Home তোমাদের গল্প বদলে যাওয়া জীবন -হাফেজ ইশমাম উদ্দীন

বদলে যাওয়া জীবন -হাফেজ ইশমাম উদ্দীন

জন্মের পর থেকেই খুব অসহায়ভাবে শুরু হয়েছে সিয়ামের জীবন। পরিবার দরিদ্র হওয়ায় তার মূল কারণ। কিন্তু কিছুই তো করার নেই। কপালে যাই লেখা ছিল তাই। সিয়ামের খুব ইচ্ছা করে অন্য সবার মত করে চলতে। সবাই পরে সুগন্ধিযুক্ত কাপড়। সবাই টিফিনে কত কিছুই না খায়। স্কুল ছুটি হলে সবাই বাড়ি যায় যার যার মায়ের সাথে গাড়িতে চড়ে। কিন্তু অন্যদের মত তার কিছুই নেই। কেউ তাকে নিতে আসে না। তার গায়ে ঘামের গন্ধযুক্ত কাপড়। কেউই তাকে বন্ধু হিসেবে দেখে না। সে বড় একা। একটা টেবিলে সে একা একা বসে।
স্কুলে ভর্তি হতেও অনেক কিছু করতে হয়েছে সিয়ামের মা বাবাকে। প্রথমে তাকে ভর্তি করাতে চাইনি স্কুল পরিচালক। কারণ টাকা না থাকা। টাকা দিলে নাকি তারা ভর্তি করাবে। তারপরও অনেক কান্নাকাটি করে হাতে পায়ে ধরে নতুন জীবনের স্বপ্নের পথে পা দিয়েছে সিয়াম। এখন সে একজন আদর্শ ছাত্র। সে নিজের মত করে নিজেকে গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখে। দেখে অনেক বড় হওয়ার স্বপ্ন। এভাবেই ৬টি মাস কেটে যায়। ৬ মাস পর হয় অর্ধবার্ষিক পরীক্ষা। পরীক্ষায়ও চমৎকার জাদু দেখিয়েছে সে। তার মা-বাবার মুখে হাসির ফুলের কলি এসেছে। এক বছর কেটে যাওয়ার পর ফাইনাল পরীক্ষায় প্রথম স্থান দখল করে সিয়াম। তার খুশিতো বলার বাইরে। তার বেশি খুশি লাগার কারণ হলো, তার মা-বাবার সেই চোখের পানির জবাব সে দিতে পেরেছে। মা-বাবাও খুব খুশি। নতুন ক্লাসে অধ্যয়ন শুরু করে সে। কিন্তু হঠাৎ নেমে আসে এক অভিশপ্ত কালো মেঘ। একদিন খুব সকাল সকাল বাড়ি থেকে কাজের উদ্দেশ্যে বের হয়ে যায় সিয়ামের বাবা। সিয়াম মাকে সালাম দিয়ে স্কুলের পথে রওনা হয়। ৩ ঘণ্টা পর রাশেদ স্যার এসে ক্লাসে বলল, তোমাদের এখানে সিয়াম কে?
সিয়াম, স্যার।
রাশেদ স্যার, সিয়াম তুমি বাড়ি চলে যাও।
সিয়াম জানতে চাইলো কেন? কিন্তু স্যার শুধু বলল যে, আগে বাড়ি যাও।
সিয়াম কোনো কথা আর বাড়াল না। পা বাড়াল বাড়ির পথে। বাড়ির কাছে গিয়েই দেখে তার বাড়ির সামনে খাটিয়া। কী হয়েছে? মনে মনে বলল সিয়াম। কাছে গিয়ে দেখে তার বাবার মাথা হতে লাল রক্ত ঝরছে। অবশ্য এখন তার বাবা আর বেঁচে নেই। সিয়াম দৃশ্য দেখা মাত্রই পাথর হয়ে গেল। কে করল এসব?
সবার মুখে মুখে জানতে পারল যে, তার বাবার কাছ থেকে নাকি এক ধনী লোক কিছু টাকা পেত। অনেকদিন হয়ে যাওয়ার পরও টাকাগুলো পরিশোধ করতে পারেননি তিনি। লোকটি বলেছিল যে, যথাসময়ে টাকা দিতে না পারলে খুব একটা ভালো হবে না। তো আজ লোকটার কাছে আরো কিছুদিন সময় চাইলে সে তার মাথায় একটি পাথর দ্বারা আঘাত করে। পাথরখানা গিয়ে পড়ে মাথার ঠিক বাম পাশের শিরার মধ্যে। সাথে সাথে রক্ত ঝরতে থাকে অঝোরে। অবশেষে মৃত অবস্থায় তাকে বাড়িতে নিয়ে আসা হয়। ধনী লোকের যেহেতু টাকা পয়সার পাহাড় তাই তার বিরোধিতা করার কেউ সাহস পায়নি। এইসব শুনে রাগে মুখ লাল হয়ে যায় সিয়ামের। তবুও কোনো রকমে নিজেকে ধরে রাখে সে। তার বাবা আজ থাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে মাত্র কিছু টাকার কারণে। এই টাকা যদি না হতো তাহলে হয়তো তার বাবার এইভাবে মৃত্যু হতো না। কেন এই টাকা এলো তার বাবার জীবনটা কেড়ে নিতে? তাকে এভাবে এতিম বানাতে? নিজেকে নিজে প্রশ্ন করে সিয়াম। কিন্তু কোথাও খুঁজে পায় না সেই প্রশ্নের উত্তর।
অন্যরা সিয়ামের বাবাকে গোসল দিয়ে কাফন পরিয়ে জানাজার জন্য মসজিদের মাঠে নিয়ে যায়। সেখানে নামাজ শেষে দাফনের কাজ শেষ করে সবাই বাড়ির পথে রওনা দেয়। এখন অন্য এক যুদ্ধে নামতে হয় সিয়ামকে। সিয়াম ছিল বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান। তাই বাবার মৃত্যুর পর পরিবারের সব দায়িত্ব এসে পড়ে ছোট্ট সিয়ামের ঘাড়ে। সে এখনও পড়ে সবে মাত্র ২য় শ্রেণীতে। বোঝার চাইতে তার বয়স অনেক কম।
অন্য দিকে সিয়ামের মাও চায় ছেলেকে যেভাবেই হোক লেখাপড়া করাতে হবে। নয়ত তার সারাটা জীবন ব্যর্থ। একদিন মা সিয়ামকে ডেকে বলল, বাবা সিয়াম তোর বাবার মৃত্যুর পর হতে পরিবারে শুধু আমি আর আমার সন্তান তুই। আমি চাই তুই লেখাপড়া করে বড় হবি। আমি যেভাবেই পারি তোকে লেখাপড়া করাব। সিয়াম কিছুই বলে না। সে শুধু তার মায়ের মলিন চেহারার দিকে এক নজরে তাকিয়ে থাকে। আর চোখ হতে ফোঁটা ফোঁটা নোনাজল ফেলে। মা ছেলের চোখের পানি দেখে আবেগে বুকে জড়িয়ে ধরে।
এমন করে ৩টি মাস পার হয়ে যায়। সিয়ামও অতি মনোযোগী হয়ে লেখাপড়ার সাগরে ডুবে আছে। অন্য দিকে মা অন্যের বাড়িতে কাজ করে যা পায় তা দিয়ে সংসারের খরচ চালায়। একদিন আবারও কালো মেঘ এসে জমা হয় সিয়ামের জীবনে।
একদিন সন্ধ্যায় মাগরিবের নামাজ পড়ে সিয়াম বাড়িতে আসে। মা ছেলে মিলে একসাথে ছোটখাটো নাশতা সেরে সিয়াম পড়ার রুমে চলে যায় আর মা যায় শুয়ার রুমে। কিছুক্ষণ পরে মা ডাক দিয়ে সিয়ামকে বলে, বাবা সিয়াম একটু এদিকে আয়তো।
সিয়াম তাড়াতাড়ি চলে যায় মায়ের রুমে। গিয়ে দেখে মা বিছানায় শুয়ে ছটফট করছে। সে কাছে গিয়ে জিজ্ঞাসা করল, মা কেমন লাগছে তোমার? তুমি এমন করছ কেন?
মা বলল, বাবা আমার খুব খারাপ লাগছে। আমি হয়ত আর বাঁচব না। বাবা তোর জীবনে আমি কিছুই দিতে পারিনি। তোর অনেক বিষয়েই অপূর্ণ রয়ে গেছে। তুই আমাকে ক্ষমা করে দিস বাবা।
সিয়াম, ‘মা তুমি এসব কী বলছ? আমায় ফেলে কিভাবে যাবে তুমি? আমার জন্য কি তোমার খারাপ লাগবে না? না মা তুমি এখন যাবে না।
মা, ‘বাবা আমার যন্ত্রণা বেড়ে যাচ্ছে। আমি সত্যিই আর বাঁচব না।’
সিয়াম কি করবে ঠিক বুঝতে পারছে না। সে তাড়াতাড়ি বাড়িতে যা টাকা ছিল তা নিয়ে ঔষুধের দোকানে চলে যায়। কিছু ঔষুধ নিয়ে সে বাড়ির দিকে আবারও রওনা হয়। কিন্তু বাড়িতে গিয়ে দেখে মা গভীর ঘুমের সাগরে ডুবে আছে। তার চোখ দু’টি বন্ধ। নেই আর তার মা। চিৎকার দিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে অঝোরে কাঁদতে থাকে। আর বলতে থাকে, ‘মা কেন তুমি আমার কথা রাখলে না। কেন এভাবে একা একা ফেলে চলে গেলে। এখন আমি কাকে মা বলে ডাকব। আমাকে কে আর খোকা বলে ডাক দিবে।’
সিয়াম এখন এই পৃথিবীতে একা। তার কেউই নেই। এখন সে ফুটপাথের টোকাই নামের কেউ। সেই মধুর ‘সিয়াম’ নামে কেউ তাকে এখন ডাকে না। শুধু ‘টোকাই আর টোকাই’। এখন তার সারাটা দিন কেটে যায় ফুটপাথে। পথে পথে হেঁটে হেঁটে সে এদিক সেদিক যায় আর বড় বড় দালানগুলো দেখে মনে মনে বলে, এই দালানগুলো যেই ধনী ব্যক্তিরা তৈরি করেছে তাদের অহংকারের জন্যই আজ তার এই জীবন। এইসব ভাবতে ভাবতে তার হৃদয় কেঁদে ওঠে। সে শুধুই হাঁটতে থাকে। হয়ত এভাবে হাঁটতে হাঁটতে একদিন তার জীবনের সমাপ্তি ঘটবে।

SHARE

Leave a Reply