কাশিটা শুরু হয়েছে একটু আগেই, এবার শুরু হলো হাঁচি।
বলি হচ্ছেটা কী? বর্ষা এখনও আসেনি, বৃষ্টিতে কেউ ভিজেনি- বৈশাখের সকাল বেলাতে। চারপাশে শুকনো খটখটে রোদ ছড়িয়ে পড়েছে। সর্দি কাশি কার হলো? ভারী উৎপাত তো!
রজতকান্তি রাগী আর গম্ভীর গলায় বলেন, এ্যাই- কী ব্যাপার! ভর সকালে হাঁচিকাশি শুরু-
হলো যে- কথাটি আর শেষ করতে পারেননি উনি। প্রথমে কাশলেন, কাশতে কাশতে চোখ দু’টি জবা ফুলের মতো লাল হয়ে ওঠে। এরপর শুরু হয় হাঁচি এবং অবিরত হাঁচি।
নাতনি টুসকি বলে, দ্যাখো দাদু, কেমন লাগে!
টুলটুল অবাক হয়ে এদিক ওদিক তাকায়।
কী- হচ্ছেটা কী?
কিচেন থেকে ঝাঁঝালো গন্ধ আসছে। দারুণ লাগছে ওর। কাশতে কাশতে হাঁচি দিতে দিতে চোখে-নাকে পানি এসে গেছে সবার। খুশি হতে গিয়েও মুখ ভার করে ও।
ক্লাসের পড়া শেখা এখনও হয়নি। প্রথমে বেশ লাগলেও এখন ভাবনা হচ্ছে টুলটুলের। রাশেদ স্যারের হাতে লিকলিকে বেত থাকে। কথাটি মনে পড়ায় সারা শরীর ঘামতে থাকে ওর। পড়ার টেবিলে সে ছুটে আসে।
বলি হচ্ছেটা কী খালা? রাঁধছ না ম্যাজিক দেখাচ্ছ। কিচেন থেকে বের হয়ে ডাইনিং স্টেজে এসে দাঁড়ায় সুন্দরী। ঘেমে নেয়ে একাকার। নিজেও খুক খুক করে কাশছে। কাশতে কাশতেই খিল খিল করে হাসে।
– আমার টুলটুল বাবা কয় কি গো? আমি নাকি ম্যাজিক দেখাইতাছি। ম্যাজিক দেখাই না গো বাবা সোনা, ডাইল সম্ভার দিতাছি।
হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ে সুন্দরী। তেজপাতা, শুকনো মরিচ আর পাঁচফোড়নের ঝাঁঝে দাদু, রজতকান্তি, মা-বাবা, টুলটুল আর টুসকির কাশি আর থামে না।
রজতকান্তি চোখ পাকিয়ে বলেন, এই- হচ্ছেটা কী? বলি হচ্ছেটা কী?
পাশের ফ্ল্যাটের আলমগীরও এসে দাঁড়ান।
– শোন হে রজত, বাঘের ঘরে ঘোগের বাসা।
হাঁচি দিতে দিতে রজত বলেন, মানেটা কি আলমগীর? আলমগীর বলেন, তোমার কিচেনই যত নষ্টের গোড়া।
সুন্দরী সামনে এসে দাঁড়ায়। ওর দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে সবাই।
রজত একদিন বলেছেন, দ্যাখো সুন্দরী, সব সময় কোমরে আঁচল গুঁজে কাজ করবে। আগুন লাগলে পুড়ে টুড়ে মরবে বাপু। আমরা পড়ব ফ্যাসাদে।
– এ কি কথা কইলেন বড়বাবু? ফ্যাসাদে পড়বেন ক্যান? দাদুর সোজা কথা- তোমার বাড়ির লোকজন এসে আমাকে ধরবে না?
সেই থেকে সুন্দরী এক ফালি আঁচল কোমরে গুঁজে রান্নাবান্না করে। মাথায় পুরনো কাপড়ের ফেট্টি বাঁধা থাকে। দাদু বলেছেন, ভাত তরকারিতে যেন কক্ষনো চুল না পাই। ভাত রাঁধবে আর মাথা চুলকাবে- সেটি হবে না বাপু।
মুখ ঘুরিয়ে সুন্দরী সেদিন বলেছে, বড়বাবুর ফ্যান কথা। কী শরমের কথাই না কয় বড়বাবু।
দাদু বলেছেন, শরমের কথা নয়, সত্য কথা। বড় বড় হোটেলে রেস্টুরেন্টে ছেলেরা সব মাথায় ক্যাপ পরে রাঁধে বাড়ে, যাতে খাবার দাবারে চুল না পড়ে।
কোমরে আঁচল গোঁজা, মাথায় ফেট্টি বাঁধা সুন্দরী দাঁড়িয়ে।
-এ্যাই, রান্নাঘরে করছিসটা কী? জবাব দে, কথা বলছিস না কেন? কাঁচুমাচু হয়ে সুন্দরী বলে, আমি তো কিছু করি নাই বড়বাবু, খালি ডাইল সম্ভার দিছি।
আলমগীর চোখ লাল করে বলেন, এটার নাম ডাল বাগার? রাজ্যের তেজপাতা-পাঁচফোড়ন দিয়ে কী ভরেছিস? দ্যাখ, কাশতে কাশতে দম আমার আটকে যাবার জোগাড়। বুঝলে রজত, তোমার ফ্ল্যাটে ডাল রাঁধা হয়, আমার বাড়িতে চলে হাঁচি আর কাশি। ঐ শোনো-শুনছো তো টুলটুল? নীলু পিলু সবাই কাশছে।
টুসকির দারুণ মজা। ঘর ভর্তি ধোঁয়া, চারপাশে হাঁচি-কাশি চলছে-এর মাঝে কি পড়াশোনা করা যায়? তার মানে ওর এখন ছুটি। বই-খাতা-পেন্সিল-রাবার সব গুছিয়ে রাখে টুসকি। আনন্দের আর সীমা নেই ওর। টুলটুল দারুণ চটেছে। ক্লাসের পড়া আর মুখস্থ হলো কই! বলে, ভাত দাও মা। খেয়ে স্কুলে তো যাই।
মিনু, বিরক্ত মুখে বলেন, এই সুন্দরী, টেবিলে ভাত দাও। বড় বাটিতে করে বেশি করে ডাল দিও, খেয়ে দেখুক সবাই কেমন হয়েছে। ভাবলেশহীন সুরে কিচেন থেকে জবাব আসে, ভাত হয় নাই, টনক রইছে।
মিনু বলেন, টনক রইছে তো আঁচ বাড়িয়ে দাও। রজতকান্তি বলেন, এই হলো আমাদের রান্নার লোক-বুঝলে আলমগীর? আলমগীর বলেন, সে তো বুঝলাম, কিন্তু টনক রইছে মানেটা কি?
-সিম্পল কথা, ভাত সেদ্ধ হয়নি শক্ত রয়েছে। দ্যাট মিনস, টনক রইছে।
হো হো করে হাসেন আলমগীর, -তাই বলো। ভাত-ডাল-তরকারি টেবিলে রাখে সুন্দরী মলিন মুখে। হাঁচি-কাশির জের তখনও কাটেনি বাড়িতে।
সুন্দরী মন খারাপ করা সুরে বিড় বিড় করে।
– এতদিন হইল এই বাসার কাজে জয়েন্ট করছি, কেউ কিছু লইয়া গাইল-মন্দ পাড়ে নাই, হা হা হি হি কইরা হাসেও নাই। ডাইল সম্ভার দিলে হাঁচি-কাশি তো অনবই। যত কাশি ততই মজা হইব ডাইল। হারাদিন তো কামই করি, রেশ তো লই না, লই কও, টুসকি বলে, খালা কথা বলো ক্ষতি নাই কিন্তু ঠিকঠাক করে বলবে তো?
– বেঠিক কি কইলাম কও দেহি।
খেতে খেতে টুলটুল বলে, এই যেমন তুমি কাজে জয়েন্ট করেছ, তুমি জয়েন বললে কেন? আরও বলেছ-সারাদিন কাজ করো রেস্ট নাও না-
গালে হাত দিয়ে সুন্দরী বলে, হাচা কথাই তো কইলাম টুলটুল বাবা। টুসকি বলে, তুমি রেস্ট বলোনি খালা, তুমি বলছ রেশ। ভেরি ব্যাড খালা ভেরি ব্যাড।
রজতকান্তি খুক খুক করে হাসতে থাকেন। কোন রকম সামলে বলেন, -কিপ কোয়াইট।
টুলটুল বলে, আর একটু ডাল আর মাছের ঝোল দাও তো খালা। পাকঘরে ডাইল-তরকারি আছেনি চেক কইরা আহি। ফিরিজে তুলতে হইবো না! কিচেনে বাসন মাজার ঝকঝক আওয়াজ হতে থাকে। এই হলো সুন্দরী, গোটা বাড়ির কাজকর্ম দু’হাত দিয়ে ম্যাজিকের মতো সারে।
ছ’সাত দিন কেটে গেছে।
পাশের ফ্ল্যাটের আলমগীর সাহেবের বউমা নিগার গ্রিলের ফাঁকে মুখ রেখে মিনুকে ডাকে।
– ও বৌদি, বৌদি।
টুলটুলের মা মিনু জানালার কাছে আসেন।
– আরে ভাবী, কী খবর?
-আমি তো ভালই আছি বৌদি। তোমাদের বাড়ি এত চুপচাপ কেন? রান্নাবান্না হচ্ছে না? কদিন থেকে কোনো সাড়াশব্দ পাচ্ছি না। চাইনিজ খেয়ে বেড়াচ্ছ নাকি?
মলিন মুখে মিনু বলেন, সুন্দরী দেশে গেছে যে।
– হঠাৎ, কী ব্যাপার?
টুলটুলের মা বলেন, ওদের আবার ব্যাপার! বাড়ির জন্য মন কেমন করেছে তাই ঘুরতে গেছে। কবে ফেরে কে জানে!
নিগার বলে, তাই বলো বৌদি, আমিও তো ভাবছি টুসকিদের বাসায় হলোটা কি? ডাল-টাল রাঁধা হয় না আজকাল? ঐ যে তোমার সুন্দরী স্পেশাল ডাল রাঁধত, হেঁচে-কেশে আমরা সারা হতাম।
হাসতে হাসতে নিগার বলে, সবাই মিলে ওকে কী বকাবকিই না করেছি।
মিনু মন খারাপ করে বলে, ডাল আর কখন রাঁধব? সকাল হলেই তো টুলটুল-টুসকির স্কুল, ওদের বাবার অফিস যাওয়া, এরপর আমার অফিসের সময় হয়ে যায়। সংসার চলছে কোন রকমে। খিচুড়ি আর ভাতে-ভাত খাচ্ছি।
দু’ভাই বোন স্কুল থেকে ফিরে নিজেরা ভাত বাড়ে।
রজতকান্তি বলে, নিজের কাজ নিজে করতে শেখো।
প্লেট নিয়ে ডেকচির ঢাকনা তুলে টুলটুল চেঁচিয়ে ওঠে।
– আবার খিচুড়ি?
টুসকি বালিশে মুখ গুঁজে বলে, রাত্তিরে ডাল ভাজি চিকেন রাঁধবে মা। নো খিচুড়ি নো ভাতে-ভাত।
মিনুও সারা দিনের অফিস শেষে ক্লান্ত হয়ে ঘরে ফিরে। এক পেয়ালা চা তৈরি করার আর শক্তি থাকে না। ছেলেমেয়ের গায়ে-মাথায় হাত বুলিয়ে বলে, খাও সোনারা, কে রাঁধে বল। সারাদিন অফিস করে তারপর কি আর রাঁধা যায়? কবে যে সুন্দরী ফিরবে।
শুক্রবার, ছুটির দিন। সবাই বাড়িতে। লুচি তরকারি তৈরি করতে করতে হিমশিম খাচ্ছে মিনু।
ঠিক এমনই সময় ধপ করে পুঁটুলি রাখার আওয়াজ হয়। সেই পরিচিত মিষ্টি গলা।
– আইয়া পড়ছে গো তোমাগো রান্ধনের মানুষ।
টুলটুল চেঁচিয়ে বলে, মা, ওমা- রান্নামাসী এসে গেছে। টুসকি ছুটে এসে বলতে থাকে, রান্না চড়াও তো সুন্দরী মাসী। মাছের ঝোল, চিকেন কারি ভালো করে রাঁধো। অনেক দিন খাইনি। তোমার স্পেশাল ডাল রাঁধবে কিন্তু সুন্দরী মাসী।
সুন্দরী ভেজা ভেজা গলায় টুসকিকে বুকে জড়িয়ে ধরে।
– ও আমার সোনা রে, আমার ময়না রে-
টুলটুল কিচেনে গিয়ে জিজ্ঞেস করে, ও মাসী তুমি ডাল রাঁধবে না? ও বাড়ির নিগার আন্টি, আলমগীর দাদু, মা-বাবা দাদু আমরা সবাই কাশতে কাশতে একেবারে মরে যাবো।
টুলটুলকে কোলে নিয়ে সুন্দরী বলে, বালাই ষাট, বালাই ষাট।
আজ আবার ড্রয়িংরুমে দাবা খেলতে বসেছেন রজতকান্তি আর আলমগীর। মিনু খুশি মনে টিভির সামনে রিমোট নিয়ে বসেছেন। বাবা নিশ্চিন্ত মনে খবরের কাগজ নিয়ে বসেছেন।
টুলটুল-টুসকি চেঁচিয়ে বলে, ও সুন্দরী মাসী, ভাত দাও টুলটুলের ঘামে ভেজা মুখ শাড়ির আঁচল দিয়ে মুছে দেয় সুন্দরী, আদুরে গলায় বলে, ভাত হয় নাই সোনা, টনক রইছে টুসকি বলে, ও মাসী আমি টনক টনক ভাত খাবো, ততা ততা ভাত খাবো।
আজ দাদু কিংবা মিনু রাগ করে কেউ বলে না, কী বাজে কথা ওদের শিখিয়েছ সুন্দরী।
আজ সুন্দরী বলে, ও টুলটুল-টুসকি, অমন কথা কইতে হয় না, ঠিক কইরা কথা কও। টনক টনক, ততা ততা ভাত এইগুলান গাঁও গেরামে বলে।
-বলব, একশ বার বলব। আমাকে ডাল আর ভাজি দিয়ে ততা ততা ভাত দাও।
আজ আবার ডাল সম্ভার দিয়েছে সুন্দরী। ছ্যাৎ করে আওয়াজ উঠেছে। ঝাঁঝালো গন্ধে কাশির সাথে মাঝে মাঝে হাঁচিও আসছে।
আলমগীর কাশতে কাশতে হাসতে থাকেন।
– এই তো রজত, তোমার বাড়ি এখন রিদমে চলছে। কাজে বেশ ছন্দ এসেছে।
টুসকির বাবা বলেন, এ কদিন খিচুড়ি আর আলু ভাতে খেয়ে পেটে চড়া পড়ে গেছে।
প্রাণ খুলে হাসে সবাই।
রান্নার ফাঁকে ফাঁকে আলনা ঘেঁটে চকরা বকরা ছাপ দেয়া গেঞ্জি এনে টুলটুলকে পরিয়ে দেয় সুন্দরী।
– পাতলা জামা গায়ে দিয়া পড়তে বইছ ক্যান সোনা! এই পিরান পায়ে দ্যাও।
বাড়িটি ঠিক আগের মতো মায়া মমতা আর খুশিতে ভরে আছে।
রাত ন’টা। ভাত খেতে বসেছে সবাই। টেবিলের ওপর বাটিতে বাটিতে তরকারি। ধোঁয়া ওঠে মনকাড়া গন্ধ ছড়াচ্ছে। টুলটুল খুশিতে আটখানা হয়ে বলে, রান্নামাসী, হিপ হিপ হুররে। দাদু বলেন, এটা কি রেঁধেছিস রে সুন্দরী।
– টম্যাটো দিয়া চুহা রানছি বড়বাবু।
হাসির হুল্লোড় ওঠে বেশ ক’দিন পর। সুন্দরী বোকার মতো হেসে বলে, খাট্টা রানছি। বাবা বলেন, চুহা নয়, খাট্টাও নয়, বল চাটনি। সুন্দরী বলে, এই হইলো, ঘাড়ের নামই গর্দনা, লেম্বুরে কয় জমির, তেঁতুলের কয় আবুলি, চিরুনির কয় কাঁকই।
কোমরে আঁচল গোঁজা, মাথায় চওড়া লাল কাপড়ের ফেট্টি, এক খুন্তি হাতে সুন্দরীকে দারুণ লাগছে। সবাই অবাক হয়ে হাসিমুখে তাকিয়ে দেখছে ওকে, মুখে কোনো কথা নেই। শুধু টুলটুল আর টুসকি দু’ভাই-বোন চেঁচিয়ে ওঠে।
-হিপ হিপ হুররে, সুন্দরী খালা দা গ্রেট।