আন্তঃগ্রহ বিজ্ঞান পরিষদের সভাকক্ষ। মাঝারি আকারের সভাকক্ষের মাঝখানে গোলটেবিলের চারদিকে অনেকগুলো রিভলবিং চেয়ার। একপাশের একটি চেয়ার অন্য চেয়ারগুলোর চেয়ে কিছুটা আলাদা। দেখেই মনে হয় এটি বিশেষ কারো জন্য নির্ধারিত। সাধারণ চেয়ারগুলোতে বসে আছেন ১৩-১৪ জন লোক। সবার মুখ গম্ভীর, সামনে রাখা ইলেকট্রনিক ডিভাইসের পর্দায় চোখ। কেউ কারো সাথে কথা বলছে না। বিশেষ চেয়ারটি খালি। কতক্ষণ পর বিপ শব্দে বিশেষ চেয়ারটির পেছনের দেয়ালের একটি জায়গা একপাশে সরে গেল। সবাই উৎসুক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন সেদিকে। কয়েক সেকেন্ড পর সেই দরজা দিয়ে এলেন একজন। সাদা পোশাক, হাতে একটি ইলেকট্রনিক ডিভাইস। তার চেহারায় গাম্ভীর্য থাকলেও নির্ভার একটি ভাব রয়েছে। যেন অনেকক্ষণ বিশ্রামের পর উঠে এসেছেন। সভাকক্ষের সবাই উঠে বিশেষ একটি ভঙ্গিতে সম্মান জানালেন আগন্তুককে। তিনি হাত তুলে প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বসে পড়লেন নিজের আসনটিতে। কয়েক সেকেন্ড সময় নিয়ে চোখ ঘুরিয়ে দেখলেন একে একে সবাইকে। তারপর ভরাট কণ্ঠে বলে উঠলেন, সম্মানিত প্রতিনিধিবৃন্দ, আমরা সভার কাজ শুরু করতে যাচ্ছি। সবাই ওপর-নিচে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিলেন।
আন্তঃগ্রহ বিজ্ঞান পরিষদের বিশেষ সভা এটি। সাধারণত প্রতি মাসে একবার এই অডিটোরিয়ামে মিলিত হয় পরিষদের প্রতিনিধিরা; কিন্তু এটি বিশেষ মিটিং, নির্ধারিত মিটিংয়ের এক সপ্তাহ আগেই এই মিটিং ডাকা হয়েছে। মিটিংয়ের জন্য যারা উপস্থিত হয়েছেন তারা বিভিন্ন গ্রহে বিজ্ঞান পরিষদের মনোনীত প্রতিনিধি। বিশাল এই সৌরজগতের সমস্ত মানব সম্প্রদায়ের জীবনব্যবস্থার নিয়ন্ত্রক এই আন্তঃগ্রহ বিজ্ঞান পরিষদ। আগের দিনে যাদের শাসক বা সরকার বলা হতো অনেকটা তেমনই এই বিজ্ঞান পরিষদের কাজ। সৌরজগতের ১১টি গ্রহে মানববসতি রয়েছে। সব গ্রহের শাসনব্যবস্থা এখন একযোগে পরিচালিত হয় একটি কেন্দ্র থেকে। আর এর নিয়ন্ত্রণ করে বিজ্ঞান পরিষদ। অর্থাৎ পুরো সৌরজগতের শাসনব্যবস্থার সর্বোচ্চ ফোরাম এই বিজ্ঞান পরিষদ। পরিষদের পক্ষ থেকে প্রতি গ্রহে এক দশকের জন্য একজন করে প্রতিনিধি মনোনয়ন করা হয়। তারাই ওই গ্রহের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
শাসন পরিচালনা ও এর জন্য বিজ্ঞান পরিষদের কাছে জবাবদিহি করতে হয় সেই প্রতিনিধিকে। আসলে তাদের করার খুব বেশি কিছু নেই। জ্ঞান- বিজ্ঞানের উৎকর্ষের ফলে সব কিছুই এখন একটি নির্দিষ্ট নিয়মের মধ্যে চলে। মানুষের করার খুব বেশি কিছু নেই। কাজ বলতে যা বোঝায় সেগুলো করে কম্পিউটার আর রোবট। বিজ্ঞানের সাহায্যে প্রায় সব ধরনের রোগ প্রতিরোধ করতে সক্ষম হয়েছে মানুষ, ফলে হাসপাতালগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। মৃত্যু ছাড়া মানুষের কষ্টের আর কোন উপাদান নেই বললেই চলে। অপরাধ কমে গেছে, ফলে আদালত, জেলখানা, পুলিশ কিংবা প্রতিরক্ষা বাহিনী প্রয়োজনীয়তা অনেক বছর আগেই শেষ হয়ে গেছে। কিছু ক্ষেত্রে যে জনবল দরকার তাতে দশম প্রজাতির কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন রোবট ব্যবহৃত হচ্ছে। কাজেই প্রতিটি গ্রহে বিজ্ঞান পরিষদের প্রতিনিধিদের খুব বেশি কিছু করার নেই। কেন্দ্রীয় কমান্ড সেন্টারে বসেই তারা গ্রহের সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করেন। প্রতিটি মুহূর্তে প্রতিটি স্থান থেকে সব কিছুর রিপোর্ট চলে আসে কমান্ড সেন্টারে। প্রত্যেক মানুষের রয়েছে চলাচল ও কর্মকাণ্ডের অবাধ স্বাধীনতা। যে গ্রহেই জন্ম নিক না কেন, সৌরজগতের যে কোন স্থানে বসবাস করার অধিকার রয়েছে তার। প্রতিটি গ্রহের নাগরিক ও সমাজব্যবস্থার মধ্যেও দারুণ সুসম্পর্ক।
বিজ্ঞান পরিষদের সবগুলো পদেই মানব সম্প্রদায়ের সেরা বিজ্ঞানীরা বসে আছেন। বিজ্ঞান মানুষের জীবনকে এমন করেছে যে, বিজ্ঞানে যে যত দক্ষ সে ততটা যোগ্য হিসেবে বিবেচিত। তাই পুরো মানব সম্প্রদায়ের নিয়ন্ত্রণই এখন বিজ্ঞানীদের হাতে। ৩০ বছর আগে সব গ্রহের বিজ্ঞানীরা মিলে গঠন করেছেন আন্তঃগ্রহ বিজ্ঞান পরিষদ। পরিষদের বর্তমান প্রধান বিজ্ঞানী জেন হিউক। প্লুটোতে জন্ম নেয়া এই বিজ্ঞানীই মূলত সর্বাধুনিক এই শাসনব্যবস্থার রূপকার। তরুণ বয়সেই তিনি মানব সম্প্রদায়ের সেরা বিজ্ঞানী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন। বর্তমান সভ্যতার যত যুগান্তকারী আবিষ্কার তাতে তারই অবদান বেশি। তিন দশক আগে তার নেতৃত্বেই গঠিত হয় বিজ্ঞান পরিষদ, তার প্রস্তাবিত এই এককেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থা বিশ্বব্যাপী এত প্রশংসিত হয় যে, সব নাগরিক এক বাক্যে এটি মেনে নেয়।
বিজ্ঞানী জেন হিউক বললেন, ‘সম্মানিত প্রতিনিধিবৃন্দ আপনাদের আহ্বানেই আজকের এই সভা। তাই আমি চাই আপনাদের পক্ষ থেকেই আলোচনা শুরু হোক।’
হাত তুলে কিছু বলার অনুমতি চাইলেন বৃহস্পতি গ্রহের প্রতিনিধ থম নু। জেন হিউক সম্মতি দিলেন।
থম নু বললেন, ‘মহামান্য প্রধান, আপনি জানেন মানব সম্প্রদায় একটি দুর্যোগের মুখোমুখি। বেশ কিছুদিন ধরেই একযোগে প্রায় সবগুলো গ্রহের ফসলে নতুন একটি রোগ দেখা দিয়েছে। বিজ্ঞানের নতুন নতুন আবিষ্কারের মাধ্যমে আমরা প্রায় সব সমস্যাই দূর করেছি; কিন্তু ফসলের রোগ তো কয়েকশো বছর আগেই দূর হয়েছে। প্রথম দিকে বিষয়টিকে তাই আমরা গুরুত্ব দেইনি; কিন্তু সম্ভাব্য সব উপায়ে চেষ্টা করেও আমরা এবারের সমস্যাটি মোকাবেলা করতে পারছি না। এ বিষয়ে আলোচনার জন্যই আজকের বৈঠকের অনুরোধ করেছি আমরা’।
একটানা কথা বলে থামলেন থম নু। জেন হিউক বললেন, ‘আর কেউ কিছু বলবেন?’
এবার বলতে শুরু করলেন পৃথিবীর প্রতিনিধি। তিনি বললেন, ‘মহামান্য প্রধান, যেভাবে ফসলের রোগ ছড়াচ্ছে তাতে আমাদের সব ফসল নষ্ট হয়ে যাবে। আপনি জানেন যে, মানুষ এখনো ক্ষেতে উৎপাদিত খাদ্যই খেতে পছন্দ করে। কৃত্রিম খাদ্য উৎপাদন শুরু করেছি আমরা বহু বছর আগে; কিন্তু সেগুলোর তুলনায় মানুষ প্রাকৃতিক খাদ্যই বেশি খায়। তাই ফসল নষ্ট হলে মানুষ ক্ষুব্ধ হবে। এ বিষয়ে আপনার কাছ থেকে সমাধান চাই আমরা।’
আরো কয়েকজন প্রতিনিধি তাদের বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন। সবার বক্তব্যের মূল কথা একটিই। অজানা এক ভাইরাসের আক্রমণে সব গ্রহের ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হতে শুরু করেছে। যে ক্ষেতে যে ফসল আছে, তাতেই দেখা গেছে আজব এই ভাইরাস। সব গ্রহের বিজ্ঞানীরা মিলেও ভাইরাসটি প্রতিহত করতে পারেনি। মূলত সে কারণেই তিন দিন আগে এ বিষয়ে আন্তঃগ্রহ বিজ্ঞান পরিষদের সভা ডাকার অনুরোধ জানায় শনির প্রতিনিধি। তার প্রেক্ষিতেই আজকের সভা।
সবার বক্তব্য শেষে বিজ্ঞান পরিষদের প্রধান বললেন, ‘আমি এখনই এই সমস্যার কোনো সমাধান দিতে পারছি না। সমস্যাটি নিয়ে আমাদের কাজ করা উচিত। আপনারা যার যার গ্রহের বিজ্ঞানীদের নিয়ে কাজ শুরু করুন। প্রয়োজনে সব গ্রহের বিজ্ঞানীদের নিয়ে একটি গবেষণা দল গঠন করুন। তারা এই সমস্যার সমাধানে চেষ্টা করবে। এটিই আমাদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ এখন। আজকের সভা এখানেই শেষ।’ বলে উঠে দাঁড়ালেন জেন হিউক। পেছনের দেয়ালটি আবার খুলে গেল। তিনি চলে গেলেন ওপাশের কক্ষে। প্রতিনিধিদের সবাইকে হতাশ মনে হলো। তারা আশা করেছিলেন প্রধান বিজ্ঞানী হয়তো কোন সমাধান দিবেন এই সঙ্কটের; কিন্তু তেমন কিছু না বলে তিনি গবেষণা করতে বললেন। তাই হতাশ হয়ে ফিরে যেতে হচ্ছে তাদের।
নিজের কক্ষে এসে বোতাম টিপে ব্যক্তিগত সহকারী রোবটটিকে ডাকলেন জেন হিউক। বললেন, ফসলের নতুন ভাইরাস নিয়ে গ্রহগুলোর কাজের অগ্রগতি আমাকে জানাবে।
রোবটটি বলল, ‘জি মহামান্য; কিন্তু তারা কি পারবে এই সমস্যার সমাধান আবিষ্কার করতে?
‘পারবে, তুমি জানো না মানব সম্পদ্রায়ের মধ্যে কত প্রতিভাবান বিজ্ঞানী আছেন। অবশ্য তুমি তো রোবট, কতটাই বা বুঝবে’।
‘জি, মহামান্য; কিন্তু আপনি সেরা বিজ্ঞানী। আপনি ইচ্ছে করেই এই সমস্যাটি কেন সৃষ্টি করেছেন? আবার তারা সমাধান চাওয়ার পরও দিলেন না।’
‘তাহলে বলি শোন। বিজ্ঞানের কল্যাণে অমরা মৃত্যু ছাড়া প্রায় সব সমস্যাকেই জয় করেছি। সবাই সুখে আছে, চাওয়া মাত্র সব কিছু পেয়ে যাচ্ছে। মানুষের অভাব, কষ্ট বলতে কিছু নেই। এত সুখে থাকতে গিয়ে মানুষের জীবন নিরানন্দ হয়ে যাচ্ছে। আমি খোঁজ নিয়ে দেখেছি অনেক মানুষের কাছেই জীবন এখন একঘেয়ে লাগতে শুরু করেছে। আসলে মানবজীবন চ্যালেঞ্জ পছন্দ করে। চ্যালেঞ্জ জয় করেই সেই আদিকাল থেকে মানুষ বেঁচে থাকতে অভ্যস্ত। তাই এর ব্যতিক্রম হলে মানুষের মনে বিরূপ প্রভাব পড়বে সেটাই স্বাভাবিক। নতুন কিছু করার সুযোগ না থাকলে মানুষ জীবনকে অর্থহীন মনে করে। তাই নতুন এই ভাইরাসটি সৃষ্টি করে ছড়িয়ে দিয়েছি আমি। মানুষ এখন এই সমস্যার সমাধান নিয়ে ব্যস্ত থাকবে। এটি সে রকমভাবেই তৈরি করেছি, যাতে সেরা বিজ্ঞানীরা এর সমধান খুঁজে পায়। একটু চেষ্টা করলেই তারা পারবে। তারপর এই চ্যালেঞ্জ জয় করে মানুষ আবার বিজয়ের হাসি হাসবে। স্বস্তি ফিরে আসবে নাগরিকদের মধ্যে। কম্পিউটার নির্ভর মানুষরা আবার চ্যালেঞ্জ জয় করার আনন্দ ফিরে পাবে। বেঁচে থাকার আগ্রহ তৈরি হবে সবার মধ্যে। প্রয়োজনে আবার কিছুদিন পর এরকম একটি কৃত্রিম সঙ্কট দেব আমি তাদের সামনে। যাতে চ্যালেঞ্জ জয় করার মধ্য দিয়ে মানুষ বেঁচে থাকার সার্থকতা খুঁজে পায়’।