দুই.
সকলের সাথে একতরফা কুশল বিনিময়ের পর শাহিনের ঘরে গেলাম। ওকে ঘরে পাওয়া গেল। ও একটা গোয়েন্দা বই পড়ছে।
ওর অগোচরে ওর পেছনে যেয়ে ওর মাথায় একটা টোকা দিয়ে বললাম, ‘কিহে শাহিন হঠাৎ কাজিনের এত কড়া তলব কেন?’
‘আরে আরে তুরান যে।’ চমকে উঠে, ‘আসসালামু আলাইকুম।’
‘ওয়ালাইকুমুস সালাম।’ বিছানার ওপর বসে বললাম।
‘আমি জানতাম তুমি আসবে কিন্তু এতো তাড়াতাড়ি তা ভাবতে পারিনি।’ বলল শাহিন।
‘হুম। কাজিন আমাকে তলব করেছে। তাড়াতাড়ি না এসে পারি?’ উত্তর আমার। ‘তা কী জন্য এই তলব। এটাতো বললে না।’
শাহিন ঠিক হয়ে বসে বলল, ‘চিঠিতেই তো জানিয়েছি।’
‘হাঁস, মুরগি, পায়রা বেমালুম উধাও। এটাকি জানার কিছু হলো নাকি?’ আগ্রহ ভরে জানতে চাইলাম আমি।
এমন সময় মাগরিবের আজান দিলো। শাহিন বইটা বন্ধ করে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘আজান দিচ্ছে। চল নামাজ পড়ে আসি তারপর সব বলব।’
‘আচ্ছা চল।’
‘হুম। চল।’
দু’জন একসঙ্গে চললাম মসজিদে নামাজ পড়তে।
শাহিন আর আমি দু’জন এক সঙ্গে ওদের বাড়ি থেকে এই গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে পড়েছি। তারপর আমি চলে যাই শহরের এক স্কুলে। কিন্তু শাহিন গ্রামের হাইস্কুলেই পড়েছে। দু’জন একই সঙ্গে এবার এসএসসি পরীক্ষা দিয়েছি।
নামাজ শেষ করে রাস্তার ওপর আমার সমবয়সী বেশ কয়েকজন দাঁড়িয়ে গল্প করছে। তাদের কাছে যেতেই তাদের মধ্য থেকে মুনতাজ সালাম দিয়ে বলল, ‘এই তুরান কখন এসেছো?’
সালামের উত্তর দিয়ে বললাম, ‘এইতো নামাজের কিছু আগে।’
মুনতাজও এবার আমাদের সাথে এসএসসি দিয়েছে।
‘কিন্তু তোমাদের গ্রামে শুনেছি কী সব হচ্ছে।’ মুনতাজের কাছে জানতে চাইলাম আমি।
‘হচ্ছে না রীতিমত ভৌতিক সব কান্ডকারখানা চলছে। হাঁস, মুরগি, সব গায়েব।’ মুনতাজের কণ্ঠে বিস্ময়!
‘কিন্তু কেমন করে?’ শোনার আগ্রহ বাড়ছে আমার।
‘ঘর ভেঙে নতুবা তালা ভেঙে নিয়ে যাচ্ছে কে বা কিসে যেন।’ বলল মুনতাজ।
‘কে বা কিসে মানেটা কী?’ রহস্যের যেন পুরো গন্ধ পেলাম। তাই জানতে চাইলাম আমি।
‘আসলে এটা মানুষ না অন্য কিছু বোঝা যাচ্ছে না।’ বলল শাহিন।
‘তার মানে কী?’ আমার জিজ্ঞাসা।
শাহিন কিছু ভেবে নিয়ে বলল, ‘সেটাই তো জানতে চাই আমরা।’
‘বিষয় পুরো ক্লিয়ার হলো না। তবে চোর হলে চোরটাকে ধরার জন্য পাহারার ব্যবস্থা কর।’ বললাম আমি।
‘করেছিলাম। তাতেও কাজ হয়নি। সকাল হলে দেখা যায় কোনো একবাড়ি থেকে যে কোনো একটা প্রাণী উধাও। তবে এটা চোরের কাজ কিনা তাতে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। আর যদি চোর হয়ও তবে সে ভীষণ চালাক।’ বলল মুনতাজ।
‘যতই চালাক-চতুর হোক না কেন আমি কিন্তু আগে থেকেই ব্যবস্থা নিয়েছি। একটা চায়নিজ তালা কিনেছি আজ। এতো দিন আমার উপর নজর পড়েনি। কিন্তু পড়তে কতক্ষণ। তাই দিন থাকতে এই ব্যবস্থা।’ বলল আলিম। ও মুনতাজের পাশে দাঁড়িয়ে ছিলো। সেও আমাদের সাথে এবার পরীক্ষা দিয়েছে।
এর বেশি ওদের সাথে আমার আর কথা হয়নি। শাহিন এর বেশি আমাকে শুধু একটা কথাই জানিয়েছে যে, সকাল হলে তাদের বাগানে পালক পাওয়া যায়।
সকাল হলে শুনতে পেলাম আলিমের দুটো গিরিবাজ পায়রা উধাও। আমি আর শাহিন দ্রুত দাঁত ব্রাশ করে হাত-মুখ ধুয়ে চললাম আলিমের বাড়িতে। ও বারান্দায় মাথা হেড করে বসে আছে। শখের পায়রা হারানোয় ও শোকাহত। আমাদের দেখে বসতে দিলো।
না বসে উঠনে দাঁড়িয়েই বললাম, ‘শেষ পর্যন্ত তোমার চায়নিজ তালাকেও হার মানালো।’
‘না..না.. না! ওটা ভাঙেনি। বাক্সের পেছনের কাঠ ভেঙেছে। বাক্সটা অনেক দিনের। আমি বুঝতে পারিনি যে, ওটার পেছন এতো নরম হবে।’
‘তুমি কোনো খোঁজ করেছো কি?’ বলল শাহিন।
‘কোথায় করবো? গত সন্ধ্যেয় আমি নিজে সব পায়রা গুনে দেখে-শুনে তবেই দরজা দিয়েছি। সুতরাং খোঁজ করে কী হবে। এ পর্যন্ত কেউ পায়নি। কাজেই আমিও পাব না।’ হতাশ কণ্ঠে বলল আলিম।
‘আচ্ছা চলোতো শাহিনদের বাগানে। ওখানে নাকি প্রত্যেকদিন পালক পাওয়া যায়। চলতো একবার দেখে আসি কিছু পাওয়া যায় কিনা।’ ওদের দু’জনকে লক্ষ করে বললাম আমি।
আমার কথায় ওরা কোনো প্রতিবাদ করলো না। তিনজন একসঙ্গে বাগানের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম। খুব বেশিদূর না বাগানটা। মামাদের উত্তরের ঘরগুলোর পেছনেই এই বাগান। এই বাগানে আছে বাঁশঝাড়। আছে দেবদারু গাছ, লাটাম গাছ, দেশি গাবগাছ, জীবন গাছ, নাম নাজানা বেশ গাছা-আগাছাও আছে। বাগানজুড়ে আছে আনারস গাছ আর বাগানের মাঝ বরাবর আছে মস্তবড় এক কাঁঠাল গাছ।
বাগানে পৌঁছলাম আমরা। এই বাগানে এখন কেউ প্রাকৃতিক কাজ সারে না। একসময় সারতো। আশপাশের অনেক পরিবার ব্যবহার করতো এই বাগান। স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রচেষ্টা, রেডিও-টেলিভিশনের প্রচার প্রচারণার ফলে সকলে বাড়িতে স্যানিটারি ল্যাট্রিন বানিয়েছে। ফলে বাগান এদিক দিয়ে পরিষ্কার। কিন্তু ভেতরে যেভাবে আনারস বাগান তাতে এর ভেতরে হাঁটা খুব মুশকিল। অনেক কষ্টে কাঁঠাল গাছটার নিচে এসে দাঁড়ালাম। গাছটা দু’জন মিলে আটা যাবে না। এই গাছটার বয়স নাকি শত বছরেরও বেশি। প্রায় ত্রিশ ফুট উঁচুতে যেয়ে চারটা ডাল চারদিকে চলে গেছে। তবে গাছে কাঁঠাল নেই। শুনেছি এই গাছে কোনোদিন কাঁঠাল ধরে না। বাগানটার যেহেতু অনেক শরিক। তাছাড়া কেউ প্রয়োজনও বোধ করেনি গাছটা কাটার।
গাছটার গোড়ায় অনেক পালক পড়ে আছে। ওগুলো থেকে কেমন পচা একটা গন্ধ আসছে।
ওগুলোর একপাশ থেকে দুইটা পালক নিয়ে নেড়েচেড়ে আলিম বলল, ‘এই দুইটা আমার একটা পায়রার। কিন্তু আর একটা পায়রার কোনো চিহ্নতো দেখতে পাচ্ছিনে?’
‘এতো পালকের মধ্যে কি চেনা যায় কোনটা কার।’ বলল শাহিন।
‘আমি আমার পায়রার প্রত্যেকটা পালক চিনি।’ টলমল চোখে বলল আলিম। পায়রার শোকে ও কেঁদে দেবে প্রায়। ‘আসলে কামাল ঠিকই বলেছিলো।’ বলল ও।
আমি বললাম, ‘কী বলেছিলো কামাল।’
‘ও বলেছিলো এটা কোনো চোর ডাকাতের কা- নয়। এ সবই করছে ভিন গ্রহের প্রাণী। ভিন গ্রহের প্রাণীর কাজ এসব।’ বলল আলিম।
‘তার মানে?’ চমকে উঠলাম আমি।
আলিম আবার বলতে আরম্ভ করলো, ‘গত বুধবার রাত। আকাশে ঐ দিন মেঘ ছিলো। চারিদিক ঘনকালো অন্ধকার। নিজের হাতকেও ভালোভাবে দেখা যাচ্ছিলো না। আনুমানিক রাত সাড়ে বারোটা-একটা হবে। কামালের পায়রা ঘরে হঠাৎ খট-খট শব্দ হলো। অল্প শব্দেও কামালের ঘুম ভেঙে গেল। এসে দেখে পায়রা ঘরের দরজা খোলা। একটা আংটা তালাসহ অন্য আংটায় ঝুলছে। নিচে দুটো পেনসিল টর্চের মত হলুদ আলো তার দিকে চেয়ে আছে। আলো দুটোর ইঞ্চি দু’য়েক নিচে একটা পায়রা ছটফট করছে। হঠাৎ পায়রাসহ আলো দুটো উধাও হলো। দূরে শব্দ হতে হতে চলে যাচ্ছে। কামাল শব্দ লক্ষ্য করে ছুটলো। শব্দটা ক্রমেই দূরে চলে যাচ্ছে। একসময় এই বাগানে এলো। কামাল পিছে। তারপর এই গাছে খস খস শব্দ হতে লাগলো। এক সময় শব্দটাও মিলিয়ে গেল। গাছের ঐ চার ডালটার ওখানে আলো দুটো এক মুহূর্ত দেখা দিয়ে মিলিয়ে গেল।’ এ পর্যন্ত এক দমে বলে থেমে গেল আলিম।
গাছের চার ডালের ঐ জায়গাটার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলাম আমি, ‘তারপর কী হলো?’
‘পরদিন কামাল গ্রামের সবাইকে বলল, আমাদের গ্রামে ভিন গ্রহের প্রাণীদের আবির্ভাব হয়েছে। কিন্তু তার এই কথায় বড়রা বিশ্বাস করলো না। তারা বলল, ভিন গ্রহের গল্প পড়ে তোর মাথাটা গেছে। দেখ কোনো চোর দুটো টর্চ একসঙ্গে জ্বেলে এই কাজ করছে কিনা? সেই তোর পায়রা নিয়ে গেছে।’ বলে একটু দম নেয় আলিম। আবার বলা আরম্ভ করে, ‘কামাল তাদের কথায় কান দেয়নি। ও কয়েকজনকে নিয়ে আসে এই বাগানে। কিন্তু কেউ গাছে উঠতে পারলো না। অগত্যা চিৎকার, চেঁচামেচি আর ঢেলা ছুড়ে সবাই চলে যায়। এখন আমারও বিশ্বাস ওটা ভিন গ্রহের প্রাণী। আমার পায়রাও নিয়েছে ভিনগ্রহের প্রাণী। আর ও এই গাছ থেকেই ভিনগ্রহে চলে যায়। যেহেতু এই গাছটা বেশ উঁচু এবং পুরাতন।’
‘ওটা ভিন গ্রহের প্রাণী নাও হতে পারে।’ বলল শাহিন।
‘তবে কী?’ অবাক কণ্ঠে জানতে চায় আলিম।
‘হয়তো বড়দের কথাই ঠিক। কোনো চোর দুটো টর্চ নিয়ে ঐ কাজ করছে। আর গাছে উঠেছে যাতে মানুষের মনে ভয় জন্মে।’ বললাম আমি।
‘সেটা অসম্ভব। দুটো টর্চ এক সাথে জ্বাললে মুরগি ধরবে কী করে?’ হাত নেড়ে প্রতিবাদ করে বলল আলিম।
আসলে ব্যাপারটা সত্যি অবিশ্বাস্য। চোরের দ্বারা এ কাজ করা কিছুতেই সম্ভব নয়। তাছাড়া দুটো টর্চ একসঙ্গে জ্বালা, তারপর ঐ গাছে ওঠা..না..না..না ওটা অন্য কোনো প্রাণী হবে। কিন্তু…। তাহলে নিচ্ছেটা কিসে? সত্যি কি ভিন গ্রহে প্রাণী আছে?
তিন.
চারদিক অন্ধকার। একহাত সামনের জিনিসকেও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। চারদিকে এক ভুতুড়ে রাজ্য বিরাজ করছে। ক্রমাগত ঝিঁঝিঁ পোকা ডেকে চলেছে। আর বাঁশে বাঁশে ঘর্ষণ লেগে এক ভুতুড়ে ক্যাস-কোস আওয়াজ তুলছে।
আমাদের কাছ থেকে ত্রিশ ফুট মতো দূরে কাঁঠাল গাছ। আমি আর শাহিন আনারস ঝোপের আড়ালে বসে আছি। আনারস গাছের কাঁটা লেগে ছুলে গেছে কতক জায়গায়। সেসব জায়গায় যন্ত্রণা করছে।
এখন রাত বারোটা মতো বাজে। আমি আর শাহিন বাড়ি থেকে বের হয়েছিলাম বারোটা বাজতে পাঁচ মিনিট আগে। সবাই তখন ঘুমে অচেতন। ঘরে বাইরে থেকে তালা দিয়ে এসেছি।
আলিমের কথামত আমরা বারোটার দিকে এসেছি। কামাল বলেছিলো সাড়ে বারোটা একটার দিকে ভিন গ্রহের প্রাণী আসে।
কিন্তু সে যে গ্রহেরই প্রাণী হোক না কেন এই অন্ধকারে দেখবো কেমন করে?
আমাদের মনের কথা বুঝতে পেরে যেন মেঘগুলো সরে গেল। আর চাঁদমামা দেখা দিলো তার রূপালি আলো নিয়ে। বাঁশের মাথার উপর দিয়ে চাঁদের আলো এসে পড়লো। ফলে চারদিকে কিছুটা পরিষ্কার হলো।
পালকগুলোর ওপর চাঁদের আলো পড়লো। কিছু পালক চিকচিক করছে। বাকিগুলো কেমন ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। উত্তুরে বাতাস বইছে। আমরা পালকের উত্তর পাশে। কাজেই পালক থেকে পচা দুর্গন্ধ আসছে।
কিছুদূরে দুটো পালক পড়ে আছে। ও দুটো আলিমের একটা পায়রার। বিকালে শুনেছি আলিমের অন্য পায়রাটা ফিরে এসেছে। ওটার গায়ে কোনো ক্ষতচিহ্ন নেই। হয়তো ওটাকে ধরতে পারেনি ভিন গ্রহের প্রাণী।
সময় কিছুতেই কাটতে চাচ্ছে না। সময় বড়ই নিষ্ঠুর। যখন তার দরকার হয় তখন সে তাড়াতাড়ি দৌড় মারে। আর যখন তাকে তাড়াতাড়ি যেতে বলা হয় তখন সে যেতেই চায় না। আমি ঘড়ির লাইট জ্বেলে দেখলাম একটা বাজে। কিন্তু কোনো কিছুরই আসার লক্ষণ নেই। এদিকে ঘুমে আমার দুচোখ বুজে আসছে।
শাহিনকে বললাম, ‘এই তোর কি ঘুম লাগছে?’
ও ওর মুখে একটা থাপ্পড় মেরে বলল, ‘ইতোমধ্যে একবার ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। কিন্তু এই হতভাগা মশা ঘুম ভাঙিয়ে দিয়েছে। অবশ্য ভালো করেছে। কিন্তু এখানে থাকাই যে মুশকিল হলো।’ বলে আবার চড়-থাপ্পড় মারা শুরু করে দিলো।
আমি বললাম, ‘এভাবে শব্দ করলে যম পর্যন্ত পালাবে।’
‘তাই বলে মশার কামড় খেয়ে ম্যালেরিয়া বাঁধাবো নাকি?’ ঝাঁঝের সাথে বলল শাহিন।
‘উপায় নেই চাঁদু। এই রহস্য ভেদ করতে হলে এটুকু তো সহ্য করতেই হবে।’ বললাম আমি।
একথা শুনার পর শাহিন আর টুঁ শব্দটি করেনি। নীরবে মশার কামড় হজম করেছে।
‘আসসালুতু খায়রুম মিনাননাউম।’
তড়িৎ গতিতে উঠে বসলাম। বসেই টের পেলাম এটা কোনো বিছানা নয়। এটা বাগান। আর আমি আছি আনারস গাছের কাছে। জামা কাঁটায় আটকে গেছে। গায়ে কাঁটা ফুটলো। ‘উ..উ’ করে উঠলাম। পাশে দেখি শাহিন তখনও বেঘোরে ঘুমুচ্ছে। জামার কাঁটা ছাড়াতে ছাড়াতে শাহিনকে ডাকলাম।
পাহারা দিতে যেয়ে আমরা কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম তা টেরই পাইনি।
শাহিন উঠে আড়মোড়া ছাড়তে যেয়ে পড়ে গেল আনারস গাছের উপর। সাথে সাথে ‘উঁ..আঁ’ করে কঁকিয়ে উঠলো।
আমার দারুণ হাসি পেল। ওর দুঃখে হেসে উঠলাম। মনে পড়লো পরের দুঃখে হাসতে নেই। কাজেই প্রদীপের মতো দপ করে হাসিটা নিভে গেল। শাহিনের দিকে তাকিয়ে দেখি ও একদৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে পরক্ষণে কাঁঠাল গাছটার দিকে তাকিয়ে হয়তো মনে করার চেষ্টা করছে এখন সে কোথায় আছে।
চার.
ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে পাহারা দিলে চলবে না। তাই আজ দুপুরে আচ্ছা করে ঘুমিয়ে নিয়েছি। আজও ঠিক একই সময়ে একই জায়গায় বসে আছি। তবে আজ শুরুতেই আকাশে চাঁদের আলো আছে। কিন্তু যখন তখন মেঘ চাঁদের আলোকে ঢেকে দিতে পারে।
অবশেষে তাই-ই ঘটলো। এক ঘণ্টা যেতে না যেতেই মেঘের আড়ালে চাঁদ চলে গেল। আর কিছুক্ষণ পরে শুরু হলো তুমুল বৃষ্টি।
কাজেই পাহারা আর দেয়া হলো না। বৃষ্টি শুরু হতেই চলে এলাম বাড়ি। বাকি রাত আর পাহারা দেয়া হলো না। কারণ সারারাতই চলল বৃষ্টি। ঘুমুলাম বাকি রাত। ঘুম ভাঙলো পর দিন সকাল ন’টায়। তখনও বৃষ্টি হচ্ছে টিনের চালে নিনাদ বাজিয়ে।
বৃষ্টি চললো একনাগাড়ে সন্ধ্যা ছ’টা পর্যন্ত। কখনও আস্তে আবার কখনও জোরে।
অন্য দিনের তুলনায় আজকে সন্ধ্যা এসেছে একটু তাড়াতাড়ি। এজন্য তাড়াতাড়ি রাতের খাবার খেয়ে ঘরে দরজা দিলাম। কিন্তু ঘুমুলাম না। বসে গল্পের বই পড়তে লাগলাম।
রাত এগারোট বাজতেই সমস্ত বাড়ি নিঝুম পুরীতে পরিণত হলো। আরো কিছু সময় অপেক্ষা করে বের হলাম বাড়ি থেকে।
নিঝুমপুরী থেকে বের হতে কোনো বেগ পেতে হলো না। গত দুই দিন যে আমরা পাহারা দিয়েছি তা কেউ টের পায়নি।
গত দুই দিনেও উধাও হওয়া থেকে রেহাই যায়নি। একদিন মুরগি এবং পর দিন হাঁস উধাও হয়েছে।
আগের নির্দিষ্ট জায়গায় বসে আছি। আকাশে কিন্তু চাঁদ নেই। আকাশ যেন মুখ গোমড়া করে বসে আছে। আর একটু বকলেই অঝোর ধারায় কেঁদে দেবে।
আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করতে লাগলাম বৃষ্টি যেন আর না হয়। কাল রাত থেকে আজ সন্ধ্যা পর্যন্ত যা হয়েছে তা মাশাআল্লাহ। বৃষ্টি না হলেও আকাশ গোমড়া হয়ে আছে।
রাত তখন সাড়ে বারটা। কাঁঠাল গাছে এক ধরনের খস খস শব্দ হয়ে পরক্ষণে শব্দটা পূর্ব দিকে চলে গেল।
শাহিন আমার দিকে তাকিয়ে ফিস ফিসিয়ে বলল, ‘তুরান আমাদের বরাতে বোধ হয় ভিন গ্রহের প্রাণীর দেখা হবে না।’
‘হয়তো।’ বললাম আমি।
‘যখন শব্দ হচ্ছিল তখন আমার ভীষণ ভয় করছিলো। তোর কী ভয় করেছে?’ জানতে চাইলো শাহিন।
‘হয়তো।’
‘ঐ শব্দ ওয়ালা জিনিসটাই কী ভিন গ্রহের প্রাণী?’
‘হয়তো।’
‘কিন্তু এই অন্ধকারেতো কোনো গ্রহের প্রাণীকে দেখতে পাব না।’ মনমরা হয়ে বলল শাহিন।
‘হয়তো।’
‘আহ! তুরান থামবে? শুধু হয়তো হয়তো। তোকে কি হয়তো রোগে পেয়েছে নাকি?’ রেগে বলল শাহিন।
শাহিন আমার সঙ্গে আর কোনো কথা বলেনি। আমার কাছ থেকে একটু দূরে সরে বসলো। আলো থাকলে হয়তো দেখতে পেতাম ও মুখটা ঐ আকাশের মত কালো গোমড়া করে আছে।
‘কিন্তু ঐ শব্দটা কিসের? তা আমি নিজেও জানি না। ওটাই কী সেই ভিন গ্রহের প্রাণী?’ নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করলাম- আমি।
একটু ঝিমুনি মত এসেছিলো। অমনি শুনি সেই একই ধরনের খস খস শব্দ। শব্দটা ক্রমেই এগিয়ে আসছে। উত্তেজনায় শরীরের প্রত্যেকটা অঙ্গ টান টান হয়ে গেছে আমার। আজ ভিন গ্রহের প্রাণী দেখবো। এতোদিন যেটাকে অবাস্তব বলে ভেবেছি আজ তাই দেখবো। ভয় ভয়ও করতে লাগলো। না জানি কিসের দেখা হবে আজ।
হঠাৎ দেখি কাঁঠাল গাছের গোড়ায় দুটো হলুদ আলো। আলোর ইঞ্চি দুয়েক নিচে একটা পাতি হাঁস ছটফট করছে আর প্যাঁক প্যাঁক করে গোংরাচ্ছে।
অনেক বইতে পড়েছি উত্তেজনায় পৌষ মাসেও নাকি শরীর দিয়ে ঘাম বের হয়। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে আমাকে রেফ্রিজারেটরের বরফ তৈরির কক্ষে বসিয়ে দেয়া হয়েছে। বরফ খন্ডে পরিণত হয়ে ঐ দিকে বিস্ফারিত চোখে চেয়ে আছি।
এদিকে কখন যে শাহিন তেলাপোকাগুলো ছেড়ে দিয়েছে তা টেরই পাইনি। যখন তেলাপোকা ওড়ার ফড়ফড় শব্দ হলো তখন বুঝতে পারলাম ও কাজ সেরে দিয়েছে।
ভিন গ্রহের প্রাণীদের শরীরে বুলেট বিঁধলেও নাকি কিচ্ছু হয় না। কোনো অস্ত্রই নাকি ওদের কোনো ক্ষতি করতে পারে না এবং কোনো প্রাণীকেও নাকি ওরা ভয় পায় না। একমাত্র তেলাপোকা ছাড়া। তেলাপোকা নাকি ভিন গ্রহের প্রাণীদের একমাত্র শত্রু। তাই শাহিন কাগজের মোড়কে করে গোটা পঁচিশেক তেলাপোকা এনেছিলো। এই তেলাপোকা ধরতে ওকে বাড়িতে অনেক কসরত করতে হয়েছে। তেলাপোকা নাকি ভিন গ্রহের প্রাণীদের চেনে এবং সরাসরি আক্রমণ করতে পারে। তাই এই ব্যবস্থা।
কিন্তু কই? হলুদ আলো দুটো তো ওখানেই স্থির হয়ে আছে। আর চেয়ে আছে আমাদের দিকে। ভয়ে অন্তরাত্মা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেল।
কোনো তেলাপোকা কিন্তু ওকে আক্রমণ করছে না। শুধু ফড়-ফড় করে উড়ে বেড়াচ্ছে।
পশ্চিম দিকে থেকে আবারও একটা শব্দ আসছে। তবে আগের শব্দের সাথে এর কোনো মিল নেই।
শাহিন আমার গা ঘেঁষে বসে ফিস ফিসিয়ে কাঁপা কাঁপা সুরে বলল, ‘তুরান আরো আসছে।’
দু’জনের চোখ এখন দ্বিতীয় শব্দের দিকে স্থির। এদিকে কখন যে হলুদ আলো দুটো পাতি হাঁসসহ উধাও হয়েছে তা খেয়াল করিনি।
দ্বিতীয় শব্দটাও এসে থামলো কাঁঠাল গাছের গোড়ায়। কিন্তু ঐ দুটো হলুদ আলোর পরিবর্তে একটা আস্ত মানুষের অবয়ব দেখা যাচ্ছে। আর তার হাতে একটা লাঠি।
আর ঠিক সেই মুহূর্তে চাঁদের নিচ থেকে মেঘ সরে গেল। দেখলাম একজন লোক খালি গায়ে কাছা মারা অবস্থায়। ওর হাতে একটা বাঁশের লাঠি। গাছের দিকে তাকিয়ে আছে সে।
আর দেরি না করে ছুটে গেল শাহিন লোকটাকে ধরতে। ইতোমধ্যে আমার সমস্ত শরীরের বরফ যেন গলে গেছে। আমিও ছুটলাম। আমার আগে শাহিন লোকটাকে ধরে ফেলল ওর কিছু বোঝার আগে। আর ঠিক তখনি ফড়-ফড় করে একটা তেলাপোকা উড়ে এসে শাহিনের মুখে বসলো। অমনি শাহিন লোকটাকে ছেড়ে দিয়ে তেলাপোকা সরাতে ব্যস্ত হয়ে গেল। আমি ওর কাছে যাওয়ার আগেই লোকটি উধাও। এবার দু’জন মিলে লোকটাকে ধাওয়া করলাম। কিন্তু বাগান পেরিয়ে কোনো জন-মানুষের ছায়া পর্যন্ত দেখলাম না।
দু’জন বোবার মতো দু’জনের দিকে চেয়ে দাঁড়িয়ে আছি। তখন বাগানের ভেতর কাঁঠাল গাছটার দিক থেকে ভেসে এলো, ‘মাফ মাফ’ শব্দ।
পাঁচ
সকালে মামাদের ঐ বাগানে যেন যুদ্ধের সাজসাজ রব পড়লো। দামামা না বাজলেও কেউ কেউ পূর্বপুরুষের বীরত্বগাথা গান গাচ্ছিল। অনেক মানুষ লাঠিসোটা নিয়ে হাজির হয়েছে বাগানে। দুইটা লম্বা দেখে বাঁশ কাটা হলো। সকলে কাঁঠাল গাছের গোড়া থেকে দশ-বার ফুট দূরে তিন পাশে দাঁড়িয়ে একটা মানব বেড়া তৈরি করলো। বেড়া এমনভাবে দেয় হলো যাতে পিঁপড়া পর্যন্ত পালাতে না পারে। সকলের হাতে লাঠি। আর এক পাশে একটা লোহার খাঁচা পেতে রাখা হলো। যাতে ভিন গ্রহের প্রাণী ওই খাঁচায় যেয়ে আশ্রয় নিতে পারে।
গ্রামের শক্তিশালী দুই পালোয়ন কেলো আর ভুতো বাঁশ বেয়ে উঠে গেল কাঁঠাল গাছের চার ডালের কাছে।
এসবই হচ্ছে ছোট মামার নির্দেশে এবং আমার ও শাহিনের পরিকল্পনা মতো। সকালে ছোট মামাকে সব জানিয়েছি। তারপর তিনি এই ব্যবস্থা গ্রহণ করেছেন।
কেলো গাছ থেকে চিৎকার করে বলল, ‘পেয়ে গেছি ভিন গ্রহের প্রাণীকে। এই চার ডালের কাছে একটা গর্ত আছে। এর মধ্যে ব্যাটা ছেলে-পুলে নিয়ে আরামসে বসে আছে। অনেক জ্বালিয়েছো ভিনগ্রহের চাঁদু। এবার বুঝবে মজা।’ একটু থেমে নিচের লোকজনের দিকে তাকিয়ে বলল কেলো, ‘এই তোমাদের মধ্য থেকে কেউ একজন আমাকে একটা লাঠি দাওতো।’
একজন একটা লাঠি উঠিয়ে দিলো। কেলো লাঠি নিয়ে গর্তের মধ্যে খোঁচা দিলো। আর অমনি ভেসে এলো গতকালকের সেই ডাক, ‘মাফ মাফ’ শব্দ।
আরো কয়েকটা খোঁচা দিলো ও। খোঁচা খেয়ে কুঁই কুঁই করে গাছ থেকে নেমে এলো চারপায়ের এক ভিন গ্রহের প্রাণী। এর উচ্চতা একহাত আর লম্বায় দেড় হাত মতো হবে। গায়ে ও পায়ে ধূসর রঙের উপর হালকা কালো ডোরা কাটা দাগ। মুখ বাঘের মতো। গোঁফ দেখতে বিড়ালের মতো। সত্যি বলতে এটাকে বিড়ালের বড় ভাই এবং বাঘের ছোট ভাই বলা যায়।
কোনো পাশে ফাঁকা না পেয়ে চারপেয়ো ভিন গ্রহের প্রাণীটা সোজা খাঁচার মধ্যে গেল। সঙ্গে সঙ্গে খাঁচার মুখ বন্ধ করে দেয়া হলো।
ওদিকে গাছের গর্তের মধ্য থেকে ভূতো এই প্রাণীর চার চারটা বাচ্চা বের করে নিয়ে এলো বস্তায় করে। বাচ্চাগুলোকেও ওর মায়ের সাথে খাঁচায় ভরে দেয়া হলো। এদের চেহারা পুরো বিড়ালের মতো। তবে গায়ে ও পায়ে ওর মায়ের মত ডোরাকাটা।
খাঁচায় ভরার পর থেকে প্রাণীগুলোকে উৎসুক জনতা প্রাণভরে দেখলো। ওগুলো আদতে কোনো ভিন গ্রহের প্রাণী নয়। বাঘও না আবার বিড়ালও না। প্রাণীগুলোর নাম হলো বনবিড়াল। গ্রাম্য ভাষায় যাকে বলে, ‘খাটাস’।
খাঁচাটা এখন ফাঁকা জায়গায় আনা হয়েছে। গ্রামের মানুষ দলে দলে আসছে ভিন গ্রহের প্রাণীরূপী খাটাস দেখতে। যে প্রায় দুই মাস ধরে গ্রামের সকল গৃহপালিত পাখি ধরে খেয়ে আসছে। সকলে খাঁচার সামনে এসে এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে খাটাসগুলোকে দু’তিনটে গালাগাল দিয়ে তবেই চলে যাচ্ছে।
এক সময় আলিম এলো। খাটাস দেখে আমার আর শাহিনের কাছে এসে বলল, ‘এবার বল ভিন গ্রহের প্রাণীরূপী খাটাসটাকে কিভাবে চিনলে?’
আমি বললাম, ‘এই বাগানে এই কাঁঠাল গাছের নিচে পালক পড়ে থাকা এটা একটা অস্বাভাবিক ব্যাপার। তারপর তোমার পায়রা হারানোর পর যখন এই বাগানে আসলাম তুমি তোমার পায়রার পালক চিনতে পারলে। তখন থেকে আমার মনে খটকা লাগলো এই গাছেই কিছু একটা আছে। সেটা ভিন গ্রহের প্রাণী হোক আর যাই হোক কিছু একটা আছে। পরে দু’জন মিলে সিদ্ধান্ত নিলাম রাতে এই বাগান মানে এই কাঁঠালগাছ পাহারা দেবো। দেখবো কী আছে ঐ কাঁঠাল গাছে। তারপর শুরু হলো পা…।’
আমার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে শাহিন বলল, ‘পাহারার প্রথম রাত গেল মশার কামড় খেয়ে আর ঘুমিয়ে। দ্বিতীয় রাত গেল বৃষ্টিতে ভিজে। আর তৃতীয় রাত অর্থাৎ সাফল্যের দিন….।’ একটু দম নিলো শাহিন। তারপর বলল, ‘তুরান তুই বল।’
‘তৃতীয় রাত যখন অস্থির হয়ে উঠেছিলাম তখনই এলো এই ভিন গ্রহের প্রাণীরূপী খাটাস। কিছু পরে এলো একজন মানুষ। কিন্তু মানুষ দেখতে যেয়ে এদিকে খাটাস তখন উধাও। তখনও আমি খাটাসকে ভিন গ্রহের প্রাণী রূপেই ভেবেছি।’ হাত উঁচু করে আমাকে থামিয়ে দিলো আলিম।
‘তারপর সেই লোকটা অর্থাৎ চোরটা গেল কোথায়?’ আলিমের প্রশ্ন।
আমি শাহিনের দিকে তাকিয়ে দেখলাম ওর চোখে-মুখে লজ্জার ছাপ। কাজেই আলিমকে তেলাপোকার কথা বললাম না। বললাম, ‘লোকটা চোর নয়। সে হয়তো খাটাসকে দেখেছিলো। অথবা তার হাঁস হয়তো খাটাস ধরে আনে তাই এসেছিলো ওর পিছে পিছে। হয়তো হাঁসটাকে বাঁচাতে।’
‘কিন্তু তুরান, তুমি কী করে বুঝলে যে এই কাঁঠাল গাছেই আছে ভিনগ্রহের প্রাণী। আর এটাই খাটাস।’ পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন ছোটমামা। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন।
‘কয়েকদিন আগে গাছ সম্পর্কে একটা বই পড়েছিলাম। তাতে ছিলো কাঁঠালগাছেই সবচেয়ে বেশি সুড়া হয় অর্থাৎ ফাঁপা হয়। আর এই গাছটা অনেকদিনের পুরাতন। সুতরাং এই গাছে সুড়ঙ্গ থাকা স্বাভাবিক। আর মামা আমি এখানে ফাইভ পর্যন্ত পড়েছি। ১৯৮৯ সালে আমি ক্লাস থ্রির ছাত্র। সময়টা এই মে মাসের ১৫ থেকে ২০ তারিখের মধ্যে হবে। কোনো এক সন্ধ্যেয় শুরু হয় বৃষ্টি। রাত বারোটা-একটা নাগাদ বৃষ্টি থামে। তখন এই প্রাণীই ‘মাফ মাফ’ বলে ডাকতে ডাকতে আপনাদের উঠানে এসেছিলো। আমি ঐ রাতে দারুণ ভয় পেয়েছিলাম। সকালে নানার কাছে জিজ্ঞাসা করায় তিনি বলেছিলেন, ‘ওই ডাক খাটাসের। আর…।’
‘আর বলেছিলেন, ওই ডাক শুনলে যতই বীর হোক না কেন তাকে রাতে চমকাতেই হবে।’ আমার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বললেন ছোট মামা।
আমাদের পাশে কেলো আর ভূতো দাঁড়িয়ে ছিল। কেলো বলল, ‘রাতে নয় এই সাত সকালে খাটাসের মাফ মাফ ডাক শুনে আমি চমকে উঠেছিলাম।’
‘আমিও তাই।’ বলল ভূতো।
সকলের মধ্যে একটা হাসির রোল উঠলো।
‘আচ্ছা! পায়রা, মুরগি ও হাঁসের ঘর ভাঙে কে? আর তালাসহ আংটাও বা উঠায় কে? তারতো কোনো সমাধান হলো না। আর খাটাসই যে এ কাজ করে তার তো কোনো প্রমাণ নেই?’ আচমকা বলল আলিম।
ছোটমামা সবজান্তার ভঙ্গিতে বললেন, ‘প্রমাণ তোমার পায়রার ঐ দুটো পালক। ও দুটো নিশ্চয় তোমার পায়রার। ফলে তোমার পায়রাঘর ভেঙেছে এই খাটাস। যে অমন কাঠ ভাঙতে পারে তার পক্ষে অমন পচা কাঠ থেকে তালাসহ আংটা উঠানো আহামরি কোনো কঠিন কাজ নায়।’
খাটাসকে না মারার জন্য আমি মামাকে বললাম, ‘মামা এদেরকে মারা যাবে না। বাঁচিয়ে রাখতে হবে এদের। কিভাবে বাঁচাবেন তার ব্যবস্থা করেন।’
ছোট মামা আমার দিকে তাকিয়ে একটা মুচকি হাসি দিলেন। তারপর সকলের উদ্দেশে একটা ছোট্ট বক্তৃতা শুরু করলেন। বললেন, ‘বাচ্চাসহ এই প্রাণীটাকে মেরে না ফেলে কোনো চিড়িয়াখানায় বা অভয়ারণ্যে ছেড়ে দিলেই মনে হয় ভালো হয়। কারণ মেরে ফেললে তো মরেই গেল। এতকাল ও যা খেয়েছে তাতো আর ফিরে পাবো না। তার চেয়ে ভালো ছেলে-পুলে নিয়েও বেঁচে থাকুক এই সুন্দর পৃথিবীতে। এরাতো আজ বিলুপ্ত প্রায়। সুতরাং আমরা ওদের মারবো না।’
মামার বক্তব্য সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য হলো। তিনি সবকিছু ঠিক করেছেন। আজ কালের মধ্যে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর হতে লোক আসবে। তারা এসে এদেরকে নিয়ে কোনো অভয়ারণ্যে ছেড়ে দেবে অথবা কোনো চিড়িয়াখানায় দিয়ে দেবে। যাতে নির্ভয়ে ওরা জীবন কাটাতে পারে।
‘হুম বুঝলাম। সাহস দেখিয়ে কাজ করলে তার ফল পাওয়া যায়। আর গত বৃষ্টির রাতে যে ডাক ছিল, ‘মাফ মাফ’ ওটা খাটাসের। তার মানে খাটাস এখনও আমাদের গ্রামে আছে।’ বলল ছোট্ট মেয়ে বুশরা। শাহিনের এক মাত্র মেয়ে ও।
গতকাল বিকালে অনেক দিন পর ওদের বাড়িতে বেড়াতে এসে ছিলাম। শাহিনের মেয়ে মানে আমার ছোট্ট মামনিটা জোর করে রাখলো ওদের বাড়িতে। রাতে প্রচ- বৃষ্টি হলো। থামলো মাঝরাতে। এর কিছু পর ভেসে এলো ‘মাফ মাফ’ শব্দ।
সক্কাল বেলায় ঘরের দরজা খুলতেই বুশরা মনিটা ছুটে এলো আমার কাছে। ও বলল, ‘চাচ্চু রাতে যে ডাক শুনেছিলাম ওটা কিসের ডাক? আব্বু আপনার কাছে জিজ্ঞাসা করতে বলেছেন।’
তখন ওকে কোলে করে নিয়ে বসার ঘরে যেয়ে দেখতে পাই শাহিনও বসে আছে।
‘হুম। তুইই ওকে বল। গতকাল রাতে ওটা কিসের ডাক ছিলো।’ বলল শাহিন।
মামনিকে কোলে করে সোফায় বসে শুরু করলাম আমার ও শাহিনের ছেলেবেলায় উদঘাটিত একটা রহস্য।
[সমাপ্ত]