আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ।
নতুন কিশোরকণ্ঠের অরুণ, তরুণ ভাইবোনদের জানাই পদ্মা, মেঘনা, যমুনার টইটম্বুর শুভেচ্ছা। টিকটিক ঘড়ির কাঁটার খোঁচায় ক্যালেন্ডারের ফাঁক গলে চলে গেল তিনটি বছর। এতদিন পর তোমাদের সাথে আলাপন, তোমরা টিপ্পনী কাটতেই পার। তোমাদের মতো আমি টিপটপ নই; বরং টিমটিমেয়ে চলি টুকটুক করে কাজ করি। আমায় দেখে আবার মুষড়ে যেয়ো না যেন; দেখ না, জাতীয় কবি তোমাদের সাথে নিয়ে কেমন ওজস্বী কণ্ঠে প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন।
ঊষার দুয়ারে হানি আঘাত/ আমরা আনিব রাঙা প্রভাত,/ আমরা টুটাব তিমির রাত,/ বাধার বিন্ধ্যাচল।
উদয়াচল। লালমাটিয়ার এফ ব্লকের হোল্ডিং নং ৬/১১। একটি ঝকঝকে বাসা, ঠিক পায়েস কালার! (আমার পুত্রধন ফারাবী চতুর্থের ছাত্রাবস্থায়, ওর থেকে অদ্ভুত কিছু কালারের নাম শিখেছিলাম, যেমন পানি কালার, মানুষ কালার এটিও সেই ঢঙ্গে।) ১৯৯৯-২০০০ সাল; তখন মিলেনিয়াম নিয়ে মার-মার কাট-কাট চলছে। প্রায় সাড়ে এক যুগ! (এটিও ছেলের যুক্তি, সব সংখ্যার আগেই সাড়ে বসে তাহলে দেড়, আড়াই কেন হবে?) আগের বয়ান। স্মৃতির আলমিরায় কিছুটা মরচে, উই ধরেছে বৈকি। ওখানে ছিল তখন একটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের জম্পেশ আয়োজন। এর তৃতীয় তলার দমবন্ধ, তেলচিটচিটে কিচেন রুম, দুনিয়ার সবচেয়ে ভয়ঙ্কর জীব! আরশোলাদের স্বর্গরাজ্য (কিছু শক্তিশালী ছেলে-মেয়ের কাছে, এই ভয়টা একটা ফ্যাশন!, ‘আরশোলা দর্শনে অক্কা প্রাপ্তি’ এখনও পত্রিকায় হেডলাইন হয়নি কিন্তু হতে আর কতক্ষণ?)। আর তাতেই সারা রাত থেমে থেমে খুটখাট শব্দ। না কোনো অশরীরীয় ভূত-প্রেত নয়। চলছে জান্তব পড়া আর কিবোর্ডে ১০ আঙুলের ক্যারিকেচার; কম্পিউটারে লেখার অবিরাম মেলবন্ধন। প্রায় রাতই এভাবে পোহাতো; ফজর পড়ে তবেই ঘুম। ঠিক এভাবেই শুরু হয়েছিল ‘মোরা বড় হতে চাই’ ধারাবাহিকের কচ্ছপ দৌড় (চৌকসরা বলবে, ‘আরে বলছেন কী! শীতের ঝামটায় মাথা-মুন্ডু ঠিক আছেতো? কচ্ছপতো হ্যাভি; খরগোশ ব্যাটাকেও রেসে হারিয়ে দেয়’; আমি বলবো, ‘আলবত! তবে তোমরা জান কি না, এ রেসের কিন্তু আরো তিনটি ভার্সন আছে; তাতে খরগোশেরও বিজয় ঘটেছে)।
ঘুটঘুটে আঁধারে, কিচেনের মাঝারে লেখালেখির বাজারে প্রায়শই যখন ধৈর্যের হাবুডুবু অবস্থা তখন মনের ক্যানভাসে ভেসে উঠতো দু-একজন ঋদ্ধ সিপাহসালারের মুখচ্ছবি, যাদের প্রেরণায় নিশি হতো কাবার, লেখা হতো সাবাড়। তাদেরই একজন সাবেক ডাকসাইটে আর্মি অফিসার, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবাদ-শিক্ষক। গেল তিন মাস আগে তিনি দুনিয়া থেকে চিরবিদায় নিয়েছেন। কেমন হয় যদি তার সাথেই আজকে পরিচয় করিয়ে দেই তোমাদের। অবশ্যই তারই সৃষ্ট একটি উদ্দীপনামূলক ঘটনার পরিসরে। শুরু করি কেমন?
একজন টাইমমেশিনের গল্প
লু হাওয়া; সাথে আগুনে হলকা। গ্রীষ্মের সকালের তির্যক কড়া রোদ; মনে হয়, সেদিন আতশি কাচ ফুড়ে আসছে।
ভার্সিটির সামনের বাস স্টপেজ। পঞ্চাশোর্ধ্ব একজন মানুষ বারবার চেষ্টা করছেন ঢাকামুখী দূরপাল্লার বাসে উঠতে। কিন্তু না; সারা রাস্তায় যত্রতত্র থামালেও এখানে দানবগুলোর গতি থাকে উল্কার মতো। অতীতে নানাজনকে চিঁড়েচ্যাপ্টা করতেও তারা কার্পণ্য করেনি। এর সঠিক কোনো পরিসংখ্যান সরকারি দফতরে রাখা নেই। জমিদারের পক্ষে কি গুনে গুনে ক্ষেতের আখ মাড়াইয়ের হিসাব রাখা সম্ভব? যত্তোসব! মূল্যবান কাগজ নষ্টের ফন্দি আর কী!
ঘেমে নেয়ে একাকার। এমনিতেই তিনি শ্যামবর্ণের সাথে বাতাসের ঝামটায় বিনে পয়সার ধুলো-পাউডার মেখে সত্যি এক বিদঘুটে অবস্থা। টিপটপ মানুষটি, আজকে যাচ্ছেতাই। হাতে সময় খুবই কম, মাথায় চিন্তার ঘূর্ণি; কিভাবে দ্রুত মগবাজার পৌঁছাবেন। পৌঁছতে যে তাকে হবেই।
ঘ্যাচ করে, একটি মুড়ির টিন মার্কা বাস এসে থামলো। কিন্তু একি! ভেতরে ‘তিল ঠাঁই আর নাহিরে’ অবস্থা। অগত্যা আগ-পাছ ভাবার ফুরসত নেই; উঠে পড়লেন ছাদে। সে আমলে, এ নিয়ে লাল কার্ড দেখানোর নিয়ম ছিল না। সারা ছাদ ফাঁকা; বাহ! তিনি ছাড়া মাত্র একজন প্যাসেঞ্জার।
সে একজন তরুণ। কিন্তু কেমন চেনা চেনা চেহারা। দু’জনে দুই দিকে মাথা ঘুরিয়ে আছেন; মুখে কোন রা নেই; ঠাঠা রোদেও কেমন শীতল নিঃসঙ্গতার চাদর মুড়ি দিয়েছেন। অবশেষে মুখ খুললেন মাঝ বয়সী মানুষটি : ‘দিনটি আজ ভালই মনে হচ্ছে; তাই না?’ এতক্ষণে যেন জান ফেরত পেল ছেলেটি; তখনো মহা-বিস্ময়ের ঘোর কাটেনি,
: ‘স্যার, আপনি এখানে? কোথায় যাচ্ছেন? স্যার আপনার গাড়ি? শিক্ষকদের বাস?’ মেশিনগানের মতোই প্রশ্নবাণ ছুড়ছে সে। একজন গানম্যান হঠাৎ ভরকে গেলে যেমনটি করে। মিলিমিটারের স্কেলে মাপা উত্তর স্যারের : ‘দেখ ছাত্রদের একটি প্রোগ্রাম আছে, আমাকে যথাসময়ে পৌঁছতে হবেতো, তাই’। তার নিজের গাড়ি নেই, এখন শিক্ষকদের বাসের সময় নয়; এত্তোসব বলার কোনো গরজই বোধ করলেন না। বরং সে ছাত্রের পারিবারিক খোঁজ-খবর, তার ভবিষ্যৎ ক্যারিয়ার নিয়েই ব্যস্ত থাকলেন। তরুণটি ছাদে তাতিয়ে উঠেছিল রোদে, এরপর যানজট, হট্টগোলতো বোনাস। কিন্তু স্যারের ¯েœহমাখা ও পিতৃসুলভ পরামর্শের মৌতাতে ভার্সিটি থেকে গাবতলী পর্যন্ত ২০ কিলোমিটার রাস্তা যেন তার এক লহমাতেই কেটে গেল।
মন্ত্রমুগ্ধ ছাত্রকে পিঠ চাপড়ে স্যার স্কুটারে ছুটলেন মগবাজার আলফালাহ প্রাঙ্গণে। হাঁপাতে হাঁপাতে চারতলার মিলনায়তনে হাজির; তখনও আলোচনা শুরুর মিনিট পাঁচেক বাকি। এক গ্লাস পানি খেয়ে, নিজকে ধাতস্থ করলেন। ওদিকে পরিচালক ঘোষণা দিচ্ছেন এখন টাইম ম্যানেজমেন্টের ওপর আলোচনা করবেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ড. মীর আকরামুজ্জামান। ঝাড়া দেড় ঘণ্টা তিনি নানা উদাহরণ দিয়ে সবাইকে তন্ময় করলেন। কিন্তু ঘুণাক্ষরেও এখানে আসতে তার দুই ঘণ্টার ডেঞ্জারাস ও কষ্টকর জার্নির কথা মুখেও আনলেন না। নাকি মানুষ গড়ার স্বপ্নের আনন্দে তা ভুলেই গেলেন! গোপন ইবাদাতের মতোই গোপন সেবার কি যে মজা তা তিনিই ভালো বুঝতেন।
‘টাইমমেশিন’ শব্দগুচ্ছটি চালু হয় প্রসিদ্ধ সাইফাই (সায়েন্স ফিকশন) লেখক এইচ জি ওয়েলসের ১৮৯৫ সালে প্রকাশিত বিখ্যাত সায়েন্স ফিকশন বই ‘দ্য টাইম মেশিন’ থেকে। এ নিয়ে বিখ্যাত তিনটি সিনেমাও হয়েছে। এ মেশিন দিয়ে কল্পলোকের অতীতে বা ভবিষ্যতে যাওয়া যায়। কিন্তু বাস্তবে তা এখনও আবিষ্কৃত হয়নি। স্যার ছিলেন বর্তমানের সকল বাধা মাড়িয়ে উল্কার গতিতে লক্ষ্যে পৌঁছার একজন জীবন্ত টাইমমেশিন।
আমরা কালেভদ্রে দেখেছি উন্নত বিশ্বের রাষ্ট্রপ্রধান (ব্রিটিশ সাবেক পিএম গর্ডন ব্রাউন ও ইরানের সাবেক প্রেসিডেন্ট আহমাদিনেজাদ) মাঝে মাঝে যানজট এড়াতে বিকল্প পাবলিক যান ব্যবহার করছেন। কিন্তু বাংলাদেশে উল্টো রাস্তার হাজারো রেকর্ড আছে। আবার বিকল্প গাড়ি; তাও আবার খাঁ খাঁ রোদে ছাদের ওপরে! ওরে বাপরে! কে যায় মরতে?
একটি প্রাসাদ গড়তে হলে হাজারো নি®প্রাণ ইটকে মাটির গহবরে নিজের অস্তিত্ব বিলাতে হয়; কিন্তু স্যার, সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়া হাজারো তরুণের জীবনের প্রাসাদ গড়েছেন। আর এ জন্য স্বেচ্ছায় নিজেকে সমর্পণ করেছেন মাটির নিচের সেই ভিত্তি হিসেবে যার কোনো প্রচার কিংবা প্রদর্শনী নেই। এ যেন সেই সম্রাট বাবরের গল্প; নিজের জীবন বিকিয়ে দিয়ে পুত্র হুমায়ুনকে রক্ষা।
কবি মতিউর রহমান মল্লিক ছিলেন স্যারের প্রিয় কবি। কবির বিখ্যাত গান : “হঠাৎ করে জীবন দেয়া, খুবই সহজ তুমি জান কি/ কিন্তু তিলে তিলে অসহ জ্বালা সয়ে, খোদারও পথে জীবনও দেয়া/ নয়তো সহজ তুমি মান কি?” কবিতা বা গানের সাথে মিলিয়ে জীবন গড়া কি সম্ভব? শ্রদ্ধেয় আকরাম স্যার ছিলেন এ গানেরই প্রোজ্জ্বল পূর্ণিমা।
কাজের ফাঁকে অনেক সময় তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে যাই। যেন ধক্ করে একটি চিরচেনা ছবি চোখের ওপর লাফিয়ে ওঠে; গুলশান কিংবা জাহাঙ্গীরনগর ভার্সিটির সামনের রাস্তা, কঠিন যানজটে লেপটে আছে। এসি, নন-এসি বাসে হাজারো যাত্রী ধুঁকছে। ধবধবে পোশাকের স্মার্ট একজন মানুষ বাস ছেড়ে পায়ে পঙ্খিরাজের গতি নিয়ে গন্তব্যে দৌড়াচ্ছেন; ক্লাসের তরুণদের জাগরণের গান শোনাবেন। বাঁহাতে কাপড়ের ঝোলা আর ডান হাতে প্রাচীন মডেলের একটি আনস্মার্ট নোকিয়া ফোন। হঠাৎ তন্দ্রা ছুটে যায়, মানুষটি আচমকা হাওয়া, ধাক্কা খাই। দু’ চোখে নামে কষ্টের প্লাবন।
(হয়তো আমার কষ্টে তোমরাও কিছুটা আপ্লুত। আমি দুঃখিত, এতদিন পর এসেই তোমাদের কষ্টের বয়ান দিলাম।)