Home বিজ্ঞান জগৎ চলে গেলেন বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং -আল জাবির

চলে গেলেন বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং -আল জাবির

হকিং ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর থিওরেটিক্যাল কসমোলজির গবেষণা প্রধান ছিলেন। তিনি ১৯৭৯ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের লুকাসীয় অধ্যাপক ছিলেন এবং ২০০৯ সালের ১ অক্টোবর এই পদ থেকে অবসর নেন। এ ছাড়াও তিনি ক্যামব্রিজের গনভিল ও কেইয়ুস কলেজের ফেলো হিসেবে কাজ করেছেন।
পদার্থবিজ্ঞানে হকিংয়ের দু’টি অবদান সর্বত্র স্বীকৃত। প্রথম জীবনে সতীর্থ রজার পেনরোজের সঙ্গে মিলে সাধারণ আপেক্ষিকতায় সিংগুলারিটি সংক্রান্ত তত্ত্ব। হকিং প্রথম অনিশ্চয়তার তত্ত্বকৃষ্ণ বিবরের ঘটনা দিগন্তে প্রয়োগ করে দেখান যে কৃষ্ণ বিবর থেকে বিকিরিত হচ্ছে কণা প্রবাহ। এই বিকিরণ এখন হকিং বিকিরণ নামে পরিচিত। তিনি রয়্যাল সোসাইটি অব আর্টসের সম্মানীয় ফেলো এবং পন্টিফিক্যাল অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সের আজীবন সদস্য ছিলেন এবং ২০০৯ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার, প্রেসিডেন্সিয়াল মেডেল অব ফ্রিডম খেতাবে ভূষিত হন। ২০০২ সালে বিবিসির ‘সেরা ১০০ ব্রিটন্স’ জরিপে তিনি ২৫তম স্থান অধিকার করেন। তার নিজের তত্ত্ব ও বিশ্বতত্ত্ব নিয়ে রচিত বই কালের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস (আ ব্রিফ হিস্টরি অব টাইম) দিয়ে তিনি বাণিজ্যিক সফলতা লাভ করেন এবং বইটি রেকর্ড ভঙ্গ করা ২৩৭ সপ্তাহ ব্রিটিশ সানডে টাইমসের সর্বোচ্চ বিক্রীত বইয়ের তালিকায় ছিল।
প্রায় ৪০ বছর ধরে হকিং তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানের চর্চা করছেন। লিখিত পুস্তক এবং বিভিন্ন অনুষ্ঠানে হাজির থেকে হকিং অ্যাকাডেমিক জগতে যথেষ্ট খ্যাতিমান হয়ে উঠেছেন। তিনি রয়্যাল সোসাইটি অব আর্টসের সম্মানীয় ফেলো এবং পন্টিফিক্যাল অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সের আজীবন সদস্য। ২০১৪ সালে তাকে নিয়ে একটি মুভি তৈরি হয়, নাম থিওরি অব এভরিথিং।
হকিংয়ের বাবা ড. ফ্রাঙ্ক হকিং একজন জীববিজ্ঞান গবেষক ও মা ইসোবেল হকিং একজন রাজনৈতিক কর্মী। হকিংয়ের বাবা-মা উত্তর লন্ডনে থাকতেন, লন্ডনে তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা চলাকালীন হকিং গর্ভে আসার পর নিরাপত্তার খাতিরে তারা অক্সফোর্ডে চলে যান। হকিংয়ের জন্মের পর তারা আবার লন্ডনে ফিরে আসেন। ফিলিপ্পা ও মেরি নামে হকিংয়ের দুই বোন রয়েছে। এ ছাড়া হকিং পরিবারে এডওয়ার্ড নামে এক পালকপুত্রও ছিল। হকিংয়ের বাবা-মা পূর্ব লন্ডনে বসাবস করলেও ইসাবেল গর্ভবতী থাকার সময় তারা অক্সফোর্ডে চলে যান। সে সময় জার্মানরা নিয়মিতভাবে লন্ডনে বোমাবর্ষণ করত। হকিংয়ের একটি প্রকাশনা থেকে জানা গেছে তাদের বসতবাড়ির কয়েকটি গলি পরেই জার্মানির ভি-২ মিসাইল আঘাত হানে।
স্টিফেনের জন্মের পর তারা আবার লন্ডনে ফিরে আসেন। সেখানে স্টিফেনের বাবা ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর মেডিক্যাল রিসার্চের প্যারাসাইটোলজি বিভাগের প্রধানের দায়িত্ব পালন করেন। লন্ডনের হাইগেটের বাইরন হাউজ স্কুলে হকিংয়ের শিক্ষাজীবন শুরু হয়। ১৯৫০ হকিংদের পরিবার হার্টফোর্ডশায়ারের সেন্ট অ্যালবান্সে চলে যায়। ১৯৫০ থেকে ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত হকিং কয়েক মাস সেন্ট অ্যালবান্সের মেয়েদের স্কুলে পড়েন। সে সময় ১০ বছর বয়স পর্যন্ত ছেলেরা মেয়েদের স্কুলে পড়তে পারতো। পরে সেখান থেকে ছেলেদের স্কুলে চলে যান।
হকিংয়ের পরিবার শিক্ষা গ্রহণে গুরুত্ব দিতো। হকিংয়ের বাবা চেয়েছিলেন হকিং প্রখ্যাত ওয়েস্টমিনস্টার স্কুলে পড়াশুনা করুক, কিন্তু ১৩ বছর বয়সী হকিং বৃত্তি পরীক্ষার দিন অসুস্থ হয়ে পড়েন। বৃত্তি ছাড়া তার পরিবার ওয়েস্টমিনস্টারে তার পড়াশুনার খরচ চালাতে পারবে না, তাই তিনি সেন্ট অ্যালবান্সে রয়ে যান।
স্কুলে তিনি ‘আইনস্টাইন’ নামে পরিচিত ছিলেন। বিজ্ঞানে হকিংয়ের সহজাত আগ্রহ ছিল। হকিং তার শিক্ষক তাহতার অনুপ্রেরণায় বিশ্ববিদ্যালয়ে গণিত বিষয়ে পড়ার সিদ্ধান্ত নেন। হকিংয়ের বাবার ইচ্ছে ছিল হকিং যেন তার মতো ডাক্তার হয়, কারণ গণিতে স্নাতকদের জন্য খুব বেশি চাকরির সুযোগ ছিল না। এ ছাড়া তার পিতা তার নিজের কলেজ অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে ভর্তি করাতে চান, কিন্তু যেহেতু সেখানে গণিতের কোর্স পড়ানো হতো না, সে জন্য হকিং পদার্থবিজ্ঞান ও রসায়ন বিষয় নিয়ে পড়ার সিদ্ধান্ত নেন। তার শিক্ষক তাকে পরের বছরের জন্য অপেক্ষা করতে বলেছিলেন, কিন্তু তিনি ১৯৫৯ সালের মার্চে পরীক্ষা দিয়ে বৃত্তি লাভ করেন। সে সময় তার আগ্রহের বিষয় ছিল তাপগতিবিদ্যা, আপেক্ষিকতা এবং কোয়ান্টাম বলবিদ্যা।
হকিং ১৯৫৯ সালের অক্টোবরে ১৭ বছর বয়সে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় কলেজে তার স্নাতক পাঠ গ্রহণ শুরু করেন। প্রথম ১৮ মাস তিনি বিরক্ত ও একাকিত্ব বোধ করতেন, কারণ তার কাছে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ ‘হাস্যকর রকমের সহজ’ মনে হতো। তার পদার্থবিদ্যার শিক্ষক রবার্ট বারম্যান পরবর্তীতে বলেন, ‘তার জন্য শুধু জানা দরকার ছিল কিছু করা যাবে এবং তিনি নিজেই অন্যরা কিভাবে করছে তা না দেখেই করতে পারতো। বারম্যানের মতে, দ্বিতীয় ও তৃতীয় বর্ষে তার মধ্যে পরিবর্তন দেখা দেয় এবং তিনি ‘অন্য ছেলেদের মত’ হওয়ার চেষ্টা করতেন। তিনি নিজেকে জনপ্রিয়, স্বতঃস্ফূর্ত ও বুদ্ধিদীপ্ত হিসেবে গড়ে তুলেন এবং ধ্রুপদী সঙ্গীত ও বিজ্ঞান কল্পকাহিনীতে আগ্রহী হয়ে ওঠেন। তার এই পরিবর্তনের একটি অংশ ছিল কলেজের বোট ক্লাব, বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ বোট ক্লাবে, যোগদান করা। রোয়িং কোচ লক্ষ করেন হকিং তার নিজের মধ্যে সাহসী প্রতিমূর্তি গড়ে তুলেছেন এবং তার দলকে বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নেতৃত্ব দিতেন।
ক্যামব্রিজে আসার পরপরই হকিং মোটর নিউরন ডিজিজে আক্রান্ত হোন। এ কারণে তার প্রায় সকল মাংসপেশি ধীরে ধীরে অবশ হয়ে আসে। ক্যামব্রিজে প্রথম দুই বছর তাঁর কাজ তেমন বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ছিল না। কিন্তু রোগের প্রকোপ কিছুটা থামলে, হকিং তার সুপারভাইজার ডেনিশ উইলিয়াম শিয়ামার সাহায্য নিয়ে পিএইচডির কাজে এগিয়ে যান।
তত্ত্বীয় কসমোলজি আর কোয়ান্টাম মধ্যাকর্ষ হকিংয়ের প্রধান গবেষণা ক্ষেত্র। ১৯৬০ এর দশকে ক্যামব্রিজের বন্ধু ও সহকর্মী রজার পেনরোজের সঙ্গে মিলে হকিং আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার তত্ত্ব থেকে একটি নতুন মডেল তৈরি করেন। সেই মডেলের ওপর ভিত্তি করে ১৯৭০ এর দশকে হকিং প্রথম তাদের (পেনরোজ-হকিং তত্ত্ব নামে পরিচিত) তত্ত্বের প্রথমটি প্রমাণ করেন। এই তত্ত্বগুলো প্রথমবারের মতো কোয়ান্টাম মহাকর্ষে এককত্বের পর্যাপ্ত শর্তসমূহ পূরণ করে। আগে যেমনটি ভাবা হতো এককত্ব কেবল একটি গাণিতিক বিষয়। এই তত্ত্বের পর প্রথম বোঝা গেল, এককত্বের বীজ লুকানো ছিল আপেক্ষিকতার সাধারণ তত্ত্বে।
শারীরিকভাবে ভীষণ রকম অচল এবং এমায়োট্রফিক ল্যাটারাল স্ক্লেরোসিসবালাউ গেহরিগ নামক এক প্রকার মোটর নিউরন রোগে আক্রান্ত হয়ে ক্রমাগতভাবে সম্পূর্ণ অথর্বতার দিকে ধাবিত হন। তবুও বহু বছর যাবৎ তিনি তার গবেষণাকার্যক্রম সাফল্যের সঙ্গে চালিয়ে যান। বাকশক্তি হারিয়ে ফেলার পরও তিনি এক ধরনের শব্দ-উৎপাদনকারী যন্ত্রের সাহায্যে অপরের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করেন।
ক্যামব্রিজে হকিং যখন স্নাতক শ্রেণীর শিক্ষার্থী, তখন জেন ওয়াইল্ডের সাথে সম্পর্ক গড়ে ওঠে। জেন ছিলেন তার বোনের বান্ধবী। ১৯৬৩ সালে হকিংয়ের মোটর নিউরন রোগের চিকিৎসার পূর্বে জেনের সাথে তার পরিচয় হয়। ১৯৬৪ সালের অক্টোবরে তাদের বাগদান সম্পন্ন হয়। হকিং পরবর্তীতে বলেন, এই বাগদান তাকে ‘বেঁচে থাকার অনুপ্রেরণা’ জোগায়। ১৯৬৫ সালের ১৪ জুলাই তারা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন।
বিবাহের প্রথম বছরে জেন লন্ডনে বসবাস করতেন এবং তার ডিগ্রি অর্জন করেন। জেন পিএইচডি শুরু করেন। তাদের পুত্র রবার্ট ১৯৬৭ সালের মে মাসে জন্মগ্রহণ করে। তাদের কন্যা লুসি ১৯৭০ সালে জন্মগ্রহণ করে এবং তৃতীয় সন্তান টিমোথি ১৯৭৯ সালের এপ্রিল মাসে জন্মগ্রহণ করে।
১৯৮৫ সালে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসেন হকিং। ১৯৮৫ সালের গ্রীষ্মে জেনেভারসার্ন-এ অবস্থানকালে নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়েছিলেন বিজ্ঞানী। চিকিৎসকরাও তার কষ্ট দেখে একসময় লাইফ সাপোর্ট সিস্টেম বন্ধ করে দেয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। সম্প্রতি হকিংয়ের জীবন নিয়ে তৈরি হয়েছে এক তথ্যচিত্র। সেখানেই এই তথ্য জানিয়েছেন হকিং। তিনি বলেছেন, ‘নিউমোনিয়ার ধকল আমি সহ্য করতে পারিনি, কোমায় চলে গিয়েছিলাম। তবে চিকিৎসকরা শেষ অবধি চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছিলেন, হাল ছাড়েননি।
পাঁচ দশক ধরে মোটর নিউরোনের ব্যাধির শিকার জগৎখ্যাত এই পদার্থবিদ। বিশেষজ্ঞদের মত, এই রোগে আক্রান্তরা বড়জোর বছর পাঁচেক বাঁচেন। তথ্যচিত্রে তুলে ধরা হয়েছে রোগের সঙ্গে হকিংয়ের লড়াইয়ের কাহিনী। বেঁচে থাকার জন্য হকিংয়ের আর্তিও ফিরে এসেছে বারে বারে।
১৯৯৭ সালে ব্ল্যাকহোল বা কৃষ্ণ গহ্বরের বিষয়ে একটি বাজি ধরেছিলেন স্টিভেন হকিং। বাজিতে তার পক্ষে ছিলেন আর এক পদার্থবিজ্ঞানী কিপ থর্ন এবং অন্য পক্ষে ছিলেন জন প্রেস্কিল। পদার্থবিজ্ঞানের ইতিহাসে এই বাজি ‘থর্ন-হকিং-প্রেস্কিল বাজি’ নামে পরিচিত। প্রফেসর হকিং এবং থর্ন যুক্তি দেখালেন যে, যেহেতু সাধারণ অপেক্ষবাদ অনুসারে কৃষ্ণ বিবরতার ঘটনা দিগন্তের ভেতরের কোনো কিছুই বাইরে আসতে দেয় না, এমনকি সেখান থেকে আলো পর্যন্ত বের হতে পারে না সেহেতু হকিং বিকিরণের মাধ্যমে বস্তুর ভর-শক্তির যে তথ্য পাওয়া যায় তা কোনো ক্রমেই কৃষ্ণবিবরের ভেতরের তথ্য নয়, তা নতুন, এবং যেহেতু এটি আবার কোয়ান্টাম বলবিদ্যার সাথে সাংঘর্ষিক সেহেতু কোয়ান্টাম বলবিদ্যা নতুন করে লেখা প্রয়োজন। অপরপক্ষে জন প্রেস্কিল যুক্তি দেখালেন, যেহেতু কোয়ান্টাম বলবিদ্যা বলে যে, এই তথ্য কৃষ্ণ বিবর দ্বারা উৎসারিত এমন তথ্য যা কৃষ্ণবিবরের প্রথম দিককার কোনো অবস্থা নির্দেশ করে এবং সেহেতু সাধারণ অপেক্ষবাদ দ্বারা নির্ণীত কৃষ্ণ বিবরের চলতি ধারণায় পরিবর্তন আনা প্রয়োজন। দীর্ঘদিন পরে ২০০৪ সালে হকিং স্বীকার করেন যে তিনি বাজিতে হেরেছেন এবং মন্তব্য করেন যে, কৃষ্ণ বিবরের উচিত তার দিগন্ত ভেঙে তথ্য নির্গমন করা এবং এটা করার জন্য তিনি মজা করে জন প্রেস্কিলকে বেসবল সম্পর্কিত একটি সম্পূর্ণ বিশ্বকোষ উপহার দিয়েছিলেন যা প্রেস্কিলের কাছে হকিংয়ের মতে কৃষ্ণ বিবর থেকে পাওয়া তথাকথিত তথ্যের মত অকাজের ইঙ্গিতবহ। তবে কিপ থর্ন পরাজয় মানেননি এবং বাজিতে তার অংশের পুরস্কার দিতে রাজি হননি।
কম্পিউটার সিমুলেশন এর মাধ্যমে দেখা গেছে যে পঞ্চম বা ততোধিকমুখী একধরনের চিকন বৃত্তাকৃতির কৃষ্ণ বিবর কালক্রমে তার বৃত্তের ওপর অনেকগুলো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কৃষ্ণ বিবরের জন্ম দিচ্ছে যার ফলে আইনস্টাইনের সাধারণ অপেক্ষবাদ দুর্বল হয়ে পড়েছে। ঘটনা দিগন্তের বাইরে অবস্থিত কৃষ্ণ বিবরের এ ধরনের উপসর্গ বা “Nacked Singularity” খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কেননা বাইরে থেকে তা পর্যবেক্ষণ করা যাবে।
২০১১ সালে গুগলের জেইটজিস্ট সম্মেলনে হকিং বলেন ‘দর্শন মৃত’। তিনি মনে করেন দার্শনিকগণ ‘বিজ্ঞানের আধুনিক বিকাশের সাথে তাল মিলাতে পারেননি’ এবং বিজ্ঞানীরা ‘আমাদের জ্ঞানের ক্ষুধা মেটাতে আবিষ্কারের আলোকবর্তিকা বহনকারী হয়ে উঠেছেন।’ তিনি বলেন, দর্শন বিষয়ক সমস্যার সমাধান বিজ্ঞান দিয়ে দেয়া সম্ভব, বিশেষ করে মহাবিশ্বের নতুন ও খুবই ভিন্ন রকমের চিত্র তুলে ধরতে নতুন বৈজ্ঞানিক তত্ত্বসমূহের ক্ষেত্রে এবং মহাবিশ্বে আমাদের অবস্থান সম্পর্কিত সমস্যার সমাধান প্রদান সম্ভব।
২০০৭ সালের ১৯ ডিসেম্বর ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের তত্ত্বীয় কসমোলজিকেন্দ্রে হকিংয়ের একটি মূর্তি স্থাপন করা হয়। প্রয়াত শিল্পী আয়ানওয়াল্টার এটি তৈরি করেন। ২০০৮ সালের মে মাসে হকিংয়ের আর একটি আবক্ষ মূর্তি উন্মোচন করা হয় দক্ষিণ আফ্রিকার কেপ টাউনে অবস্থিত আফ্রিকান ইনস্টিটিউট অব ম্যাথমেটিক্যাল সায়েন্সের সামনে। মধ্য আমেরিকার দেশ এল সালভাদর তাদের রাজধানী সান সালভাদরে বিজ্ঞান জাদুঘরটির নাম হকিংয়ের নামে রেখেছে।
পদার্থবিজ্ঞানের প্রাণপুরুষ বলা হতো স্টিফেন হকিংসকে। কৃষ্ণবস্তুর তত্ত্ব আবিষ্কার করে অমর হয়ে আছেন তিনি। অনেক পুরস্কার লাভ করেছেন তিনি। কিন্তু স্টিফেন হকিংসই পেলেন না নোবেল পুরস্কার।
ডিনামাইটের আবিষ্কারক আলফ্রেড বার্নহার্ড নোবেল তার জীবনের উপার্জিত অর্থ দিয়ে মানবজাতির কল্যাণে কাজ করা ব্যক্তিদের নোবেল পুরস্কার দেয়া হয়। যে ছয়টি বিষয়ে নোবেল পুরস্কার দেয়া হয় তার মধ্যে একটি পদার্থবিজ্ঞান। আর এই বিভাগেই পুরস্কার পেতে পারতেন সদ্য প্রয়াত স্টিফেন হকিংস।
কিন্তু আলফ্রেডের রেখে যাওয়া উইলে আরও দু’টি শর্তের কথা বলা হয়। যে তত্ত্বের জন্য নোবেল পুরস্কার দেয়া হবে সেই তত্ত্বটিকে হতে হবে ‘বাস্তবিক বা ব্যবহারিকভাবে প্রমাণিত’। অর্থাৎ সহজ ভাষায়, শুধু খাতা কলমে তত্ত্ব থাকলেই হবে না। তত্ত্বটির ব্যবহারিক নিশ্চয়তা প্রমাণিত হতে হবে। আর দ্বিতীয় শর্তটি হলো এই যে, নোবেল পুরস্কার শুধু জীবিত ব্যক্তিকেই দেয়া যাবে। মরণোত্তর নোবেল পুরস্কার দেয়া যাবে না।
স্টিফেন হকিংস তার জীবদ্দশায় কৃষ্ণবস্তুর কণা বা ‘হকিং কণা’র উপস্থিতি প্রমাণ করে যেতে পারেননি। নোবেল না পাওয়ার এই আক্ষেপের কথা জানতেন স্টিফেন নিজেও। কয়েক বছর আগে এক সম্মেলনে বক্তৃতা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, “যদি কম ভরের কৃষ্ণগহ্বর আবিষ্কৃত হয়, তাহলেই আমি নোবেল পুরস্কার পেয়ে যাব।”
স্টিফেন হকিংস নিজেও তার তত্ত্ব প্রমাণে কাজ করেছিলেন। ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে টাইমস ম্যাগাজিনকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন যে, তিনি এমনভাবে কাজ করছেন যেন কৃষ্ণগহ্বর নিয়ে তার তত্ত্ব সত্য বলে প্রমাণিত হতে পারে। সফলতার খুব কাছেও চলে এসেছিলেন তিনি। এই সাক্ষাৎকারের কয়েক মাস বাদে আগস্টে ন্যাচার সাময়িকীতে নিজের তত্ত্বের স্বপক্ষে একটি নিবন্ধ লেখেন। কিন্তু সেটি এখন পর্যন্ত সত্য বলে প্রমাণিত হয়নি। তবে স্টিফেন হকিংসের তত্ত্ব প্রমাণিত করতে কাজ করেছেন আরও কয়েকজন বিজ্ঞানী।
১৯৮০ সালে কানাডার ব্রিটিশ কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বিল আনরু হকিং কণার বিকিরণ পরীক্ষা করার একটি তত্ত্ব দেন। তিনি এমন একটি ব্যবস্থার কথা বললেন, যা দ্রুত গতিতে চলমান। ঝর্ণা বা জলপ্রপাতের বেলায় এমনটা দেখা যায়। জলপ্রপাতের একটি নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছালে কোনো সাঁতারুই এমন গতিতে সাঁতার কাটতে পারে না, যা জলপ্রপাতের আকর্ষণকে এড়াতে পারে। ফলে সে সাঁতারু যতই দক্ষ হোক না কেন, তাকে জলপ্রপাতের কাছে নতি স্বীকার করতেই হয়। আনরুর বক্তব্য ছিল, এটিই একটি ঘটনা দিগন্ত। কাজেই শব্দের জন্য যদি কোনো ‘ব্ল্যাকহোল’ বানানো যায়, তাহলেই হকিং বিকিরণ সেখানেও দেখা যাবে।
২০১৬ সালে এই প্রস্তাবকে কাজে লাগিয়ে স্টিফেন হকিংসের তত্ত্ব প্রমাণের খুব কাছে চলে আসেন বিজ্ঞানী স্টেইনহওয়ার। তিনি ব্ল্যাকহোলের ফোটন কণার মত এক ধরনের ফোটন কণা তৈরি করতে সক্ষম হন। তবে বিজ্ঞানীরা আজও এই পরীক্ষা প্রমাণ করতে পারেননি। গত দেড় বছর ধরে অনেকেই নিজেদের মত চেষ্টা করলেও কেউই সফলতার মুখ দেখতে পারেনি এখনও।
নোবেল পুরস্কার না পেলেও এক জীবনে অনেক স্বীকৃতি পেয়েছেন এই পদার্থবিজ্ঞানী। ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে গোটা একটি ভবন আছে তার নামে। এ ছাড়াও আছে বেশ বড়সড় এক মূর্তি। দক্ষিণ আফ্রিকার রাজধানী কেপটাউনেও তার মূর্তি আছে।
এ ছাড়াও ব্রিটিশ রাজ পরিবার থেকেও পেয়েছেন সম্মাননা। রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথকে অর্ডার অব দ্য ব্রিটিশ এম্পায়ার এবং অর্ডার অব দ্য কম্প্যানিয়ন অনারে ভূষিত করেছেন। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা তাকে দিয়েছেন প্রেসিডেন্সিয়াল মেডেল অব ফ্রিডম।
এর পাশাপাশি আন্তর্জাতিক পুরস্কারের তালিকা আরও লম্বা। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো তত্ত্বীয় পদার্থবিদদের সর্বোচ্চ সম্মান আলবার্ট আইনস্টাইন পদক। সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি ছয়টি পেয়েছেন ছয়টি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। ১৯৭৯ সালে গণিতের লুকাসিয়ান অধ্যাপক হিসেবে স্টিফেনকে নিয়োগ দেয় ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়। এক সময় এ পদে ছিলেন স্যার আইজ্যাক নিউটন। তারও আগে ১৯৭৪ সালেই রাজকীয় বিজ্ঞান সমিতির ফেলো হয়েছেন। ২০০৯ সালে আবার এই পদে যোগ দেন তিনি। সর্বশেষ ২০১৫ সালে পেয়েছেন বিবিভিএ ফাউন্ডেশন ফ্রন্টিয়ার অব নলেজ অ্যাওয়ার্ড।
মূলত স্টিফেন হকিংসের তত্ত্ব প্রমাণ করার মত সক্ষমতা হয়তো এখনও পৃথিবী অর্জন করতে পারেননি। অদূর ভবিষ্যতে হয়তো তার তত্ত্বের ব্যবহারিক প্রয়োগ করব আমরা। তিনি হয়ে থাকলেন কম্পিউটারের আবিষ্কারক চার্লস ব্যাবেজের মত। যার কম্পিউটার অ্যালগারিদম নিজের সময়ে প্রমাণ করে যেতে পারেননি। ব্যাবেজের মতই তাই নোবেল অধরা থাকল এই পদার্থপণ্ডিতের।
‘জীবন যদি মজার না হতো এটি হতো দুঃখ ভরা’- এ কথাগুলো বিখ্যাত বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং ধারণ করেছিলেন। ১৪ মার্চ তিনি ৭৬ বছর বয়সে মারা গেছেন। তাঁর দুর্দান্ত রসবোধ, এলিয়েন বা ভিনগ্রহের প্রাণী ও ব্ল্যাকহোল বা কৃষ্ণগহ্বরে দৃঢ় বিশ্বাসের কথা মানুষ দীর্ঘদিন মনে রাখবে।

SHARE

Leave a Reply