Home খেলার চমক তামিম ইকবাল বাংলাদেশের ব্যাটিং স্তম্ভ -আবু আবদুল্লাহ

তামিম ইকবাল বাংলাদেশের ব্যাটিং স্তম্ভ -আবু আবদুল্লাহ

দীর্ঘদিন ধরেই বাংলাদেশী সমর্থকদের হাহাকার ছিলো একজন মারকুটে ওপেনারের জন্য। উপমহাদেশের অন্য দলগুলোতে যখন সাইদ আনোয়ার, সনথ জয়সুরিয়া কিংবা বীরেন্দ্র শেবাগরা ইনিংসের শুরুতেই ব্যাট হাতে ঝড় তুলেছেন, বাংলাদেশ তখন খুব করেই চাইতো এরকম একজন ওপেনার। যিনি শুরুতেই দলকে এনে দেবেন উড়ন্ত সূচনা, প্রতিপক্ষের বোলারদের বুকে ধরাবেন কাঁপন।
২০০৭ সালের জানুয়ারিতে জিম্বাবুয়ে সফরে দলে নেয়া হলো নতুন একটি ছেলেকে। খোঁজ নিয়ে জানা গেল ছেলেটি নাফিস ইকবালের ছোট ভাই ও আইসিসি ট্রফি জয়ী বাংলাদেশ দলের অধিনায়ক আকরাম খানের ভাতিজা। ঘরোয়া ক্রিকেটে তেমন আলোচিত নাম না হয়েও জাতীয় দলে কিভাবে সুযোগ পেল তাই নিয়ে নানা প্রশ্ন ঘুরতে থাকলো চারদিকে; কিন্তু নির্বাচকরা যে রতœ চিনতে ভুল করেননি তার প্রমাণ দিতে দেরি করেনি ছেলেটি। তামিম ইকবাল খান; চট্টগ্রামের খান পরিবার থেকে উঠে আসা তৃতীয় আন্তর্জাতিক ক্রিকেটার তিনি। তবে প্রতিভা আর খ্যাতিতে তামিম ছাড়িয়ে গেছেন আগের দু’জনকে।
জিম্বাবুয়েতে ওই সিরিজের তৃতীয় ওয়ানডেতেই ওপেনিংয়ে নামিয়ে দেয়া হলো তামিমকে। বয়স মাত্র আঠারো। প্রথম ম্যাচটি খুব ভালো যায়নি, ৫ রান করে আউট হয়েছেন। পরের ম্যাচে করেছেন ৩০ রান। এরপর এই অনভিজ্ঞ ব্যাটসম্যনকে নিয়েই বিশ্বকাপ খেলতে ওয়েস্ট ইন্ডিজে উড়াল দিলো হাবিবুল বাশারের দল। বিশ্বকাপের মতো বড় আসরে এমন আনকোরা ব্যাটসম্যান দেখে অনেকেই ভ্রু কুঁচকেছেন। তবে পোর্ট অব স্পেনে তামিম বিশ্ব ক্রিকেটকে জানিয়ে দিলেন, তিনি স্থায়ী হতেই এসেছেন। বিশ্বকাপে নিজেদের প্রথম ম্যাচে মাশরাফির দারুণ বোলিংয়ে ভারতকে ১৯১ রানে অলআউট করে দেয় বাংলাদেশ। কিন্তু বাউন্সি পিচে জহির খান, অজিত আগারকারদের সামলাবে কে?
আরেক ওপেনার শাহরিয়ার নাফিস ২ রানে আউট হলেও সেই দায়িত্বটা নিলেন তামিম। একের পর এক সাহসী শটে জানিয়ে দিলেন তিনি বিশ্বসেরাদের চোখে চোখ রেখে কথা বলতে জানেন। দারুণ সব স্ট্রোক খেলতে থাকেন উইকেটের চারদিকে। উইকেট ছেড়ে বেরিয়ে এসে জহির খানকে যখন মিড উইকেটের ওপর দিয়ে মাঠের বাইরে পাঠালেন, ধারাভাষ্যকার বললেন ‘রীতিমতো খুন!, একে থামানো সম্ভব নয়’। ২ ছক্কা আর ৭টি চারে ৫৫ বলে ৫১ রান করে যখন আউট হন ততক্ষণে দারুণ এক সূচনা পেয়ে গেছে বাংলাদেশ। আর ক্রিকেট বিশ্ব দেখেছে বাংলাদেশেও আছে দাপুটে ব্যাটসম্যান। তামিম আউট হওয়ার পর মুশফিকুর রহীম আর সাকিব আল হাসানের হাফ সেঞ্চুরিতে বাংলাদেশ জিতেছিলো ৫ উইকেটে।
পরের বছর জানুয়ারিতে (২০০৮ সালে) নিউজিল্যান্ড সফরে ডুনেডিনে টেস্টে অভিষেক হয় তামিমের। প্রথম ইনিংসে ৫৩ আর দ্বিতীয় ইনিংসে ৮৪ রানের ইনিংস খেলে সাদা পোশাকের অভিষেকটা রাঙিয়ে তুলেছিলেন চট্টলার এই বীর। সে বছরই মিরপুরে আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে পেয়েছেন ক্যারিয়ারের প্রথম ওয়ানডে সেঞ্চুরি (১২৯)। পরের বছর ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে তার প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরির (১২৮) সুবাদে দেশের বাইরে প্রথম টেস্ট জেতে বাংলাদেশ। ২০১০ সালে জানুয়ারিতে ঢাকা টেস্টে ভারতের বিপক্ষে খেলেছেন ১৫১ রানের আরেকটি মহাকাব্যিক ইনিংস। মে মাসে লন্ডনের লর্ডস ও ম্যানচেস্টারের ওল্ড ট্রাফোর্ডে পরপর দুই টেস্টে সেঞ্চুরি করে আরো একবার প্রশংসা কুড়িয়েছেন ক্রিকেট বোদ্ধাদের। ক্রিকেটের সবচেয়ে ঐতিহ্যবাহী মাঠ লর্ডসের অনার্স বোর্ডে নাম উঠিয়েছেন প্রথম বাংলাদেশী হিসেবে। ১৫ চার আর দুই ছক্কায় ৯৪ বলে পূর্ণ করছেন দাপুটে সেঞ্চুরি। ১০৩ রানের ইনিংসের পর পরের ম্যাচে খেলেছেন ১০৮ রানের ইনিংস। ওই কৃতিত্বই তাকে স্থান করে দিয়েছে ক্রিকেটের বাইবেল হিসেবে পরিচিত উইজডেন ম্যাগাজিনের বর্ষসেরা ক্রিকেটার হিসেবে।
ওই সিরিজের আগে ইংল্যান্ডের সাবেক ক্রিকেটাররা বাংলাদেশকে ছোট করে অনেক মন্তব্য করেছিলেন, ব্যাট হাতে তার উপযুক্ত জবাব দিয়েছেন তামিম। দু’টি টেস্টেই দল হারলেও ইংলিশরা স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে বাংলাদেশ সাহসী ক্রিকেট খেলতে জানে। আর ক্রিকেট মোড়লদের এই স্বীকৃতি আদায় হয়েছিলো তামিমের ব্যাটের জোরেই।
ভালো সময়ের পাশাপাশি ক্যারিয়ারে খারাপ সময়ও দেখতে হয়েছে তামিমকে। যেমন প্রথম ওয়ানডে সেঞ্চুরির পর দ্বিতীয় সেঞ্চুরি পেতে সময় লেগেছে ৩৩ ম্যাচ। অসম্ভব প্রতিভা থাকার পরও কেন এখনো তার সেঞ্চুরি সব মিলে ১৭টি সে প্রশ্নের কোনো উত্তর নেই। ফেসবুক, টুইটারেও একটা সময় ক্রিকেট সমর্থকদের সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছে তাকে। বিভিন্ন সময় ব্যঙ্গ করা হয়েছে খারাপ পারফরম্যান্সের কারণে। আসলে ২০০৭ বিশ্বকাপে ভারতকে হারানো ম্যাচের পর তামিমেকে ঘিরে সমর্থকদের যে আশা তৈরি হয়েছিলো ১৯ বছরের এক তরুণের পক্ষে তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। স্বাভাবিকভাবেই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের কঠিন পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে নিতে সময় লাগবে। তবে তামিম ব্যাট হাতেই সব সমালোচনার জবাব দিয়েছেন। বারবারই খারাপ সময় পেছনে ফেলে ফিরে এসেছেন। ২০১২ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত এশিয়া কাপের দল থেকে বাদ দেয়া হয়েছিলো তামিমকে। দর্শক, মিডিয়ার চাপ আর অনেক নাটকের পর তিনি ফিরেছেন দলে। সেই টুর্নামেন্টে টানা চার ম্যাচে চারটি হাফ সেঞ্চুরি করে সব সমালোচনার জবাব দিয়েছেন।
বছর যত গড়িয়েছে ধীরে ধীরে তার ব্যাটিংয়ে এসেছে পরিণত ক্রিকেটারের ছাপ। এক সময় তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে আউট হওয়া তামিম এখন অনেক বড় আস্থার নাম। এই মুহূর্তে বাংলাদেশের সবচেয়ে সফল ব্যাটসম্যানের নামও তামিম ইকবাল। ২০১৫ সালে পাকিস্তানের বিপক্ষে খুলনা টেস্টে পেয়েছেন প্রথম ডাবল সেঞ্চুরি। ওয়ানডে সিরিজে পরপর দুই ম্যাচে খেলেছেন ১৩২ ও ১১৬* রানের দু’টি ইনিংস। গত জানুয়ারিতে ঢাকায় অনুষ্ঠিত ত্রিদেশীয় সিরিজেও হয়েছেন সর্বোচ্চ রান সংগ্রহকারী (৮৪*, ৮৪, ৭৬, ৫ ও ৩)। ওই সিরিজেই প্রথম বাংলাদেশী ক্রিকেটার হিসেবে পূরণ করেছেন ওয়ানডে ক্যারিয়ারের ৬ হাজার রান। টেস্টেও বাংলাদেশীদের মধ্যে সর্বোচ্চ রান তার। সব ফরম্যাট মিলে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে রান সংখ্যা ১০ হাজার ছাড়িয়েছে। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে বাংলাদেশীদের মধ্যে একমাত্র তারই আছে শতরানের ইনিংস।
তামিম খেলেছেন ইংল্যান্ডের বিখ্যাত কাউন্টি ক্রিকেটে ও নিউজিল্যান্ডে ঘরোয়া ক্রিকেটে। পাকিস্তান সুপার লিগ, ক্যারিবীয় সুপার লিগের সব কয়টি মৌসুমেই ছিলেন। ডাক পেয়েছিলেন আইপিএলের দল পুনে ওয়ারিয়র্স থেকেও। বিশ্ব ক্রিকেটে বাংলাদেশকে পরিচিতি এনে দিতে যে কজন ক্রিকেটার সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রেখেছেন তাদের মধ্যে অন্যতম তামিম। একটি দিক দিয়ে তিনি সবার চেয়ে এগিয়ে, সেটি হলো সাহসী ব্যাটিং। মোহাম্মদ আশরাফুলের হাত ধরে বাংলাদেশের ক্রিকেটে যে স্ট্রোক প্লের সূচনা হয়েছে, তা পূর্ণতা পেয়েছে তামিমের ব্যাটে।
১৯৮৯ সালের ২০ মার্চ জন্ম নেয়া তামিম ব্যক্তিগত জীবনে এক সন্তানের জনক। ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে তামিম ও আয়শা ইকবালের ঘর আলো করে জন্ম নেয় পুত্র আরহাম ইকবাল খান। চট্টগ্রামের সন্তান তামিমের বড় ভাই নাফিস ইকবাল বাংলাদেশ দলের সাবেক ওপেনার। খেলেছেন ১১ টেস্ট ও ১৬ ওয়ানডে (২০০৩-২০০৬)। চাচা আকরাম খান তো বাংলাদেশের ক্রিকেটের প্রথম নায়ক। শৈশবেই বাবাকে হারিয়েছেন তামিম। তার বাবা ইকবাল খান ছিলেন ফুটবলার ও পরবর্তীতে ফুটবল কোচ। তবে ক্রিকেটেরও ভীষণ ভক্ত ছিলেন ইকবাল খান।

SHARE

Leave a Reply