বন্ধুরা, তোমরা তো জানো ১০ জুন আমাদের প্রিয় কবি ফররুখ আহমদের জন্মদিন। বারবার করে এ দিনটি আমাদের মাঝে আসে। আবার চলে যায়। কবির জন্ম-মৃত্যু এলেই আমরা তাঁকে স্মরণ করি, আবার ভুলে যাই। তাই না? হ্যাঁ বন্ধু, যে কবি মানুষের কবি, মানবতার কবি, ফুলপাখিদের কবি, ফল ও ফুলের কবি, ছোট বড় সবার কবি তাকে কি কখনো ভোলা যায়? না, মোটেও ভোলা যায় না। কিভাবে ভুলবে? যেসব গুণ একজন মানুষকে কালের পটে অমর করে, মহৎ করে তার সবগুলোই তো ছিল ফররুখ চরিত্রে। আর তাইতো ফররুখ আহমদ একজন কবি, একজন আদর্শ মানুষ, একটি আদর্শ প্রতিষ্ঠান। চলো না তাহলে এ কবি কেমন ছিলেন আমরা তার কিছু জানার চেষ্টা করি।
কবি ফররুখ আহমদের দেহের গড়ন ছিল লম্বা, হালকা-পাতলা, তার দীর্ঘ উন্নত নাক, তীব্র ও তীক্ষè দু’টি চোখ মানুষকে মুগ্ধ করতো।
ছাত্রজীবনে তিনি খুব ভালো ছাত্র ছিলেন। সবসময় ক্লাসে প্রথম হতেন। তাঁর স্মরণশক্তি ছিল অত্যন্ত প্রখর। দেশী-বিদেশী অনেক কবির কবিতা তিনি অনর্গল মুখস্থ আবৃত্তি করতে পারতেন। অসংখ্য কুরআনের আয়াত এবং হাদিস তাঁর কণ্ঠস্থ ছিল।
অর্থের প্রতি কবির কখনোই লোভ ছিল না। জীবনে তাঁর যা খ্যাতি ছিল তা নিয়ে ধনৈশ্বর্যের মালিক হওয়া অত্যন্ত সহজ ছিল, কিন্তু কবি সে পথকে ঘৃণাভরে বর্জন করেন। অর্থ কষ্টের কারণে অনেক সময় তিনি বন্ধুদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখেননি। তাঁকে জুতো সেলাই, পট্টি করিয়ে, কাপড়ে তালি লাগিয়ে ব্যবহার করতে হয়েছে।
দারিদ্র্যকে তিনি সাদরে গ্রহণ করেছেন। আভিজাত্য বা বিলাসিতার প্রতি তাঁর সামান্য লোভও ছিল না। সংসারে অভাব অনটন থাকা সত্ত্বেও তিনি কারো কাছে কখনো হাত পাতেননি। বরং তিনি সবাইকে বলতেন-
“তোরা চাসনে কিছু কারো কাছে
খোদার মদদ ছাড়া
তোরা পরের উপর ভরসা ছেড়ে
নিজের পায়ে দাঁড়া।”
তিনি এ শিক্ষা কোথা থেকে নিয়েছেন জানো? তিনি আমাদের প্রিয়নবী রাসূল (সা.) থেকেই এই শিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন। যেমন রাসূল (সা.) একদিন নামাজ পড়ে খুব তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরছিলেন। সাহাবারা জিজ্ঞেস করলেন, হুজুর আজকে এত তাড়াহুড়ো করছেন কেন? রাসূল (সা.) বললেন, আমার ঘরে কিছু স্বর্ণ এসেছে, রাত হওয়ার আগেই এই স্বর্ণ বিলিয়ে দিতে হবে। অর্থাৎ রাসূল নিজের জন্য অর্থসম্পদ কিছুই রাখতেন না। সব তিনি গরিবদের মধ্যে বিলিয়ে দিতেন। আমাদের প্রিয় কবি ফররুখ রাসূলের জীবন থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে তা নিজের জীবনে বাস্তবায়ন করেন। কারণ তাঁর নিজের সঞ্চয় বলতে কিছু ছিল না। যা আয় করতেন তা থেকে নিজের পরিবারের জন্য খরচ করতেন আবার গরিবদের মধ্যেও বিলাতেন। ফলে মৃত্যুর পর তার জমানো কোনো ধন-সম্পদ বলতে কিছুই ছিল না।
সমস্ত জীবন আদর্শের সংগ্রামে নিয়োজিত থাকলেও সংসার সম্পর্কে কবি অত্যন্ত সচেতন ছিলেন। গৃহকর্তা হিসেবে, পিতা হিসেবে তাঁর দায়িত্ব পালনের তুলনা করা যায় না। দুর্ভিক্ষ, জরা, মৃত্যু, দাঙ্গা, মহামারী এই সমস্ত অস্থিরতার মাঝেই কেটেছে তার জীবন। কিন্তু তিনি কখনো নিরাশ হননি। ঘন অন্ধকার আর কুয়াশা ভেদ করে তাঁর চোখে ভেসে উঠতো আলোর রাজ তোরণ।
কবি ফররুখ আহমদ সারা জীবন মানবতার পক্ষে কথা বলেছেন। পাপকে তিনি ঘৃণা করতেন। কেউ অভাব-অনটনের কথা জানালে কবি যদ্দুর সম্ভব নিজে না খেয়ে থাকলেও তাকে সাহায্য করার চেষ্টা করতেন। বেতন পেয়েছেন, এমন সময় রাস্তায় কেউ এসে নিজের চিকিৎসা বা অন্য কোনো সমস্যার কথা বলেছেন, কবি তার বেতনের সবকটি টাকাই তাকে দিয়ে শূন্য পকেটে বাড়ি ফিরতেন। এ উদার কবি এদেরকে নিয়েই আবার লিখতেন কবিতা। কবি পেট ভরে কখনো খেতেন না। অর্ধেকটা খেয়ে বাকিটা দিয়ে দিতেন কোনো অনাহারী মানুষকে।
এবার দেখো, অতিথিপরায়ণতার লোকটা কেমন ছিলেন। এমন কথা এখনো তাঁর পরিচিতজনদের কাছে এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে আছে। তার চা, মিষ্টি, শিঙ্গাড়া খেতে হয়েছে পরিচিত সবাইকে। প্রাপ্ত বেতনের বেশির ভাগই ব্যয় হতো আতিথেয়তায়। রেডিও অফিসের পাশে আবুল মিয়ার চায়ের দোকানে বসে কবি ভক্তদের নিয়ে হাসি, রঙ্গ রসে গল্প করে মাতিয়ে তুলতেন, আর তখন ফাঁকে ফাঁকে চলতো চা-নাশতা খাওয়া। মাস শেষ হলে বেতন পেতেই আবুল মিয়ার বিল পরিশোধ করতেন।
সত্যবাদিতায় কেমন ছিলেন কবি? মনে মনে চিন্তায়-চেতনায় মিথ্যাকে কোনো মুহূর্তেই স্থান দেননি কবি। তাঁর সমস্ত জীবনে একবারও মিথ্যা বলেছেন তার প্রমাণ পাওয়া যায় না। এমনকি তাঁর নিন্দুকেরাও এর প্রমাণ দিতে পারবে না।
তোমরা যারা ছোট, তাদেরকে কবি খুব আদর করতেন। তিনি কাছে পেলেই ছোটদের আদর করে টেনে নিতেন। চুমো খেতেন। ছোটরা ছিল কবির প্রাণ। ছোটদের ভালো না বাসলে কবি তাদের জন্য এত গান, এত কবিতা লিখতে পারতেন না। কবি ছোটদের সাথে প্রাণ দিয়ে মিশতেন এবং শিশুদের সাথে শিশুদের মতো করে কথা বলতেন। পিতা-মাতা যেমন সন্তানদের সঙ্গে স্নেহের সঙ্গে আদরের সঙ্গে কথাবার্তা বলেন, মেলামেশা করেন, কবি ফররুখ আহমদও ঠিক তেমন করে ছোটদের সাথে ব্যবহার করতেন। রেডিওতে ছোটদের জন্য তাঁর পরিচালিত অনুষ্ঠানটিতে তিনি যে রকমভাবে কথা বলতেন, বুঝাতেন, সেটা যারা শুনেছেন তারাই জানে, যে তিনি কেমন করে ছোটদের সঙ্গে প্রাণ খুলে কথা বলতেন।
ছোটদের জন্য কবির লেখাগুলো রঙ্গ-রসে ভরপুর ছিল। তিনি তোমাদের মতো ছোট্ট বন্ধুদের কথা ভেবেই অনেকগুলো ছড়া, কবিতা, বর্ণমালার বই, গান, নাটক লিখে গেছেন। পাখির বাসা, নতুন লেখা, চিড়িয়াখানা, এমন অনেক বই আছে তাঁর। তিনি ছোট্ট বন্ধুদের উদ্দেশ করে বলেন-
“আমরা সকল দেশের শিশু যাবো
নবীর মদিনায়
তোরা সঙ্গে যাবি আয়।”
কবি ফররুখ আহমদের প্রিয় শখ ছিল ফুলের বাগান করা, দামি কলম কেনা। তাঁর প্রিয় খাবারের কথা বললে তো তোমাদের জিবে পানি চলে আসবে। তাঁর প্রিয় খাবার ছিল শিক কাবাব, টিকিয়া, চাইনিজ, চালকুমড়ার মোরব্বা, ভালো নাশতা, রোজ সিরাপ, পনির, গোশতের কিমা, আরবি খেজুর ও আম।
কবির প্রিয় শিল্পী ছিলেন শচীন দেব বর্মণ, বেদার উদ্দিন আহমদ, সোহরাব হোসেন, আব্বাস উদ্দীন ও আব্দুল আলীমের মতো খ্যাতিমান শিল্পীরা। তাঁর পছন্দের গান-
“ও পদ্মার ঢেউরে ও এবার
তুমি জানিতে চেও না আমারে। …”
তার প্রিয় পোশাক ছিল পাজামা-পাঞ্জাবি, শেরওয়ানি, শীতে পুলওভার আলোয়ান।
১৮১৮ সালের ১০ জুন যশোরের মাঝআইলে কবি ফররুখ আহমদ জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম সৈয়দ হাতেম আলী, আর মাতার নাম বেগম রওশন আখতার। সৈয়দ হাতেম আলী ছিলেন প্রভাবশালী পুলিশ ইন্সপেক্টর।
১৯৭৪ সালেল ১৯ অক্টোবর কবি ফররুখ আহমদ ইন্তেকাল করেন, রমজান মাসে যে মানুষটির জন্ম হয়েছিল আবার রমজান মাসেই তিনি বিদায় নিয়েছেন অন্য জগতে।
কবি ফররুখ ছিলেন দৃঢ় চরিত্রের আদর্শ মানুষ। আবার হৃদয়বানও। মানুষকে গভীরভাবে ভালোবাসতেন তিনি। ফলে ইতিহাসে তিনি একজন বড় মানুষ হিসেবেই স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। স্মরণীয় হয়ে থাকবেন লাখ লাখ শিশু-কিশোরের হৃদয়ের মণিকোঠায়। হ