Home নিবন্ধ পরশ যুগে থুমামাহ বিন আথাল -ইকবাল কবীর মোহন

পরশ যুগে থুমামাহ বিন আথাল -ইকবাল কবীর মোহন

থুমামাহ বিন আথাল ইয়ামামাহ প্রদেশের নেতা ছিলেন। ইয়ামামাহ সৌদি আরবের রিয়াদের পাশে অবস্থিত একটি স্থান। থুমামাহ ছিল ইসলামের ঘোর শত্রু। অনেকবার সে আল্লাহর নবীকে হত্যা করার হুমকি দিয়েছিল। অথচ মহানবী (সা) সব সময় থুমামাহর হিতাহিত জ্ঞান ফিরে আসার জন্য আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করতেন।
থুমামাহ একবার মক্কায় উমরা পালন করার জন্য ইয়ামামাহ ত্যাগ করল। তবে সে পথ হারিয়ে ফেলল। সে মদিনার চারদিকে পাহারারত একদল মুসলিম সেনার হাতে ধরা পড়ল। মদিনার লোকেরা তাকে চিনত না। তাই তারা তাকে শক্ত করে মসজিদের কলামের সাথে বেঁধে রাখল। আর তারা তার ভাগ্য নির্ধারণের জন্য মহানবী (সা)-এর সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় রইল। মহানবী (সা) মসজিদে প্রবেশ করার সময় থুমামাহকে দেখতে পেলেন। তিনি সাহাবিদের জিজ্ঞেস বললেন, তোমরা কি জানো তোমরা কাকে ধরে এনেছ?
সাহাবিরা জবাবে বললেন, না, আল্লাহর রাসূল (সা), আমরা তাকে চিনি না।’
মহানবী (সা) তখন বললেন, এ হচ্ছে থুমামাহ বিন আথাল আল-হানাফি। তোমরা তাকে বন্দী করে ভালো কাজ করেছ। মহানবী (সা) তারপর বাড়িতে ফিরে এলেন। তিনি বললেন, যা খাবার আছে তা থুমামাহ বিন আথালের জন্য পাঠিয়ে দাও।
তারপর মহানবী (সা) থুমামাহর জন্য উটের দুধ পাঠালেন। আল্লাহর নবী (সা) তারপর একদিন থুমামাহকে ইসলামে দীক্ষিত হওয়ার জন্য উৎসাহ দিলেন। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, তুমি তোমার নিজের ব্যাপারে কী বলতে চাও?
জবাবে থুমামাহ বলল, আপনি যদি যুদ্ধকালীন সময়ের প্রতিশোধ হিসেবে আমাকে হত্যা করতে চান, তা হলে আপনি আমাকে হত্যা করতে পারেন। আর আপনি ক্ষমা ও দয়াপরবশ হয়ে আমাকে মাফ করে দিতে চাইলে আমি কৃতজ্ঞ থাকব। আর আপনি যদি ক্ষতিপূরণ হিসেবে অর্থ চান, তা হলে সেই অর্থ দিতে আমি প্রস্তুত আছি।
মহানবী (সা) থুমামাহর কথা শুনে কিছুই বললেন না। তিনি তাকে আরো দু’দিন অবকাশ দিলেন। তবে এই দুই দিন তার জন্য নিজেই খাবার, পানীয় এবং দুধ পাঠিয়ে দিলেন। মহানবী (সা) দু’দিন পর আবার থুমামাহর কাছে গেলেন। তাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি তোমার নিজের ব্যাপারে কী বলতে চাও? থুমামাহ আজও আগের মতো একই জবাব দিল। মহানবী (সা) আজও চলে গেলেন। পরদিন আবার তার কাছে এলেন। তিনি সেদিনও বললেন, তুমি তোমার নিজের ব্যাপারে কী বলতে চাও? থুমামাহর জবাবের কোনো পরিবর্তন হলো না। সে একই কথা বারবার বলে গেল। এবার মহানবী (সা) তাঁর এক সাহাবিকে ডেকে পাঠালেন। তারপর থুমামাহকে ছেড়ে দিতে সাহাবিকে নির্দেশ দিলেন।
থুমামাহ ছাড়া পেয়ে মহানবী (সা)-এর মসজিদ থেকে চলে গেল। কিন্তু তার মনে মহানবী (সা)-এর ব্যবহার প্রচন্ড আলোড়ন তুলল। মদিনার আল বাকি পর্যন্ত সে উট চালিয়ে এগিয়ে গেল। সে তার উটকে পানি পান করাল এবং নিজে ভালো করে গোসল সেরে পবিত্র হলো। তারপর থুমামাহ নবীর মসজিদের দিকে ফিরে এলো। সেখানে সে মুসলমানদের নামাজের কাতারে শামিল হলো। তারপর ঘোষণা করল, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে আল্লাহ ছাড়া কোনো মাবুদ নেই এবং আমি আরও ঘোষণা করছি যে, মুহাম্মদ (সা) আল্লাহর দাস এবং তাঁর নবী।
অতঃপর থুমামাহ মহানবী (সা)-এর কাছে গেল এবং বলল, আমি আল্লাহর নামে শপথ করে বলছি, হে মুহাম্মদ! আমার কাছে দুনিয়ায় আপনার মুখের চেয়ে ঘৃণার আর কিছু ছিল না। আর আজ আপনার মুখের চেয়ে প্রিয়মুখ আমার কাছে আর নেই। আমি আপনার কিছু লোককে হত্যা করেছি। আমি আজ আপনার কাছে দয়া চাই। আপনি আমার জন্য কী করবেন?
মহানবী (সা) জবাবে বললেন, আজ তোমার প্রতি আর কোনো অভিযোগ নেই। মুসলিম হওয়ার সাথে সাথে তোমার আগেকার সব গুনাহ মাফ হয়ে গেছে। এখন থেকে তুমি নতুনভাবে শুরু কর। নবীজির কথা শুনে থুমামাহ খুব খুশি হলো। সে নিজেকে ভারমুক্ত বলে ভাবল। তার চেহারায় ফুটে উঠল বিস্ময়ের চিহ্ন। আর আনন্দে ভরে গেল তার বুক। এবার সে দৃঢ়তার সাথে বলল, আল্লাহর শপথ! আমি নিজেকে সম্পূর্ণভাবে সোপর্দ করলাম। আমার তরবারি এবং আমার সাথে যা কিছু আছে সবই আপনার সেবায় এবং আপনার ধর্মের জন্য নিয়োজিত করলাম। তিনি বলেই চলেছেন। তারপর থুমামাহ বললেন, ওহে আল্লাহর রাসূল (সা)! আপনার ঘোড়সওয়ারীরা যখন আমাকে বন্দী করল, আমি তখন উমরাহ পালন করার জন্য পথ চলছিলাম। আপনি কি মনে করেন, আমি এখন তা করতে পারব?
মহানবী (সা) জবাবে বললেন, এগিয়ে যাও এবং উমরাহ সম্পন্ন কর। তবে এটি তুমি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিধান অনুযায়ী কর। এরপর কিভাবে উমরাহ পালন করতে হবে, আল্লাহর রাসূল (সা) তা থুমামাহকে শিখিয়ে দিলেন।
থুমামাহ তার ইচ্ছা পরিপূর্ণ করার জন্য চলে গেল। মক্কার উপকূলে পৌঁছেই থুমামাহ চিৎকার করে তালবিয়াহ পড়তে শুরু করল। সে বলল, এখানে আমি তোমার আদেশ পালন করার জন্য হাজির হে আমার প্রতিপালক। আমি এখানে হাজির। আমি এখানে হাজির। তোমার কোনো অংশীদার নেই। আমি এখানে উপস্থিত। তোমার কল্যাণ এবং ক্ষমতার প্রশংসা করছি। তোমার কোনো অংশীদার নেই।
থুমামাহই হচ্ছেন দুনিয়ার বুকে প্রথম মুসলিম যিনি তালবিয়াহ পাঠ করতে করতে মক্কায় প্রবেশ করেন। কুরাইশরা থুমামাহর তালবিয়াহ শুনতে পেল। এতে তারা ক্ষিপ্ত হলো। আবার এটাকে তারা সতর্কতা হিসেবেও নিলো। কুরাইশরা তরবারি খুলে বেরিয়ে পড়ল। যেখান থেকে তলবিয়াহর সুর ভেসে আসছিল তারা সেদিকে এগিয়ে গেল। কুরাইশরা যতই কাছে আসছিল থুমামাহ তত জোরে তলবিয়াহ পাঠ করতে লাগলেন। কুরাইশদের এক যুবক এতে ক্ষিপ্ত হয়ে থুমামাহর প্রতি তীর ছুঁড়ে মারতে উদ্যত হলো। কিন্তু অন্যরা খপ করে তার হাত ধরে ফেলল এবং চিৎকার করে বলল, তোমাদের জন্য দুঃসংবাদ! তোমরা কি জান সে কে? সে ইয়ামামাহর শাসক থুমামাহ বিন আথাল। আল্লাহর কসম, তোমরা যদি তার কোনো ক্ষতি করতে চাও, তা হলে তার লোকেরা তোমাদের খাবারের সরবরাহ বন্ধ করে দেবে। এতে তোমরা খুব দুর্বিপাকে পড়বে।’
এ কথা শুনে কুরাইশরা তাদের তরবারি খাপের মধ্যে ঢুকিয়ে ফেলল। তারপর তারা থুমামাহর কাছে গিয়ে বলল, তুমি কি কোনো ভুল করছ? তুমি কি তোমার ধর্ম ছেড়ে দিয়েছ? তুমি তোমার পূর্বপুরুষদের ধর্ম ত্যাগ করেছ?
থুমামাহ বললেন, না আমি নতি স্বীকার করিনি। তবে আমি সবচেয়ে ভালো ধর্মের অনুসরণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমি মুহাম্মদ (সা)-এর ধর্ম অনুসরণ করছি। অতঃপর থুমামাহ এগিয়ে যেতে লাগলেন এবং বলতে লাগলেন, আমি এই ঘরের প্রভুর নামে শপথ করে বলছি, ইয়ামামায় ফিরে যাওয়ার পর কোনো খাদ্যশস্য যেমন গম বা অন্য কোনো শস্য তোমাদের কাছে পৌঁছবে না, যতক্ষণ না তোমরা মুহাম্মদের ধর্ম গ্রহণ করবে।
থুমামাহর দৃঢ়তাপূর্ণ কথা শুনে কুরাইশরা আর কিছুই ভাবতে পারল না। তারা হতবাক হলো। তবে তারা থুমামাহর প্রতি খুবই নজর রাখল। আল্লাহর রাসূল (সা)-এর নির্দেশ মতো থুমামাহ উমরাহ পালন করলেন। তিনি একাই আল্লাহর নামে তার কাজ সম্পন্ন করলেন।
অবশেষে থুমামাহ তার দেশ ইয়ামামায় ফিরে গেলেন। তিনি তার দেশের লোকদের নির্দেশ দিলেন, তারা যেন কোনো খাদ্যশস্য কুরাইশদের কাছে সরবরাহ না করে। এই বয়কট কাজে লাগল। ধীরে ধীরে এই বয়কটের প্রভাব মক্কায় পড়তে শুরু করল। অবশেষে এক কঠিন পরিস্থিতির তৈরি হলো। খাদ্যশস্যের দাম হু হু করে বাড়তে লাগল। অনাহারের পরিস্থিতি সৃষ্টি হলো মক্কায়। এতে কুরাইশদের মধ্যে মৃত্যুর ভয়ও সৃষ্টি হলো। তাই তারা মহানবী (সা)-এর কাছে চিঠি লিখল।
তারা লিখল, আপনার সাথে আমাদের চুক্তি (হুদায়বিয়ার চুক্তি) শর্ত হলো আপনি রক্তের সম্পর্ক মেনে চলবেন। কিন্তু এখন আপনি এর বিপরীতে চলে গেলেন। আপনি রক্তের সম্পর্ক ছিন্ন করছেন। আপনি হত্যা করছেন এবং ক্ষুধার মাধ্যমে মৃত্যুর পথ সৃষ্টি করেছেন। থুমামাহ বিন আথাল আমাদের সাথে সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে এবং আমাদের চরম ক্ষতি সৃষ্টি করেছে। আমাদের মনে হয়, আপনি তাকে নির্দেশ দিলে সে আমাদের যা প্রয়োজন তা পাঠাতে শুরু করবে।
আল্লাহর রাসূল (সা) কালবিলম্ব না করে তাঁর একজন সাহাবিকে থুমামাহর কাছে পাঠালেন। তাকে বয়কট তুলে নিয়ে খাদ্য সরবরাহ শুরু করার নির্দেশ দিলেন। আর মহানবী (সা)-এর নির্দেশ থুমামাহ অক্ষরে অক্ষরে পালন করলেন। কী মহান আদর্শই না ছিল আল্লাহর নবীর। তিনি শত্রুর প্রতিও মানবতাবোধের আদর্শ তুলে ধরতে ভুলে যাননি। ইসলাম এই মানবতাবোধই শিখিয়েছে। আর এর মাধ্যমে দুনিয়ায় ইসলামের সুমহান আদর্শ প্রতিষ্ঠা করেছে।

SHARE

Leave a Reply