আম্মু নেই! ওদের মা কোথায়? টোকাইদের কারো মা নেই, কারো বাবা নেই কারো বাবা মা দুইজনের কেউ নেই বললেন তাওসিফের আম্মু। তাওসিফ আরো বিস্মিত হয়ে জানতে চাইল তাহলে ওদের স্কুলে কে দিয়ে আসে? কে ওদের আদর করে খাওয়ায়? ওরা কেন রাস্তায় থাকে, কেন ওরা ফুটপাথে ঘুমায়? এভাবে হাজারো প্রশ্ন তাওসিফের। ততক্ষণে জ্যাম শেষে গাড়ি ছাড়ার সবুজ বাতি জ্বলে ওঠে। বাসার উদ্দেশে আবার চলতে থাকে গাড়ি। ততক্ষণে বৃষ্টিও আর নেই টোকাইদের দুরন্তপনাও হারিয়ে যায় তাওসিফের চোখের আড়ালে।
টোকাইদের ব্যাপারে তাওসিফের মনে জাগে কৌতূহল। ওদের আম্মু নেই, কারো আব্বুও নেই। আদর করে ওদের কেউ খাওয়ায় না, স্কুলেও ওরা যায় না! তাওসিফের মনের ভেতরে জাগে হাজারো প্রশ্ন। নতুন নতুন প্রশ্ন তৈরি করে মায়ের কাছে জানতে চায় সে। একদিন বিকেলে তাওসিফ যখন বাড়ির লনে খেলাধুলা করছিল তখন বাড়ির সামনে গেটের ফাঁক দিয়ে দেখতে পেল একটা টোকাই ছেলে কাঁদছে। তাওসিফ এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, তুমি কাঁদছ কেন? তোমার বাসা কোথায়? তোমার আম্মু আব্বু কোথায়? কাঁদতে কাঁদতে টোকাই ছেলেটি জানাল গত কয়েকদিন কোন খাওয়াই তার ভাগ্যে জুটেনি, খিদের জ্বালায় পেট চোঁ চোঁ করছে। আর সেই যন্ত্রণাই সে কাঁদছে। তা ছাড়া তার আব্বু নেই, কাজের খোঁজে মা সকালে বেরিয়েছে খাবার আনার কোন খবর নেই। তাওসিফের মায়া হলো টোকাই ছেলেটির জন্য। বসায় ছুটে গিয়ে তার জন্য কলা আর পাউরুটি নিয়ে এলো। তৃপ্তি ভরে খেল টোকাই ছেলেটি। তার মুখে তৃপ্তির হাসি দেখে তাওসিফেরও ভালো লাগে। তাওসিফের আম্মু দরজায় দাঁড়িয়ে দেখে টোকাইদের প্রতি তাওসিফের ভালোবাসা! প্রতিদিন স্কুলে যাওয়ার পথে কোন টোকাই গাড়ির পাশে এসে হাত পাতলে তাওসিফ তার টিফিন থেকে অর্ধেক খাবার দিয়ে দেয়। তাওসিফের আম্মু তাই টিফিনে নাস্তা এখন একটু বেশি করেই দেন।
তাওসিফের মতো শিশুরা দরজায় এসে কিছু চাইলে তাওসিফই ওদের দান করতে সবার আগে এগিয়ে আসে। তাওসিফ ছোট্ট। রমজানের রোজা এখনো রাখা শুরু করেনি। আরেকটু বড় হলেই রোজা রাখতে শুরু করবে সে। তবে ইফতারের সময় আব্বু আম্মু সবার সাথেই এক টেবিলে ইফতার করতে বসে। সেখানে বসেও তাওসিফের নানা প্রশ্ন। তাওসিফ তার আব্বুর কাছে জানতে চায় টোকাইরা কি রোজা রাখে? ওরা কি আমাদের মত ইফতার করে? তাওসিফের আব্বু কাউকে দান করার সময় তাওসিফের হাতে দিয়েই দান করায়। তাওসিফ তার আম্মুর কাছ থেকে ইফতার নিয়ে বাসার সামনের ফুটপাথে থাকা শিশুদের মাঝে বিলি করে আসে। শীতের সময় একদিন তাওসিফ তার পুরনো একটা সুয়েটার দিয়ে দেয় এক টোকাইকে। কনকনে শীতের সময় অনেক সুয়েটার থেকে একটি সুয়েটারই যদি একজনকে শীতের কষ্ট থেকে নিবারণ করতে পারে এর চেয়ে আনন্দের আর কী হতে পারে!
রমজান শেষের দিকে। চারদিকে ঈদের প্রস্তুতি চলছে। অনেকের হাতেই শোভা পাচ্ছে কেনাকাটা করা ঈদের নতুন জামার প্যাকেট। আব্বু আম্মুর সাথে শিশুরাও মার্কেটে যাচ্ছে। হরেক রকম জামা কিনছে। আব্বু আম্মুর সাথে মার্কেটে গিয়ে তাওসিফের জন্যও কেনা হলো ঈদের নতুন জামা। তাওসিফ আরেকটি জামা কেনার বায়না ধরলো তার আব্বুর কাছে। তাওসিফের আম্মু বলল, তোমারতো জামা কেনা হয়েছে। কিন্তু তাওসিফ বায়না ধরলো তার আরেকটি জামা চাই। আদরের ছেলের আবদার পূরণ করে কেনা হলো আরেকটি জামা। বিকেলে বাসায় ফিরে গাড়ি থেকে নেমেই তাওসিফ একটি জামা তার বাসার সামনে ফুটপাথের টোকাই শিশুটিকে দিয়ে দেয়। দু’টি জামা থেকে একটি জামা টোকাইকে দান করার দৃশ্য দেখে বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে যান তাওসিফের আব্বু আম্মু। মমতায় জড়িয়ে তাওসিফকে আদর করেন, অনেক দোয়া করেন। তাওসিফ বলে, ওর গায়ে কোন জামা নেই। এবারের ঈদে ও নতুন জামা পাবে কোথায়? ওরতো কেউ নেই। তাই তার জন্য একটি জামা কিনেছি। টোকাইয়ের প্রতি তাওসিফের সহানুভূতি আর ভালোবাসা তাওসিফের আব্বু-আম্মুকে এটিই স্মরণ করিয়ে দেয় টোকইরাও তাওসিফদের মত শিশু, টোকাইরাও আমাদের মতোই মানুষ।